জুলাই ঘোষণাপত্র বা সনদ ঘিরে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, তার পটভূমিতে এই সনদের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কিছুটা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তবে সনদে শেষ পর্যন্ত কী কী থাকবে, এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে আমাদের হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।

৬ জুন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই মাসেই একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপনের আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।

তাঁর বর্ণনায়, ‘এই জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কটিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে তারা জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।’

আমরা জানি, গণ-অভ্যুত্থানপ্রসূত অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভাব্য সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ১১টি বিষয়ে কমিশন গঠন করেছিল, প্রথমে ছয়টি এবং পরে আরও পাঁচটি। দুই দফায় গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশমালা জমাও পড়েছে দুটি আলাদা সময়ে। প্রথম পর্যায়ের ছয়টি কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে তাই তখনই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাদের সুপারিশগুলোর কোনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই একমত কিংবা ভিন্নমত থাকলে তা কোথায় এবং আলোচনার মাধ্যমে মতভেদ দূর করার চেষ্টা যে এখন চলছে, তা আমরা সবাই টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের কল্যাণে প্রত্যক্ষ করছি।

যে ছয়টি কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে, সেগুলো হচ্ছে সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন। অন্য যে পাঁচটি কমিশন কাজ করেছে, সেগুলো হচ্ছে গণমাধ্যম, শ্রম খাত, নারী, স্বাস্থ্য খাত ও স্থানীয় সরকার সংস্কারবিষয়ক। দ্বিতীয় দফায় গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ সম্পর্কে ঐকমত্য কমিশনকে কোনো দায়িত্ব না দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, এসব বিষয়ের সংস্কারে কি ঐকমত্যের প্রয়োজন নেই? নাকি ঐকমত্য ছিল এবং আছে, এখন তা শুধু বাস্তবায়নের অপেক্ষা?

ঐকমত্য কমিশন গঠনের দুই থেকে চার মাস পর অন্য কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা হওয়ায় কিছু সংস্কারের প্রস্তাব প্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো ঐকমত্য কমিশনের বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়নি বা তাদের নজরে আনা হয়নি। এখানে সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে গণমাধ্যম কমিশনের একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের কথা বলা যায়।

সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত–অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে ক.

প্রত্যেক নাগরিকের বাক্‌ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং খ. সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’

গণমাধ্যম কমিশন সুপারিশ করেছে, বাক্‌স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের বিষয়টি শুধু যুদ্ধাবস্থায় কার্যকর হবে।

আরও পড়ুননির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে এখনই যা করা দরকার১৯ ঘণ্টা আগে

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় সংবাদমাধ্যমের জন্য এই অব্যাহতির বিষয়টি যেহেতু আসেনি, তাই ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়ও এর স্থান নেই। একইভাবে গণমাধ্যম কমিশন সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের মতো সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা এবং সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন না করার অধিকার নিশ্চিত করার বিধান সংবিধানে যুক্ত করার যে প্রস্তাব করেছে, তা আলোচনায় আসছে না। কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের নিজস্ব প্রকাশনায় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রক্ষায় সুইডেনের মতো বিধান করার অঙ্গীকার করেছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আদালতের সমালোচনা করার অধিকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছে। কিন্তু আদালতের সমালোচনা এবং আদালত অবমাননার আইনগত সংজ্ঞায়ন স্পষ্ট করা না হলে তা যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় কত বড় বাধা হয়ে রয়েছে, তা এই পেশায় নিয়োজিতদের চেয়ে কেউ ভালো জানে না। কমিশন তাই আদালত অবমাননার স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন চেয়েছে এবং তা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময়ে আলোচিত হয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের তৈরি করা বিচার বিভাগ সংস্কারের সারসংক্ষেপে বিষয়টির কোনো উল্লেখ না থাকা হতাশারই বলতে হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, তার তালিকা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই পাঠানো হয়েছে। সবার জন্য তা কেন উন্মুক্ত করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার তালিকায় অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ সংশোধনের কথাও আছে এবং প্রস্তাবটি এসেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের তালিকা থেকে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, উন্মুক্ত তথ্যনীতির অংশ হিসেবে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে যুগোপযোগী করার কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংশোধন কী বা একাধিক সংশোধনী প্রয়োজন কি না, তার উল্লেখ নেই। বিষয়টি গণমাধ্যমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সে কারণে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বলেছে, এ আইনের ৫ ধারা সংশোধন করে কেবল জাতীয় নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া উচিত এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য জনস্বার্থের প্রশ্নে আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা সংযোজন করা উচিত।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ অংশে সুপারিশ আছে ৪০টি, যেগুলো ঐকমত্য কমিশন সারসংক্ষেপ আকারে মোটাদাগে পাঁচটিতে এনে দলগুলোর কাছে তুলে ধরেছে। তাদের মূল সুপারিশে আছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতায় কোনো ধরনের সীমা আরোপ করা যাবে না, কিন্তু সারসংক্ষেপে তার উল্লেখ নেই। ঐকমত্যের আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা মূল সুপারিশগুলো আত্মস্থ না করে থাকলে সারসংক্ষেপ ধরে মতামত দিলে সমঝোতায় ঘাটতি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য যে অনেক দিন ধরেই রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যেমন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্প্রচারমাধ্যম—বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে তিন জোটের যে যৌথ ঘোষণা ছিল, তাতে এগুলোর স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু কেউ তা বাস্তবায়ন করেনি। এরপর যতবারই সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন হয়েছে, প্রতিবারেই এই স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়েছে।

