এনসিপির সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে যে প্রশ্ন
Published: 5th, March 2025 GMT
অবশেষে বিপুল কলরবে রাজনীতির মঞ্চে নামল জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি)। বিপুল কলরব এই অর্থে যে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে দলটি ব্যাপকভাবে মানুষের, বিশেষ করে রাজধানীর মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমাকে সংবাদমাধ্যমগুলোর বহু সাংবাদিক মন্তব্যের জন্য ফোন করেছেন। তাঁদের প্রশ্নের জবাবে আমি যা বলেছি, সেটা দিয়েই আজকের লেখা শুরু করি।
সাধারণভাবে বলা যায়, রাজনীতির যত বিস্তার ঘটে, চর্চা হয়, যত বেশি মানুষ রাজনীতিতে যুক্ত হয়, ততই রাজনীতি স্পষ্ট হয়, পরিচ্ছন্ন হয়। এই হিসাবে এ দেশের তরুণসমাজ ও ছাত্রসমাজ রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে—এটা একটা খুশির খবর।
২০২৪ সালের অনন্য গণ-অভ্যুত্থান মানুষের চিন্তাকে রাতারাতি পাল্টে দিয়েছে। আগে মানুষ রাজনীতির সমালোচনা করত, রাজনীতিবিদদের দেখতে পারত না। একটা বড় গ্রুপই গড়ে উঠেছিল ‘আই হেট পলিটিকস’ নামে। কিন্তু ৮ আগস্টের অল্প দিন পর থেকেই মানুষ বুঝতে শুরু করল, রাজাকে রাজনীতি জানতে হয়। একটা অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকারে যে কোনো রাজনীতিবিদ নেই এবং এ কারণে এটা যে একটা দুর্বল সরকার, এটা অনেকে বলাবলি করতে লাগল।
প্রকৃতপক্ষেই রাজনীতি হলো সমাজের চালিকা শক্তি। আর যা কিছু আছে—অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য—সবকিছুই পরিচালিত। সাকিব আল হাসান খেলতে পারবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত নেয় রাজনীতি। বাজেটে কোথায় কত টাকা বরাদ্দ করা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয় রাজনীতি। একটা সিনেমা কিংবা নাটক প্রদর্শিত হবে কি না, সে সিদ্ধান্তও নেয় রাজনীতি। এ জন্যই এই তরুণ ছাত্ররা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নিচ্ছে—এটাকে আমি শুভ লক্ষণ মনে করি। আর এই তরুণ ছাত্ররাই তো মাত্র গত বছরের শেষ দিকে একটি অসাধ্যসাধন করেছে, যা গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো যুগপৎভাবে আন্দোলন করেও করতে পারেনি।
ছাত্র-যুবকদের ধন্যবাদ। ফ্যাসিবাদবিরোধী সেই রক্তাক্ত লড়াই শেষ হয়েছে। পাহাড়প্রমাণ ত্যাগ-তিতিক্ষার পর আমরা জিতেছি এ লড়াই। কিন্তু তাই বলে লড়াই শেষ হয়নি। সামনে আছে আরেক লড়াই—দেশ গড়ার লড়াই, নতুন বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু এ লড়াই আলাদা। প্রথম পর্যায়ের লড়াই শেষ হয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জানবাজি লড়াইয়ের বিজয়ে। এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশ গড়ার লড়াই; আন্দোলনের মধ্য থেকে যার স্লোগান উঠেছিল নতুন বাংলাদেশ গড়ার। কীভাবে গড়ে উঠবে সেই দেশ?
এখানেই সংস্কারের কথা উঠেছে। এ কথা আমরা সবাই জানি, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। ৫৩ বছরের বাংলাদেশ আজও আমাদের বাসযোগ্য হয়নি। এটা ছিল একটা মৃত্যু-উপত্যকা। সেই মৃত্যুর কোনোটাই স্বাভাবিক নয়। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে গুম, খুন, ক্রসফায়ার, আয়নাঘর—কোনো কিছু বাকি থাকেনি। এসবের অবসান চাই। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। ১৫ বছরের আওয়ামী শাসন ছিল একটা দুঃস্বপ্নের মতো। মানুষ মানুষ ছিল না। তার কথা বলার অধিকার ছিল না। ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না, গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছিল। নির্বাচন বলে যে প্রক্রিয়া, তা ছিল শেখ হাসিনার ইচ্ছার দাস।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক মেরুকরণ পরিষ্কার হচ্ছে১১ ঘণ্টা আগেযারা এসব মানবতাবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী অপরাধ করেছিল, তাদের বিচার হওয়ার প্রয়োজন ছিল এবং নতুন একটা পরিবেশ গড়ে তোলার দরকার ছিল, যা গণতন্ত্রের জমি তৈরি করতে পারে। এ জন্যই সংস্কারের কথা এসেছে। সংস্কার, যা রাষ্ট্রকে গতি দেবে, মানুষকে দেবে স্বস্তি, শান্তি। ভোটপ্রক্রিয়াকে করবে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য। খুবই ধীরস্থিরভাবে, জ্ঞানের আলোকে ঠান্ডা মাথায় চিহ্নিত করতে হবে ভুলত্রুটিগুলো এবং তার যথাযথ সংশোধন করতে হবে। নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না যে এ লড়াই স্বৈরতন্ত্রের উৎখাতের লড়াই থেকে আলাদা। এখানে আবেগ বড় নয়। রাগ, ক্রোধ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে।
এ কথা এখন বিতর্কহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে জুলাই অভ্যুত্থান ছিল প্রধানত স্বতঃস্ফূর্ত। ফ্যাসিবাদ যে নৃশংসতায় গণ-আন্দোলনকে দমন করে আসছিল, তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ও সাহসী প্রতিবাদ। এ জন্যই যখন ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়েছিল, তখন আন্দোলনের নেতৃত্ব বলে সংজ্ঞায়িত কিছু ছিল না। শেখ হাসিনার পরাজয়ের পরে শাসনকার্যে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তাকে কোনো রকমে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছিল। পরবর্তীকালে আমরা এখানে চিন্তার দুটি ধারার প্রকাশ দেখি। একটি র্যাডিক্যাল ধারা (আমি বিপ্লবী বলব না), আরেকটি গণতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক ধারা। এ জন্যই ক্ষমতার শূন্যতা দেখা দেওয়ার পরে তা পূরণ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল।
