‘জিনিসপত্রের দাম এখন মোটামুটি স্বাভাবিক। তবে সামনের সপ্তাহে কী হয়, সেটি দেখার বিষয়। রোজা শুরু হলে তো ব্যবসায়ীরা বেতাল হয়ে যায়।’ গতকাল বুধবার রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে সবজি কেনার পর নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সমকালের কাছে এভাবেই খেদোক্তি প্রকাশ করেন বেসরকারি চাকরিজীবী রিয়াজ হাসান। ভোজ্যতেল নিয়ে দুর্দশার কথা জানালেন রহিমা সুলতানা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘মহল্লায় না পেয়ে কারওয়ান বাজারে আইলাম। আট-দশটা দোকানে খুঁজেও তেল পাইলাম না। এই তেল গেল কই?’ 

রোজার আগে নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে রিয়াজ আর রহিমার মতো অনেক ক্রেতাই নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। প্রতিবছর রোজার আগমুহূর্তে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরবরাহ কমে যাওয়ার ছুতায় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এবার বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মনের ভেতর জমে থাকা পুরোনো ভয় কাটছে না। রোজা শুরুর পরপরই কিছু পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি ও দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কেউ কেউ। যদিও এ বছর ভরপুর ফলনের কারণে পানির দরে কেনা গেছে সবজি। ফলে অন্যসব পণ্যের দরও কিছুটা নাগালে। তবে রোজার আগের এই স্বস্তি একাই কেড়ে নিয়েছে সরবরাহ সংকটে পড়া ভোজ্যতেল।

তবে বাজারে পণ্যের দাম একেবারে বাড়ছে না, তেমনটা নয়। এ সপ্তাহে কিছুটা মাথাচাড়া দিয়েছে ব্রয়লার মুরগি, ছোলা, বেগুন, লেবু, শসা ও বিদেশি ফল। এগুলোর বেশির ভাগই ইফতারির পণ্য। 

তেল এখনও বেতাল

দুই মাসের বেশি সময় ধরে ভোজ্যতেলের বাজারে চলছে অরাজকতা।

 বড় আকারে শুল্ককর ছাড় দেওয়া হলেও আমদানিকারকরা ভোক্তার সঙ্গে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ থেকে বের হতে পারেননি। নানা অজুহাতে ফের সামনে এনেছেন দর বাড়ানোর আবদার। যদিও তা আমলে নিচ্ছে না সরকার। ফলে বিলম্ব আমদানি দেখিয়ে সরবরাহ কমানোর অভিযোগের তীরে বিদ্ধ তারা।

গেল সপ্তাহে ভোক্তা অধিদপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমদানিকারকদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গতকাল থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। তবে সেটি যে ‘কথার কথা’ ছিল, তা ক্রেতারা টের পেয়েছেন বাজারে গিয়েই। গতকাল বুধবার ঢাকার মহাখালী, হাতিরপুল, তেজকুনিপাড়া ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভোজ্যতেলের সংকট আরও প্রবল হয়েছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১০ দোকান খুঁজলে মেলে দুই-এক দোকানে। একসঙ্গে পাঁচ লিটার কিনলে দামে কিছুটা সাশ্রয় হয়। সে জন্য এই বোতলের চাহিদা বেশি। খোলা সয়াবিনের সরবরাহ স্বাভাবিক দেখা গেলেও কিনতে গিয়ে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। সরকার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দর ১৫৭ টাকা নির্ধারণ করলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ১৮০ থেকে ১৮২ টাকা দরে। কারওয়ান বাজারের আবদুর রব স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো.

নাইম বলেন, পাইকারিতে প্রতি লিটার কেনা পড়ে ১৭৫ টাকার বেশি, এর সঙ্গে আছে অন্যান্য খরচ। এ জন্য বাড়তি দরে বিক্রি করতে হয়। 

তেজগাঁওয়ের মেঘনা গ্রুপের ডিলার মায়ের দোয়া স্টোরের মালিক হেলাল উদ্দিন বলেন, তিনবার ক্রয়াদেশ নিয়েছে বিপণনকর্মী। তবে তেল এখনও পায়নি। তা ছাড়া পাঁচ কার্টন তেলের চাহিদা দিলে কোম্পানি পাঠায় দুই কার্টন। 

