জনপ্রশাসনে প্রথম ‘সুনামি’ শুরু হয়েছিল ৫ আগস্টের পর। দ্বিতীয় সুনামি শুরু হলো অতি সম্প্রতি। তবে দুই সুনামির মধ্যে ফারাক আছে। প্রথমটি ছিল অনেকটা জোরজবরদস্তিমূলক। কারও মনে হলো, অমুক মন্ত্রণালয়ে পছন্দসই একজনকে বসাতে হবে। কিন্তু সেই পদে তো একজন আছেন। সাবেক সরকারের অপার মহিমায় পদ ছাড়া বহু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিলেও এক পদে দুজনকে বসানোর কোনো সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে আগেরজনকে সরাতে হবে। সে জন্য একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এভাবে স্বৈরাচারের দোসর বলে অনেককে সরানো হয়েছে। আবার শূন্যস্থানে যাঁদের বসানো হয়েছে, তঁাদের নামেও একই অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। 

জনপ্রশাসনে রদবদল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা কিংবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর উদাহরণ খুব বেশি নেই। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি-জামায়াতের দোসর কালিমা দিয়ে অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছিল। ২৫ বছরের দোহাই দিয়ে অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়। এর আগে বিএনপি সরকারের আমলেও এমন ঘটনা ঘটেছে।

আলাপ প্রসঙ্গে একজন সাবেক সচিব বললেন, ঢালাও ওএসডি ও অবসরে পাঠানোর কাজটি শুরু হয় বিএনপির দ্বিতীয় সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রথম সরকারের সময় কর্মকর্তাদের গায়ে রাজনীতির তকমা লাগানোর ঘটনা তেমন ছিল না। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিএনপি–জামায়াতের ট্যাগ লাগিয়ে অনেক বেশিসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখে এবং এক পর্যায়ে তাদের অবসরে পাঠিয়ে দেয়।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন সচিব পদে ১১৯ জন, গ্রেড-১ (সচিবের সমান বেতন গ্রেড) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ জন কর্মকর্তা। যাঁরা অবসরে গেছেন, তাঁরা ‘ভূতাপেক্ষভাবে’ পদোন্নতি পাবেন। ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বঞ্চিত দাবি করে ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এর মধ্যে মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের করা ১৯টি আবেদনও ছিল। এ–সংক্রান্ত গঠিত একটি কমিটির সুপারিশে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

যে দেশে থানা পর্যায়ের একজন নেতা ও জেলা পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, সেখানে সাখাওয়াত হোসেনের এ দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় বলে মনে করি। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যদি সত্যি সত্যি দেশটা বদলাতে চান, শুরুটা নিজেকে দিয়েই করতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে।’

এ হলো জনপ্রশাসনের একদিকের চিত্র। অপর দিকের চিত্র হলো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) সালে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকা সাবেক জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাঁদের মধ্যে যাঁদের চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়েছে, তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। অন্যদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে ২২ জন সাবেক ডিসিকে, যাঁরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ নানা পদে অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর ওএসডি করা হয়েছে ৩৩ কর্মকর্তাকে। এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড.

মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা ডিসিদের এই মেসেজ দিতে চাচ্ছি—আপনারা রিটার্নিং অফিসার হবেন, ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে সাহসের সঙ্গে আইনকানুন মেনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। যাঁরা করবেন না, তাঁরা এই মেসেজ পেয়ে যাবেন যে না হলে কী ফল হবে!’ খুবই কঠিন বার্তা। 

নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মুখ্য ভূমিকা থাকে, এটা সত্য। কিন্তু ভোটকেন্দ্রের মূল কাজটি তো করে থাকেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তারা। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল রাতের ভোটে। ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটে’ আমলাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দৌরাত্ম্য কম ছিল না। সে ক্ষেত্রে অন্যদের বাদ দিয়ে কেবল ডিসিদের শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো দলীয় সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। কারণ, দলীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ ও সাহস কেউ দেখাতে পারেননি। সেটা ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪–এর জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচনের জন্যও।

