বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ রেখে কর্মবিরতি ও শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা
Published: 10th, December 2025 GMT
সম্প্রতি বার্ষিক পরীক্ষার সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের কর্মবিরতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এক গভীর নৈতিক সংকট সামনে এনেছে। সমাজের যে পেশাজীবী শ্রেণি জ্ঞান, আদর্শ ও নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে মর্যাদা পায়, তাদের কাছ থেকে দায়িত্বহীন আচরণ কেবল হতাশাজনকই নয়, বিপজ্জনকও বটে। কারণ, শিক্ষকতা আর দশটা চাকরির মতো নয়; এটি একধরনের নৈতিক প্রতিশ্রুতি, এক সামাজিক চুক্তি।
এ পেশায় শিক্ষক নিজের আচরণের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে দায়িত্ববোধের শিক্ষা দেন। শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবইয়ের পড়া না শিখিয়ে কীভাবে সদাচরণ করতে হয়, কীভাবে কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হয়, তা শেখানোই হচ্ছে শিক্ষকতা পেশার প্রকৃত কাজ। অতএব প্রাথমিকের শিক্ষকদের একাংশের পরীক্ষার মতো সংকটময় সময়ে শিক্ষার্থীদের বেকায়দায় ফেলে নিজেদের দাবি আদায়ের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নিঃসন্দেহে পেশাগত নীতিভ্রষ্টতা।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশাজীবীর ক্ষেত্রে যেমন দাবি আদায়ের অজুহাতে হঠাৎ রাস্তায় নামা বিশেষ নিয়মে পরিণত হয়েছে, শিক্ষকদের এ কর্মবিরতিও সেই সামগ্রিক অবক্ষয়েরই আরেকটি দৃষ্টান্ত। ফলে কেবল শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে না, গোটা সমাজেও নৈতিক নেতৃত্বের এক গভীর সংকট তৈরি হয়।
শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক যে আদর্শ বা আচরণগত দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন, তা কেবল কোনো নৈতিক পরামর্শ নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক সত্য, যার ধারাবাহিকতা মানবসভ্যতার ইতিহাসেই দৃশ্যমান। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিক্ষককে সমাজে নৈতিক দিশারি, আলোক প্রদর্শক এবং মূল্যবোধের বাহক হিসেবে দেখা হয়েছে। এ কারণেই শিক্ষকতা পেশায় ব্যক্তিগত আচরণের প্রশ্ন কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না; তা শিক্ষার্থীর চিন্তা, চরিত্র ও ভবিষ্যৎ নাগরিক পরিচয়কে নির্ধারণ করে।
এ অবস্থায় কোনো শিক্ষক যদি বছর শেষে কোর্স সমাপনী পরীক্ষার মতো সংবেদনশীল মুহূর্তে নিজ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সচেতনভাবে কর্মবিরতিতে গিয়ে রাষ্ট্রকে চাপ দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেন, তবে তা শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন শেখানো দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা ও নৈতিকতার মৌলনীতিরই সরাসরি পরিপন্থী। কারণ, শিক্ষক নিজেই যদি নৈতিক আচরণের মানদণ্ড অমান্য করেন, তবে শিক্ষার্থীর কাছে নীতি ও দায়িত্বশীলতা কেবল মুখের কথা হয়ে দাঁড়ায়।
দর্শনের ভাষায় বলা যায়, শিক্ষকের ব্যক্তিগত আচরণই শিক্ষার্থীর জন্য প্রথম ও জীবন্ত পাঠশালা। আর এখানেই পেশাজীবী হিসেবে তাঁর সামাজিক দায়িত্ববোধ সর্বাধিক। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, চরিত্র গঠনের প্রধান উপায় হলো ‘অনুশীলন’ ও ‘অনুকরণ’। সুতরাং শিক্ষক যদি অনুকরণের যোগ্য নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে ব্যর্থ হন, তবে তা কেবল ব্যক্তিগত বিচ্যুতিই নয়, সমাজের মানুষগুলোর নৈতিক কাঠামোর ভিতকেও দুর্বল করে দেয়।
পরীক্ষার তারিখ পেছানো বা পরীক্ষার অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ওপর তীব্র মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এই অপ্রত্যাশিত মানসিক চাপ তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আত্মবিশ্বাসকে সরাসরি বিঘ্নিত করে।