কারওয়ান বাজারের পুষ্টি ব্র্যান্ডের ডিলার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে, তবে স্বাভাবিক হয়নি। যেখানে দৈনিক দরকার ২০ কার্টন, দিচ্ছে ১০ কার্টন। ফলে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ সংকট রয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দুই-তিনটা প্রতিষ্ঠানের মিল বন্ধ। ফলে অন্য কোম্পানির ওপর চাপ বেড়েছে, সে জন্যই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।  

চট্টগ্রামেও মিলছে না তেল

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানিয়েছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জেও মিলছে না ভোজ্যতেল। খুচরা বাজারে হন্যে হয়ে খুঁজেও তেল কিনতে পারছেন না ভোক্তা। রমজান ঘনিয়ে এলেও স্বাভাবিক হচ্ছে না সরবরাহ। বেশির ভাগ বাজারে এক ও দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন মিলছে না। কয়েকটি স্থানে পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।

এ ব্যাপারে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, মাত্র একটি কোম্পানির কিছু তেল এসে বন্দরে পৌঁছেছে। মেঘনার একটি জাহাজ আসবে শুক্রবার, আরেকটা আসবে ৬ মার্চ। দেরিতে তেল আসার কারণে বাজার ধরতে পারছি না। এতে লোকসানের আশঙ্কা করছি।

লেবুর বাজার চড়া

ইফতারে লেবুর শরবত কমবেশি সবার পছন্দ। সেই লেবুর বাজার ছয়-সাত দিন ধরে চড়া। হালিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। বাজারে এখন মাঝারি আকারের এক হালি লেবু কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৮০ টাকা, যা সপ্তাহখানেক আগে কেনা গেছে ২০ থেকে ৫০ টাকায়।

কারওয়ান বাজারের লেবু বিক্রেতা হামিদ মিয়া বলেন, এখন লেবুর মৌসুম নয়। সে জন্য চাহিদা বেশি থাকলেও বাজারে সেই হারে লেবু আসছে না। ফলে মাসখানেক ধরেই লেবুর দাম বাড়তি।

মাল্টারও দামও বেড়েছে। এক সপ্তাহে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়। এভাবে কমলা, আপেল ও আঙুরের দামও বেড়েছে কেজিতে সর্বোচ্চ ২০ টাকা। পাশাপাশি দেশি ফলের দামও কিছুটা চড়েছে। তিন-চার দিন আগে পেয়ারার কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল শতক ছুঁয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন জাতের কলা ডজনে ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়তি দেখা গেছে।

প্রথা ভেঙেছে খেজুর

রোজার শুরুতে খুচরা বাজারে খেজুরের আগুনদর থাকাটাই ছিল নিয়ম। এবার খেজুরের দাম উল্টো পড়ে গেছে। ১৫ থেকে ২০ দিনে মানভেদে খেজুর কেজিতে কমেছে ২০ থেকে ১০০ টাকা। বেশি চাহিদা জায়েদি খেজুরের। গত বছর মানভেদে কেজি ছিল ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা। এবার কেনা যাচ্ছে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। গত বছর এ সময় মাবরুর জাতের খেজুরের দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, এবার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকার আশপাশে। আজওয়া বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৯০০ থেকে হাজার টাকা। কেজিতে ২০০ টাকার মতো কমে মেডজল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায়। এভাবে অন্য জাতের খেজুরের দামও কমেছে।

আমদানিকারকরা বলছেন, এবার রমজানে খেজুরের দাম গতবারের চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ কম হবে। শুল্ক কর কমানোর কারণে আমদানি বেড়েছে। ফলে দাম কমছে। বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমদানিতে শুল্ক কর কমানোর কারণে দাম কিছুটা কমেছে। তবে যৌক্তিক শুল্কায়ন মূল্য কমানো হলে খেজুরের দাম আরও কমবে।

বেগুন এখনও নাগালে

ইফতারির অন্যতম পদ বেগুনি। এর মূল উপাদান বেগুন। বেগুনে আগুন– রোজার আগে এমন শিরোনাম বহুবার দেখেছেন ক্রেতা। এবারও সেই পথে বেগুন হাঁটবে কিনা, তা নিয়ে জনমনে রয়েছে উদ্বেগ। তবে এখন পর্যন্ত দাম নাগালে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। সপ্তাহখানেক আগে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সেই হিসাবে এরই মধ্যে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা।

