রাজধানীর উত্তরখানে গ‍্যাসের লাইন লিকেজের আগুনে দগ্ধ এক দম্পতির মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁদের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

নিহতরা হলেন স্বামী ময়নুল (৪০) ও স্ত্রী আনোয়ারা (৩২)। ময়নুল পেশায় রিকশাচালক ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

উত্তরখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.

জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে ওই দম্পতি দগ্ধ হন। এরপর বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে একজন আর রাত ১০টার পরে অপরজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

স্থানীয়রা জানান, এই দম্পতি উত্তরখানের ভূইয়াবাড়ি বাঁশতলায় একটি টিনশেড বাড়িতে থাকতেন। রাত ১২টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন লাইটার দিয়ে মশার কয়েল জ্বালানোর সময় আগুনে তাঁরা দগ্ধ হন। তাঁদের চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এসে পানি দিয়ে আগুন নেভান। পরে দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দুর্ঘটনাস্থলের পাশের সড়কে সিটি করপোরেশনের কাজ চলছিল। ভেকু দিয়ে মাটি কাটার সময় ওই বাসার গ্যাসের লাইন ফেটে যায়। গত কয়েক দিন ধরেই ফেটে যাওয়া লাইন থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। ঠিকাদারকে এ বিষয়ে জানানো হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এ নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ওসি জিয়াউর রহমান বলেন, রাস্তার কাজ চলমান রয়েছে। সেখান থেকেই গ‍্যাস লিকেজ হয়েছে। পরে বুধবার রাতেই ফায়ার সার্ভিস এসে পুলিশের উপস্থিতিতে গ‍্যাস লাইনের লিকেজ বন্ধ করে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি বলেও জানান তিনি।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

হাসিনার সঙ্গে দেখা ও আলাপ: ১৫ বছরে যেভাবে তিনি পাল্টে গেলেন

শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল দুবার ওয়াশিংটন এলাকায় ঘরোয়া পরিবেশে। প্রথমবার ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে, তিনি যখন ওয়াশিংটন এলাকায় তাঁর ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। দ্বিতীয়বার পরের বছর ২০০৮ সালে তাঁকে সেসময়ের সরকার প্যারোলে মুক্তি দিলে।

তখন বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তিনি এবং সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তখন বেশ রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে। দুজনের বিরুদ্ধেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতির তদন্ত চালাচ্ছিল। গুঞ্জন ছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে শিগগিরই সরকার মামলা ঠুকবে।

এমন অবস্থায় হাসিনা যখন ওয়াশিংটনে, সেই সময় আমি হঠাৎ নিমন্ত্রণ পাই আমার বহু পরিচিত ওয়াশিংটন এলাকাবাসী এক জ্যেষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে। তিনি তখন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি। আমন্ত্রণ শেখ হাসিনার জন্য, তিনি রাতে একটি ভোজের আয়োজন করেছেন এবং তিনি বললেন এটি কোনো দলের ব্যাপার না।

তিনি ডেকেছেন এলাকার কিছু অরাজনৈতিক পেশাজীবীদের, যাঁদের সঙ্গে শেখ হাসিনা দেখা করতে চান। আমি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে বললাম, ‘ভাই, আমি শুধু অরাজনৈতিক না, শেখ হাসিনা আমাকে চেনেনও না।’ আমি যেতে অস্বীকার করলে তিনি পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। যেহেতু আমন্ত্রণকারী আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, আমি রাজি হই এবং সে রাতের নিমন্ত্রণে যাই।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনার পতন ও ইতিহাসের শিক্ষা২০ নভেম্বর ২০২৫

শেখ হাসিনাকে এর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ওয়াশিংটনে সরকারি অনুষ্ঠানে দেখেছি, শুনেছি। আমি বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই তাঁকে প্রথম দেখি। আমি তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কার্যালয়ে বিশেষ সহকারী হিসেবে কাজ করেছি বেশ কয়েক মাস বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর।

