বিজয় মানেই সব সময় বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাড়ানো নয়; কখনো কখনো বিজয় মানে হলো নিজ ঘরের ভেতরে বেড়ে ওঠা অশুভ ছায়াকে পরাজিত করে আলোর পথে ফেরা। আজ ১০ ডিসেম্বর, ইরাকের ‘বিজয় দিবস’ (ভিক্টোরি ডে)। ২০১৭ সালের এই দিনে ইরাক সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস বা দায়েশ) বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছিল।

২০১৪ সাল। ইরাকের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। দেশটির বিশাল অংশ দখল করে নেয় আইএস। মসুলসহ বড় বড় শহরে শুরু হয় তাদের বর্বর শাসন। প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস করা হয়, নির্বিচার হত্যা করা হয় ভিন্নমতাবলম্বীদের, আর নারীদের ওপর নেমে আসে মধ্যযুগীয় দাসপ্রথার নির্যাতন। মনে হচ্ছিল, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে হাজার বছরের সভ্যতা বুঝি চিরতরে হারিয়ে যাবে অন্ধকারের গহ্বরে।

আইএসকে পরাজিত করার পর ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজপথে পতাকা হাতে উল্লসিত ইরাকি.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

বাশারমুক্ত সিরিয়ায় বিদেশি শক্তির পাশাখেলা

সিরিয়ায় আসাদ বংশকে ক্ষমতা থেকে সরানোর সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু ২০১১ সালে এবং সফল হয় ২০২৪–এর ডিসেম্বরে। চলতি ডিসেম্বরে বাশার আল–আসাদহীন সিরিয়ার এক বছর হলো। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, বাথ পার্টিবিরোধী ‘বিপ্লবী’রা ক্ষমতায় এসে এক বছরে মানুষের জন্য কী করলেন, দেশটির কী অবস্থা?

বাশার এখন মস্কোতে

আসাদকে পালানোতে বাধ্য করে মুখ্যত হায়াত তাহরির আল-শামস (এইচটিএস)। এই নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘সিরিয়ার মুক্তির জন্য গঠিত সংস্থা’। এটা ছিল হঠাৎ সৃষ্ট ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সশস্ত্র জোট। চূড়ান্ত যুদ্ধকালে তুরস্কের সহায়তাপুষ্ট সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মিও (এসএনএ) এইচটিএসের পাশে ছিল। এসএনএ গড়ে ওঠে বাশারের বাহিনী ছেড়ে আসা কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে। গৃহযুদ্ধের শুরুতে দেশটির বিভিন্ন দিকে অনেকগুলো সংগঠন বাশারবিরোধী যুদ্ধে নামে। ক্রমে তারা টেলিগ্রাম চ্যানেলকে ব্যবহার করে যত যূথবদ্ধ হয়েছে, তত প্রতিপক্ষকে কাবু করায় সফল হয়েছে।

সিরিয়ায় আসাদ বংশ ক্ষমতায় ছিল প্রায় ৫০ বছর। পরিবারের সর্বশেষ শাসক ক্ষমতাচ্যুত বাশার আল-আসাদ এখন মস্কোতে। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি সেখানে পালান। বাশারের ক্ষমতাচ্যুতির ভেতর দিয়ে বিগত শতাব্দীর শেষ দিকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিকাশমান বাথ পার্টির শেষ দুর্গের পতন হয়।

বাশারের পর

বাশার আল-আসাদ ডিসেম্বরে পালিয়ে গেলেও আহমেদ আল-শারা দেশটির প্রেসিডেন্ট হন দু-তিন মাস পর। বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শুরুতে তিনি ছিলেন আল-কায়েদার সিরিয়া শাখা আল-নুসরা ফ্রন্টের নেতা। এইচটিএস ওই আল-নুসরার পরিবর্তিত এক ধরনের নাম।
শারার সরকার এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। আরও চার বছর এই সংবিধানের অধীনে দেশ চলবে। এত দিনকার বাশারবিরোধী সশস্ত্র গ্রুপগুলো নতুন সরকারের প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসেবে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।

নতুন সরকারের এক বছর পূর্তিকালে সবচেয়ে বড় চমক হলো, এইচটিএস বলছে, আইএস (ইসলামিক স্টেট) গেরিলাদের নির্মূলে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে সিরিয়া।মানবাধিকার দলন উল্টো চেহারা নিয়েছে

বাশার বংশ দামেস্ক থেকে চলে গেছে—এটা প্রচারিত হওয়ামাত্র সিরিয়াজুড়ে ব্যাপক লুটপাট হয় বেশ কয়েক দিন। লুটের প্রধান শিকার হয় বাশারের সহযোগী, রাষ্ট্রীয় নানান প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষভাবে সংখ্যালঘু আলাউইত ও দ্রুজ পরিবাগুলো। কোথাও কোথাও কবরস্থানগুলোও ভাঙচুর হয়। এ রকম একটা স্থান হলো বাশার আল-আসাদের বাবা হাফেজ আল-আসাদের কবর। হাফেজ আসাদ ও সাদ্দাম হোসেন ছিলেন আরব জাতীয়তাবাদী বাথ পার্টির দুই বড় চরিত্র। আট দশক আগে সিরিয়াতেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ওই রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল।

বাশার পরিবারের পলায়নমাত্র দেশটির অনেক মানবাধিকারকর্মী ওই আমলের অন্যায়-অবিচারের ডকুমেন্টেশন শুরু করেন, যাতে বিচারের দাবি তোলা যায়। তাঁদের সমস্যা হলো, আসাদদের পরে অন্যায়-অবিচারের ভিন্ন আরেক সুনামি বইছে সিরিয়াজুড়ে এবং এর শিকার মুখ্যত অ-সুন্নি জনগোষ্ঠী। আলাউইত ও দ্রুজদের বাইরে খ্রিষ্টানরাও নিয়মিত আক্রান্ত ও অপহৃত হচ্ছে। কেউ কেউ মারা পড়ছে। বড় অংশ পালাচ্ছে। তবে আল-শারার মন্ত্রিপরিষদে দ্রুজ, খ্রিষ্টান, কুর্দি ও আলাউইত সম্প্রদায়ের একজন করে সদস্য রাখা হয়েছে। মন্ত্রিসভার এই অন্তর্ভুক্তিমূলক চেহারা দেশ-বিদেশে প্রশংসিতও হয়েছে।

নতুন সরকারের এক বছর পূর্তিকালে সবচেয়ে বড় চমক হলো, এইচটিএস বলছে, আইএস (ইসলামিক স্টেট) গেরিলাদের নির্মূলে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে সিরিয়া। শারা রীতিমতো ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে এই অঙ্গীকার করে এসেছেন গত নভেম্বরে। একদিকে সাবেক আইএস সহযোগীরা ক্ষমতায়, আবার তারাই অন্য আইএসদের ধরপাকড়ে সহযোগিতা করতে চায়—এ রকম সবই একধরনের ধাঁধার মতো।

যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে নতুন সিরিয়ার কাছে আরেক নীরব চাওয়া, দামেস্ক যেন ক্রমে ইসরায়েলের বন্ধু হয়ে ওঠে। একে ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়ই বলতে হবে; কারণ, বহুকাল ধরে সিরিয়া প্যালেস্টাইন গেরিলাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের বড় কূটনৈতিক বন্ধু। এখন শারার কল্যাণে পুরোনো সিরিয়ার পুরোনো ইসরায়েল নীতি অনেকটা বদলে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

(বাঁ থেকে ডানে) সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে, ১৪ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাশারমুক্ত সিরিয়ায় বিদেশি শক্তির পাশাখেলা