রমজানের বাজারে বড় অস্বস্তি ভোজ্যতেলে
Published: 27th, February 2025 GMT
‘জিনিসপত্রের দাম এখন মোটামুটি স্বাভাবিক। তবে সামনের সপ্তাহে কী হয়, সেটি দেখার বিষয়। রোজা শুরু হলে তো ব্যবসায়ীরা বেতাল হয়ে যায়।’ গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে সবজি কেনার পর নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সমকালের কাছে এভাবেই খেদোক্তি প্রকাশ করেন বেসরকারি চাকরিজীবী রিয়াজ হাসান। ভোজ্যতেল নিয়ে দুর্দশার কথা জানালেন রহিমা সুলতানা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘মহল্লায় না পেয়ে কারওয়ান বাজারে আইলাম। আট-দশটা দোকানে খুঁজেও তেল পাইলাম না। এই তেল গেল কই?’
রোজার আগে নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে রিয়াজ আর রহিমার মতো অনেক ক্রেতাই নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। প্রতিবছর রোজার আগমুহূর্তে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরবরাহ কমে যাওয়ার ছুতায় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এবার বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মনের ভেতর জমে থাকা পুরোনো ভয় কাটছে না। রোজা শুরুর পরপরই কিছু পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি ও দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কেউ কেউ। যদিও এ বছর ভরপুর ফলনের কারণে পানির দরে কেনা গেছে সবজি। ফলে অন্যসব পণ্যের দরও কিছুটা নাগালে। তবে রোজার আগের এই স্বস্তি একাই কেড়ে নিয়েছে সরবরাহ সংকটে পড়া ভোজ্যতেল।
তবে বাজারে পণ্যের দাম একেবারে বাড়ছে না, তেমনটা নয়। এ সপ্তাহে কিছুটা মাথাচাড়া দিয়েছে ব্রয়লার মুরগি, ছোলা, বেগুন, লেবু, শসা ও বিদেশি ফল। এগুলোর বেশির ভাগই ইফতারির পণ্য।
তেল এখনও বেতাল
দুই মাসের বেশি সময় ধরে ভোজ্যতেলের বাজারে চলছে অরাজকতা।
বড় আকারে শুল্ককর ছাড় দেওয়া হলেও আমদানিকারকরা ভোক্তার সঙ্গে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ থেকে বের হতে পারেননি। নানা অজুহাতে ফের সামনে এনেছেন দর বাড়ানোর আবদার। যদিও তা আমলে নিচ্ছে না সরকার। ফলে বিলম্ব আমদানি দেখিয়ে সরবরাহ কমানোর অভিযোগের তীরে বিদ্ধ তারা।
গেল সপ্তাহে ভোক্তা অধিদপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমদানিকারকদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। তবে সেটি যে ‘কথার কথা’ ছিল, তা ক্রেতারা টের পেয়েছেন বাজারে গিয়েই। গতকাল বুধবার ঢাকার মহাখালী, হাতিরপুল, তেজকুনিপাড়া ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভোজ্যতেলের সংকট আরও প্রবল হয়েছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১০ দোকান খুঁজলে মেলে দুই-এক দোকানে। একসঙ্গে পাঁচ লিটার কিনলে দামে কিছুটা সাশ্রয় হয়। সে জন্য এই বোতলের চাহিদা বেশি। খোলা সয়াবিনের সরবরাহ স্বাভাবিক দেখা গেলেও কিনতে গিয়ে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। সরকার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দর ১৫৭ টাকা নির্ধারণ করলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ১৮০ থেকে ১৮২ টাকা দরে। কারওয়ান বাজারের আবদুর রব স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো.
