ইরানে ইসরায়েলের অতর্কিত হামলা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে। ইসরায়েল-ইরানের এই যুদ্ধে ক্রমশ বিশ্বের ক্ষমতাধর পরাশক্তিগুলোও তৎপর হয়ে উঠছে। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছে, যুদ্ধ বন্ধে কড়া বার্তা ও হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেছে। বিশ্ব এখনও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধকলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; তার সঙ্গে যুক্ত হলো ইসরায়েল-গাজা-ইরান যুদ্ধের ভয়াবহ ঘটনা।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের ক্ষতিগ্রস্ত সোরোকা হাসপাতাল পরিদর্শনের পর বলেছেন, ‘আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে আর থাকতে (বেঁচে) দেওয়া যাবে না।’ স্থানীয় গণমাধ্যম ও এএফপির বরাতে এ সংবাদ প্রকাশ করেছে বিবিসি। (সমকাল, ১৯ জুন)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও প্রকারান্তরে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন এবং তাদের ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের’ আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরান আক্রমণের এই ঘটনায় ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ মন্তব্য করেছেন, ‘ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে আমেরিকার হস্তক্ষেপ পরিবেশকে আরেকটি ভয়াবহ উত্তেজনার দিকে নিয়ে যাবে।’ তারা ইরানে ইসরায়েলের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। এ ছাড়া ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা না দেওয়ার জন্য আমেরিকাকেও সতর্ক করেছেন রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকভ। (সমকাল, ১৯ জুন)।
চলমান এই সংঘাত নিয়ে টেলিফোনে কথা বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ফোনালাপে ইসরায়েলের ইরানবিরোধী পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন দুই বিশ্বনেতা। সংঘাত থামাতে ভ্লাদিমির পুতিন আবারও মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন।
ইসরায়েল ও মার্কিনের হুমকি-আক্রমণের মধ্যেই দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইরানি জনগণকে ভয় না পেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। (বিবিসি)।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, সময় ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৪০ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজবাহী রণতরী ‘ইউএসএস নিমিটজ’ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা করেছে। এর সঙ্গে রয়েছে একাধিক গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, যেগুলো পারস্য ও ওমান উপসাগরে অবস্থানরত মার্কিন যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৬, এফ-১২ ও এফ-৩৫ মডেলের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘাঁটিতে স্থানান্তর করেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষ আশা করেছিল, মার্কিন শাসকরা নতুন করে যুদ্ধে জড়াবে না কিন্তু তিনি সেই ভাবনায় পেরেক ঠুকে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। বিশ্ববাসী একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী চাইলেও দিন দিন যুদ্ধ-সংঘাত-রক্তপাত-প্রাণহানি জনজীবনের সংকট ও অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েলের এই আক্রমণ কি শুধু ইরানের পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার সম্ভাবনার অভিযোগ না অন্য কোনো বিষয় আছে? এই প্রসঙ্গে জিও পলিটিক্যাল ইকোনমির এক ব্লগে খ্যাতিমান সাংবাদিক বেন নরটন আটটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ইসরায়েল-আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করছে, তার প্রধান কারণগুলো হচ্ছে– ১.