বেড়ে আবার কমেছে ছোলা

মাস দুয়েক আগে ছোলার দাম বেড়ে ১৩০ টাকা ছাড়িয়েছিল। এখন দাম নেমেছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। তবে এই দাম গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি। গত বছর এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে ছোলার চাহিদা বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার টন। রমজানে লাগে প্রায় লাখ টন। যদিও ছোলা আমদানিকারকরা বলছেন, দেশে প্রতিবছর ছোলার চাহিদা দুই লাখ টনের মতো। এবার পর্যাপ্ত ছোলা আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত চার মাসে প্রায় ৫৮ হাজার টন ছোলা আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে।

গরুর মাংস ৭৫০

এবার গরুর মাংসের দাম তেমন বাড়েনি। কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৩০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে। তবে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের ভরসা ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে। গত সপ্তাহের চেয়ে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। এ ছাড়া সোনালি জাতের মুরগির কেজি কেনা যাচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা দরে।

যেখানে স্বস্তি

কিছুটা স্বস্তির খবর আছে চিনি, সবজি, আলু, পেঁয়াজে। ফলন বেশি হওয়ায় এখন আলুর কেজি নেমেছে ২০ টাকায়। গত বছর এ সময় আলুর কেজি ছিল ৩০ টাকার মতো। একই পরিস্থিতি পেঁয়াজে। গত বছর এ সময় পেঁয়াজের কেজি ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। এখন প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমেছে দাম। মান ও জাতভেদে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ কেনা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। সবজির দামও বেশ কম। টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে। কাঁচামরিচের কেজি কেনা যাচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। তবে গত চার-পাঁচ দিনের তুলনায় কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে শসা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

গত বছর এ সময় চিনির কেজি ছিল ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। এবার তা কেনা যাচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়।

কারা কী বলছেন

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, অনেক দিন ধরেই বোতলজাত সয়াবিন বাজার থেকে উধাও। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে এগুলো উধাও করেছেন। এ নিয়ে রিফাইনারগুলো এবং তাদের ডিস্ট্রিবিউটররা একে অপরের ওপর দোষারোপ করছেন। তবে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। সরকারের উচিত, রমজানের আগে তদারকি জোরদার করা। যাতে ব্যবসায়ীরা সরবরাহ ঘাটতি দেখিয়ে কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে না পারেন।
তবে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ঘাটতি নিয়ে ভোক্তার অভিযোগকে উড়িয়ে দিলেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। সমকালকে তিনি বলেন, তেলের সংকটের বিষয়টি সঠিক নয়। বাজারে অভাব নেই। সব জায়গায় ভরপুর তেল আছে। শুধু ভোজ্যতেল নয়, কোনো পণ্যের সংকট নেই। 

এদিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কার্যদিবসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রমজানে ভোক্তাদের স্বস্তিতে রাখতে যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, তা ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এখন অগ্রাধিকার কর্মসূচি। একই সঙ্গে টিসিবির পণ্য বিক্রির তদারকি জোরদার করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন ত যপণ য ক রওয় ন ব জ র ভ জ যত ল র ব যবস য় র সরবর হ স র সরবর হ আমদ ন ক ১০ ট ক ২০ ট ক ৫০ ট ক ৩০ ট ক ২০ থ ক ক র টন ৫০ থ ক রমজ ন গতক ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।

মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।

সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়ন

টিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।

উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।

বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’

হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান

অবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’

হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।

জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’

জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।

চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’  

হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ গেল ভারতে
  • তুরস্কের সঙ্গে উত্তেজনা: সাইপ্রাসকে ‘এস–৩০০’–এর চেয়েও ভয়ংকর ‘বারাক এমএক্স’ দিল ইসরায়েল
  • গুদামে খাওয়ার অনুপযোগী চাল নিয়ে রাজশাহী খাদ্য বিভাগে তোলপাড়, ৮ তদন্ত কমিটি
  • ‘কেনতো পারমু না, হেইতে ইলশার সুরতটা দেইখ্যা যাই’
  • ৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
  • বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে ২৬ ব্যাংক থেকে ৩৫ কোটি ডলার কিনল কেন
  • নিলামে ৩৫৩ মিলিয়ন ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক
  • যুক্তরাজ্য থেকে আসছে মাদক এমডিএমএ, গ্রেপ্তার ৫
  • চাপে পড়ে নয়, অনুরোধে ভারতে ইলিশ পাঠানোর অনুমোদন: ফরিদা আখতার
  • ভোটের সরঞ্জাম আসছে ইসিতে