লুট হওয়া অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বেগ পেতে হচ্ছে
Published: 21st, June 2025 GMT
অর্থ সংকটসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মাঝে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ চালাতে হচ্ছে। লুট হওয়া অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বেগ পেতে হচ্ছে। এর মধ্যে স্বল্প সময়ের দায়িত্বে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের জন্য অনুসরণীয় কিছু নমুনা রেখে যাচ্ছে সরকার।
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাজেট বিতর্ক: প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ড.
ফাওজুল কবির খান বলেন, সংকটময় পরিস্থিতিতে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যেই বাজেট ঘোষণা করতে হয়েছে। বহু বছর ধরে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট হয়েছে। দুর্নীতি, অপচয় ও অদক্ষতা এখানে মূল সমস্যা। এখন প্রয়োজন সামগ্রিক সংস্কার, তা না হলে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি বড় প্রতিবন্ধকতা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবাই একমত কিন্তু কেউ তা বন্ধ করতে চায় না।
তিনি জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর জ্বালানি খাতে ৩ বিলিয়নের বেশি ডলার বকেয়া নামিয়ে আনা হয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ মিলিয়নে। সময়মতো পরিশোধ করায় এলএনজির দামও কমেছে। আগে প্রতি ইউনিট ১৬ থেকে ১৭ ডলার ছিল। এখন তা ১২ ডলারে এসেছে।
উপদেষ্টা বলেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নেওয়া হয় ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। অথচ বেসরকারি কেন্দ্র থেকে ১৩ টাকার বেশি দরে কেনা হচ্ছে। আগের সরকার প্রতি দুই মাসে একবার দাম সমন্বয়ের নীতি নিলেও অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ মাসে একবারও দাম বাড়ায়নি।
উপদেষ্টা বলেন, বাসা ও কারখানার ছাদে সৌর প্যানেল স্থাপন করে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে; যা বাস্তবায়ন করা গেলে গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমবে। গ্যাস আমদানিতে সরকার বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে। ৬৫ টাকা দরে গ্যাস কিনে শিল্পে ৩০ টাকায়, বিদ্যুতে ১২ টাকা এবং সারে ১৬ টাকায় সরবরাহ করছে। ভর্তুকি কমাতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো গেলে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে। আর জাতীয় গ্রিডেও উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ যোগ করা যাবে।
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, আপাতদৃষ্টিতে অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট গতানুগতিক মনে হলেও এটি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। বিএনপি নেতা ও এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমলা ও ব্যবসায়ী শ্রেণি মিলেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করেছে। প্রকৃত উদ্যোক্তাদের সুযোগ কমে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার সংস্কারের কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, বিনিয়োগের জন্য উদ্ভাবনের সংযোগ ঘটাতে হবে বাজেটে। আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া রাজস্ব বৃদ্ধি দুর্নীতি ও অদক্ষতা বজায় রাখার মাধ্যম হয়ে উঠবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অতনু রব্বানী প্রশ্ন রাখেন, সরকারি সেবা নিতে যদি ঘুষ দিতে হয়, তাহলে জনগণ কর দিতে আগ্রহী হবে কেন?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান বাজেটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, সরকারি তথ্যের স্বচ্ছতা ও নাগরিক নিরাপত্তার অভাব এ প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, করনীতি হতে হবে বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায্যতার সহায়ক।
বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. জুলফিকার আলী জানান, শিক্ষা খাতে বাজেটের অগ্রাধিকার কমছে। শিক্ষার মানও আশঙ্কাজনক। চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়তেও পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য সায়মা হক বিদিশা বলেন, ১৬ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৪৩ শতাংশ তরুণ এখন কর্মে বা পড়াশোনায় নেই, যা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৩৫৬ কোটি টাকা কি পানিতে গেল
দেশের ১৪টি জেলায় ডাকব্যবস্থাকে আধুনিক ও গতিশীল করার লক্ষ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মেইল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার (এমপিসি) নির্মাণ করেছিল। কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এই সেন্টারগুলো কার্যত অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, শতকোটি টাকার সরঞ্জাম পরিণত হয়েছে ‘ভাগাড়ে’। এভাবে জনগণের অর্থ অপচয়ের প্রকল্প খুবই হতাশাজনক। এ প্রকল্প কেন ব্যর্থ হলো, কারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এখন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২৮৯ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৩ ধরনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মতো প্রধান সেন্টারগুলোতেও অনেক সরঞ্জাম এখনো বাক্সবন্দী বা অযত্নে পড়ে আছে। মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে গেট, ট্রলি, এক্স-রে গুডস—সবকিছুই অব্যবহৃত। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও একই চিত্র। ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম—সবখানেই কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অলস পড়ে আছে, অনেকগুলো আবার নষ্ট, যা পচনশীল পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ একটি সরঞ্জাম চিলার চেম্বার, সেটিরও কোনো ব্যবহার নেই।
সার্ভিস সেন্টারগুলো চালু না হওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সফটওয়্যারের অভাব এবং দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন (এসপিএস) চালুর জন্য সফটওয়্যার না দেওয়ায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ৪২০ সেট হার্ডওয়্যারও অব্যবহৃত। এমনকি এই এসপিএস প্যাকেজ এমপিসি প্রকল্পের অধীনে কেনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কারণ এটি মূলত ডাকঘরের পার্সেল ও ই-কমার্স সেবার জন্য কেনা হয়েছিল। এটি কি কেবলই ভুল পরিকল্পনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছে? সম্ভাব্যতা যাচাই ও চাহিদার মূল্যায়ন না করায় এ প্রকল্পটির এমন বেহাল পরিণতি হলো। এখানে সরঞ্জাম কেনার পেছনে বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এটি একটি গুরুতর অভিযোগ, যার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি।
ডাক বিভাগের ওয়েবসাইটে এমপিসি সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকা এবং প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট জবাব না পাওয়ার বিষয়টিতে স্পষ্ট হয়, এখানে জবাবদিহির চরম অভাব ছিল। প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁরাই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের কাছে অবশ্যই জানতে চাওয়া হোক কেন বিপুল ব্যয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করার পর এর বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হলো না? কেন অদরকারি সরঞ্জাম কেনা হলো?
জনগণের টাকার এমন অপচয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অবিলম্বে এই এমপিসি প্রকল্পের একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। কারা এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী, কেন শতকোটি টাকার সরঞ্জাম অকেজো হয়ে পড়ে আছে এবং কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব, তা খুঁজে বের করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।