যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্বব্যাপী শুল্ক আরোপের ঘোষণা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন খোদ তাঁর ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ব্যবসায়ী নেতারা। গত বুধবার ট্রাম্পের ওই শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর থেকে সারা বিশ্বে পুঁজিবাজারগুলোয় ব্যাপক দরপতন হচ্ছে।

ট্রাম্পের সমর্থক ধনকুবের বিনিয়োগকারী বিল অকম্যান গত রোববার সতর্ক করে বলেছেন, নতুন শুল্ক আরোপ নিয়ে সামনে অগ্রসর হলে সেটা অর্থনৈতিকভাবে পরমাণু যুদ্ধ শুরু করার শামিল হবে। ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিলেন অকম্যান।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাকি বিশ্বের বাণিজ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলে ২ এপ্রিল বেশ কয়েকটি দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তালিকায় থাকা কয়েকটি দেশের ওপর তিনি উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’–এ এক পোস্টে অকম্যান লিখেছেন, যদি নতুন শুল্ক কার্যকর হয়, তবে বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ক্রমশ গতি হারাবে এবং ক্রেতারা অর্থ ব্যয় বন্ধ করে দেবেন।

অকম্যান আরও লিখেন, ‘বাকি বিশ্বের কাছে আমাদের যে সুনাম রয়েছে, আমরা সেটির গুরুতর ক্ষতি করব এবং এই সুনাম পুনরুদ্ধার করতে কয়েক বছর এবং সম্ভবত কয়েক দশক লেগে যাবে।’

অকম্যানের এই পোস্ট ১ কোটি ৬০ লাখ বার দেখা হয়েছে।

পারশিং স্কয়ার ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অকম্যান আরও বলেছেন, ‘যদি ট্রাম্প তাঁর পথ পরিবর্তন না করেন, তবে আমরা নিজেদের তৈরি করা একটি অর্থনৈতিক পরমাণু দুর্যোগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এবং আমাদের আশ্রয় খোঁজা শুরু করা উচিত।’

কেন তিনি এ কথা বলছেন, তার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন অকম্যান। তিনি বলেন, ‘একটি অর্থনৈতিক পরমাণু যুদ্ধের মাঝখানে কোনো সিইও এবং কোনো পরিচালনা পরিষদ আমাদের দেশে বড়, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিতে কি স্বস্তিবোধ করবেন? প্রেসিডেন্ট বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক নেতাদের আস্থা হারাতে শুরু করেছেন।’

ট্রাম্প বুধবার সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা সব পণ্যের ওপর যে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, তা গত শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ আরোপ করা শুল্ক কার্যকর হবে আগামীকাল বুধবার থেকে।

অন্যান্য লাখো কোটিপতি ও ধনকুবের ব্যবসায়ীরাও খোলাখুলি ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সমালোচনা করেছেন। তাঁদের একজন জেমি ডিমোন। তিনি জেপিমরগ্যান চেজ–এর চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনিও ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে পরিচিত।

গতকাল সোমবার ডিমোন সতর্ক করে বলেন, শুল্কের ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দার দিকে ধাবিত হওয়ার এবং বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। 

শেয়ারহোল্ডারদের কাছে পাঠানো বার্ষিক চিঠিতে ডিমোন আরও লেখেন, ‘সাম্প্রতিক শুল্ক খুব সম্ভবত মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করবে এবং অনেকেই মনে করছেন, এতে মন্দার সম্ভাবনাও অনেক বাড়বে। শুল্কের কারণে মন্দা দেখা দেবে কি দেবে না, তা নিয়ে এখনো হয়তো প্রশ্নের অবকাশ আছে, কিন্তু এটা অর্থনীতির গতি হ্রাস করবে।’

আরও পড়ুনএশিয়ার ৬ দেশসহ যে ১০ দেশের ওপর সবচেয়ে বেশি শুল্কারোপ করলেন ট্রাম্প৫ ঘণ্টা আগে

আরেক কোটিপতি বিনিয়োগকারী স্ট্যানলি ড্রুকেনমিলার গতকাল এক্সে এক পোস্টে বলেছেন, তিনি ১০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপের পক্ষে নন।

গতকাল রাতে ফিশার ইনভেস্টমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান ধনকুবের কেন ফিশার এক্সে এক পোস্টে বলেছেন, ‘ট্রাম্প (গত) বুধবার যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা বোকামি, ভুল, চরম উদ্ধত, ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা করা এবং সমস্যাই নয়—এমন একটি বিষয়কে ভুল যন্ত্র দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, এটা ব্যর্থ হবে এবং সমস্যা যতটা তার চেয়ে আতঙ্ক বেশি এবং এখান থেকে এটা অতিরঞ্জিত।’

ফিশার এদিন বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, তিনি সাধারণত প্রেসিডেন্টদের কার্যক্রম নিয়ে জনসম্মুখে কথা বলেন না। কিন্তু শুল্ক নিয়ে এখন পর্যন্ত ট্রাম্প যা করেছেন, সেটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।

এমনকি বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইলন মাস্ক পর্যন্ত এ নিয়ে কথা বলেছেন। গত রোববার তিনি বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে ‘শুল্কবিহীন অবস্থার’ ব্যাপারে আশাবাদী।

অনলাইনে ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক আরও বলেন, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে একটি কার্যকর মুক্ত-বাণিজ্য অঞ্চল তৈরি হোক, সেটা দেখতে চান তিনি।

আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্র আরোপিত শুল্কের শেষ দেখে নেওয়ার অঙ্গীকার চীনের৭ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র ধনক ব র ক র যকর ব যবস য় বল ছ ন কর ছ ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