কথা ছিল, এপ্রিলের ১ তারিখ বাংলাদেশ ব্যাংক তার নতুন ঋণবিন্যাস নীতি চালু করবে। এখন শোনা যাচ্ছে, ব্যাংকিং খাতের নাজুকতা ও ভঙ্গুরতার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে এ কার্যক্রম নিয়ে পুনঃআলোচনা করবে। এ নতুন নীতি অনুসারে, কোনো ঋণ যদি তিন মাস পরেও অপরিশোধিত থাকে, তাহলে সে ঋণকে খেলাপি বলে ঘোষণা করা হবে। এর আগে এ সময়সীমা ছিল ছয় মাস। খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই নতুন নীতি বৈশ্বিক ‘তৃতীয় ব্যাসেল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা’র সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৪০৭ কোটি ডলারের যে ঋণ পেয়েছে, তার শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে এই নতুন ঋণবিন্যাস নীতি বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছিল। 

তৃতীয় ব্যাসেল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নের বিলম্বীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একা নয়; যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ ব্যাপারে অতিরিক্ত সময় চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের জুলাই মাস থেকে তিন বছরের উত্তরণ সময়কালসহ এ বাস্তবায়ন শুরু করবে। তাদের মধ্যম আয়তনের ব্যাংকগুলো যাতে চাপের মুখে না পড়ে, সে জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যাসেল কাঠামোর বাস্তবায়ন বিলম্বিত করবে। এ সবকিছুর ফলে পুনঃআলোচনার জন্য বাংলাদেশের অবস্থান হয়তো জোরদার হবে। 

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ খেলাপি ঋণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশ ছিল। এক বছর আগের অনুপাত ছিল ৮ শতাংশ। গত এক বছরে বাংলাদেশের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা বেড়ে গিয়েছে। এর ফলে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩.

৬ লাখ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রাক্কলন অনুসারে, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩০ শতাংশ হতে পারে এবং অনপেক্ষভাবে এ ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর দুর্বলতা, ক্রমাগত অদক্ষতা, অর্থ এবং পুঁজি পাচারের মতো অবৈধ অর্থপ্রবাহের কারণে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। 
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন ঋণবিন্যাস নীতি বাস্তবায়নে বেগ পেতে হবে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি বৈশ্বিক মানে ফিরে যায়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে; যাতে আইএমএফের শর্ত মানা দুষ্কর হতে পারে। আইএমএফের শর্ত হচ্ছে, ২০২৬ সাল নাগাদ রাষ্ট্রীয় ঋণদাতাদের ক্ষেত্রে মোট বিতরণকৃত ঋণে খেলাপি ঋণের অনুপাত হতে হবে ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই অনুপাতকে হতে হবে ৫ শতাংশ। বিষয়টি আইএমএফের বাংলাদেশকে দেয় ঋণের তৃতীয় কিস্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার পূর্বনির্ধারিত বিতরণ তারিখ ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। কোনো ব্যাখ্যা ভিন্নই সে তারিখ স্থগিত করা হয়েছে। 

অন্যদিকে বাংলাদেশের সম্পদের গুণগত মান কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ অবস্থা বিষয়ে মুডিস তার মূল্যায়ন কমিয়ে নিচে নামিয়ে এনেছে। আরও কঠিন ঋণবিন্যাস নীতি দেশের আর্থিক খাতের দেয় অবস্থাকে জটিল করে তুলবে। দেশের অর্থনৈতিক শ্লথতা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে  আরও বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি উদ্যোক্তা সময়সীমার মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবেন। 

খেলাপি ঋণ নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ২০১২ সালে খেলাপি ঋণ নির্ণয়ের বৈশ্বিক মানদণ্ড গ্রহণ করেছিল। সেই মানদণ্ড অনুসারে ঋণগ্রহীতা যদি তিন মাস পরে ঋণ পরিশোধে অপারগ হন, তাহলে সে ঋণকে খেলাপি ঋণ বলে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু ২০১৯ সালে সেই মানদণ্ডকে শিথিল করে সংশ্লিষ্ট সময়সীমা তিন মাস থেকে ছয় মাস করা হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের জন্য ৯ মাস সময় দেওয়া হতো। তারও আগে, ২০১২ সালের ‘ঋণের সময়কাল পুনর্নির্ধারণ নীতি’র কারণে ঋণখেলাপিরা তাদের নিজ নিজ ঋণ মোট তিনবার পুনর্বিন্যস্ত করতে পারতেন, যার কারণে কুসম্পদের পরিমাণ লুকিয়ে রাখা যেত। 

এসব বিচ্যুতির বিভিন্ন কারণ ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ ছিল রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে অবৈধ সুবিধা দেওয়া। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এসব গোষ্ঠী ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করেছে তাদের ব্যক্তিগত কোষাগারের মতো। তারা নানাভাবে অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধের শৃঙ্খলা ভেঙে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে জাঁকিয়ে বসেছিল, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ আত্মসাতের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছিল। যে ব্যবস্থায় না ছিল কোনো দৃশ্যমানতা কিংবা দায়বদ্ধতা। এমন প্রক্রিয়ার ফল হয়েছিল দুটো– এক. কোটি কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধ না করা এবং দুই. খেলাপি সেসব অর্থ ও সম্পদ বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করা। 