ওই বিশ্লেষণ বলছে, চলমান হামলা-আক্রমণের প্রধান কারণ–ইরান সরকারকে উৎখাত না হয় দুর্বল করা। ইরানকে দুর্বল করাই কি ইসরায়েলের আসল উদ্দেশ্য? এ প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাইকেল ফ্লিন ১৭ জুন স্টিভ ব্যাননের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য হলো ‘চীনের ক্ষমতা দুর্বল করা’ এবং ‘মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্য নিশ্চিত করা’।
তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইরান সরকারকে উৎখাত করা। ভবিষ্যতে ইরানে যে নতুন সরকার আসবে, তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক সম্পর্ক থাকলে সেটি আমাদের জন্য লাভজনক হবে– বিশেষ করে চীনের বিপরীতে।’ ফ্লিন আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের বিজয় যদি ঘটে, তাহলে সেটি মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্যের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে– মানসিকভাবে হলেও। আর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।’
ফ্লিন, যিনি ওবামা প্রশাসনে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (ডিআইএ) পরিচালক ছিলেন এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেন– এই যুদ্ধ কেবল ইরানের বিরুদ্ধে নয়, এটি একটি বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক কৌশল; যার লক্ষ্য চীনের প্রভাব খর্ব করে যুক্তরাষ্ট্রকে একচেটিয়া বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
মাইকেল ফ্লিন বলেন, ‘একুশ শতকের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে চীন। চীন, চীন, চীন– এটিই সবাইকে বুঝতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যদি আমরা এবং ইসরায়েল ইরানের সরকারকে উৎখাত করতে পারি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার সব শক্তি ও মনোযোগ চীনের দিকে স্থানান্তর করতে পারবে।’
এই চরমপন্থি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ইউরোপীয় মধ্যউদারপন্থি নেতৃত্বের কথারও মিল পাওয়া যায়। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মার্জ ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘ইসরায়েল আসলে পশ্চিমা বিশ্বের নোংরা কাজটা করে দিচ্ছে।’ এই সব মন্তব্য ইঙ্গিত দেয়, ইরানের বিরুদ্ধে বর্তমান যুদ্ধ কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন নয়– এটি বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্নির্ধারণের লড়াই, যার কেন্দ্রে রয়েছে চীনকে মোকাবিলা করে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
এ প্রসঙ্গে ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘আমেরিকার ক্রসেড’ বইয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থিরা একটি ‘পবিত্র যুদ্ধ’ চালাচ্ছে চীন, আন্তর্জাতিক বামপন্থা এবং ইসলাম– বিশেষত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে। ইসরায়েলকে দিয়ে ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া তাদের এই যুদ্ধ সেই অভিসন্ধিরই বহিঃপ্রকাশ।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ইসর য় ল র এই য দ ধ লক ষ য আম র ক উৎখ ত সরক র ইসর য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত স্থগিত, তবে বাতিলের দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, রোববার এ নিয়ে জরুরি সিন্ডিকেট সভার আহ্বান করা হয়েছে।
বিকেল থেকে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে এ সিদ্ধান্ত নিল প্রশাসন। তবে এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি শিক্ষার্থীরা। তাঁরা উপাচার্যের নির্বাহী ক্ষমতাবলে এ সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। রাত দেড়টার দিকেও শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করে বিক্ষোভ করছিলেন। এটি না হলে আন্দোলন চলবে বলেও তারা জানান।
রাত পৌনে ১টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রশাসনের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতিতে রবিবার ২১ সেপ্টেম্বর জরুরি সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করা হয়েছে।'
শনিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা জুবেরী ভবনের সামনে তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করেন। এতে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীনসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক প্রায় সাত ঘণ্টা পর অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পান।
এর আগে শনিবার বেলা তিনটার দিকে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রশাসনিক ভবন থেকে বের হলে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা তাঁর গাড়ি আটকে দেন। পরে তিনি হেঁটে তাঁর বাসভবনের দিকে যেতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর বাসভবনের ফটকে তালা লাগিয়ে দিলে তিনি জুবেরী ভবনের দিকে যান। তাঁর সঙ্গে প্রক্টর মাহবুবর রহমানও ছিলেন। বিকেল সাড়ে চারটার দিক থেকে জুবেরী ভবনে সহ-উপাচার্য মাঈন উদ্দীনসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে আটকে রাখেন শিক্ষার্থীরা।
এমন পরিস্থিতিতে শনিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে সহ-উপাচার্যসহ অন্য শিক্ষকদের ‘লাঞ্ছিত’ করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রোববার কর্মবিরতির ডাক দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি আবদুল আলিম। সিনেট ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীও কর্মবিরতিতে থাকবেন বলে উল্লেখ করেন।
এরপর রাত সোয়া ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা জুবেরী ভবন ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডসংলগ্ন উপাচার্য সালেহ হাসান নকীবের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক ছাত্রীও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, পোষ্য কোটা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করবেন। পোষ্য কোটার বিলুপ্তি করেই তাঁরা ফিরবেন।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও উপাচার্য সালেহ হাসান নকীব ফোন ধরেননি। তবে রাত সাড়ে ১১টার দিকে একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা খুবই ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছি। কিন্তু এভাবে জিম্মি করে আটকে রেখে সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আজকে তারা যা করল, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রাকসু নির্বাচন হবে কি না, এটা শিক্ষার্থীদের আচরণের ওপর নির্ভর করবে। তবে আমি রাকসু নির্বাচন নিয়ে খুবই সিরিয়াস।’
আরও পড়ুনএবার উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের১ ঘণ্টা আগে