জনপ্রশাসনসচিব বলেছেন, অপরাধ করে কেউ ভবিষ্যতেও পার পাবেন না, শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু অতীতের অন্যায়ের বিচারের ক্ষেত্রে শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তারা কেন শাস্তি পাবেন? অন্যরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ নির্বাচনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবার আমলনামা খতিয়ে দেখা হোক। তদন্ত সাপেক্ষে তাঁদেরও বিচারের আওতায় আনা হোক। 

ডেইলি স্টার–এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন আগামী অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছেন। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে অক্টোবরেই তফসিল ঘোষণা করতে হবে। তিনি আগামী বছরের জানুয়ারিতে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নেবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। 

নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে সংশয় সন্দেহ আছে, তাঁর এ বক্তব্যের মাধ্যমে কাটবে কি না জানি না, এর আগে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তফসিলের বিষয়ে কিছু না বললেও ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে সাখাওয়াত হোসেন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও একটা বাস্তব ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের প্রত্যাশা সরকারের গতি ৮০ কিলোমিটার হোক, আমরা হয়তো ৪০-৫০–এ চলছি।’ অর্থাৎ সরকারের জনপ্রত্যাশার অর্ধেক পূরণের অবস্থায় আছে।

উপদেষ্টাদের ক্ষমতাচর্চা সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে নানা রকম আলোচনা আছে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘অন্যদের বিষয়টা বলতে পারব না। আমার জন্য বরাদ্দ সরকারি গাড়ির বাড়তি ব্যবহার করি না, আমার পরিবারের কাউকে করতে দিই না।...বিদেশে গেলে ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করি না। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটেও ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করি না। লন্ডনে গিয়েছি, বিজনেস ক্লাসের টিকিট নিইনি, ইকোনমি ক্লাসে গিয়েছি। ভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার না করায় আমার সহকর্মীদের তো মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। তাদের বলি, তোমরা যারা ভিভিআইপিতে যেতে চাও যাও, আমি সাধারণ লাইনে দাঁড়িয়ে যাব।’

যে দেশে থানা পর্যায়ের একজন নেতা ও জেলা পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, সেখানে সাখাওয়াত হোসেনের এ দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় বলে মনে করি। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যদি সত্যি সত্যি দেশটা বদলাতে চান, শুরুটা নিজেকে দিয়েই করতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে।’

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর য য় র একজন সরক র র আমল ল গ সরক র সরক র র স উপদ ষ ট ন সরক র র জন য বছর র ব এনপ ক ষমত আওয় ম ভ আইপ র সদস প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে

ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে উপনিবেশিত সব দেশকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়েছিল। অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষা আর সংগ্রামের বিনিময়ে এসেছিল স্বাধীনতা; কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘মুকুটরত্ন’ খ্যাত ভারতের মতো এত বিশাল ও বিস্তৃত পরিসরের দেশে ও দেশের বাইরে বিরাট ক্যানভাসে স্বাধীনতার সংগ্রাম মনে হয় আর কোনো উপনিবেশের স্বাধীনতার জন্য করতে হয়নি।

আমরা সাধারণত ভারতীয় উপমহাদেশে সক্রিয় ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু এমন অনেকে ছিলেন, যাঁরা ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে বিদেশের মাটিতে বসে অসংখ্য বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলাদেশের জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা কিংবা জনপ্রিয় লেখাজোখাতেও তাঁদের আত্মত্যাগের গল্প খুব কমই উঠে আসে।

অথচ এই বিপ্লবীদের রয়েছে এমন এক গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বগাথা, যা ভারতীয় উপমহাদেশসহ সারা দুনিয়ায় ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামরত সব মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার। কল্পনা করুন, পুলিশের চোখ এড়াতে একজন বিপ্লবী সিঙ্গাপুরের উপকূল থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে পাড়ি দিচ্ছেন জেলে নৌকার সাহায্যে। আরেকজন ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে সাঁতরে পাড়ি দিচ্ছেন মিসরের সুয়েজ খাল। এসব ঘটনা থেকে দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের অদম্য প্রচেষ্টার দু–একটি উদাহরণ পাওয়া যায়।