সন্দেহ নেই, এসব বিচ্যুতির কারণে বিশাল অঙ্কের ঋণখেলাপ কাগজে-কলমে এড়ানো গেছে, কিন্তু এর কারণে চূড়ান্তভাবে দেশের আর্থিক কুশল বিঘ্নিত হয়েছে। এতে গত দশকে ১০টি ব্যাংক একদম ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এ ধরনের শিথিলতা সত্ত্বেও বৈশ্বিক ঋণ মূল্যায়ন সংস্থাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের মান কমায়নি। কিন্তু খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়ে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে নীতিমালার আসন্ন কঠিন বাস্তবায়নের কারণে আগামীতে আরও মান কমার আশঙ্কা রয়েছে। 
আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার যে প্রস্তুতি বাংলাদেশ ব্যাংক নিচ্ছে, তার ফল দেশের আর্থিক খাতের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর বিধিবিধান এবং দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা একটি বড় বিষয় হয়ে দেখা দেবে।

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ শ র আর থ ক আইএমএফ র পর শ ধ

এছাড়াও পড়ুন:

৪৭তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষার্থীদের জন্য পিএসসির যত নির্দেশনা

আগামী শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের ওয়েবসাইটে পরীক্ষার আসনব্যবস্থা, সময়সূচি ও শিক্ষার্থীদের জন্য নানা নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়েছে।

পিএসসি জানিয়েছে, ৪৭তম বিসিএসে অংশ নিতে মোট ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪৭ জন চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেছেন। ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ৪৭তম বিসিএসে মোট শূন্য ক্যাডার পদের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৮৭। আর নন-ক্যাডার পদের সংখ্যা ২০১। এই বিসিএস থেকে মোট ৩ হাজার ৬৮৮ জনকে (ক্যাডার ও নন–ক্যাডার মিলিয়ে) নিয়োগ দেওয়া হবে। এই বিসিএসে কিছু নতুন পদ যুক্ত হয়েছে।

সময়সূচি ও কেন্দ্র

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে পরীক্ষা। পরীক্ষাকেন্দ্র ৮টি। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ।

আরও পড়ুনইউনিমেট-শাবানা মাহমুদ-দেখার হাওর-বেন গুরিয়ান বিমানবন্দর-কী, জেনে নিন১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫পরীক্ষার্থীদের করণীয়

১। পরীক্ষার্থীদের অবশ্যই সকাল ৯টা ৩০ মিনিটের মধ্যে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে হবে। ৯টা ৩০ মিনিটের পর কোনো পরীক্ষার্থী হলে প্রবেশ করতে পারবেন না। পরীক্ষার্থীদের হলের নাম ও কক্ষ নম্বর আগেই মেসেজের মাধ্যমে তাঁদের মুঠোফোন নম্বরে প্রেরণ করা হবে।

২। সকাল ৯টা ৩০ থেকে ৯টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তরপত্র বিতরণ করা হবে। উত্তরপত্রের ৪টি সেট থাকবে, যেমন সেট # ১, ২, ৩ ও ৪। সকাল ১০টায় পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হবে।

আরও পড়ুন১২ দিনের ছুটিতে যাচ্ছে সরকারি নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

৩। পরীক্ষাকেন্দ্রে বইপুস্তক, সব ধরনের ঘড়ি, মুঠোফোন, ক্যালকুলেটর, সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ব্যাংক কার্ড/ক্রেডিট কার্ডসদৃশ কোনো ডিভাইস, গহনা ও ব্যাগ আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বর্ণিত নিষিদ্ধ সামগ্রীসহ কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে পারবেন না।

৪। পরীক্ষার সময় পরীক্ষার্থীরা কানের ওপর কোনো আবরণ রাখবেন না, কান খোলা রাখতে হবে। কানে কোনো ধরনের হিয়ারিং এইড ব্যবহারের প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শপত্রসহ কমিশনের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।

৫। পরীক্ষায় মোট ২০০টি এমসিকিউ টাইপ প্রশ্ন থাকবে। পরীক্ষার্থী প্রতিটি শুদ্ধ উত্তরের জন্য ১ নম্বর পাবেন, তবে ভুল উত্তর দিলে প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য মোট প্রাপ্ত নম্বর থেকে ০.৫০ নম্বর করে কাটা হবে।

আরও পড়ুন৪৭ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি: শেষ মুহূর্তে আত্মবিশ্বাসই আসল প্রস্তুতি১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

৬। প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে শ্রুতলেখক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কমিশনের মনোনীত শ্রুতলেখক ছাড়া অন্য কেউ শ্রুতলেখক হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য শ্রুতলেখকদের ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টার পরীক্ষার জন্য ১০ মিনিট অতিরিক্ত সময় দেওয়া হবে এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টার পরীক্ষার জন্য ৫ মিনিট অতিরিক্ত সময় দেওয়া হবে।

পরীক্ষাকেন্দ্র ও নির্দেশনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন।

আরও পড়ুন৪৩তম বিসিএসের প্রশাসনে প্রথম শানিরুলকে ভাইভায় যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল ২৯ মে ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চাকসু: মনোনয়নপত্র বিতরণের সময় বৃদ্ধির দাবি ছাত্রদলের
  • রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
  • ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাংলাদেশ সফরের সময়সূচি ঘোষণা
  • ৪৭তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষার্থীদের জন্য পিএসসির যত নির্দেশনা
  • যুক্তরাষ্ট্রে টিকটকের মালিকানা সংক্রান্ত চুক্তি নিয়ে ওয়াশিংটন–বেইজিং সমঝোতা