তেজগাঁওয়ের মেঘনা গ্রুপের ডিলার মায়ের দোয়া স্টোরের মালিক হেলাল উদ্দিন বলেন, তিনবার ক্রয়াদেশ নিয়েছে বিপণনকর্মী। তবে তেল এখনও পায়নি। তা ছাড়া পাঁচ কার্টন তেলের চাহিদা দিলে কোম্পানি পাঠায় দুই কার্টন।
কারওয়ান বাজারের পুষ্টি ব্র্যান্ডের ডিলার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে, তবে স্বাভাবিক হয়নি। যেখানে দৈনিক দরকার ২০ কার্টন, দিচ্ছে ১০ কার্টন। ফলে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ সংকট রয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দুই-তিনটা প্রতিষ্ঠানের মিল বন্ধ। ফলে অন্য কোম্পানির ওপর চাপ বেড়েছে, সে জন্যই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
চট্টগ্রামেও মিলছে না তেল
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানিয়েছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জেও মিলছে না ভোজ্যতেল। খুচরা বাজারে হন্যে হয়ে খুঁজেও তেল কিনতে পারছেন না ভোক্তা। রমজান ঘনিয়ে এলেও স্বাভাবিক হচ্ছে না সরবরাহ। বেশির ভাগ বাজারে এক ও দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন মিলছে না। কয়েকটি স্থানে পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
এ ব্যাপারে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, মাত্র একটি কোম্পানির কিছু তেল এসে বন্দরে পৌঁছেছে। মেঘনার একটি জাহাজ আসবে শুক্রবার, আরেকটা আসবে ৬ মার্চ। দেরিতে তেল আসার কারণে বাজার ধরতে পারছি না। এতে লোকসানের আশঙ্কা করছি।
লেবুর বাজার চড়া
ইফতারে লেবুর শরবত কমবেশি সবার পছন্দ। সেই লেবুর বাজার ছয়-সাত দিন ধরে চড়া। হালিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। বাজারে এখন মাঝারি আকারের এক হালি লেবু কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৮০ টাকা, যা সপ্তাহখানেক আগে কেনা গেছে ২০ থেকে ৫০ টাকায়।
কারওয়ান বাজারের লেবু বিক্রেতা হামিদ মিয়া বলেন, এখন লেবুর মৌসুম নয়। সে জন্য চাহিদা বেশি থাকলেও বাজারে সেই হারে লেবু আসছে না। ফলে মাসখানেক ধরেই লেবুর দাম বাড়তি।
মাল্টারও দামও বেড়েছে। এক সপ্তাহে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়। এভাবে কমলা, আপেল ও আঙুরের দামও বেড়েছে কেজিতে সর্বোচ্চ ২০ টাকা। পাশাপাশি দেশি ফলের দামও কিছুটা চড়েছে। তিন-চার দিন আগে পেয়ারার কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল শতক ছুঁয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন জাতের কলা ডজনে ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়তি দেখা গেছে।
প্রথা ভেঙেছে খেজুর
রোজার শুরুতে খুচরা বাজারে খেজুরের আগুনদর থাকাটাই ছিল নিয়ম। এবার খেজুরের দাম উল্টো পড়ে গেছে। ১৫ থেকে ২০ দিনে মানভেদে খেজুর কেজিতে কমেছে ২০ থেকে ১০০ টাকা। বেশি চাহিদা জায়েদি খেজুরের। গত বছর মানভেদে কেজি ছিল ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা। এবার কেনা যাচ্ছে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। গত বছর এ সময় মাবরুর জাতের খেজুরের দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, এবার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকার আশপাশে। আজওয়া বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৯০০ থেকে হাজার টাকা। কেজিতে ২০০ টাকার মতো কমে মেডজল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায়। এভাবে অন্য জাতের খেজুরের দামও কমেছে।
আমদানিকারকরা বলছেন, এবার রমজানে খেজুরের দাম গতবারের চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ কম হবে। শুল্ক কর কমানোর কারণে আমদানি বেড়েছে। ফলে দাম কমছে। বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমদানিতে শুল্ক কর কমানোর কারণে দাম কিছুটা কমেছে। তবে যৌক্তিক শুল্কায়ন মূল্য কমানো হলে খেজুরের দাম আরও কমবে।
বেগুন এখনও নাগালে
ইফতারির অন্যতম পদ বেগুনি। এর মূল উপাদান বেগুন। বেগুনে আগুন– রোজার আগে এমন শিরোনাম বহুবার দেখেছেন ক্রেতা। এবারও সেই পথে বেগুন হাঁটবে কিনা, তা নিয়ে জনমনে রয়েছে উদ্বেগ। তবে এখন পর্যন্ত দাম নাগালে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। সপ্তাহখানেক আগে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সেই হিসাবে এরই মধ্যে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা।