মাসের পর মাস অধ্যবসায়ের পর হঠাৎ পরীক্ষার স্থগিতাদেশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হতাশা ও বিভ্রান্তি তৈরি করে, তা শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যা নয়; বরং দীর্ঘ মেয়াদে তাদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা ও মনোবলকে দুর্বল করে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সময়সূচি, বৃত্তির আবেদন কিংবা পরবর্তী ক্যারিয়ার-পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজন হয়। এই সময়সীমা ভেঙে গেলে একটি সম্পূর্ণ ব্যাচের জীবন-পরিকল্পনা ব্যাহত হয় এবং সেই ক্ষতি অনেক সময় পূরণ করা সম্ভব হয় না।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘শিক্ষাগত অনিশ্চয়তা’ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং হতাশা বাড়ায়, যা বিভিন্ন গবেষণায় সুপ্রতিষ্ঠিত। যে শিক্ষকেরা এই মানসিক ও ভবিষ্যতের ক্ষতির পরোয়া না করে কেবল নিজেদের আর্থিক স্বার্থ রক্ষায় পরীক্ষার সময় কর্মবিরতিতে যান, তাঁরা প্রকৃত অর্থে জাতিগঠনের দায়িত্ববোধসম্পন্ন শিক্ষকতার নৈতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নন। বরং তাঁরা শিক্ষার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত করে ভবিষ্যৎ নাগরিক গঠনের পথকেই বিপন্ন করে তোলেন, যার ফলে সমাজের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির ভিত্তি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইতিহাসের দৃষ্টান্ত অনুসারে, যে সমাজে শিক্ষকেরা নৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেখানে জ্ঞানবুদ্ধি, নিয়ম–শৃঙ্খলা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়েছে; আর যেখানে শিক্ষকেরা দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেখানেই সমাজে শৃঙ্খলা ভেঙেছে, নৈতিক ভিত্তি ক্ষয় হয়েছে এবং মূল্যবোধের অধঃপতন ঘটেছে।যাঁরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের চেয়ে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন, তাঁদের হাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার মতো মহৎ দায়িত্ব অর্পণ করা রাষ্ট্র ও জাতির জন্য নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী। কারণ, রাষ্ট্রের জন্য সুনাগরিক তৈরির প্রধান প্রতিষ্ঠান হলো বিদ্যালয়, আর বিদ্যালয়ের প্রাণশক্তিই শিক্ষক।
ইতিহাসের দৃষ্টান্ত অনুসারে, যে সমাজে শিক্ষকেরা নৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেখানে জ্ঞানবুদ্ধি, নিয়ম–শৃঙ্খলা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়েছে; আর যেখানে শিক্ষকেরা দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেখানেই সমাজে শৃঙ্খলা ভেঙেছে, নৈতিক ভিত্তি ক্ষয় হয়েছে এবং মূল্যবোধের অধঃপতন ঘটেছে।
প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’-এ যে আদর্শ রাষ্ট্রের ভাবনা তুলে ধরেছেন, তার কেন্দ্রস্থল ছিল নৈতিক শিক্ষা, আর সেই নৈতিক শিক্ষার মেরুদণ্ড ছিল শিক্ষক-নেতৃত্ব। ফলে একজন শিক্ষক যখন ইচ্ছাকৃত দায়িত্ব বর্জনের উদাহরণ তৈরি করেন, তখন তিনি কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শিক্ষার পরিবেশকে দূষিত করেন না, বরং জাতির সামগ্রিক নৈতিক কাঠামোকে দীর্ঘ মেয়াদে দুর্বল করে দেন। সমাজতত্ত্বের একটি মৌলিক শিক্ষা হলো, বর্তমান প্রজন্মে যে মূল্যবোধ রোপিত হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মে তার প্রতিফলন দেখা দেয়। তাই শিক্ষকের দায়িত্বহীন আচরণ ভবিষ্যৎ নাগরিক সৃষ্টির ভিতকে দুর্বল করে, যার পরিণতি রাষ্ট্রীয় অগ্রগতি ও মানবিক উন্নয়ন—উভয় ক্ষেত্রেই গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আমাদের শিক্ষকসমাজকে সর্বাগ্রে মনে রাখতে হবে, ‘আপনি আচরি ধর্ম, পরেরে শিখাও’—এটি কেবল একটি প্রবাদ নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক শিক্ষাধারায় নৈতিক শিক্ষারও মৌলনীতি এবং শিক্ষকতার সামগ্রিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। সমাজ যাঁদের নৈতিকতার জীবন্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে, তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশাও থাকে অধিক সংযম, অধিক দায়িত্ববোধ এবং অধিক মানবিকতার।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের সাধারণ মানুষকে অসহায় অবস্থায় ফেলে কোনো দাবি আদায় কখনো ন্যায়সংগত হতে পারে না; এটি ন্যায়, নীতি, আইনকানুন ও মানবিকতার মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিক্ষক যদি নিজেই ন্যায় ও মানবিকতার অবস্থান ত্যাগ করতে শুরু করেন, তাহলে জাতির নৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে, যে সমাজে শিক্ষকের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়েছে, সেখানে শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ ও মানবিকতার ভিত্তিও ক্রমে দুর্বল হতে হতে একসময় ভেঙে পড়েছে। তাই শিক্ষকতা পেশায় মহৎ দায়িত্ব পালনে সততা, সংবেদনশীলতা ও পেশাগত নীতিনৈতিকতা রক্ষা শুধু একটি পেশাগত বাধ্যবাধকতা নয়, বরং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে নৈতিকতা ও মানবিকতার আলো পৌঁছে দেওয়ার জাতীয় প্রতিশ্রুতি।
ড.
