জুলাই ঘোষণাপত্র বা সনদ ঘিরে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, তার পটভূমিতে এই সনদের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কিছুটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তবে সনদে শেষ পর্যন্ত কী কী থাকবে, এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে আমাদের হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।

৬ জুন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসেই একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপনের আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।

তাঁর বর্ণনায়, ‘এই জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে তারা জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।’

আমরা জানি, গণ-অভ্যুত্থানপ্রসূত অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভাব্য সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ১১টি বিষয়ে কমিশন গঠন করেছিল, প্রথমে ছয়টি এবং পরে আরও পাঁচটি। দুই দফায় গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশমালা জমাও পড়েছে দুটি আলাদা সময়ে। প্রথম পর্যায়ের ছয়টি কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে তাই তখনই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাদের সুপারিশগুলোর কোনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই একমত কিংবা ভিন্নমত থাকলে তা কোথায় এবং আলোচনার মাধ্যমে মতভেদ দূর করার চেষ্টা যে এখন চলছে, তা আমরা সবাই টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের কল্যাণে প্রত্যক্ষ করছি।

যে ছয়টি কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে, সেগুলো হচ্ছে সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন। অন্য যে পাঁচটি কমিশন কাজ করেছে, সেগুলো হচ্ছে গণমাধ্যম, শ্রম খাত, নারী, স্বাস্থ্য খাত ও স্থানীয় সরকার সংস্কারবিষয়ক। দ্বিতীয় দফায় গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ সম্পর্কে ঐকমত্য কমিশনকে কোনো দায়িত্ব না দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, এসব বিষয়ের সংস্কারে কি ঐকমত্যের প্রয়োজন নেই? নাকি ঐকমত্য ছিল এবং আছে, এখন তা শুধু বাস্তবায়নের অপেক্ষা?

ঐকমত্য কমিশন গঠনের দুই থেকে চার মাস পর অন্য কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা হওয়ায় কিছু সংস্কারের প্রস্তাব প্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো ঐকমত্য কমিশনের বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়নি বা তাদের নজরে আনা হয়নি। এখানে সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে গণমাধ্যম কমিশনের একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের কথা বলা যায়।

সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত–অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে ক.

প্রত্যেক নাগরিকের বাক্‌ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং খ. সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

গণমাধ্যম কমিশন সুপারিশ করেছে, বাক্‌স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের বিষয়টি শুধু যুদ্ধাবস্থায় কার্যকর হবে।

আরও পড়ুননির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে এখনই যা করা দরকার১৯ ঘণ্টা আগে

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় সংবাদমাধ্যমের জন্য এই অব্যাহতির বিষয়টি যেহেতু আসেনি, তাই ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়ও এর স্থান নেই। একইভাবে গণমাধ্যম কমিশন সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের মতো সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা এবং সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন না করার অধিকার নিশ্চিত করার বিধান সংবিধানে যুক্ত করার যে প্রস্তাব করেছে, তা আলোচনায় আসছে না। কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের নিজস্ব প্রকাশনায় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রক্ষায় সুইডেনের মতো বিধান করার অঙ্গীকার করেছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আদালতের সমালোচনা করার অধিকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছে। কিন্তু আদালতের সমালোচনা এবং আদালত অবমাননার আইনগত সংজ্ঞায়ন স্পষ্ট করা না হলে তা যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় কত বড় বাধা হয়ে রয়েছে, তা এই পেশায় নিয়োজিতদের চেয়ে কেউ ভালো জানে না। কমিশন তাই আদালত অবমাননার স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন চেয়েছে এবং তা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়ে আলোচিত হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের তৈরি করা বিচার বিভাগ সংস্কারের সারসংক্ষেপে বিষয়টির কোনো উল্লেখ না থাকা হতাশারই বলতে হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, তার তালিকা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই পাঠানো হয়েছে। সবার জন্য তা কেন উন্মুক্ত করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার তালিকায় অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ সংশোধনের কথাও আছে এবং প্রস্তাবটি এসেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের তালিকা থেকে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, উন্মুক্ত তথ্যনীতির অংশ হিসেবে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে যুগোপযোগী করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংশোধন কী বা একাধিক সংশোধনী প্রয়োজন কি না, তার উল্লেখ নেই। বিষয়টি গণমাধ্যমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সে কারণে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বলেছে, এ আইনের ৫ ধারা সংশোধন করে কেবল জাতীয় নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া উচিত এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য জনস্বার্থের প্রশ্নে আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা সংযোজন করা উচিত।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ অংশে সুপারিশ আছে ৪০টি, যেগুলো ঐকমত্য কমিশন সারসংক্ষেপ আকারে মোটাদাগে পাঁচটিতে এনে দলগুলোর কাছে তুলে ধরেছে। তাদের মূল সুপারিশে আছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতায় কোনো ধরনের সীমা আরোপ করা যাবে না, কিন্তু সারসংক্ষেপে তার উল্লেখ নেই। ঐকমত্যের আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা মূল সুপারিশগুলো আত্মস্থ না করে থাকলে সারসংক্ষেপ ধরে মতামত দিলে সমঝোতায় ঘাটতি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য যে অনেক দিন ধরেই রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যেমন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্প্রচারমাধ্যম—বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে তিন জোটের যে যৌথ ঘোষণা ছিল, তাতে এগুলোর স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু কেউ তা বাস্তবায়ন করেনি। এরপর যতবারই সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন হয়েছে, প্রতিবারেই এই স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়েছে।

