মেঝেতে পড়ে থাকার ভিডিও ফেসবুকে, ভুক্তভোগী বেঁচে আছেন ‘জীবন্ত লাশের মতো’
Published: 20th, April 2025 GMT
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার সেই গৃহবধূর দিন কাটছে ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে। ঘটনার তিন দিনেও মুখোশ পরা যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তাঁকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবারের সদস্যরা।
এদিকে পাশবিক নির্যাতন শেষে ওই গৃহবধূকে হাত-পা শিকলে বেঁধে বিবস্ত্র অবস্থায় ঘরের মেঝেতে ফেলে যায় জড়িত ব্যক্তিরা। পরে তাঁর বৃদ্ধ শাশুড়ির চিৎকারে স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে গৃহবধূকে পড়ে থাকতে দেখতে পান। কেউ একজন তাঁকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। তখন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে ভুক্তভোগীর মেঝেতে পড়ে থাকার ছবি তোলেন, আবার কেউ ভিডিও ধারণ করেন। এরই মধ্যে এসব ছবি ও ভিডিও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েছেন ভুক্তভোগী নারী।
গত বৃস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নাঙ্গলকোট উপজেলার দৌলখাঁড় ইউনিয়নের একটি গ্রামে ওই গৃহবধূর ওপর পাশবিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ওই গৃহবধূর স্বামী ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বাড়িতে ৭০ বছর বয়সী অসুস্থ শাশুড়ি আর দুই বছর বয়সী কন্যাসন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। ২২ বছর বয়সী ওই গৃহবধূকে শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে পাশবিক নির্যাতনের পর তাঁর মাথার চুলও কেটে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় শুক্রবার সকালে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন নির্যাতিত ওই গৃহবধূ। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে ওই দিন রাতে অভিযোগটি মামলা হিসিবে নথিভুক্ত করে।
আজ রোববার বিকেলে ওই গৃহবধূর স্বামী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই লম্পটরা যখন আমার স্ত্রীকে হাত-পা শিকলে বেঁধে তালা মেরে বিবস্ত্র অবস্থায় ঘরের মেঝেতে ফেলে যায়, তখন আশপাশের লোকজন এসে প্রথমে ঘর থেকে একটি কাপড় তাঁর শরীরে দেয়। এ সময় স্থানীয় লোকজন এসে অনেকে এ ঘটনার ভিডিও করে ফেলে। পরে এসব ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন ঘটনায় আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। মানুষের মধ্যে কি মনুষ্যত্ব নেই?’
ওই গৃহবধূর স্বামী আরও বলেন, ‘৯৯৯-এর মাধ্যমে ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ এসে আমার স্ত্রীকে হাত-পায়ের শিকল ও তালা খোলে। আমি তখন ঢাকায় আমার কর্মস্থলে ছিলাম। এ ঘটনায় আমার স্ত্রী মানসিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি লম্পটদের বিচার চাই।’
এ ঘটনায় হওয়া মামলায় দুজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা একজনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান আসামি ওই তরুণের নাম মো.
ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে ভুক্তভোগী গৃহবধূ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। জীবন্ত লাশের মতো বেঁচে আছি। আমার আর কোনো কিছু চাওয়ার নেই, শুধু ওই লম্পটদের কঠোর শাস্তি চাই। ঘটনার মূল হোতা ইমাম হোসেন গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে যেই লম্পট মুখোশ পরা অবস্থায় আমার সর্বনাশ করেছে, সে এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। আমি তার ফাঁসি চাই। ইমাম হোসেনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে আসবে। দ্রুত বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।’
গ্রেপ্তার ইমাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নাঙ্গলকোট থানার উপপরিদর্শক গনেশ চন্দ্র শীল। রোববার বিকেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আদালতে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছি। তবে এখনো রিমান্ড শুনানি হয়নি। আশা করছি ইমাম হোসেনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে পুরো তথ্য বেরিয়ে আসবে। আমরা মামলাটি ভালোভাবে তদন্ত করছি।’
নির্যাতিত ওই গৃহবধূর ভাষ্য, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘরের দরজা ভেঙে প্রবেশ করে তিনজন। পাশবিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি ওই লম্পটরা লুট করে নিয়েছে ঘরে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ মালামালও। নির্যাতন ও লুট শেষে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা ঘরে জামাকাপড়ের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া গৃহবধূর মাথার চুলও কেটে দেয়।
নাঙ্গলকোট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মামলার প্রধান আসামি এখন কারাগারে আছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। শনিবার গৃহবধূর মেডিকেল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে কুমিল্লা মেডিকেলে। ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। মামলার অপর দুই আসামিকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ই গ হবধ র ন ঙ গলক ট গ হবধ ক আম র স ঘটন র এ ঘটন ঘটন য় তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
সুনামগঞ্জে বালু লুট : আসামির তালিকায় আছে আন্দোলনকারীদেরও নাম
