মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগের সিদ্ধান্ত
Published: 19th, April 2025 GMT
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্য মশিউর সিকিউরিটিজের (ট্রেক নং-১৩৪) বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে সমন্বিত গ্রাহক হিসাব (সিসিএ) থেকে ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা এবং শেয়ার শেয়ার বিক্রির ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে। একক কোনো ব্রোকারেজ হাউজ হিসেবে এটাই সবচেয়ে বড় জালিয়াতি।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ব্যবস্থা নিতে মশিউর সিকিউরিটিজের পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শেয়ার ও তহবিল তছরুপের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
ব্রোকারেজ হাউজটির পরিচালক-কর্মকর্তারা যেন বিদেশ পালিয়ে যেতে না পারেন, সেজন্য দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য দুদকে জরুরি ভিত্তিতে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন স্থায়ীভাবে স্থগিত করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটটকে (বিএফআইইউ) অবহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
মশিউর সিকিউরিটিজের বিষয়ে ইতোপূর্ব গঠিত তদন্ত কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিএসইসির একাধিক সূত্র রাইজিংবিডি ডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
আগের সরকারের আমলে আইন লঙ্ঘন করা ব্রোকারেজ হাউজগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তবে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত বিএসইসি সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি থাকা ব্রোকারেজ হাউজগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট ডিএসইর পরিদর্শন দল মশিউর সিকিউরিটিজের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ৬৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঘাটতি পায়। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর বিও হিসাবে থাকা শেয়ার বিক্রি বাবদ ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সরিয়ে ফেলার তথ্য পায় পরিদর্শন দল। পরে এসব তথ্যে উল্লেখ করে ওই বছরের গত ২৮ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৯ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। কমিটির সদস্যরা হলেন—বিএসইসির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ এমদাদুল হক, সহকারী পরিচালক মো.
তদন্ত কমিটি মশিউর সিকিউরিটিজের গ্রাহকদের হিসাব, ব্যাক অফিস সফটওয়্যার, অনুমোদিত ট্রেডিং ওয়ার্ক স্টেশনের তালিকা এবং নেতিবাচক ইকুইটির অবস্থা যাচাই করে। একই মোবাইল নম্বর, ই-মেইল, ব্যাংক হিসাব দিয়ে দুটির বেশি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে কি না এবং প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক, সিইও, অনুমোদিত প্রতিনিধি ও অন্যান্য কর্মচারীর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে কোনো লেনদেন হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হয়।
এর আগে ২০২০ সালের ২৪ জুন ক্রেস্ট সিকিউরিটিজে ১২৪ কোটি টাকা, ২০২১ সালের ১৫ জুন বানকো সিকিউরিটিজে ১২৮ কোটি টাকা, ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর তামহা সিকিউরিটিজের ১৪০ কোটি টাকা সমন্বিত গ্রাহক হিসেবে ঘাটতি পাওয়া যায়।
এদিকে, চলতি বছরের গত ১০ এপ্রিল রাজধানীর বিজয়নগরে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন মশিউর সিকিউরিটিজের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একই সঙ্গে প্রতারক প্রতিষ্ঠান মশিউর সিকিউরিটিজের পরিচালক, কর্মকর্তাসহ ডিএসই ও বিএসইসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানান তারা।
বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন, মশিউর সিকিউরিটিজ অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ক্লায়েন্টের শেয়ার বিক্রি করে এবং অনুমোদনহীন ব্যাক অফিস সফটওয়্যার ব্যবহার করে ক্লায়েন্টের ই-মেইলে জাল পোর্টফলিও পাঠায়, যা মূল পোর্টফোলিওর অনুরূপ। যাতে করে গ্রাহক বুঝতে না পারে তার পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি হয়েছে। পরবর্তীতে তারা টাকা আত্মসাৎ করে। শেয়ার বিক্রয় কিংবা ক্রয় করলে সিডিবিএল থেকে কনফার্মেশন মেসেজ আসে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে নিজেদের মোবাইল নম্বর চালিয়ে দেয় মশিউর সিকিউরিটিজ। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। এছাড়া, রেকর্ড ডেটের আগে বেশি দামে যে পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করে রেকর্ড ডেটের পর সেই পরিমাণ শেয়ার কিনে রেখে দিত। যাতে বিনিয়োগকারী বুঝতে না পারে। ফলে, বিনিয়োগকারী লভ্যাংশ পেত না এবং বিক্রি ও ক্রয়ের মূল্য পার্থকের টাকা হিসাব থেকে সরিয়ে নিত। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের পোর্টফোলিওতে রক্ষিত নগদ টাকা গ্রাহককে ফেরত না দিয়ে নিজেরা আত্মসাৎ করেছে। মশিউর সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নাকের ডগায় বসে অর্থ লোপাট করেছে, যা দুঃখজনক এবং স্পর্শকাতর। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিনিয়োগকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দীর্ঘদিন গ্রাহকের অর্থ ও শেয়ারের প্রকৃত তথ্য আড়াল করার মাধ্যমে ১৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিএসইসির সিদ্ধান্ত