আমি স্বাধীনতাসংগ্রামের একজন নেতা কামারুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে কাজ করেছি তিন বছর। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি আছে, আর কামারুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে তো বটেই। (আমি সেই চার বছরের ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছি আমার সদ্য প্রকাশিত অস্থির সময়: বাংলাদেশের প্রথম চার বছর বইতে।) শেখ হাসিনাকে সে সময় আমার দেখার কোনো সুযোগ হয় নাই। কথা বলা তো দূরের কথা।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বা পরে বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকার সময় কয়েকবার বেসরকারিভাবে ওয়াশিংটন এসেছেন। তিনি যখনই আসতেন তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতারা ওয়াশিংটন এলাকার কোনো স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোচনা সভার আয়োজন করতেন। উল্লেখযোগ্য এসব আলোচনা চক্রে আমন্ত্রিত হতেন এলাকার বাংলাদেশি পেশাজীবীরা, যাঁরা আন্তর্জাতিক সংস্থা, অধ্যয়ন সংস্থা বা আইন-সম্পর্কিত সংস্থার সঙ্গে কাজ করতেন। তাঁরা প্রায়ই অরাজনৈতিক ব্যক্তি, তবে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে তাঁরা সরব থাকতেন। আমার সেসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনার ফাঁসির রায় এবং তাঁর রাজনৈতিক মৃত্যু১৭ নভেম্বর ২০২৫

সে রাতে আমাদের জ্যেষ্ঠ বন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখলাম আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি, যাঁরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মচারী, কিছু অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, আর কিছু ফেডারেল গভর্নমেন্টের কর্মচারী। আমার জানা মতে প্রায় সবাই অরাজনৈতিক লোক। সব মিলিয়ে বিশজন হবে। কিছু পরে শেখ হাসিনা এলেন তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে। তাঁদের সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন, যাঁরা শেখ হাসিনার সহচর ছিলেন।

পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর শেখ হাসিনা সবার কুশল জেনে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে কেউ কেউ সামান্য কিছু বলে উল্টো জানতে চাইলেন শেখ হাসিনার নিজস্ব মতামত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে।

আমি বেশ অবাক হয়ে শুনলাম তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা দলটির নেত্রী সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করলেন না। বরং তিনি নিজের দল নিয়েই বেশি বললেন, দেশের স্বাধীনতায় দলের অবদান, তাঁর সরকারের অবদান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর আশা।

কথা তখন গড়াতে গড়াতে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক দুরবস্থা এবং এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দায়দায়িত্ব এ পর্যায়ে যখন যায়, তখন আমি একটি প্রশ্ন করি তাঁকে। আমি জানতে চাইলাম যে তিনি কি মনে করেন না যে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা পর্যায়ে পরিবর্তন দরকার? এক নেতৃত্ব বহুদিন ধরে থাকলে কি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্জীব হয়ে যায় না?

আরও পড়ুন১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণে ডুবিয়ে হাসিনা যেভাবে উন্নয়নের গল্প বানাতেন১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শেখ হাসিনা আমার দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে উত্তর দিলেন, ‘আপনার কি মনে হয় আমি সেধে সেধে (তাঁর ভাষায় সাইধা সাইধা) দলের প্রধান হইছি? দলের বিশ হাজার কাউন্সিলর আমারে ভোট দিয়া প্রেসিডেন্ট বানাইছে।’ আমি নাছোড়বান্দার মতো আবারও বললাম, ‘তা আপনি নিজে থেকে সরে না দাঁড়ালে তাঁরা তো আপনাকে চাইবেই।’ উত্তরটা অবশ্যই তাঁকে খুশি করেনি। তিনি আমার সঙ্গে আর কোনো বাক্য বিনিময় করলেন না।

তিনি আমাদের বললেন, ‘আমার দেশে ফিরে যাওয়ার আরেকটি রাস্তা আছে। সবাই তো মনে করে আমি ভারতের অনুরক্ত, আমি ভাবছি আমি প্রথম ভারতেই চলে যাব। সেখান থেকে আমি বোরকা পরে ওদের সাহায্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ব। তারপর দেশে গেলে যা হয় তা হবে।’ বলেই তিনি হাসতে থাকলেন। আরও সবাই হাসল এটাকে একটি দারুণ কৌতুক হিসেবে। আর আমি অবাক হলাম কীভাবে শেখ হাসিনা সহজভাবে তাঁর ভারতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের কথা বললেন কৌতুকের ভেতর।