বিদেশে বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু সুপরিচিত। তবে তাঁরও অনেক আগে একদল ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। শুরুতে তাঁরা জার্মানি এবং পরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন ১৮৯২ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী। তিনি একা নন, মস্কোয় আরও দুজন বাঙালি বিপ্লবী লুহানীর মতো একই ভাগ্য বরণ করেছিলেন। একজন তৎকালীন বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যজন সাতক্ষীরার অবনী মুখোপাধ্যায়।

যেভাবে বইটির সূচনা

সম্প্রতি প্রকাশিত গোলাম আম্বিয়া খান লুহানী: এক অজানা বিপ্লবীর কাহিনি বই থেকে বিপ্লবী লুহানীর বর্ণিল জীবন ও বহুমুখী কার্যকলাপ সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়। বইটির লেখক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লুহানীর জীবন ও কর্ম উদ্‌ঘাটন করেছেন তাঁর ৪২ বছরের নিরলস সাধনায়।

মতিউর রহমান ১৯৮১ সালে দিল্লি ভ্রমণে গেলে বিজ্ঞানী ও কমিউনিস্ট নেতা ড. গঙ্গাধর অধিকারীর কাছ থেকে লুহানীর কথা প্রথম জানতে পারেন। গঙ্গাধর অধিকারী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস নিয়ে কাজ করার সময় লুহানীর বহুমুখী কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯২৯ সালের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর গ্রেপ্তারের ঘটনাটি বেশ আলোচিত। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ব্রিটিশ সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।

১৯৮১ সাল থেকে মতিউর রহমান লুহানী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বার্লিন, মস্কো, দিল্লি ও কলকাতার বিভিন্ন আর্কাইভের শরণাপন্ন হন। তিনি সবকিছু জোগাড় করতে পারেননি বলে বইয়ের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন। তবে আপাত ‘বিস্মৃত’ এই বিপ্লবীর ওপর যে পরিমাণ তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছেন, সেটিও অভূতপূর্ব।

এই বইয়ে লেখক লুহানীর বহুমুখী কাজের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিকও তুলে এনেছেন। বইটিতে প্যারিস থেকে সিরাজগঞ্জে মায়ের কাছে লেখা লুহানী ও তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলের চিঠি এবং তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় লুহানীর পরিবারের সদস্য ও কলকাতার একটি শিপিং এজেন্সির মধ্যকার চিঠি আদান–প্রদানও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বইটির প্রতি লেখকের গভীর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। ১৯৮০’–এর দশকের মাঝামাঝি রুশ ইতিহাসবিদ ও ভারতবিশেষজ্ঞ লিওনিদ মিত্রোখিনের সঙ্গে লেখকের দেখা হয়েছিল মস্কোয়। ১৯৯১ সালে মিত্রোখিন দিল্লি থেকে প্রকাশিত সোভিয়েত ল্যান্ড পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো তিনজন বাঙালি বিপ্লবী—বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখোপাধ্যায় ও গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর করুণ পরিণতির কথা প্রকাশ করেন। তাঁদের সবারই বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্গে যোগসূত্র ছিল। নিবন্ধের শেষে মিত্রোখিন লিখেছেন, মতিউর রহমান লুহানীকে নিয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করছেন, যা এই বিপ্লবীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। কয়েক দশক পর অবশেষে ২০২৪ সালের অক্টোবরে সেই প্রতীক্ষিত বইটি আলোর মুখ দেখেছে।

বইটি থেকে জানা যায়, লুহানী প্রবেশিকা পরীক্ষা (বর্তমান মাধ্যমিক পরীক্ষার সমমান) পাস করার পর ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত মিডিয়া ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফতেহ লোহানী ও ফজলে লোহানী এবং তাঁদের বোন বিশিষ্ট গায়িকা অধ্যাপক হুসনা বানু খানমের মামা। ফজলে লোহানীর মাধ্যমে মতিউর রহমানের যোগাযোগ ঘটে গোলাম আম্বিয়া খান লুহানীর ভাগনে মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদের সঙ্গে; যিনি বহু বছর ধরে পারিবারিক চিঠিগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।

বইটি যখন প্রকাশের জন্য প্রস্তুত, তার কয়েক মাস আগে ২০২৪ সালের মে মাসে একটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। নিউইয়র্কের শিল্প–গবেষক জুলিয়া বডেউইন মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে লুহানীর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েল সোয়েন সম্পর্কে জানতে চান। এই যোগাযোগের সূত্র ধরে আরও বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর জানা যায় যে গ্যাব্রিয়েল ছিলেন একজন ফরাসি মডেল ও ফ্যাশন ডিজাইনার।

লুহানীর খোঁজে 

মতিউর রহমানের সংগ্রহ করা নথিপত্র থেকে জানা যায়, লুহানী লন্ডনে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও শ্রমিক আন্দোলন এবং সোভিয়েত বিপ্লবের সমর্থনে কাজ করেছেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি সাংবাদিক ও শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে বসবাস করেন এবং সেখানকার সংবাদপত্রগুলোতে ভারতের রাজনৈতিক ও শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ইংরেজি ছাড়াও তিনি ফরাসি, ফারসি, জার্মান ও হিন্দি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

১৯২১ সালে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লুহানী প্রথম একটি প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী দলের অংশ হিসেবে মস্কো সফর করেন। কিন্তু দলটি কমিন্টার্নের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। তবে লুহানী কিছু সময়ের জন্য সেখানে থেকে কমিন্টার্নের প্রচার বিভাগ অ্যাজিটপ্রপে কাজ করেন। প্যারিসে থাকাকালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা দ্য মেসেজ অব ইন্ডিয়া সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এ ছাড়া তিনি কমিটি প্রো-হিন্দুর (ভারতীয় অর্থে) সঙ্গে কাজ করেছেন। এই কমিটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করত। ফরাসি লেখক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী ওঁরি বারবুস ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। বারবুসের লেখার মাধ্যমে ‘লস্ট জেনারেশন’–এর বহু লেখক প্রভাবিত হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও এরিখ মারিয়া রেমার্ক অন্যতম।

প্যারিসে থাকাকালে লুহানীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ উঠলে সেখানে তাঁর থাকার অনুমতি বাতিল করা হয়। এ বছরের জুলাই মাসে আমি প্যারিসে গেলে মোঁপানাস এলাকায় লুহানীর সেই বাড়ির ঠিকানায় যাই। বাড়ির উল্টো দিকে থাকা একটি ক্যাফের লোকদের সঙ্গে আলাপে লুহানীর কাহিনি শুনে তাঁরা অবাক হন। ক্যাফের একজন জানান, বাড়িটি এখনো আবাসিক ভবন হিসেবেই আছে; কিন্তু কোনো বাঙালি থাকেন বলে তাঁরা জানেন না। অপ্রত্যাশিতভাবে পাশের সড়কেই পেয়ে যাই লুহানীর স্ত্রীর পোর্ট্রেট আঁকা প্রখ্যাত শিল্পী আমেদেও মোদিলিয়ানির বাড়ি। যদিও লুহানীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর পরিচয়ের অনেক আগেই মোদিলিয়ানি সেই পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, এটি এখন আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

১৯২৫ সালের অক্টোবরে লুহানী স্থায়ীভাবে মস্কোয় চলে যান। ১৯২৮ সালে তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ এবং ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এ সময়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের বৈশ্বিক কেন্দ্র কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে (কমিন্টার্ন) বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।

লুহানীর ওপর লেখা এই বইয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে। তিনি সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে কমিন্টার্নসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। যুক্ত ছিলেন পিজ্যান্টস ইন্টারন্যাশনাল ও মোপার (বিপ্লবীদের সাহায্য করার আন্তর্জাতিক সংস্থা) সঙ্গে। এ ছাড়া তিনি রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, নারিমানভ ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ ও কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অব দ্য টয়েলার্স অব দ্য ইস্ট-এ কাজ করেছেন। তিনি মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় বিষয় নিয়েও বক্তৃতা দিতেন।