আইন বিভাগ, মার্কেট অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়ারিজ অ্যাফেয়ার্স বিভাগ ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগের একটি সমন্বিত প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো—প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গের দায়ে এনফোর্সমেন্ট প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে। মানিলন্ডারিং ও অর্থ আত্মসাতের (প্যানেল কোড, ১৮৬০ এর সংশ্লিষ্ট ধারা ভঙ্গ) বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অভিযোগটি দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হবে। এ-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত মশিউর সিকিউরিটিজের পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন স্থায়ীভাবে স্থগিত করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠানো হবে এবং তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের লক্ষ্যে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি পাঠানো হবে। এসব বিষয়ে বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেছেন, মশিউর সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। বিএসইসির তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছে। তাই, ব্রোকারেজ হাউজটির পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় ব্যবস্থা নিতে দুদকে অভিযোগ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
এ বিষয়ে জানতে মশিউর সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ঢাকা/এনটি/রফিক
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর কর মকর ত দ র ব এসইস র ব যবস থ ট র পর
এছাড়াও পড়ুন:
পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেবে বিএসইসি
শেয়ার সূচকের নিয়মিত পতনের মূল কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সেই সঙ্গে যেসব শেয়ারের অস্বাভাবিক বিক্রির চাপ দেখা যাচ্ছে, বাজার তদারকির মাধ্যমে সেসব শেয়ার চিহ্নিত করা হবে বলেও জানিয়েছে তারা।
দেশের পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক নিম্নমুখী প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। গতকাল মঙ্গলবার এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে তাৎক্ষণিক কিছু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। এ ছাড়া সভায় বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, বিএসইসির কমিশনার মু. মোহসিন চৌধুরী, মো. আলী আকবর, ফারজানা লালারুখ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব দেলোয়ার হোসেন, পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের প্রতিনিধি ও বিএসইসির নির্বাহী পরিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন।
সভার সিদ্ধান্ত হয়, বিনিয়োগকারীদের জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় টক শো ও বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি বিআইসিএম ও বিএএসএম পুঁজিবাজার-বিষয়ক শিক্ষণীয় ভিডিও তৈরি করবে। ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পুঁজিবাজার সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা প্রচার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সচেতন করা হবে।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন লাভজনক কোম্পানির শেয়ার অফলোড করা, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করা এবং টেক্সটাইল ও ওষুধ খাতের দেশী লাভজনক কোম্পানিগুলোর শেয়ার পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা হবে।
যেসব কোম্পানি এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি, তাদের তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত করার জন্য আকর্ষণীয় করছাড় দেওয়া হবে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ সীমিত করা এবং পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, পুঁজিবাজারের উন্নয়নের স্বার্থে দেশের আর্থিক খাতের অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো হবে। সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া আসন্ন জাতীয় বাজেটে বিনিয়োগকারীদের জন্য করছাড়ের সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হবে। এর মধ্যে লভ্যাংশ আয়ের ওপর করছাড় এবং পুঁজিবাজারের বিনিয়োগের ওপর বিশেষ করছাড়ের সুবিধা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।