Samakal:
2025-09-18@03:32:39 GMT

আলু নিয়ে নিরুপায় কৃষক

Published: 22nd, March 2025 GMT

আলু নিয়ে নিরুপায় কৃষক

বাড়ির কাছে তিনটি হিমাগারে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। এ দৃশ্য দেখে তিন দিনে ভ্যানভর্তি আলু নিয়ে ইফতারের পরই হিমাগারে আসেন রংপুরের বড়ঘোলার কৃষক আইয়ুব আলী, মোস্তফা মিয়া, খেজমতপুরের রাশেদুল ইসলাম ও বড় মহজিদপুরের আনিছুর রহমানসহ কয়েকজন। রাত গড়িয়ে সাহ্‌রির পর দিনের আলোতেও আলু রাখতে ব্যর্থ তারা। উল্টো তিন দিনের ভ্যান ভাড়া, সময় নষ্টসহ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আবাদে লোকসান পোষাতে হিমাগারে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা।
হিমাগার থেকে ৫০০ গজ দূরে জমিতে বস্তাভর্তি আলু পাহারা দিয়েছেন কৃষক। এরপরও সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়ে লোকসানে জমি থেকেই বিক্রি করছেন। কৃষক আইয়ুব আলীর পাঁচ, মোস্তফা মিয়ার তিন, আনিছার রহমান দুই বিঘা জমিতে আলুবীজ ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি কিনে আবাদ করেছিলেন। উৎপাদনে কেজিপ্রতি ব্যয় ১৫ থেকে ১৬ টাকা। ৫-৬ টাকা লোকসানে ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন তারা।
সিন্ডিকেটের কারণে আলুবীজ ১২০ টাকায় কিনতে হয়েছে খেজমতপুরের কৃষক রাশেদুল ইসলামের। তিনি বলছিলেন, ভ্যানে আলু পাঠালে ফেরত আসে। ট্রাক ও মহেন্দ্র গাড়ি ভর্তি করে হিমাগারে নিতে ব্যস্ত কর্তৃপক্ষ। ৮০ হাজার টাকা বছর চুক্তিতে জমিতে আলু আবাদ করে লোকসান হলো। কৃষককে বাঁচাতে সরকারি সহায়তা চান তিনি। কৃষক মোস্তফা মিয়া সরকারি সহায়তার পাশাপাশি কোম্পানির নিম্নমানের বীজে উৎপাদনে ঘাটতির অভিযোগ করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রামনাথপুর ইউনিয়নে শত শত একর জমির আলু তুলে বস্তা ভরতে ব্যস্ত কৃষক। অনেকে বিক্রি করে দিচ্ছেন। স্টিক জাতের আলু ৪০০ থেকে ৪১০ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। ভেন্ডাবাড়ির রোকন ট্রলিতে করে ৮২ বস্তা বীজ ও মাদারহাটের শাহিন সরদার ৭২ বস্তা খাবার আলু নিয়ে শয়েকপুরের শান্তনা কোল্ড স্টোরেজে এসেছিলেন। একই হিমাগারে মিঠাপুকুরের ভক্তিপুর থেকে সোহেল ৪০০ বস্তা আলু আনেন।
তাদের অভিযোগ, ২৪ ঘণ্টায়ও কর্তৃপক্ষ আলু নেয়নি। উল্টো তাদের সামনে আলু নেওয়া বন্ধের ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে। অথচ বস্তাপ্রতি ৫০ টাকার অগ্রিম দিয়ে বুকিং স্লিপ ছিল তাদের কাছে। এভাবে শত শত কৃষক বিপদে পড়েছেন। তাদের অভিযোগ, হিমাগার কর্তৃপক্ষ যোগসাজশ করে মজুতকারীদের সংরক্ষণের কার্ড দিয়ে কৃষককে বঞ্চিত করেছেন। কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
শান্তনা কোল্ড স্টোরেজ ও কৃষিকল বীজ হিমাগারের সামনে মহাসড়কে শত শত আলুভর্তি যানবাহনের লাইন দেখা যায়। কৃষিকলের ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন বলেন, গত ১৪ মার্চ মাইকিং করে আলু সংরক্ষণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও মানুষ আসছেন। তিন লাখ বস্তা ধারণক্ষমতা থাকলেও ২ লাখ ৮০ হাজার নেওয়া যাবে। অনেকে ৫০-৫৫ কেজির স্থলে ৬০-৬২ কেজির বস্তা রাখছেন। শ্রমিক সংকটেও কষ্ট হয়েছে কৃষকের।
একই কথা উল্লেখ করে শাহ ইসমাঈল গাজী কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, ধারণক্ষমতা দুই লাখ বস্তা হলেও এক লাখ ৯০ হাজারের স্লিপ হয়েছে। চেম্বার করার পর আরও চার-পাঁচ হাজার বস্তা লাগতে পারে। পীরগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার কবিরুল ইসলামের ভাষ্য, তাদের ধারণক্ষমতা এক লাখ ৯ হাজার হলেও এক লাখ ৫ হাজার বস্তা রাখা যায়।
শান্তনা কোল্ড স্টোরেজে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়া কৃষকের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বুকিং স্লিপের আলু সংরক্ষণ হয়েছে। একই স্লিপ ফটোকপি করে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে আসছেন। গত মঙ্গলবার টার্গেট পূরণ হয়েছে। ধারণক্ষমতা দুই লাখ ৬০ হাজার হলেও দুই লাখ ৫০ হাজার বস্তা নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কৃষি অফিস থেকে জানা গেছে, উপজেলায় এবার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ৮৫০ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ২০০ হেক্টরে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার ৩৫০ হেক্টরে বেশি আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং রোগবালাই না হওয়ায় ফলন হয়েছে ভালো। সোয়া দুই লাখ টন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলার চারটি হিমাগারে ৪৯ হাজার ৫০০ টন সংরক্ষণ করা যাবে। ফলে উৎপাদিত বেশির ভাগ আলুই বাইরে থাকবে।
এসব কারণে কৃষক বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে দাম কমে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। শুরুতে দাম বেশি থাকলেও এখন ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। আলোচিত কৃষক স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিন ৩৫-৩৬ বিঘা ইজারার জমির ৪১শ, মোশারফ হোসেনের ২২ বিঘার ২৩শ, নজরুল ইসলামের ২৬ বিঘার ১৮শ ও সাইফুল আমিন দুই হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণের কয়েকদিন হিমাগারে সময় কাটিয়েছেন।
তারা জানান, ১৪ মার্চ থেকে কৃষিকল হিমাগারে লাইনে আছেন। চার দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া এখানেই। গাড়ি ভাড়া লোকসান আরও বাড়িয়েছে। শ্রমিক সংকটের অজুহাতে ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের। জানা গেছে, গত বছর প্রতি বস্তা আলুর ভাড়া ৬০ টাকা বাড়িয়ে ৩৮০ টাকা নিয়েছিল। এবারও ৫০ কেজির এক বস্তার ভাড়া পড়বে ৪২০ টাকা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাদেকুজ্জামান বলেন, আলু বাড়িতে সংরক্ষণে পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন সংবলিত লিফলেট কৃষকের মাঝে বিতরণ চলছে। মাঠকর্মীরা পরামর্শ দিচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন সহায়তায় রামনাথপুরে পাঁচ-ছয়টি সংরক্ষণ ঘর নির্মাণ করেছে। ইতোমধ্যে দেশে ১০০ মিনি কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আল ধ রণক ষমত ল ইসল ম উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