প্রশাসনে ‘সুনামি’ ও এক অ–ভিআইপি উপদেষ্টা
Published: 22nd, February 2025 GMT
জনপ্রশাসনে প্রথম ‘সুনামি’ শুরু হয়েছিল ৫ আগস্টের পর। দ্বিতীয় সুনামি শুরু হলো অতি সম্প্রতি। তবে দুই সুনামির মধ্যে ফারাক আছে। প্রথমটি ছিল অনেকটা জোরজবরদস্তিমূলক। কারও মনে হলো, অমুক মন্ত্রণালয়ে পছন্দসই একজনকে বসাতে হবে। কিন্তু সেই পদে তো একজন আছেন। সাবেক সরকারের অপার মহিমায় পদ ছাড়া বহু কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিলেও এক পদে দুজনকে বসানোর কোনো সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে আগেরজনকে সরাতে হবে। সে জন্য একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এভাবে স্বৈরাচারের দোসর বলে অনেককে সরানো হয়েছে। আবার শূন্যস্থানে যাঁদের বসানো হয়েছে, তঁাদের নামেও একই অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ।
জনপ্রশাসনে রদবদল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা কিংবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর উদাহরণ খুব বেশি নেই। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি-জামায়াতের দোসর কালিমা দিয়ে অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছিল। ২৫ বছরের দোহাই দিয়ে অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়। এর আগে বিএনপি সরকারের আমলেও এমন ঘটনা ঘটেছে।
আলাপ প্রসঙ্গে একজন সাবেক সচিব বললেন, ঢালাও ওএসডি ও অবসরে পাঠানোর কাজটি শুরু হয় বিএনপির দ্বিতীয় সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রথম সরকারের সময় কর্মকর্তাদের গায়ে রাজনীতির তকমা লাগানোর ঘটনা তেমন ছিল না। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিএনপি–জামায়াতের ট্যাগ লাগিয়ে অনেক বেশিসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখে এবং এক পর্যায়ে তাদের অবসরে পাঠিয়ে দেয়।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে জনপ্রশাসনে বঞ্চিত ৭৬৪ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন সচিব পদে ১১৯ জন, গ্রেড-১ (সচিবের সমান বেতন গ্রেড) পদে ৪১ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন এবং উপসচিব পদে ৪ জন কর্মকর্তা। যাঁরা অবসরে গেছেন, তাঁরা ‘ভূতাপেক্ষভাবে’ পদোন্নতি পাবেন। ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বঞ্চিত দাবি করে ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এর মধ্যে মারা যাওয়া কর্মকর্তাদের পক্ষে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের করা ১৯টি আবেদনও ছিল। এ–সংক্রান্ত গঠিত একটি কমিটির সুপারিশে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
যে দেশে থানা পর্যায়ের একজন নেতা ও জেলা পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, সেখানে সাখাওয়াত হোসেনের এ দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় বলে মনে করি। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যদি সত্যি সত্যি দেশটা বদলাতে চান, শুরুটা নিজেকে দিয়েই করতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে।’এ হলো জনপ্রশাসনের একদিকের চিত্র। অপর দিকের চিত্র হলো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) সালে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকা সাবেক জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাঁদের মধ্যে যাঁদের চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়েছে, তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। অন্যদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে ২২ জন সাবেক ডিসিকে, যাঁরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ নানা পদে অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর ওএসডি করা হয়েছে ৩৩ কর্মকর্তাকে। এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড.
নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মুখ্য ভূমিকা থাকে, এটা সত্য। কিন্তু ভোটকেন্দ্রের মূল কাজটি তো করে থাকেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তারা। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল রাতের ভোটে। ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটে’ আমলাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দৌরাত্ম্য কম ছিল না। সে ক্ষেত্রে অন্যদের বাদ দিয়ে কেবল ডিসিদের শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো দলীয় সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। কারণ, দলীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ ও সাহস কেউ দেখাতে পারেননি। সেটা ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪–এর জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য ১৯৯৬ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচনের জন্যও।
জনপ্রশাসনসচিব বলেছেন, অপরাধ করে কেউ ভবিষ্যতেও পার পাবেন না, শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু অতীতের অন্যায়ের বিচারের ক্ষেত্রে শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তারা কেন শাস্তি পাবেন? অন্যরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ নির্বাচনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবার আমলনামা খতিয়ে দেখা হোক। তদন্ত সাপেক্ষে তাঁদেরও বিচারের আওতায় আনা হোক।
ডেইলি স্টার–এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন আগামী অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছেন। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে অক্টোবরেই তফসিল ঘোষণা করতে হবে। তিনি আগামী বছরের জানুয়ারিতে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নেবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে সংশয় সন্দেহ আছে, তাঁর এ বক্তব্যের মাধ্যমে কাটবে কি না জানি না, এর আগে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তফসিলের বিষয়ে কিছু না বললেও ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে সাখাওয়াত হোসেন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও একটা বাস্তব ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের প্রত্যাশা সরকারের গতি ৮০ কিলোমিটার হোক, আমরা হয়তো ৪০-৫০–এ চলছি।’ অর্থাৎ সরকারের জনপ্রত্যাশার অর্ধেক পূরণের অবস্থায় আছে।
উপদেষ্টাদের ক্ষমতাচর্চা সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে নানা রকম আলোচনা আছে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এই উপদেষ্টা বলেন, ‘অন্যদের বিষয়টা বলতে পারব না। আমার জন্য বরাদ্দ সরকারি গাড়ির বাড়তি ব্যবহার করি না, আমার পরিবারের কাউকে করতে দিই না।...বিদেশে গেলে ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করি না। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটেও ভিভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করি না। লন্ডনে গিয়েছি, বিজনেস ক্লাসের টিকিট নিইনি, ইকোনমি ক্লাসে গিয়েছি। ভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার না করায় আমার সহকর্মীদের তো মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। তাদের বলি, তোমরা যারা ভিভিআইপিতে যেতে চাও যাও, আমি সাধারণ লাইনে দাঁড়িয়ে যাব।’
যে দেশে থানা পর্যায়ের একজন নেতা ও জেলা পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, সেখানে সাখাওয়াত হোসেনের এ দৃষ্টান্ত অনুসরণীয় বলে মনে করি। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা যদি সত্যি সত্যি দেশটা বদলাতে চান, শুরুটা নিজেকে দিয়েই করতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে।’
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর য য় র একজন সরক র র আমল ল গ সরক র সরক র র স উপদ ষ ট ন সরক র র জন য বছর র ব এনপ ক ষমত আওয় ম ভ আইপ র সদস প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
কালো পতাকার মানুষ
সব গমনাগমনে কি তৈরি পথ লাগে! আলো, হাওয়া, শব্দ নিজেরা পথ তৈরি করে ছুটে চলে দিগ্বিদিক, যাদের ধরার তারা ধরে ফেলে। শব্দ আসার সম্ভাব্য ক্ষীণ পথগুলো কাপড়ের টুকরা বা কাগজের দলা দিয়ে বন্ধ করতে থাকেন ‘আম্মা’। বিছানায় ছেলেমেয়েরা ঘুমাচ্ছে। ওরা এভাবে গাদাগাদি করে শুতে অভ্যস্ত নয়। বড় ছেলেদের ঘর আলাদা, তারা নিজ নিজ বিছানায় হাত–পা ছড়িয়ে ঘুমায়। মেয়ে দুটো ছোট, তারা মায়ের ঘরে শুলেও তাদের আলাদা খাট। কিন্তু বড় মেয়েটা ভীতু হওয়ায় ও প্রায় সময় মায়ের কাছে ঘুমায়। আজও সে ছটফট করছে। ওর জন্যই জানালার পাল্লার চিকন, ক্ষুদ্র, ফাঁকও বন্ধ করার চেষ্টা করছেন তিনি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝমঝমানি ছাপিয়ে বাইরের খানকাঘরের বারান্দার সামনের তর্জন–গর্জন আর আর্তনাদের মিহিন ছিটেফোঁটা নিশুতি রাতে দ্বিগুণ হয়ে ঘরে আসছে। সেসব শব্দে তীব্র আতঙ্কে বাচ্চা মেয়েটা কেবল চমকে চমকে উঠছে। সন্তানের জন্য আম্মা শব্দের পথ একটা একটা করে বন্ধ করে চলেছেন।
শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। এত এত ঘর, প্রতিটি ঘরে মানুষ, বিপন্ন মানুষ, যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। আম্মারা নিজেরাও শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। এটি তাঁর শ্বশুরবাড়ি। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে। তাঁরা নিজেদের শোবার ঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা একটি ঘরে কোনো রকমে থাকছেন।
তাঁর স্বামী এলাকার মান্যগণ্য প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, নানা মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তাঁর বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য মানুষ আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
রাত বেড়ে গভীর হচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেব মেয়ের পাশে উদ্বিগ্ন আধশোয়া স্ত্রীকে বলেন, ‘দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, আমি বাইরে যাচ্ছি, কখন ফিরব ঠিক নেই।’
যুদ্ধের পুরো সময়টা ফেরার ঠিক নেই, খাওয়া, ঘুমের ঠিক নেই। এভাবেই কাটছে তাঁদের।
শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে।২.বাড়িতে দিনের বেলা খানসেনারা আসে মুক্তির খোঁজে। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের নানাবিধ কথা দিয়ে, ভালো খাবারদাবার দিয়ে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন, শান্ত করে বিদায় দেন। রাতের অন্ধকারে সুপ্ত আতশবাজির মতো আসে মুক্তির ছেলেরা। চেয়ারম্যান সাহেব এবং বাড়ির আম্মা তাদের বুক দিয়ে সহায়তা দিতে চেষ্টা করেন। তারা খেয়েদেয়ে কিছু রসদ, কিছু পরামর্শ নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এসব কাজে পাশে থাকেন তাঁর স্ত্রী, সবাই যাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকে। এভাবে সস্ত্রীক মানুষটি তাঁর নিজের এলাকা, এলাকার আতঙ্কিত মানুষগুলোকে রক্ষা করেন। যখন চারপাশের এলাকা যুদ্ধ নামক আগুনের করালগ্রাসে ভস্মীভূত হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিজ এলাকাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন প্রাণপণে।
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায় সেই কুলাঙ্গারের বিচার করছে। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।
রাজাকারের নাম মকবুল। সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনকে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা মানুষদের ধরিয়ে দিত। আরেকটা কাজ সে নিষ্ঠার সঙ্গে করত, মিলিটারির হাতে নিহত মানুষদের শেষ সময়ে সবাইকে নিজের পেশাব খাওয়াত, সরাসরি মুখে পেশাব করে দিত। এ জন্য তার নাম হয়েছে ‘মুতিয়া মকবুল’। এ নাম পাওয়াতে সে এতই খুশি যে কেউ এ নামে ডাকলে খুশিতে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। মনে হয় সে খান বাহাদুর উপাধি পেয়ে গেছে। আজ আর মুখে হাসি নেই।
জসিম স্টেনগানের নলটা মাথায় ঠেকিয়ে বলে, ‘দেই? ওই শালা হারামি দেই ট্রিগার টিপে?’ ঘোড়েল মকবুল আজ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। ধরা সে পড়েছে কয়েক দিন আগে। লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ধরা পড়ার পরপরই চাচার কাছে খবর যায়। তিনি জানিয়ে দেন, একেবারে মেরে না ফেলে শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় কি না। তাঁর কড়া নির্দেশ—অহেতুক কোনো প্রাণ যেন নষ্ট না হয়। দুরন্ত ছেলেরা তাঁর নির্দেশ মেনে চলে।
তবে ছেলেরা মকবুলকে ভালো রকম শিক্ষা দিচ্ছে। মারধর তো করেছেই, ক্ষণে ক্ষণে গুলি করার হুমকি, এ ছাড়া খাবার, পানীয় কিছুই দেয়নি, ঠিক করেছে ওকে পানি দেওয়া হবে না। মিলিটারিরা এই বর্ষণমুখর রাতে আসবে না জেনে তারা এই বিচার বসিয়েছে। তাদের চাচা বাড়ি থেকে এখনো বের হননি। তিনি আসার আগেই ছেলেরা ওকে যা করার তা–ই করছে। হঠাৎ দেখা যায়, এক যুবক হনহন করে আসছে। এসে হিসহিস করে বলে, ‘খবরদার, এই কুত্তার বাচ্চাক গুলি কইরবা না। অরে আমি ধারালো ছুরি দিয়া কুচি কুচি কইরব। অরে পানি দেব না। অর মুখত মুতি দেব। শালা আমার ভাইয়ের মুখত মুতি দিছিল। পাকি কুত্তারা আমার ভাইটাকে গুলি করে ঝাঁঝরা করি দিছিল, আর এই হামার পড়শি, এই জানোয়ার, শেষ সময়ে তার মুখে মুতি দিছে।’
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায়। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।এই বলে সে মাটিতে থেবড়ে বসে হু হু করে কেঁদে ওঠে। আরও একবার সবাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। মন্টু বলে ওঠে, ‘আরে এত কথায় কাজ কী, দেই শালাক শেষ করে। এই এক বালের জন্য এত সময় নষ্ট।’ সোহরাব ফিসফিস করে ওঠে, ‘এই চাচা আসতেছে।’ গুঞ্জন থেমে যায়। এর মধ্যেই একজন সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি কষলে হাত বাঁধা মকবুল একদিকে কাত হয়ে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একজন ঘুষি মেরে সোজা করে দেয়, ‘হারামজাদা, সোজা হয়া বসি থাক।’
চেয়ারম্যান সাহেব এসে বসে সব কথা শোনেন। তিনি গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও। তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো।’ তিনি এখন জানেন, এই গাদ্দার এলাকার নারীদের ক্যাম্পে নিয়ে গেছে, এলাকার তরুণ–যুবকদের ধরিয়ে দিয়েছে। যে বাড়ির ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে সে বাড়ির মানুষজনকে মিলিটারির কাছে ধরিয়ে দিয়েছে। এমনকি তার পড়শিকেও নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে, হেনস্তা করেছে। চেয়ারম্যান সাহেব ওর দিকে একটা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে চলে যান।
এবারে ছেলেরা চাপা উল্লাসে জেগে ওঠে। ওরা ওকে হাত বাঁধা অবস্থায় হাঁটিয়ে নিতে থাকে।
মকবুল ঘাড়ের ওপর প্রেশার কুকারের সিটির মতো মৃত্যুর গরম নিশ্বাস অনুভব করে। পানির তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে; কিন্তু এরা তো পানি দিচ্ছে না।
চেয়ারম্যান চাচার বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে গেছে একটি শান্ত নদী। পাড় দিয়ে অগণন বৃক্ষের সারি। সেখানে সবাই এসে হাজির হয়। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বের হয়ে এসেছে।
মকবুলের হাত বাঁধা ছিল। এবারে পা–ও বেঁধে ওকে পানির কিনারে বসিয়ে দেওয়া হয়। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।
একজন গলা তুলে বলে, ‘ফায়ার কিন্তু আমি করব।’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘না, আমি ধরছি, ফায়ার আমি করব।’ আরেকটি কণ্ঠ শোনা যায়, ‘তার আগে হারামজাদার মুখটা কেউ তুলে ধর তো, আমি অর মুখত পেচ্ছাব করে দেই, তারপর গুলি না করে জবাই করা হোক।’
মকবুলের হাত বাঁধা। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।মকবুল নিজের অবস্থা বুঝে কেঁপে কেঁপে ওঠে। এরা তো মারবেই। তা মরার সময় একটু পানিও খেতে পারবে না? ওর মনে পড়ে, ওরই বয়সের হামিদুলের কথা। হামিদুল মুক্তি। সে এসেছিল বাবা–মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে নিজে মিলিটারি ডেকে এনে ধরিয়ে দিয়েছে। গুলি খেয়ে পড়ার পর হামিদুল পানি পানি করছিল। তখন সে লুঙ্গি তুলে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা খেলার সাথি হামিদুলের মুখে ছরছর করে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। হামিদুল কী গভীরতর ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে শেষবারের মতো তাকিয়েছিল।
আজ এরা ওকে প্রস্রাবই দেবে। কিন্তু বুকটা তো ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি, হিমশীতল একটু পানি না খেলে হবে না। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে পানির জন্য হাহাকার জেগে উঠছে। জিবটা শুকনা খড়ের মতো রুক্ষ হয়ে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে, ভেতরে একটু থুথুও জমছে না। গলার ভেতরটা মরুভূমির বালুর মতো খসখসে, ঢোক গিলেতে গেলে কাঁটার মতো বিঁধছে। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে, এক ফোঁটা পানি, এক বিন্দু তরল যেন জীবনটাকে শীতল করে দিত। চোখ দুটো জ্বালা করতে থাকে, মাথার ভেতর হালকা ধোঁয়ায় ভরে যায়, ঘোর লাগে, মনে হয় এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিলে জীবনের সব যন্ত্রণা মুছে যেত। পানির পিপাসা যে এমন, তা মকবুল আগে বোঝেনি।
সে গুঙিয়ে ওঠে, ‘ভাই রে, তোমার আল্লাহর দোহাই, আমাক এনা পানি দেও। আমাক গুলি করো, জবাই করো, কিন্তু এক ফোঁটা পানি আমাক দেও। আমাক দয়া করো, তোমার পাও ধরি একনা পানি দেও...’
বৃষ্টি থেমে গিয়ে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বেরিয়ে এসে সবার ওপর সমানভাবে জ্যোৎস্না ছড়াতে থাকে।
ঠিক সে সময় বাড়ির খাস কাজের লোক স্বচ্ছ কাচের জগ ভর্তি টলটলে পানি আর ঝকঝকে একটি গ্লাস নিয়ে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘আম্মা কয়া দিছে অরে পানি খাওয়াইতে। যা করমেন করেন, কিন্তক পানি খাওয়ান।’
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের মতোই আরেক যোদ্ধা এই আম্মাকে ভালোভাবে চেনে, জানে। আম্মা ঘরের ভেতর থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন নানাভাবে। তারা সবাই থির হয়ে যায়। জগের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে ওঠে। সবার চোখ জগের দিকে।
মুতিয়া মকবুলের খড়খড়ে জ্বলুনি চোখেও কি পানি জমে! সে পানি ভরা চোখে জগটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন একটা অপার্থিব দৃশ্য। সবার জোড়া জোড়া চোখের সামনে দৃশ্যটা একটা ঐশ্বরিক ফ্রেমে আটকা পড়ে।