আলী হোসেনের (২৪) বাড়ি সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর তীরের লাউড়েরগড় গ্রামে। এই তরুণ পেশায় আলোকচিত্রী, থাকেন ঢাকায়। ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলেন বাড়িতে। এ সময় যাদুকাটা নদীতে বালু লুটের ঘটনা শুরু হলে সেটির ভিডিও ও ছবি নেন। এসব ছবি ও ভিডিও পাঠান গণমাধ্যমকর্মীদের। তাঁর তোলা বালু লুটের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। অথচ অবৈধ বালু উত্তোলনের অভিযোগে করা একটি মামলায় আসামির তালিকায় তাঁর নামও আছে।
সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ঘটনায় গত দুই দিনে জেলার তাহিরপুর থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর, অন্যটি করেছেন ইজারাদার। দুই মামলায় আসামি করা হয়েছে ৮৮ জনকে। অজ্ঞাত আসামি আছেন ৫০ জনের মতো। দুটি মামলাতেই ৬ থেকে ১১ অক্টোবর নদীর লাউড়েরগড় এলাকায় জড়ো হয়ে নদীর পাড় কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ করা হয়েছে। ইজারাদারের পক্ষে করা মামলার আসামির তালিকা নিয়ে বেশ সমালোচনা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলায় আসামির তালিকায় এই নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীসহ আলোচিত বেশ কয়েকজনের নাম আছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাইমিনুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার তাহিরপুর থানায় মামলাটি করেন। এই মামলায় ৩৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় উপজেলার সোহালা গ্রামের বাসিন্দা তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্থানীয় বাদাঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আফতাব উদ্দিন, তাঁর বড় ভাই উপজেলা বিএনপির যুক্ত আহ্বায়ক রাকাব উদ্দিন, উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা বিশ্বজিৎ সরকার, নদী তীরের বাসিন্দা মোশাহিদ আলম ওরফে রানু মেম্বারের নাম আছে। রানু মেম্বার একই অভিযোগে এর আগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই মামলায় ৩৬ নম্বরে আছে আলোকচিত্রী আলী হোসেনের নাম।
আলী হোসেন বলেন, ‘আমি বালু লুটের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। সবাইকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলাম। মামলার বাদী পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাও নদী তীরে দাঁড়িয়ে আমার কাছ থেকে তথ্য নিয়েছেন, এখন দেখি আমিই আসামি। আমি বিস্মিত, হতবাক।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোহাইমিনুল হক অবশ্য বলেছেন, তাঁরা যাচাই-বাছাই করেই আসামির তালিকাটি করেছেন। যেহেতু একটি নাম নিয়ে কথা হচ্ছে, তাই সেটি সম্পর্কে আবারও খোঁজ নেবেন তাঁরা।
এর আগের দিন বুধবার একই অভিযোগে থানায় আরেকটি মামলা করেন মোশারফ হোসেন আরির তালুকদার নামের এক ব্যক্তি। তিনি যাদুকাটা-১ বালু মহালের ইজারাদার মো. নাছির মিয়ার আত্মীয়। এই মামলায় ৫১ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৩০ জনকে অজ্ঞাত আসামি রয়েছেন। এই মামলার ৩৮ আসামি বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই মামলায় বালু উত্তোলনবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকা ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের আসামি করা হয়েছে। আবার পাড় কাটায় যুক্ত অনেকের নাম আসেনি।
নদীর তীরের ঘাগটিয়া গ্রামের বাসিন্দা কাসমির রেজা দীর্ঘদিন থেকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। তিনি পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি। এবারও নদে বালু লুটের ঘটনা শুরু হলে তিনি প্রতিবাদ করেন। অথচ এই মামলায় তাঁর ভাই আস্তারুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় এলাকার নারজেল, পারভেজ ও মাসুদ রানা নামের তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁরা পাড় কাটার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত ছিল বলে অনেকেই জানিয়েছেন।
কাসমির রেজা বলেন, ‘কার যোগসাজশে, কারা বালু লুট করে এটা তো এলাকাবাসীর জানা। তাই মামলায় আসামি করে, হুমকি দিয়ে কোনো কাজ হবে না। আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।’
ইজারাদার নাছির মিয়া বলেছেন, তাঁরা স্থানীয় সাংবাদিক ও গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যসহ স্থানীয় নির্ভরযোগ্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যারাই ঘটনায় যুক্ত ছিলেন তাঁদের মামলায় আসামি করেছেন। আন্দোলনকারী বা প্রতিবাদকারী কাউকে উদ্দেশ্য করে মামলা করা হয়নি।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য এবং সুনামগঞ্জ নদী ও হাওর রক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ রাজু আহমেদ বলেন, প্রশাসন, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কঠোর না হলে শুধু মামলা করে এসব অপকর্ম বন্ধ করা যাবে না। মামলায় কোনো নিরীহ, নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন সেটি খেয়াল রাখতে হবে।
তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, মামলার তদন্তে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। যারা দোষী নন তাঁরা বাদ যাবেন। দোষী অথচ এজাহারে নাম সেই তদন্তে এমন কাউকে পাওয়া গেলে তিনিও যুক্ত হবেন। তবে নির্দোষ কেউ হয়রানির শিকার হবেন না।
সুনামগঞ্জে তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর দুটি বালু মহাল এবার ১০৭ কোটি টাকায় ইজারা হয়েছে। তবে মামলা–সংক্রান্ত জটিলতায় গত পাঁচ মাস বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। চলতি মাস থেকে বালু উত্তোলন শুরু হয়।