এনসিপি যদিও তরুণদের দিয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক দল, কিন্তু তারাও রাজনীতির মাঠে দায়িত্বশীল প্লেয়ার হবে—এটা আমি অন্তত কামনা করি। কিন্তু সে জন্য তাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। বর্তমান যে সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করতে হবে। কিন্তু তারাই যদি নতুন বিতর্ক সামনে নিয়ে আসে বা তৈরি করে, তবে তার নিষ্পত্তি কে করবে?শিক্ষার্থীরা ছিল র্যাডিক্যাল ধারার। তা-ই হয়। এই বয়স র্যাডিক্যালিজম পছন্দ করে। কিন্তু র্যাডিক্যাল ধারা লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করার পর রাষ্ট্র গঠনে গণতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক ধারাই প্রাধান্য পেয়েছিল। শিক্ষার্থীরা বহুদিন ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। তারা বুঝে কিংবা না বুঝে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দু-তিনটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ, এমনকি সেসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। কিন্তু তাদের আন্দোলন সফলতা পায়নি। পাওয়া সম্ভবও ছিল না।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রায় সাত মাস পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের নিরসন হয়েছে বলে মনে হয় না। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনকালে এবং তার পরবর্তী সময়ে তাদের ধারণা সম্পর্কে বক্তব্য দিয়েছে এবং প্রায়ই তারা সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে। সরকার হয়তো তাতে বিব্রত হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি, তারা কৌশলে সেগুলো হ্যান্ডল করেছে। সমাধান করেনি। অথবা সরকারেরও অন্য কোনো কৌশল আছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি কমিটি ঘোষণা করার সময় আবার নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি সেকেন্ড রিপাবলিকের ঘোষণা দিয়েছে এবং এটা প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা সাংবিধানিক সভার বৈঠক ডাকার কথা বলেছে।
আরও পড়ুননতুন দল নতুন কী নিয়ে হাজির হবে০৪ মার্চ ২০২৫যখন তারা জাতীয় নাগরিক কমিটি ছিল কিংবা ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিল, তখনো তারা এ ধরনের কথাবার্তা বলেছে। তা তারা নিশ্চয়ই বলতে পারে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই দেশ নিয়ে, দেশের রাজনীতি নিয়ে নিজস্ব চিন্তাভাবনা থাকবে। কিন্তু সব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচির উদ্দেশ্য থাকবে দেশ গঠন এবং জনগণের কল্যাণ। এমন কর্মসূচি, যা জনগণের কাছে সহজবোধ্য ও সহজে বাস্তবায়নযোগ্য।
আমরা ইতিহাসের এমন এক ক্রান্তিলগ্নে আছি, যখন গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন এবং তাকে টেকসই করার প্রশ্ন সবচেয়ে বড়। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যেমন বলেছেন, সংস্কার করার জন্য জাতীয় ঐকমত্য অবশ্য প্রয়োজন। আমি মনে করি, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোর এখন উচিত ঐকমত্যের পথে হাঁটা, অনৈক্য পরিহার করা।
এনসিপি যদিও তরুণদের দিয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক দল, কিন্তু তারাও রাজনীতির মাঠে দায়িত্বশীল প্লেয়ার হবে—এটা আমি অন্তত কামনা করি। কিন্তু সে জন্য তাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। বর্তমান যে সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করতে হবে। কিন্তু তারাই যদি নতুন বিতর্ক সামনে নিয়ে আসে বা তৈরি করে, তবে তার নিষ্পত্তি কে করবে?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রশ্ন তুলেছেন, সেকেন্ড রিপাবলিক কেন? তাঁর মতে, ‘যারা গণপরিষদের বিষয় সামনে আনছে, যারা সেকেন্ড রিপাবলিকের বিষয় সামনে আনছে, হয় তারা তা বোঝে না অথবা বুঝেও আমাদের এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও দীর্ঘায়িত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রে আছে।’
ইতিমধ্যে সংবিধান সংশোধন কমিশন তাদের প্রস্তাব পেশ করেছে এবং সেটা জাতির সামনে হাজির করা হয়েছে। স্পষ্টতই তাদের প্রস্তাবের মধ্যে নবগঠিত ওই রাজনৈতিক দলের সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদের বিষয় নেই। এনসিপি কি তাদের এ বক্তব্য নিয়েই মাঠে নামতে চাইছে? তার মানে, তারা কি একটি বিতর্ককে উপজীব্য করেই রাজনীতির মাঠে নামতে চায়? তারা কি মনে করে, দেশের বর্তমান গণতন্ত্রের সংকটের সমাধানের প্রশ্নে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়?
দেখতে হবে আগে কী হয়।
মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ক ন ড র প বল ক র জন ত র ম গণতন ত র ই র জন ত র জন য এনস প সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।
নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।
এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবেএআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।
ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।
প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।
এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।
জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।
অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক