যেন কবিতার কোনো লাইন, অথবা প্রেমিকাকে সম্বোধন করা কোনো একটি নাম–প্যারিস। বিশ্বের যত শহর, তার মধ্যে প্যারিসের আবেদন একেবারে আলাদা, অন্যরকম। শহরটি কেবল চোখে পড়ার মতো নয়, হৃদয়ের গভীরেও ধারণ করার মতো। প্রথম যখন প্যারিসে পা রাখলাম, তখন মনে হয়েছিল, এটি কোনো শহর নয়, যেন প্রেমিকাকে দেখছি। প্রতিটি গলি, নান্দনিক বাড়ি, প্রতিটি জানালা, আর কফিশপ– সব খানেই একধরনের মাদকতা কিংবা রোমান্টিক জাদু মিশে আছে। সে জাদু আপনাকে মাতাল করে ফেলবে, মুগ্ধ করে তুলবে। এই জাদুর শিখরই যেন আইফেল টাওয়ার। প্যারিসে লোহার তৈরি স্মৃতি আর প্রেমের নীরব ভাষা!

প্যারিস শহরজুড়ে ঘোরার পর একদিন গিয়ে দাঁড়ালাম আইফেল টাওয়ারের সামনে। যে টাওয়ার ইতিহাস, প্রেম আর গর্বের এক উচ্চতম মিনার হয়ে দণ্ডায়মান। শরীরে এক ধরনের আবেশ বয়ে গেল। এতদিন সিনেমা কিংবা ছবিতে দেখে আসা এই টাওয়ার জীবন্ত হয়ে উঠল চোখের সামনে। তখন মনে পড়ল বিখ্যাত ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের করা উক্তিটি। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক শিল্পীরই দুটি মাতৃভূমি। একটি, যেখানে সে জন্মেছে; অন্যটি ফ্রান্সে।’ উক্তিটি আগে তেমন ভাবায়নি। প্যারিস শহর দেখার পর বারবার যেন শার্ল বোদলেয়ারের উক্তিটি মনে পড়ছিল। তবে বিপরীত উক্তিও আছে। এই যেমন আইফেল টাওয়ারকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবলই লৌহকঙ্কাল বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে এটি আদতে ১ হাজার ৬৩ ফুট উঁচু এক লৌহকঙ্কাল ছাড়া কিছুই নয়। তবে লৌহকঙ্কালটি কাছে গিয়ে দেখতে গিয়ে বুঝলাম প্রায় ৩৩০ মিটার উঁচু এই টাওয়ারটি শুধু একটি স্থাপনা নয়–এটি যেন ফ্রান্সের আত্মার প্রকাশ। প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে টাওয়ারটি মাথার ওপর তাকাতেই প্রথমে যে কথাটি মনে হলো তা হলো– টাওয়ারটি যেন আকাশকে ছুঁয়ে বলছে, ‘আমি প্যারিস, আমি স্বপ্ন’।

প্রতি বছর এই স্বপ্নের টানেই লাখ লাখ মানুষ এখানে আসেন। তাদের দলে এবার শামিল আমিও। ফ্রান্স সরকার এই লৌহকঙ্কালটি এতটাই জোরালোভাবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করছে যে প্যারিসে এসে আইফেল টাওয়ার দর্শন না করলে মনে হবে ফ্রান্স ভ্রমণ বৃথা। আরও বেশি বৃথা মনে হবে যদি আইফেল টাওয়ারে চড়ে প্যারিসের শোভা উপভোগ না করা যায়। যদিও প্যারিসের যেকোনো প্রান্ত থেকে আইফেল টাওয়ার দর্শন সম্ভব। সেটি কেবলই দর্শন। ছুঁয়ে দেখা নয়, উপলব্ধি করা নয়। উভয়ের জন্য এর কাছাকাছি আসতে হবে। টাওয়ারে চড়তে হলে আপনাকে ২৫ ইউরো খরচ করতে হবে। এ জন্য আগে থেকেই টিকিটও কাটতে হবে। 

