বিশ্ববিদ্যালয় মানেই শুধু ক্লাসরুম, পরীক্ষার খাতা আর সনদপত্র নয়। প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান সৃষ্টির কেন্দ্র, নতুন চিন্তার জন্মস্থান এবং সমাজের সমস্যার বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধানের কারখানা। বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু শিক্ষাদানেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সমাজব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে।

কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই গবেষণাভিত্তিক পরিবেশ এখনো গড়ে ওঠেনি। এখানে পড়াশোনা মানে শুধু পরীক্ষায় পাস করা, সিজিপিএ তোলা আর ডিগ্রি অর্জনের প্রতিযোগিতা। গবেষণা যেন একটি অতিরিক্ত বা গৌণ বিষয়। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি—এই গবেষণাহীনতাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা।

১.

বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার সম্পর্ক

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল তিনটি কাজ—শিক্ষাদান, গবেষণা ও সমাজসেবা। এর মধ্যে গবেষণা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গবেষণার মাধ্যমেই নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়। গবেষণার ফল শিক্ষাদানকে সমৃদ্ধ করে এবং সমাজের বাস্তব সমস্যার সমাধানে সহায়তা করে।

কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণাকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। সিলেবাসে গবেষণার কথা থাকলেও বাস্তব প্রয়োগ খুব সীমিত। অনেক শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করলেও প্রকৃত গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায় না। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।

২. গবেষণাহীনতার বর্তমান চিত্র

বর্তমানে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বলতে বোঝায়—থিসিসের জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহ, ইন্টারনেট থেকে লেখালেখি কপি-পেস্ট করা এবং ডিগ্রি শেষ করা। মৌলিক গবেষণা, উদ্ভাবন বা নতুন ধারণা তৈরির পরিবেশ খুবই সীমিত।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণও হলো গবেষণায় দুর্বলতা। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা দেখছি—লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় জার্নাল নেই, গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, আর গবেষণা নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টির কোনো সংস্কৃতি নেই।

৩. গবেষণাহীনতার প্রধান কারণসমূহ

• পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের অভাব

গবেষণা একটি ব্যয়বহুল কার্যক্রম। উন্নত লাইব্রেরি, ল্যাব, জার্নাল সাবস্ক্রিপশন, সফটওয়্যার, ফিল্ডওয়ার্ক—সবকিছুর জন্য অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ খুবই সীমিত।

অনেক সময় বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হয় প্রশাসনিক কাজে, ভবন নির্মাণে বা আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমে। গবেষণা তখন উপেক্ষিত থেকেই যায়।

• শিক্ষক ও গবেষণার চাপ

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একদিকে নিয়মিত ক্লাস নেন, অন্যদিকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। এত চাপের মধ্যে গবেষণায় সময় দেওয়ার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রে থাকে না।

অনেক শিক্ষক গবেষণা করতে চাইলেও পর্যাপ্ত সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণার অভাবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে গবেষণা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সীমাবদ্ধ থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় না।

• গবেষণাবান্ধব পরিবেশের অভাব

গবেষণার জন্য যে মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ দরকার, তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুপস্থিত। নিয়মিত সেমিনার, গবেষণা আলোচনা, ওয়ার্কশপ, একাডেমিক বিতর্ক—এসব খুব কম হয়।

ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণার আগ্রহ তৈরি হয় না। গবেষণাকে অনেকেই বাড়তি ঝামেলা বা সময় নষ্ট মনে করে।

৪. শিক্ষাব্যবস্থায় মুখস্থনির্ভরতার প্রভাব

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ছোটবেলা থেকেই মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এর প্রভাব রয়ে গেছে। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য তথ্য মুখস্থ করাই মুখ্য লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

গবেষণার জন্য প্রয়োজন বিশ্লেষণী চিন্তা, প্রশ্ন করার মানসিকতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা—যা মুখস্থনির্ভর শিক্ষায় গড়ে ওঠে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও অনেক শিক্ষার্থী গবেষণাভিত্তিক চিন্তায় অভ্যস্ত হতে পারে না।

৫. গবেষণাহীনতার কারণে শিক্ষার মানের অবনতি

গবেষণাহীন বিশ্ববিদ্যালয় মানেই স্থবির জ্ঞান। যখন শিক্ষকেরা গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান অর্জন করেন না, তখন তাঁদের পাঠদানও পুরোনো ও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

ফলাফল হিসেবে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগহীন তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করে। চাকরির বাজারে এই জ্ঞান অনেক সময় কাজে আসে না। এতে শিক্ষার্থী ও সমাজ—উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৬. জাতীয় উন্নয়নে গবেষণার ভূমিকা ও আমাদের ব্যর্থতা