বেড়ে আবার কমেছে ছোলা
মাস দুয়েক আগে ছোলার দাম বেড়ে ১৩০ টাকা ছাড়িয়েছিল। এখন দাম নেমেছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। তবে এই দাম গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি। গত বছর এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে ছোলার চাহিদা বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার টন। রমজানে লাগে প্রায় লাখ টন। যদিও ছোলা আমদানিকারকরা বলছেন, দেশে প্রতিবছর ছোলার চাহিদা দুই লাখ টনের মতো। এবার পর্যাপ্ত ছোলা আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত চার মাসে প্রায় ৫৮ হাজার টন ছোলা আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে।
গরুর মাংস ৭৫০
এবার গরুর মাংসের দাম তেমন বাড়েনি। কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৩০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে। তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ভরসা ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে। গত সপ্তাহের চেয়ে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। এ ছাড়া সোনালি জাতের মুরগির কেজি কেনা যাচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা দরে।
যেখানে স্বস্তি
কিছুটা স্বস্তির খবর আছে চিনি, সবজি, আলু, পেঁয়াজে। ফলন বেশি হওয়ায় এখন আলুর কেজি নেমেছে ২০ টাকায়। গত বছর এ সময় আলুর কেজি ছিল ৩০ টাকার মতো। একই পরিস্থিতি পেঁয়াজে। গত বছর এ সময় পেঁয়াজের কেজি ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। এখন প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে দাম। মান ও জাতভেদে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ কেনা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। সবজির দামও বেশ কম। টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে। কাঁচামরিচের কেজি কেনা যাচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। তবে গত চার-পাঁচ দিনের তুলনায় কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে শসা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
গত বছর এ সময় চিনির কেজি ছিল ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। এবার তা কেনা যাচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়।
কারা কী বলছেন
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, অনেক দিন ধরেই বোতলজাত সয়াবিন বাজার থেকে উধাও। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে এগুলো উধাও করেছেন। এ নিয়ে রিফাইনারগুলো এবং তাদের ডিস্ট্রিবিউটররা একে অপরের ওপর দোষারোপ করছেন। তবে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। সরকারের উচিত, রমজানের আগে তদারকি জোরদার করা। যাতে ব্যবসায়ীরা সরবরাহ ঘাটতি দেখিয়ে কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে না পারেন।
তবে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ঘাটতি নিয়ে ভোক্তার অভিযোগকে উড়িয়ে দিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। সমকালকে তিনি বলেন, তেলের সংকটের বিষয়টি সঠিক নয়। বাজারে অভাব নেই। সব জায়গায় ভরপুর তেল আছে। শুধু ভোজ্যতেল নয়, কোনো পণ্যের সংকট নেই।
এদিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কার্যদিবসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রমজানে ভোক্তাদের স্বস্তিতে রাখতে যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এখন অগ্রাধিকার কর্মসূচি। একই সঙ্গে টিসিবির পণ্য বিক্রির তদারকি জোরদার করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ত যপণ য ক রওয় ন ব জ র ভ জ যত ল র ব যবস য় র সরবর হ স র সরবর হ আমদ ন ক ১০ ট ক ২০ ট ক ৫০ ট ক ৩০ ট ক ২০ থ ক ক র টন ৫০ থ ক রমজ ন গতক ল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।