আরও কিছু আলাপ আলোচনার পর খাবার পরিবেশন হলে আমি খাবার হাতে নিয়ে দেখলাম শেখ হাসিনা বসে খাচ্ছেন আর পাশে তাঁর ছেলে জয়। আমাকে গৃহকর্ত্রী বসতে বললে আমাকে অবাক করে শেখ হাসিনা বললেন তাঁর কাছে বসতে। হঠাৎ জয় উঠে দাঁড়ালে আমাকে গৃহকর্ত্রী ইশারা করলেন পাশের চেয়ারে বসতে। আমি পাশে বসে প্রথমেই হাসিনাকে বললাম যে আমি তাঁকে তাঁর সভাপতিত্ব নিয়ে কোনো কটাক্ষ করিনি এবং আশা করি তিনি মনে কিছু নেননি। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, না, কিছু মনে করেননি।

এরপর তাঁকে আমি বললাম যে তাঁর সঙ্গে আমার এর আগে কোনো দিন কথা হয়নি। আমি তাঁকে প্রথম দেখি তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। আমি তখন তাঁকে আরও বললাম যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর আমি তাঁর পিতার সঙ্গে কাজ করেছি বেশ কয়েক মাস। এরপর তিনি আমাকে মন্ত্রী কামারুজ্জামানের একান্ত সচিব হিসেবে পাঠিয়ে দেন। আমি কামারুজ্জামানের সঙ্গে ছিলাম যত দিন তিনি মন্ত্রী ছিলেন। দেখলাম শেখ হাসিনা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠে বললেন, ‘ও তাই নাকি। কামারুজ্জামান সাহেবের ছেলেকে তো আমরা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করেছি।’

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা কি তাহলে পুলিশের ওপরই সব দায় চাপিয়ে দিলেন০৬ নভেম্বর ২০২৫

খাওয়ার শেষে আবার কিছুক্ষণ আলাপচারিতার সময় কথা উঠল তাঁর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন চিন্তা নিয়ে। কারণ, তখন কথা উঠেছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁর দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে জল্পনায় রয়েছে।

একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বললেন যে এটা সত্যি কি না আর তিনি ফিরে গেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে কি না, এটা যাচাইয়ের জন্য একমাত্র উপায় দেশে ফিরে গিয়ে এটার মুখোমুখি হওয়া। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তিনি তাঁর দেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বা সম্ভাব্য গ্রেপ্তার নিয়ে কথা বলছেন নিরুদ্বেগে, যেন এটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এর পরে যা বললেন তা ছিল আরও বিস্ময়কর, যদিও এটা ছিল হাস্যোচ্ছলে বলা।

তিনি আমাদের বললেন, ‘আমার দেশে ফিরে যাওয়ার আরেকটি রাস্তা আছে। সবাই তো মনে করে আমি ভারতের অনুরক্ত, আমি ভাবছি আমি প্রথম ভারতেই চলে যাব। সেখান থেকে আমি বোরকা পরে ওদের সাহায্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ব। তারপর দেশে গেলে যা হয় তা হবে।’ বলেই তিনি হাসতে থাকলেন। আরও সবাই হাসল এটাকে একটি দারুণ কৌতুক হিসেবে। আর আমি অবাক হলাম কীভাবে শেখ হাসিনা সহজভাবে তাঁর ভারতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের কথা বললেন কৌতুকের ভেতর।

আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪

সে রাতে খাবার আর গল্পের পর ফিরতে বেশ দেরি হয়। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনার ওপর বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হলে তিনি ঢাকা ফেরত যান।

কিন্তু তার কিছুদিন পর জুলাই ২০০৭ মাসে তাঁকে এবং খালেদা জিয়াকে অন্তরিন করা হয়। প্রায় এগারো মাস পর ২০০৮ সালের জুন মাসে তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য। আবার তিনি ওয়াশিংটন আসেন এবং থাকেন তাঁর ছেলের সঙ্গে ভার্জিনিয়াতে কয়েক মাস। এবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় দ্বিতীয়বারের মতো। এবার মেরিল্যান্ডে, আমার অঙ্গরাজ্যে।