কিন্তু এসব কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে এমন বিষয়ও আছে, যেগুলো সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর সবার অবস্থান স্পষ্ট নয়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈপরীত্যপূর্ণ। কিছু সংস্কারের প্রস্তাব অপরিসীম গুরুত্বের দাবি রাখে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ, তাই সেগুলোর জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।

ন্যূনতম জাতীয় মজুরি কিংবা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে শ্রম খাতের সংকট দূর হবে কীভাবে? নতুন বন্দোবস্তের বাংলাদেশে এসব বিষয়ে শ্রমিকেরা কার কাছে তাঁদের হিস্যা চাইবেন? তাঁরা কাউকে কি প্রশ্ন করার সুযোগ পাবেন?

জুলাই সনদের যে আলোচনা, তার মূলে আছে বিদ্যমান রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামো এবং পদ্ধতিগুলোর মধ্যে যেগুলো অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ তৈরি করে দেয়, সেগুলো বদলে দিয়ে গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, সংসদ, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও স্বৈরতন্ত্রের সহায়ক হাতিয়ার করে ফেলা হয়েছিল কিংবা তাদের অনেকে উৎসাহী সহযোগী হয়ে উঠেছিল। এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হলে তা জনস্বার্থের বদলে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বার্থকেই রক্ষা করে চলবে। গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করে তোলায় মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট নয়। ব্যক্তি খাতে গণমাধ্যমে কালোটাকার দৌরাত্ম্য, প্রভাবক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং নৈতিক মানের অনুপস্থিতির মতো বিষয়গুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, তার তালিকা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই পাঠানো হয়েছে। সবার জন্য তা কেন উন্মুক্ত করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়। এই তালিকায় নেই, কিন্তু যেসব বিষয়ে পরিবর্তন না আনলে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ তো দূরের কথা; গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনও সম্ভব নয়, গণমাধ্যমের সংস্কার সে রকম একটি বিষয়। গণমাধ্যম কীভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে, তার বিশদ আলোচনা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে রয়েছে।

গণমাধ্যম সংস্কারের বিষয়টিকে তাই অগ্রাধিকার তালিকায় পেছনে ফেলে রাখা ভুল হবে। অন্তত যেসব সংস্কার জরুরি কিন্তু সময়সাপেক্ষ হতে পারে, সেগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্পষ্ট অঙ্গীকার প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে জুলাই সনদে তার স্থান হবে কি?

