চার দশক ধরে চা-শিঙাড়া বিক্রি করে সংসার চালান বিলাল
Published: 8th, February 2025 GMT
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকে তাঁকে ‘বিলাল মামা’ বলে ডাকেন। ক্লাস-পরীক্ষা শেষে সন্ধ্যাকালীন আড্ডার সময় তাঁর দোকানে চা কিংবা শিঙাড়া-পেঁয়াজি খাননি—বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের অদূরে চা-শিঙাড়া-ডালপুরি আর পেঁয়াজি বিক্রি করেন বিলাল উদ্দিন। বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। প্রায় ৪ দশক ধরে এ পেশায় আছেন তিনি। সিলেট সদরের টুকের বাজার এলাকায় আশির দশকে তিনি এ কাজ শুরু করেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিলাল উদ্দিনের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, শিঙাড়া-ডালপুরি-পেঁয়াজি বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। দোকানটির চারদিক খোলা। ওপরে একচালা টিনের শেড। এই ঝুপড়ি দোকান ঘিরেই তাঁর যত কর্মযজ্ঞ। দোকানটির আশপাশে ভিড় করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই নিজেদের পাতে শিঙাড়া-পুরি বা পেঁয়াজি পেয়ে খাওয়া শুরু করেছেন। বাকিরা অপেক্ষায় আছেন।
এর এক ফাঁকে চা খেতে খেতে কথা হয় বিলাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাঝে কিছুদিন সিলেটের বন্দরবাজারে ভাত বিক্রির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু আশানুরূপ না হওয়ায় এটি বাদ দেন। এরপর শহরের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে চা-শিঙাড়ার ব্যবসা শুরু করেন। আর প্রায় ছয় বছর ধরে ভার্সিটি প্রধান ফটক–সংলগ্ন ওই এলাকায় এ ব্যবসা করছেন। আয়ের একমাত্র উৎস থেকেই তিনি সংসার চালিয়ে আসছেন। আগে শিঙাড়া-পুরি তৈরি, পরিবেশন, চা বানানোসহ দোকানের সব কাজ একাই করতেন। কিন্তু বয়সের কারণে এখন চাইলেও অনেক কিছু একা সামলাতে পারেন না। তাই একজন সহযোগী রেখেছেন। তবে খাবার ও চা তিনি নিজেই তৈরি করেন।
বিলাল উদ্দিনের দোকানটি প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দোকান চালু থাকে। সেখানে প্রতিদিনই প্রায় ৪-৫ কেজি ময়দা দিয়ে শিঙাড়া-পেঁয়াজি-পুরি তৈরি করা হয়। এগুলোর প্রতিটির দাম পাঁচ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে প্রতিদিন সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এর মধ্যে হাজার খানিক টাকা বিলালের লাভ থাকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে তখন আর লাভের আশা থাকে না। পুঁজির টাকা উঠলেই খুশি থাকেন তিনি।
ময়দার খামির দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এসব নাশতাজাতীয় খাবার বানিয়ে তেলে ভাজেন বিলাল। এতে শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ আরও বাড়ে। গরম-গরম শিঙাড়া-পুরি-পিঁয়াজি খেতেই শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় আর খাবারের উৎসাহ দেখলেই তা আঁচ করা যায়।
বিলাল বলেন, ‘ছাত্র মামারা আমারে অনেক মায়া করে। আমার দোকানে এইখন বসার ৯টা বেঞ্চ আছে, এইডার মইধ্যে মাত্র দুইডা আমি কিনছি। বাকি সাতডা মামারা কিইন্যা দিছে। মামারা কেউ বাকি নেয় না। টেখা না থাকলে কইয়া খায়, এক দুই দিন পর দিয়া যায়। আইজ পর্যন্ত মামারা কেউ টেখা মারে নাই। মামারা অনেক আন্তরিক।’
বিলালকে শিক্ষার্থীরাও বেশ ভালোবাসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মেহেরাব সাদাত বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের উনি (বিলাল) কখনো কাস্টমার (ক্রেতা) হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে মনে হয়নি। আমাদের তিনি একদম নিজের আপনজন মনে করেন। আমাদের কত-শত আড্ডা, আলাপ-আলোচনার স্মৃতির সঙ্গে যে মামা ও তাঁর চা-শিঙাড়া থাকবে, তার ইয়ত্তা নেই।’
আলাপের একপর্যায়ে হাতের ইশারায় অদূরে একটি দোকান দেখিয়ে বিলাল উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘ওই যে শাটারওয়ালা দোকানডা দেখা যায়, ৫ আগস্টের আগে ওইডা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অফিস আছিল। এরার কাছে ১৬-১৭ হাজার টেখা বাকি পাই। এইখন এরার কোনো খোঁজ পাইতাছি না।’
পরিবারের বিষয়ে বিলাল বলেন, সিলেট সদরের টুকেরবাজার এলাকায় তিনি সপরিবারে বসবাস করেন। তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর ছয় সদস্যের পরিবার। মেজ ছেলে প্রতিবন্ধী। তবে বড় ছেলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালানো শিখছেন। এতে তাঁর দুঃখ কিছুটা লাঘব বলে প্রত্যাশা করেন। মেয়ে দশম শ্রেণি ও ছোট ছেলে মাদ্রাসায় পড়ছে। এখন শুধু ছেলেমেয়েদের মানুষ হিসেবে গড়া তোলার স্বপ্ন দেখেন শিক্ষার্থীদের ‘বিলাল মামা’।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে
সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’
বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।
এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।
এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।