প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গত দেড় দশকে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তে জাতিসংঘের যেকোনো ধরনের সহযোগিতা বাংলাদেশ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, জাতিসংঘ আমাদের চলমান তদন্তপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হোক। এতে প্রক্রিয়াটি আরও শক্তিশালী হবে।’

সোমবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতিসংঘের গুম বা নিখোঁজবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের (ডব্লিউজিআইডি) ভাইস চেয়ারপারসন গ্রাজিনা বারানোস্কা এবং সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাদিয়ো পেরেজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন।

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা গুমের ঘটনা প্রতিরোধে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গৃহীত উদ্যোগ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ সনদে (আইসিপিপিইডি) বাংলাদেশের সংযুক্তির প্রশংসা করেন। তবে এ ক্ষেত্রে এখনো অনেক কিছু করার রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন।

তাঁরা গুমের ঘটনা তদন্তে সরকার গঠিত তদন্ত কমিশনের কাজ এবং প্রতিশ্রুতিকেও সাধুবাদ জানান।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকার ডিসেম্বর পর্যন্ত কমিশনের মেয়াদ বাড়াচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘তাঁদের নানাভাবে হুমকি দেওয়া হলেও কমিশন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। তাঁরা যখন সর্বশেষ প্রতিবেদন জমা দিল, আমি বলেছিলাম, দর্শনার্থীদের জন্য একটি “ভয়ের জাদুঘর” থাকা উচিত। আপনাদের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। আমাদের সহায়তা ও একসঙ্গে কাজ করার দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে ১৩ বছর পর আমরা জাতিসংঘের একটি দলকে এখানে স্বাগত জানাতে পারছি। আমরা চাই আপনারা আমাদের কমিশনের কাজে সহায়তা করুন এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে দিকনির্দেশনা ও শক্তি জোগান।’

বারানোস্কা জানান, ২০১৩ সাল থেকে তাঁরা বাংলাদেশে গুম ইস্যুতে কাজ করার চেষ্টা করছেন এবং তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিশন ও এর কাজ আপনার সরকারের এক বিশাল প্রতিশ্রুতি। এ জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। এটি আমাদের জন্য এক বিশাল সম্মান।’

তিনি আরও জানান, তাঁরা ঢাকার বাইরে গিয়ে ভুক্তভোগী, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ ম র ঘটন আম দ র তদন ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নদীর কোলে শিক্ষার সংগ্রাম: চরের শিশুদের গল্প

সকাল ৬টা। চর বাটিকামারীর ১০ বছরের আসিয়া নৌকায় চড়ে স্কুলের পথে রওনা দেয়। সঙ্গে তার ছোট ভাই মিলনও। বইখাতা বাঁশের তৈরি ছোট ব্যাগে গুঁজে নেওয়া। মায়ের মুখে একটাই কথা—‘পড়তে গেলে অনেক কষ্ট করতেই হয় মা।’
গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র বিধৌত চর বাটিকামারি যেন এক স্বপ্ন ও সংগ্রামের আখড়া। এখানে শিক্ষার মানে শুধু ক্লাসে যাওয়া নয়, প্রতিদিন জল-জোয়ার, কাঁদা, বালু ও ভয়কে অতিক্রম করে টিকে থাকার লড়াই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরের জীবন যেমন হুমকির মুখে, তেমনি হুমকির মুখে এখানকার শিশুদের ভবিষ্যৎ।

নদীভাঙন ও বন্যার করাল থাবা: ব্রহ্মপুত্রের পাড়ঘেঁষা এই চরে নদীভাঙন নতুন কিছু নয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ ভাঙন হয়েছে আরও হঠাৎ ও ভয়াবহ। সম্প্রতি চর বাটিকামারির একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পূর্ণ ভেঙে নদীগর্ভে চলে গেছে। এখন শিক্ষার্থীরা পড়ে অস্থায়ী টিন ও বাঁশের ঘরে, যা বর্ষাকালে টিকিয়ে রাখা কঠিন।

স্থানীয় বাসিন্দা রওশন আরা বেগম বলেন, “আগে একটা স্কুল ছিলো। এখন বাচ্চারা খোলা আকাশের নিচে পড়ে। কখনও বাঁশের চালায়, কখনও গাছের ছায়ায়। একটু বেশি বৃষ্টি হলে স্কুল বন্ধ।”