ছোট একটা তথ্য জানিয়ে রাখি, আইফেল টাওয়ার যখন ১৮৮৯ সালে নির্মিত হয়, তখন সেটিই ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ মানবসৃষ্ট স্থাপনা। টানা ৪১ বছর এই গৌরব ধরে রেখেছিল টাওয়ারটি। সময়ের সঙ্গে বদলেছে প্রযুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি। এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০০ উঁচু ভবনের তালিকায় আইফেল টাওয়ার নেই। উচ্চ ভবন নির্মাণ এখন অনেক দেশের জন্য সম্মান ও প্রতিযোগিতার বিষয়। আকাশ ছোঁয়ার এই দৌড়ে শীর্ষে রয়েছে দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা–উচ্চতা ২ হাজার ৭১৭ ফুট। ভবিষ্যতে এই শীর্ষস্থান কতদিন টিকবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

১৮৮৯ সালের এক বিশ্বমেলার জন্য গুস্তাভ আইফেলের তৈরি এই লোহার কাঠামোটি প্রথমে অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। অনেকেই একে ‘লোহার দানব’ বলে তিরস্কার করেছিল। সময়, ভালোবাসা আর শিল্পবোধ একে করে তুলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শনগুলোর একটি। এমনকি ফ্রান্সের প্রতীক হিসেবেও একে ধরা হয়।

প্যারিসে সূর্য ডুবে রাত ১০টার দিকে। আমরা আইফেল টাওয়ারে পৌঁছেছিলাম বিকেল ৪টায়। চারদিকে তখন সূর্যের তেজহীন কিরণ। সেই কিরণে ছবি তোলার ধুম পড়েছে চারপাশে। যে যার মতো ঢঙে ছবি তুলছেন। কেউ বিয়ের পোশাকেও এসেছেন দেখলাম। মুহূর্তটা আরও রাঙিয়ে তুলতে এখানে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করতে আসা। প্রথম দেখার পর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ। এর আরও কাছাকাছি যেতে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলাম। একটু জানিয়ে রাখি, আইফেল টাওয়ারের পাশেই রয়েছে একটি সবুজ বাগান, সেই বাগানের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি অনন্য স্মৃতিস্তম্ভ–‘শান্তির দেয়াল’। জেরুজালেমের ‘কান্নার দেয়াল’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পী ক্লারা হ্যাল্টার ও স্থপতি জিন মাইকেল উইলমোট এটি নির্মাণ করেন, বিশ্বে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার আশায়। ১৬.

৪ মিটার দীর্ঘ, ১৩.৮ মিটার প্রস্থ ও ৯ মিটার উচ্চতার এই কাঠ ও কাচের দেয়ালে ৪৯টি ভাষায় লেখা রয়েছে ‘শান্তি’। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ৩২টি লোহার দণ্ড যেন বিশ্বমানবতার প্রতীক। ২০০০ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক এর উদ্বোধন করেছিলেন। প্রথমদিকে এই স্মৃতিস্তম্ভে দর্শনার্থীরা কাছাকাছি যেতে পারতেন, শান্তির বাণী লিখতে পারতেন। সেই সুযোগ এখন নেই। স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশে লোহার বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। বলতে গেলে স্মৃতিস্তম্ভের কাছাকাছি যাওয়া নিষেধ। তবে দর্শনার্থী যারা আইফেল টাওয়ার দেখতে আসেন তাদের অনেকেরই এই দুটি স্মৃতিস্তম্ভ চোখে পড়ে না। না পড়ারই কথা। চোখের সামনে এমন বিশাল আইফেল টাওয়ার থাকলে এমনটি হওয়ার কথা। 

হেঁটে হেঁটে একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলাম প্রবাসী আসাদুজ্জামন অভি, শুভ,সাইফুল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান নাফিজ। বলতে গেলে তারা ছিল বলেই প্রেমিকার মত প্যারিস শহর হয়ে উঠেছিল আরও দর্শনীয়। খুটিনাটি বিষয়গুলো তারাই জানিয়ে দিয়েছেন। আইফেল টাওয়ারের অলিগলি তাদের কল্যাণেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখার সুযোগ হয়ে উঠেছিল। 