মস্কোয় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কমিন্টার্ন কংগ্রেসে লুহানী ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে তিনি এম এন রায়ের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। ১৯৬৪ সালের ৩০ আগস্ট, লিংক-এর মস্কো সংবাদদাতা পি উন্নিকৃষ্ণান একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে লুহানী জাতীয় ও ঔপনিবেশিক বিষয়ে কমিন্টার্নের একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। মতিউর রহমান ৪২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টা ও আবেগের সংমিশ্রণে সংগৃহীত নথিপত্র কাজে লাগিয়ে লুহানীর এই অসাধারণ জীবন ও বহুমুখী অবদানকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

লুহানী ছাড়াও এই বইয়ে বার্লিন ও মস্কোভিত্তিক ভারতীয় বিপ্লবীদের কার্যকলাপ ও উদ্যোগের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। ১৯২১ সালে লুহানী, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং পান্ডুরাজ খানখোজে যৌথভাবে ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন’ নামে একটি থিসিস রচনা করে রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এর প্রত্যুত্তরও তাঁরা পেয়েছিলেন লেনিনের কাছ থেকে। উল্লেখ্য, ‘নাইটিঙ্গেল অব দ্য ইস্ট’ নামে পরিচিত বিখ্যাত রাজনৈতিক কর্মী ও কবি সরোজিনী নাইডুর ছোট ভাই ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।

এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত লুহানীর প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষণক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিখ্যাত বিপ্লবী এম এন রায় এবং সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টির প্রশংসা করেছেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি ও সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে।

মরণোত্তর সম্মান

বইটিতে ব্যবহৃত সোভিয়েত গোয়েন্দা নথিপত্র থেকে জানা যায়, স্তালিনের শাসনামলে লুহানী সন্দেহ ও অবিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন। সেই সময়ে অনেককে ভিন্নমতের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই করুণ পরিণতি থেকে লুহানীও রেহাই পাননি। ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর স্তালিনের নির্দেশে মস্কোর কাছে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা এনকেভিডির প্রশিক্ষণ মাঠ কমিউনারকায় তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত সুপ্রিম কোর্টের সামরিক কলেজিয়াম তাঁর বিচারকে ভুল বলে ঘোষণা করে এবং তাঁকে মরণোত্তর সম্মান প্রদান করে।

এই বইয়ে লুহানীর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ, প্রতিবেদন ও ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড রেভল্যুশন’ থিসিসসহ অনেকগুলো চিঠি ও নথি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ড. বিনায়ক সেনের একটি প্রবন্ধ, লিওনিদ মিত্রোখিনের ‘আ ট্রিপল ট্র্যাপ’ নিবন্ধ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কমিন্টার্ন–বিশেষজ্ঞ ড. শোভনলাল দত্তগুপ্তের সঙ্গে মতিউর রহমানের একটি কথোপকথন। তাঁদের এই আলোচনায় সেই সময়ের বিপ্লবী, কমিন্টার্ন ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

লুহানীর দুর্লভ রঙিন ছবি, তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েলের পোর্ট্রেট ও প্রতিকৃতি, বিভিন্ন শহরে তাঁদের বাসস্থানের ছবি এবং গুরুত্বপূর্ণ চিঠি যুক্ত করার মাধ্যমে বইটি আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বই থেকে একজন বাঙালি বিপ্লবীর করুণ পরিণতি সম্পর্কে যেমন জানা যায়, তেমনি বিচরণ করা যায় ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট কালপর্বে, যার প্রভাব আজও ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজ–রাজনীতির নানা স্তরে। নিঃসন্দেহে এই বই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

খলিলউল্লাহ্ লেখক ও সাংবাদিক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফ্রান্সজুড়ে কৃচ্ছ্রতা বিরোধী বিক্ষোভ
  • চিমামান্দা এনগোজি আদিচির নারীবাদ
  • ভোররাতে রণক্ষেত্র: নরসিংদীতে নিহত ১, গুলিবিদ্ধ ৫
  • এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • পুলিশের ৯ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর
  • ইতিহাসের দ্রুততম মানবের এখন সিঁড়ি ভাঙতে দম ফুরিয়ে আসে