কামাল আহমেদ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান

* মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক র প রস র প রস ত ব স রস ক ষ প র স ব ধ নত জ ল ই সনদ ব যবস থ প রক শ র জন য ব ষয়ট সমঝ ত

এছাড়াও পড়ুন:

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ জাতির সঙ্গে প্রতারণা: বাম জোট

জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে জাতির সঙ্গে প্রতারণা বলে আখ্যা দিয়েছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। এই ভাষণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে দেশকে দীর্ঘস্থায়ী সংকটে ঠেলে দেবে বলেও মন্তব্য করেছেন তাঁরা।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে বাম জোটের নেতারা এমন মন্তব্য করেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) একমত হওয়াকেই যদি সবার ঐকমত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তা এত দিন ধরে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠককেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।’

বাম জোটের নেতারা বলেন, সনদ বাস্তবায়নের জন্য ঐকমত্য কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণেও একই কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত মতামত উঠে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের যে ন্যূনতম সংস্কারটুকু করার সুযোগ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল, তা–ও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ১৮০ দিন জাতীয় সংসদ দ্বৈত সত্তা নিয়ে চলবে অর্থাৎ একই সঙ্গে সংসদ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করার যে কথা বলা হয়েছে; এটাও সংবিধান পরিপন্থী। এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনে কোনো আলোচনা হয়নি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো ঐকমত্য হয়নি।

বিবৃতিতে নেতারা বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণভোট ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ নিয়ে যে কথা প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে বলেছেন, তা একদেশদর্শী ও সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধানে আদেশ জারি বা গণভোটের কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্রপতি কেবল অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে সংবিধান পরিপন্থী কাজ করা হয়েছে।

বাম জোটের নেতারা বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে গণভোট ও আদেশ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তাতে দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টের (দ্বিমতের) উল্লেখ থাকছে না। ঐকমত্য কমিশনে সংবিধানসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাবের মধ্যে ৩০টিতে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলে প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন—এ তথ্যও সঠিক নয়। ৩০টি প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, এ রকম প্রস্তাব ১১টির বেশি নয়।

এ ছাড়া বিবৃতিতে লালদিয়ার চরে ডেনমার্কের কোম্পানিকে বন্দর নির্মাণ এবং পানগাঁও টার্মিনাল সুইজারল্যান্ডের কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোটের উদ্যোগে আগামী রোববার দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে কেন সরকার একের পর এক আমাদের লাভজনক বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে অতি তৎপর হয়ে উঠেছে, তা দেশবাসীর মনে গভীর সন্দেহ সৃষ্টি করছে। এ ধরনের প্রকল্পে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক নানা ঝুঁকি থাকে। দেশের নানা মহল থেকে বারবার সেই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হলেও সরকার সেদিকে কর্ণপাত না করে আগের স্বৈরাচার সরকারের বন্দর ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।’

বাম জোটের নেতাদের বিবৃতিতে উঠে আসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি। তাঁরা বলেন, মব সন্ত্রাস লাগামছাড়া, নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে, উগ্র মৌলবাদী তৎপরতা সমাজজীবনকে বিষিয়ে তুলছে, দিনদুপুরে ফিল্মি কায়দায় গুলি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, মানুষের বেঁচে থাকার উপায়ের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। আর এই সুযোগে পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি নানা ধরনের গুপ্ত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে জনজীবনে এক চরম নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সরকারের গত ১৫ মাসের কর্মকাণ্ডই এই পতিত শক্তিকে জনপরিসরে স্থান করে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ বাম জোটের নেতাদের।

গণভোট ও উচ্চকক্ষ অপ্রয়োজনীয় এবং জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে—এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে বাম জোটের নেতারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কেবল একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদেরই। তাই কালবিলম্ব না করে দ্রুত নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করুন। দেশের বন্দরসহ জাতীয় সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ থেকে বিরত থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো প্রতিকারে উদ্যোগ নিন।’

বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আবদুল আলীর পক্ষ থেকে বিবৃতিটি পাঠানো হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সফল নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিক উত্তরণের অর্ধেকপথ পার করা সম্ভব হবে: মান্না
  • কী হবে যদি গণভোটে ‘না’ জয়ী হয়
  • প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ জাতির সঙ্গে প্রতারণা: বাম জোট
  • ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি রুখতে বামপন্থি সরকার গড়তে হবে: সেলিম
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে কোন দলের দাবি কতটা রাখা হলো