একটি দেশের কৃষি উন্নয়ন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিল্প, প্রযুক্তি—সবখানেই বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু গবেষণাহীনতার কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় উন্নয়নে প্রত্যাশিত অবদান রাখতে পারছে না।

কৃষিতে নতুন প্রযুক্তি, পরিবেশসংকটের সমাধান, নগর সমস্যা, দারিদ্র্য দূরীকরণ—এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা হতে পারত দেশের জন্য বড় সম্পদ। কিন্তু গবেষণার অভাবে আমরা বিদেশি জ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি।

৭. শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অংশগ্রহণের সুযোগের অভাব

গবেষণাহীনতার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী গবেষণায় আগ্রহী হলেও সুযোগের অভাবে এগোতে পারে না।

সুপারভাইজারের পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া, গবেষণার অর্থসংকট, উপযুক্ত নির্দেশনার অভাব—সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা গবেষণা থেকে দূরে সরে যায়। এতে ভবিষ্যৎ গবেষক তৈরির পথও সংকুচিত হয়ে পড়ে।

৮. আন্তর্জাতিক মান ও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া

বর্তমান বিশ্ব জ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টিকে থাকতে হলে গবেষণায় এগিয়ে থাকা জরুরি। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণাহীনতা আমাদের বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যৌথ গবেষণা, স্কলারশিপ—এসব সুযোগ কমে যাচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা অনুভব করি, বিশ্বমানের গবেষণায় অংশগ্রহণের স্বপ্ন অনেকটাই অধরা থেকে যাচ্ছে।

৯. গবেষণাহীনতার মানসিক ও সামাজিক প্রভাব

গবেষণাহীন পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হয়ে ওঠে কেবল রুটিনমাফিক ক্লাস ও পরীক্ষার চক্র। সৃজনশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়ে যায়।

সমাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় যখন নতুন ভাবনা দিতে পারে না, তখন সামাজিক উন্নয়নও স্থবির হয়ে পড়ে।

লুৎফুন্নাহার দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র ব শ ব অন ক শ ক ষ ব যবস থ পর ব শ র জন য পর ক ষ সবচ য় সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

মিরসরাইয়ে বিএনপির ২ পক্ষের সংঘর্ষে যুবক নিহত

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বিএনপি দুই পক্ষের সংঘর্ষে গাজী তাহমিদ খান (২৫) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) মারা যান তিনি। 

জোরারগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী নাজমুল হক সংঘর্ষে একজন নিহতের তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

আরো পড়ুন:

হবিগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১, ১৪৪ ধারা জারি 

নরসিংদীতে দু’পক্ষে সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবক নিহত 

নিহত তাহমিদ উপজেলার বারইয়ারহাট পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মো. আলমগীরের ছেলে। তিনি ছাত্রদল কর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বুধবার বিকেলে বারইয়ারহাট পৌর বাজারে একটি দোকানে পায়ের উপর পা তুলে বসে ছিলেন হিঙ্গুলী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের জুবায়ের। এসময় বারইয়ারহাট পৌর বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম লিটন সেখানে যান। তাকে দেখে জুবায়ের পা নামিয়ে না বসায় লিটন ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে লাথি মারেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাকবিতাণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে তারা সেখান থেকে চলে যান। পরে লিটন ও জুবায়ের জামালপুর ও হিঙ্গুলীর লোকজনদের নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান। এ ঘটনায় ৮ থেকে ১০ জন আহত হন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত ১২টার দিকে মারা যান তাহমিদ। 

জোরারগঞ্জ থানার ওসি কাজী নাজমুল হক বলেন, “সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে বিএনপির একই গ্রুপের দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে তাহমিদ নামে একজন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।”

ঢাকা/রেজাউল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বেগম রোকেয়াকে নিয়ে রাবি শিক্ষকের মন্তব্য একাডেমিক নৈতিকতার লঙ্ঘন: আসক
  • কালো পতাকার মানুষ
  • ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এআই দিয়ে বানানো ছবি ছড়ানো হচ্ছে: কৃষ্ণ নন্দী
  • কাস্টমস কর্মকর্তাদের ভয় দেখাতে হামলা, নির্দেশদাতা এখনো পলাতক
  • ‘প্রতারক পুরুষ বিশ্বাসঘাতকতা গোপন রাখে, তবে আল্লাহ সব দেখেন’
  • নিম্নবিত্তের জীবনে সুখের সংজ্ঞা
  • পসরা সাজিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মিলছে তাৎক্ষণিক ঋণসুবিধাও
  • বাফেলোতে মসজিদের সামনে দীর্ঘ সময় আইস পুলিশের অবস্থান
  • মিরসরাইয়ে বিএনপির ২ পক্ষের সংঘর্ষে যুবক নিহত