আমার দ্বিতীয় দেখা হয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কারণ, আমার প্রথম সাক্ষাৎ নিয়ে আমি কিছু বিব্রত ছিলাম। কাজেই আমাকে যখন আমার সুপরিচিত বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি তাঁর বাড়িতে শেখ হাসিনার সৌজন্যে আরেকটি রাতের নিমন্ত্রণে আহ্বান করলেন (ঘটনার এক মাস আগে), আমি আমার অপারগতা জানালাম অন্য আরেকটি ব্যাপারে ব্যস্ততা জানিয়ে। আমি ভাবলাম আমি অব্যাহতি পেয়েছি।

কল্পনার বাইরে এ জন্য যে তাঁকে পরপর দুইবার যে মূর্তিতে দেখেছিলাম, তাঁর বাহ্যিক যে রূপ দেখেছিলাম, পরবর্তী পনেরো বছর তিনি যেভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ভয়াল পরিবর্তন আনেন, তা তাঁকে চোখে দেখা আর শোনা থেকে ব্যক্তিত্ব অনেক দূরে ছিল।

কিন্তু এর দুই সপ্তাহ পরে আমার বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি আবার আমাকে নিমন্ত্রণের কথা জানিয়ে বললেন যে এবার আমাকে আসতেই হবে, কারণ তাঁর ‘নেত্রী’ নিজে আমার নাম নিয়ে বলেছেন যে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে। শুধু আমি নই, আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসতে। আমি তো হতবাক! প্রথমত শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র এক বছর আগে। তিনি আমাকে কীভাবে মনে রাখলেন? আর বঙ্গবন্ধু বা কামারুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে কাজ করা তাঁর কাছে এমন কোনো বিশেষ বস্তু না যে তার জন্য আমাকে তাঁর নিমন্ত্রণে আসার অনুরোধ করবেন? আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে পরে নিমন্ত্রণকর্তাকে জানালাম যে আমি আসব।

এবারের রাতের অনুষ্ঠান ছিল আরও ব্যাপক। এই অর্থে যে এখানে লোকসমাগম আরও বেশি ছিল। শেখ হাসিনার দলও ছিল বেশ বড়। আগের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে চারজন লোক ছিল তাঁর ছেলে ছাড়া। এবার দেখলাম প্রায় দশজন লোক, জয় তো আছেই। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে কয়েকজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক আর গোটা কয়েক পেশাজীবী। শেখ হাসিনার সঙ্গীরা ছাড়া আর কেউ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না।

এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। প্রধান দলগুলো ছাড়া অন্য দলগুলো সাড়া দিয়ে নির্বাচনে কাজে নেমেছে। আওয়ামী লীগ সরকারিভাবে না হলেও ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে তারা নির্বাচনে নামবে। শুধু বিএনপি তখনো জানান দেয়নি।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সে রাতের আলোচনা মূলত ছিল আগামী নির্বাচন। এ নিয়ে শেখ হাসিনা তাঁর মনোভাব জানালেন। তাঁর ছেলে জয় নির্বাচনী প্রচার টেলিভিশনের মাধ্যমে করার ওপর জোর দিলে আমি বললাম যে বাংলাদেশে টেলিভিশন এখনো গ্রামে গ্রামে পৌঁছায় নাই। তার চেয়ে রেডিও ও মাইকিং করে প্রচার ভালো। তার ওপর জয় আরও কিছু বলতে গেলে হাসিনা তাঁর ছেলেকে থামিয়ে বললেন, ‘তুমি চুপ করে ওদের কথা শোনো।’ জয় থেমে গেল।

খাওয়ার টেবিলে আবার শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে! আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কারা কারচুপি করবে বলে আপনার ভয়? সরকারি কর্মচারীরা?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘না, তাদের কেন ভয় করব। সরকারি কর্মচারীরা তো তরল পদার্থ। যে পাত্রে রাখা হয় সে পাত্রের আকার ধারণ করে।’

নাছোড়বান্দার মতো আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কারা? এখন তো নির্দলীয় সরকার। তাদের তো এ নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব থাকার কোনো কারণ নেই।’ শেখ হাসিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন, ‘তবু নির্বাচনে কিছু ভয় থাকে।’

