বাড়ির কাছে তিনটি হিমাগারে যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। এ দৃশ্য দেখে তিন দিনে ভ্যানভর্তি আলু নিয়ে ইফতারের পরই হিমাগারে আসেন রংপুরের বড়ঘোলার কৃষক আইয়ুব আলী, মোস্তফা মিয়া, খেজমতপুরের রাশেদুল ইসলাম ও বড় মহজিদপুরের আনিছুর রহমানসহ কয়েকজন। রাত গড়িয়ে সাহ্রির পর দিনের আলোতেও আলু রাখতে ব্যর্থ তারা। উল্টো তিন দিনের ভ্যান ভাড়া, সময় নষ্টসহ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আবাদে লোকসান পোষাতে হিমাগারে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা।
হিমাগার থেকে ৫০০ গজ দূরে জমিতে বস্তাভর্তি আলু পাহারা দিয়েছেন কৃষক। এরপরও সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়ে লোকসানে জমি থেকেই বিক্রি করছেন। কৃষক আইয়ুব আলীর পাঁচ, মোস্তফা মিয়ার তিন, আনিছার রহমান দুই বিঘা জমিতে আলুবীজ ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি কিনে আবাদ করেছিলেন। উৎপাদনে কেজিপ্রতি ব্যয় ১৫ থেকে ১৬ টাকা। ৫-৬ টাকা লোকসানে ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন তারা।
সিন্ডিকেটের কারণে আলুবীজ ১২০ টাকায় কিনতে হয়েছে খেজমতপুরের কৃষক রাশেদুল ইসলামের। তিনি বলছিলেন, ভ্যানে আলু পাঠালে ফেরত আসে। ট্রাক ও মহেন্দ্র গাড়ি ভর্তি করে হিমাগারে নিতে ব্যস্ত কর্তৃপক্ষ। ৮০ হাজার টাকা বছর চুক্তিতে জমিতে আলু আবাদ করে লোকসান হলো। কৃষককে বাঁচাতে সরকারি সহায়তা চান তিনি। কৃষক মোস্তফা মিয়া সরকারি সহায়তার পাশাপাশি কোম্পানির নিম্নমানের বীজে উৎপাদনে ঘাটতির অভিযোগ করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রামনাথপুর ইউনিয়নে শত শত একর জমির আলু তুলে বস্তা ভরতে ব্যস্ত কৃষক। অনেকে বিক্রি করে দিচ্ছেন। স্টিক জাতের আলু ৪০০ থেকে ৪১০ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে দেখা যায়। ভেন্ডাবাড়ির রোকন ট্রলিতে করে ৮২ বস্তা বীজ ও মাদারহাটের শাহিন সরদার ৭২ বস্তা খাবার আলু নিয়ে শয়েকপুরের শান্তনা কোল্ড স্টোরেজে এসেছিলেন। একই হিমাগারে মিঠাপুকুরের ভক্তিপুর থেকে সোহেল ৪০০ বস্তা আলু আনেন।
তাদের অভিযোগ, ২৪ ঘণ্টায়ও কর্তৃপক্ষ আলু নেয়নি। উল্টো তাদের সামনে আলু নেওয়া বন্ধের ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছে। অথচ বস্তাপ্রতি ৫০ টাকার অগ্রিম দিয়ে বুকিং স্লিপ ছিল তাদের কাছে। এভাবে শত শত কৃষক বিপদে পড়েছেন। তাদের অভিযোগ, হিমাগার কর্তৃপক্ষ যোগসাজশ করে মজুতকারীদের সংরক্ষণের কার্ড দিয়ে কৃষককে বঞ্চিত করেছেন। কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
শান্তনা কোল্ড স্টোরেজ ও কৃষিকল বীজ হিমাগারের সামনে মহাসড়কে শত শত আলুভর্তি যানবাহনের লাইন দেখা যায়। কৃষিকলের ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন বলেন, গত ১৪ মার্চ মাইকিং করে আলু সংরক্ষণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও মানুষ আসছেন। তিন লাখ বস্তা ধারণক্ষমতা থাকলেও ২ লাখ ৮০ হাজার নেওয়া যাবে। অনেকে ৫০-৫৫ কেজির স্থলে ৬০-৬২ কেজির বস্তা রাখছেন। শ্রমিক সংকটেও কষ্ট হয়েছে কৃষকের।
একই কথা উল্লেখ করে শাহ ইসমাঈল গাজী কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, ধারণক্ষমতা দুই লাখ বস্তা হলেও এক লাখ ৯০ হাজারের স্লিপ হয়েছে। চেম্বার করার পর আরও চার-পাঁচ হাজার বস্তা লাগতে পারে। পীরগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার কবিরুল ইসলামের ভাষ্য, তাদের ধারণক্ষমতা এক লাখ ৯ হাজার হলেও এক লাখ ৫ হাজার বস্তা রাখা যায়।
শান্তনা কোল্ড স্টোরেজে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়া কৃষকের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বুকিং স্লিপের আলু সংরক্ষণ হয়েছে। একই স্লিপ ফটোকপি করে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে আসছেন। গত মঙ্গলবার টার্গেট পূরণ হয়েছে। ধারণক্ষমতা দুই লাখ ৬০ হাজার হলেও দুই লাখ ৫০ হাজার বস্তা নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কৃষি অফিস থেকে জানা গেছে, উপজেলায় এবার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ হাজার ৮৫০ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ২০০ হেক্টরে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার ৩৫০ হেক্টরে বেশি আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং রোগবালাই না হওয়ায় ফলন হয়েছে ভালো। সোয়া দুই লাখ টন উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলার চারটি হিমাগারে ৪৯ হাজার ৫০০ টন সংরক্ষণ করা যাবে। ফলে উৎপাদিত বেশির ভাগ আলুই বাইরে থাকবে।
এসব কারণে কৃষক বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে দাম কমে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। শুরুতে দাম বেশি থাকলেও এখন ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। আলোচিত কৃষক স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিন ৩৫-৩৬ বিঘা ইজারার জমির ৪১শ, মোশারফ হোসেনের ২২ বিঘার ২৩শ, নজরুল ইসলামের ২৬ বিঘার ১৮শ ও সাইফুল আমিন দুই হাজার বস্তা আলু সংরক্ষণের কয়েকদিন হিমাগারে সময় কাটিয়েছেন।
তারা জানান, ১৪ মার্চ থেকে কৃষিকল হিমাগারে লাইনে আছেন। চার দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া এখানেই। গাড়ি ভাড়া লোকসান আরও বাড়িয়েছে। শ্রমিক সংকটের অজুহাতে ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের। জানা গেছে, গত বছর প্রতি বস্তা আলুর ভাড়া ৬০ টাকা বাড়িয়ে ৩৮০ টাকা নিয়েছিল। এবারও ৫০ কেজির এক বস্তার ভাড়া পড়বে ৪২০ টাকা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাদেকুজ্জামান বলেন, আলু বাড়িতে সংরক্ষণে পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন সংবলিত লিফলেট কৃষকের মাঝে বিতরণ চলছে। মাঠকর্মীরা পরামর্শ দিচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন সহায়তায় রামনাথপুরে পাঁচ-ছয়টি সংরক্ষণ ঘর নির্মাণ করেছে। ইতোমধ্যে দেশে ১০০ মিনি কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আল ধ রণক ষমত ল ইসল ম উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।