যাতায়াতই বড় চ্যালেঞ্জ: চরের ভেতরে নেই পাকা রাস্তা। বর্ষাকালে প্রায় পুরো এলাকা পানির নিচে চলে যায়। তখন একমাত্র ভরসা নৌকা। কিন্তু নৌকা চালানো সহজ নয়। ছোট ছোট শিশুদের দুই থেকে তিন ঘণ্টা নৌকা করে স্কুলে যেতে হয়।
ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী রাব্বি বলে, “সকালে নৌকা না পেলে স্কুল মিস হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে পানি এত বেশি হয়, নৌকা উল্টে যাওয়ার ভয় থাকে। তবু যাই, না গেলে তো পরীক্ষা দেওয়া যাবে না।”

ফ্রেন্ডশিপ নামের এনজিওর এক্সিকিউটিভ ফিল্ড অপারেশন (গাইবান্ধা) মো. মোসাদ্দিকুর রহমান বলেন, “চরের শিক্ষার্থীরা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও শেখার আগ্রহ ধরে রেখেছে। আমাদের স্কুল প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে।”

পরীক্ষা দিতে গিয়ে বিপদ : এসএসসি পরীক্ষার্থী রুনার গল্পটা হৃদয়বিদারক। গত বছর বন্যার সময় সে পরীক্ষা দিতে গাইবান্ধা শহরের একটি কেন্দ্রে যাওয়ার পথে হঠাৎ ঝড় ওঠে। নৌকা উল্টে যায়। কোনোরকমে তীরে উঠতে পারলেও সে দিনের পরীক্ষা দিতে পারেনি। “আম্মু কান্না করছিল, আমি খালি বলছিলাম—‘পরীক্ষা না দিলে এবার আর পড়ালেখা করতে পারবো না’।”
এমন হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা চরের অনেক শিক্ষার্থীর। প্রতিটি পরীক্ষা যেন তাদের কাছে একেকটা যুদ্ধ।

শিক্ষকদের সীমাবদ্ধতা ও মানবিকতা: স্থানীয় এক শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা নিজেরাও চরবাসী। আমরাও কষ্ট করে আসি, কিন্তু ক্লাস চালিয়ে যাই। কারণ আমরা জানি, এই শিক্ষাই ওদের একমাত্র আশার আলো।”

তবে অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক স্বল্পতা ও উপকরণের অভাব শিক্ষকদের কাজ কঠিন করে তুলেছে। কোনো কোনো স্কুলে নেই বিজ্ঞান ল্যাব, নেই গ্রন্থাগার, এমনকি পর্যাপ্ত বেঞ্চও নেই।

প্রশ্ন সরকারি উদ্যোগ নিয়ে: চরের মানুষ বারবার প্রশ্ন করেন—সরকার কি তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট? স্থানীয় চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলাম বলেন, “আমরা জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। স্থায়ী স্কুল ভবন, শিক্ষকের আবাসন, নৌকা বা শাটল সার্ভিসের আবেদন করেছি। এখনো সাড়া মেলেনি।”

তবু সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আসিয়া, রাব্বি, রুনারা স্বপ্ন দেখে। কেউ শিক্ষক হতে চায়, কেউ ডাক্তার। নবম শ্রেণির তানজিনা আক্তার বলে—“আমি চাই চরেও একটা ভালো স্কুল হোক, যেন ছোট ভাই-বোনেরা আমার মতো কষ্ট না পায়।”

এই শিশুদের চোখের জল, নদীর ঢেউয়ের গর্জন আর টিনের চালের নিচে বই পড়ে যাওয়ার কষ্ট—সব মিলে বলে দেয়, চরবাসীর শিক্ষার গল্পটা শুধুই টিকে থাকার লড়াই নয়, বরং মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার এক অসাধারণ সংগ্রাম।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে, তখন দেশের ভেতরেই লাখো শিশু লড়ছে একটাই অধিকার রক্ষায়— শিক্ষার অধিকার। এখন সময়, কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার।

ঢাকা/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