আরও পড়ুনদ্য উইকে শেখ হাসিনার নিবন্ধ, অস্বীকারের রাজনীতি ও অসত্য চর্চার নমুনা১৪ নভেম্বর ২০২৫

কথা আরেকটু বাড়িয়ে আমি তাঁকে বললাম, ‘দেখেন, এ নির্বাচনের পরে আপনার সঙ্গে আবার দেখা নাও হতে পারে। তাই বলছি, আমি আমার সরকারি চাকরিজীবনে জেলা প্রশাসক হিসেবে দুই জেলায় তিনটি নির্বাচনী কাজে দায়িত্বে ছিলাম। এর মধ্যে একটি ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, একটি ছিল সংসদ নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেমন দলভিত্তিক হয়েছিল, তেমনি সংসদ নির্বাচনও। তখনকার প্রেসিডেন্ট তাঁর পদে থেকে নির্বাচন করেছিলেন এবং পরবর্তী সংসদ নির্বাচনও তাঁর সৃষ্ট রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এ দুটিতে কারচুপি হয়েছিল বলব না, তবে যখনই একটি নির্বাচনে একজন প্রতিষ্ঠিত সরকারি নেতা বা তাঁর দল অংশগ্রহণ করে, তাঁদের দিকে পাল্লা ভারী থাকে। এই নির্বাচনে এ রকম কোনো পরিস্থিতি তো নেই।’

আমার এই মন্তব্যের পর শেখ হাসিনা বললেন, ‘নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব না থাকলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এর গ্যারান্টি কে দেবে?’ আমি এর উত্তর আর কী দেব।

আরও পড়ুনহাসিনা পালিয়ে বাঁচলেন, ধ্বংস করলেন তাঁর পিতাকে২০ আগস্ট ২০২৪

সে রাতের আলাপ আলোচনা থেকে আমার দুটো উপসংহার ছিল। শেখ হাসিনা অবশ্যই নির্বাচনে যাবেন। আর তিনি এ নির্বাচনে জয়ী হবেন—এ প্রত্যাশা রাখেন। কিন্তু পরে এই জয়কে ধরে রাখতে আরও কী কী প্রক্রিয়া তিনি হাতে নেবেন, তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।

কল্পনার বাইরে এ জন্য যে তাঁকে পরপর দুইবার যে মূর্তিতে দেখেছিলাম, তাঁর বাহ্যিক যে রূপ দেখেছিলাম, পরবর্তী পনেরো বছর তিনি যেভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ভয়াল পরিবর্তন আনেন, তা তাঁকে চোখে দেখা আর শোনা থেকে ব্যক্তিত্ব অনেক দূরে ছিল।

তিনি বাইরে ছিলেন একজন সহজ সরল, সাদাসিধে লোক যে তাঁর অনানুষ্ঠানিক ব্যবহার দিয়ে মানুষকে জয় করতেন। বিশেষত যাঁদের তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ মনে করেননি। তাঁর বাহ্যিক ব্যবহারে সাধারণ লোক তা বুঝতে পারত না। ভারতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা কৌতুকের মতো বললেও তিনি ভেতরে-ভেতরে ভালোই জানতেন যে ভারত তাঁর সব বিপদে পাশে থাকবে। তিনি জানতেন যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভারত তাঁর পেছনে থাকবে। তিনি ভান করেছিলেন নির্বাচনে কারচুপির ভয়ের।

আমার দুঃখ এই যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়েও শেখ হাসিনা তাঁর পিতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা দূরদর্শিতা পাননি। কারণ, তাঁর পিতা তাঁকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছিলেন। তিনি হয়তো তাঁর মেয়েকে ভালোভাবে জানতেন। তিনি আর জওহরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী এক নন।

শেষ করার আগে আমি শেক্‌সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার থেকে একটি উক্তি উদ্ধৃত করতে চাই। সিজার তার বন্ধু ব্রুটাসকে বলেছিল, ‘ব্রুটাস, আমাদের ভাগ্যের জন্য আমাদের নক্ষত্র দায়ী নয়, আমরা নিজেরাই আমাদের ভাগ্যের জন্য দায়ী।’ আজ শেখ হাসিনা যে কারণে দণ্ডিত হলেন সেটা তাঁর নক্ষত্রের জন্য নয়, এটা তাঁর কর্মফলের জন্য।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