টাওয়ারের চূড়ায় উঠলাম এলিভেটরে করে। নিচে তাকিয়ে শহরের চিত্র দেখে মনে হলো, আমি যেন কোনো মহাকাব্যের পৃষ্ঠায় বসে আছি। প্যারিস শহরের ছাদগুলো যেন গানে ভরা, সেই গানে ভেসে আসে শিল্প, সাহিত্য, বিপ্লব আর ভালোবাসার স্মৃতি। দূরে সিন নদী, ধীরে বইছে। তার তীরে জড়ো হয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দীর কাহিনি। সেখানে থাকতে থাকতেই যেন সূর্য ডুবু ডুবু ভাব।

অবাক হলাম সূর্য ডুবের যাওয়ার পর। এতক্ষণ যে টাওয়ারকে দেখলাম, যে রূপ দেখলাম সেটি এবার ম্লান। নববধূর মতো নতুন রূপে নতুন সাজে ধরা দিল টাওয়ার। অন্ধকার নামতেই টাওয়ারের গায়ে জ্বলে উঠল হাজারো বাতি, মনে হলো, এটি কোনো লোহার কাঠামো নয়–এ যেন এক জীবন্ত জ্যোতির্ময়ী নারী, শহরের বুকজুড়ে দাঁড়িয়ে প্রেমের ঘোষণা দিচ্ছে। শহরের প্রতিটি প্রান্ত থেকে তাকে দেখছে অসংখ্য চোখ।

পাশে ফরাসি এক বৃদ্ধ দম্পতি একে অপরের হাত ধরে তাকিয়ে আছেন টাওয়ারের দিকে। আমার কেন যেন মনে হতে লাগলো পঞ্চাশ বছর আগে তারা হয়তো এখানেই প্রেমে পড়েছিলেন, যে প্রেমে ডুবে আছেন এখনও....। 


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ রমণ স ম ত স তম ভ প য র স শহর র স মন শহর র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে শান্তির পথ হবে না: ট্রাম্প-পুতিনকে ইউরোপীয় নেতাদের সতর্কবার্তা

ট্রাম্প-পুতিন আগামী সপ্তাহের শীর্ষ বৈঠক নিয়ে ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, সম্ভাব্য চুক্তিতে ইউক্রেনকে তার ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হতে পারে।

এ উদ্বেগ থেকে গতকাল শনিবার রাতে ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রতি রাশিয়ার ওপর চাপ আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ খুঁজে পেতে আগামী শুক্রবার আলাস্কায় বৈঠকে বসবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ওই বৈঠকে যোগ দিতে চাইছেন। ইউক্রেন ও ইউরোপের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, কিয়েভকে অবশ্যই আলোচনার অংশ করতে হবে।

গত শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের ঘোষণা দেওয়ার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘উভয় পক্ষের মঙ্গলের জন্য কিছু ভূখণ্ড অদলবদল করতে হবে।’ এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত আর কিছু বলেননি।

পরদিন গতকাল শনিবার জেলেনস্কি  সতর্ক করে বলেন, শান্তি কেনার জন্য তাঁর দেশ রাশিয়াকে কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেবে না।

ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ বৈঠকের দিন ঘোষণার পর নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে গতকাল শনিবার যুক্তরাজ্যে বৈঠক করেন কিয়েভের মিত্রদেশগুলোর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের প্রতিনিধিরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জেলেনস্কি লেখেন, ‘ইউক্রেনীয়রা দখলদারের কাছে নিজেদের ভূমি দেবে না। আমাদের স্বার্থবিরোধী যেকোনো সিদ্ধান্ত, আর ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্ত হবে শান্তির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত।’

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে ফোনালাপে জেলেনস্কি ইউক্রেনের মিত্রদের প্রতি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘স্পষ্ট পদক্ষেপ’ নেওয়ার আহ্বান জানান।

গতকাল রাতে এক যৌথ বিবৃতিতে ইউরোপীয় নেতারা বলেন, সক্রিয় কূটনীতি, ইউক্রেনকে সহায়তা ও রুশ ফেডারেশনের ওপর চাপ সৃষ্টি—এ তিনটিকে মিলিয়ে একটি যৌথ পদ্ধতিই শুধু রাশিয়ার অবৈধ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে সফল হতে পারে।

ইউরোপের নেতারা ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ইউক্রেনকে সমর্থন অব্যাহত রেখে, পাশাপাশি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ আরোপ ও তা বজায় রেখে তাঁরা ট্রাম্পকে যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত।

ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এ যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি

সম্পর্কিত নিবন্ধ