ধন্যবাদ ডোনাল্ড ট্রাম্প। অস্ট্রেলিয়ানরা বড় বড় কথা বলার চেয়ে বরং তাদের পরিচয় ঠিকভাবে তুলে ধরতেই সিদ্ধহস্ত। কাজটি তারা করছেন তারা কী নন, তা তুলে ধরার মাধ্যমে। অস্ট্রেলিয়ানরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দিয়েছেন, তারা ক্রুদ্ধ খুদে আমেরিকান নন। সাংস্কৃতিক যোদ্ধা বা স্বার্থপর স্বাধীনতাবাদীও নন।

আমরা সবসময় জানতাম, এই জাতির মধ্যে মজ্জাগতভাবে এক ধরনের শালীনতা রয়েছে। কিন্তু তা তখনই ফুটে উঠল যখন তাদের মার্কিন প্রেসিডেন্ট উত্ত্যক্ত করছেন। তিনি লোক দেখানো বীরত্ব প্রদর্শন করছেন। প্রথমে হাজার হাজার মানুষ যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ বাতিল করেন। তারপর তা আরও নিশ্চিত হয় যখন লাখ লাখ ভোটকেন্দ্রে কার্ডবোর্ডের ঘেরাটোপে গোপনীয়তার মধ্যে তারা তাদের রায় দেন।
এমনকি যে প্রধানমন্ত্রীকে ২০২২ সালে তাঁর প্রথম বিজয়ী ভাষণে অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ দেশের মতো’ ক্লিশে বক্তব্য থেকে বেরিয়ে আসতে সংগ্রাম করতে হয়েছিল, সেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের রাতে এ দেশ কী কী কারণে অনন্য ও সম্ভাবনায় পূর্ণ– সহজেই তুলে ধরেছেন। অনুশীলন ও আত্মবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে তিনি আরও শক্তিশালী হবেন। এমনকি তা রূপান্তরমূলক পদক্ষেপের মধ্যে ফুটে উঠতে পারে; স্রেফ ফাঁপা বুলি হয়ে থাকবে না। 

সংস্কৃতি প্রায় সবসময় রাজনীতির আগে থাকে। এর লক্ষণগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে। ২০০৫ সালে স্যাম কেকোভিচ নিরামিষভোজী, হিপ্পি বা অপ্রচলিত ধারায় জীবন যাপনকারীসহ সব ধরনের ভিন্নমতাবলম্বীদের নিন্দা করার পর নন-অস্ট্রেলীয় হওয়ার ধারণাটি আলোচনায় ঝড় তুলেছিল। প্রায় দুই দশক পর তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ২০২৩ সালে বৈচিত্র্য আলিঙ্গন করে আইকনিক অস্ট্রেলিয়া দিবসে ভেড়ার মাংসের বিজ্ঞাপনটি উল্টে যায়। ‘অনুমান করুন আমরা সবাই কিছুটা নন-অস্ট্রেলীয়, এটাই আমাদের অস্ট্রেলীয় করে তোলে।’
ওটা ছিল শুরু। যখন অস্ট্রেলিয়ান নেতারা বুঝতে পারেন, উদ্ভাবনকে ভয় না পেয়ে সাহস ও সমবেদনার সঙ্গে হাতে যা আছে তার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্টটি গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করলেই অসাধারণ কিছু ঘটতে পারে। এটি আগেও ঘটেছে। এটি ঠিক যে, সাধারণত দুই ধাপ এগিয়ে এক ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার নৃত্যেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুই ধাপ একই সঙ্গে এগিয়ে নতুন দিকনির্দেশনা তৈরি করে। এটা আশ্চর্যজনক ছিল, কোষাধ্যক্ষ জিম চালমার্স তাঁর দলের বিজয়কে ফেডারেশনের পর সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। ফেডারেশন সম্পর্কে আর কে কথা বলেন? কিন্তু এটি ছিল অসাধারণ। প্রতিটি উপনিবেশে এক দশক বিতর্ক এবং দু’বার ভোটের দরকার হওয়া এবং তারপর লন্ডনে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। এরই মধ্য দিয়ে এমন এক জাতি গঠিত হয়েছিল, যা পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য গণতান্ত্রিক ও সামাজিক উদ্ভাবনের একটি বিশ্বব্যাপী মডেল ছিল।

আমরা ঠিকই মনোযোগ দিই। আর তা খুব অস্ট্রেলিয়ান পন্থায়। সেটা হতে পারে নেতিবাচক দিকগুলোর ওপর; শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়া নীতির কঠোরতার ওপর; দক্ষিণ সমুদ্র দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের জোরপূর্বক নির্বাসনের ওপর; প্রথম জনগণের বর্জন ও নির্মূলের চেষ্টার ওপর। কিন্তু বাকি বিশ্ব উদ্ভাবন, অর্থনৈতিক সাফল্য এবং একটি সহানুভূতিশীল মনের মিশ্রণে অস্ট্রেলিয়ান মডেলের জন্ম দেখেছিল। অস্ট্রেলিয়ানরা শিক্ষিত, ইতিবাচক ছিল এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ জীবনযাত্রার মান উপভোগ করেছিল। তাদের ছিল অজস্র সম্ভাবনা। 
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মহামন্দার সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কারণে এ আত্মবিশ্বাস কমে গিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই পুনর্গঠন পরিকল্পনা তৈরি করা হয় এবং পূর্ববর্তী দশকগুলোর শিক্ষা বাস্তবায়ন করা হয়।

আশির দশকে যখন পুরাতন আমদানিবিরোধী বা সুরক্ষাবাদী অর্থনৈতিক মডেল ভেতর থেকে ভেঙে পড়ে; অস্ট্রেলিয়া আবারও মানবিক মুখসমৃদ্ধ নিউ লিবারালিজম মডেল নিয়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়। এটি নিখুঁত ছিল না, তবে বিশ্বজুড়ে তা অনুকরণ করা হয়েছিল এবং তৎকালে ‘তৃতীয় উপায়’ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হস্তগত করে সবকিছু বেসরকারীকরণের চেয়ে এটি অনেক ভালো ছিল। তারপর বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটে অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা সাড়া দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তারা অন্য বহু দেশে ঘটে যাওয়া বিপর্যয় রোধে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। এসব মডেল আত্মবিশ্বাস জোগায়– এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ান উপায় আছে, যা অস্তিত্বগত সংকটের মুখেও উদ্ভাবনকে সম্ভব করে তোলে। বৃহৎ পরাশক্তিগুলো কী করছে, তার ওপর অযথা নির্ভরশীল হওয়ার দরকার হবে না।
আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে। তার ভিত্তি 
স্থাপন ও ভবিষ্যৎ আমাদেরই নির্মাণ করতে হবে। নতুন জাতি সম্পর্কে ফেডারেশনের বিতর্কে অংশগ্রহণকারী রোজ স্কট বিচক্ষণতার সঙ্গে বলেছিলেন: ‘সাহসী হও, সাহসী হও, সাহসী হও। সংস্কার কঠিন, কিন্তু তা মূল্যহীন নয়।’

জুলিয়ান শুলজ: ‘দি আইডিয়া অব
অস্ট্রেলিয়া’ বইয়ের লেখক; দ্য
গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তরিত

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম দ র প রথম র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