মাহরুফ চৌধুরী ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য। ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ য় ত বব ধ শ ক ষকদ র ও ম নব ক পর ক ষ র শ ক ষকত প রজন ম র জন য প শ গত ন ত কত অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
দীর্ঘদিনের কোয়ান্টাম রহস্যের সমাধান করলেন বিজ্ঞানীরা
প্রায় ১০০ বছর আগে আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত একটি পরীক্ষা আবার করার মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিকসের একটি মূল নীতিকে নিশ্চিত করেছেন চীনের একদল বিজ্ঞানী। নতুন এ পরীক্ষার মাধ্যমে একটি কণার পথ ও তার তরঙ্গসদৃশ আচরণ একই সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা যায় না বলে প্রমাণ করা হয়েছে। নতুন এই প্রমাণ কোয়ান্টাম বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে নিলস বোরের ধারণাকে সমর্থন করে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
১৯২৭ সালে ব্রাসেলসের সলভে কনফারেন্সে কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভিত্তি নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই তত্ত্ব সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতেন। তিনি বিজ্ঞানী বোরের সম্পূরকতার নীতিকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেন। বোরের মতে, ফোটনের মতো কোয়ান্টাম কণা একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ উভয় রূপেই আচরণ করতে পারে। তবে এই দুটি বৈশিষ্ট্য একসঙ্গে পরিমাপ করা অসম্ভব।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর একটি চিন্তামূলক ডাবল–স্লিট পরীক্ষার একটি সংশোধিত সংস্করণ প্রস্তাব করেন; যার মাধ্যমে দেখা যায়, দুটি বৈশিষ্ট্য সম্ভবত একই সঙ্গে পরিমাপ করা যেতে পারে, যা আবার বিজ্ঞানী বোরের তত্ত্বের পরিপন্থী হতো। কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই চ্যালেঞ্জ কেবল তাত্ত্বিকই ছিল। চীনের বিজ্ঞানী পান জিয়ানওয়েইয়ের নেতৃত্বে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অব চায়নার একদল বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ধারণাকে বাস্তবে একটি পরীক্ষায় রূপান্তরিত করেছেন।
বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্রাংশ তৈরি করেছেন, যা একটি একক ফোটনের ক্ষুদ্র গতিও শনাক্ত করতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, কণার পথ পরিমাপের চেষ্টা করলে ব্যতিচার ধরন নষ্ট হয়ে যায়। আবার ব্যতিচার প্যাটার্ন পর্যবেক্ষণ করলে কণার পথ নির্ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ফলাফল বোরের তত্ত্বকে প্রমাণ করে। কণার বৈশিষ্ট্য সম্পূরক ও একই সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। নতুন এই পরীক্ষাকে পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে স্বাগত জানানো হচ্ছে।
কোয়ান্টাম কণার এমন অস্বাভাবিক আচরণ বাস্তবতার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য, এটি কোনো পরীক্ষামূলক ত্রুটি নয়। গবেষণাটি ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারসে প্রকাশিত হয়েছে। পরীক্ষাটি বিজ্ঞানী বোরের কোপেনহেগেন ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে দীর্ঘদিনের বিতর্কের নিষ্পত্তি করেছে।
সূত্র: এনডিটিভি
https://www.ndtv.com/science/chinese-scientists-test-einsteins-100-year-old-thought-experiment-confirm-bohrs-quantum-theory-9763355