কিন্তু এসব কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে এমন বিষয়ও আছে, যেগুলো সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর সবার অবস্থান স্পষ্ট নয়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈপরীত্যপূর্ণ। কিছু সংস্কারের প্রস্তাব অপরিসীম গুরুত্বের দাবি রাখে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ, তাই সেগুলোর জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।

ন্যূনতম জাতীয় মজুরি কিংবা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে শ্রম খাতের সংকট দূর হবে কীভাবে? নতুন বন্দোবস্তের বাংলাদেশে এসব বিষয়ে শ্রমিকেরা কার কাছে তাঁদের হিস্যা চাইবেন? তাঁরা কাউকে কি প্রশ্ন করার সুযোগ পাবেন?

জুলাই সনদের যে আলোচনা, তার মূলে আছে বিদ্যমান রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামো এবং পদ্ধতিগুলোর মধ্যে যেগুলো অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ তৈরি করে দেয়, সেগুলো বদলে দিয়ে গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, সংসদ, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও স্বৈরতন্ত্রের সহায়ক হাতিয়ার করে ফেলা হয়েছিল কিংবা তাদের অনেকে উৎসাহী সহযোগী হয়ে উঠেছিল। এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হলে তা জনস্বার্থের বদলে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বার্থকেই রক্ষা করে চলবে। গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করে তোলায় মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট নয়। ব্যক্তি খাতে গণমাধ্যমে কালোটাকার দৌরাত্ম্য, প্রভাবক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং নৈতিক মানের অনুপস্থিতির মতো বিষয়গুলোতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, তার তালিকা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই পাঠানো হয়েছে। সবার জন্য তা কেন উন্মুক্ত করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়। এই তালিকায় নেই, কিন্তু যেসব বিষয়ে পরিবর্তন না আনলে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ তো দূরের কথা; গ্রহণযোগ্য, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনও সম্ভব নয়, গণমাধ্যমের সংস্কার সে রকম একটি বিষয়। গণমাধ্যম কীভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে, তার বিশদ আলোচনা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে রয়েছে।

গণমাধ্যম সংস্কারের বিষয়টিকে তাই অগ্রাধিকার তালিকায় পেছনে ফেলে রাখা ভুল হবে। অন্তত যেসব সংস্কার জরুরি কিন্তু সময়সাপেক্ষ হতে পারে, সেগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্পষ্ট অঙ্গীকার প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে জুলাই সনদে তার স্থান হবে কি?

কামাল আহমেদ সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান

* মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক র প রস র প রস ত ব স রস ক ষ প র স ব ধ নত জ ল ই সনদ ব যবস থ প রক শ র জন য ব ষয়ট সমঝ ত

এছাড়াও পড়ুন:

সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটে বাধা রাজনৈতিক দলগুলো

নির্বাচন কমিশন, খান ফাউন্ডেশনের ‘‘এমপাওয়ারিং উইমেন থ্রু রির্জাভড সিট ইন পার্লামেন্ট: ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স?’ (সংসদে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ণ: লড়াই নাকি পালানোর প্রবণতা?’ শিরোনামের গবেষণা প্রতিবেদন, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের বিভিন্ন নিউজ লেটার ও প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৯৭৩-১৯৭৫ মেয়াদের প্রথম জাতীয় সংসদে ১৫টি সংরক্ষিত আসনের প্রতিনিধিরাই ছিলেন সংসদের নারী প্রতিনিধিত্ব। ১৯৭৯-১৯৮২ মেয়াদে দ্বিতীয় সংসদে ২ জন নির্বাচিত ও ৩০টি নারী আসন মিলিয়ে মোট ৩২ জন নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৮৮-৯০ মেয়াদে চতুর্থ সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল না। ৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৯১-১৯৯৫ মেয়াদে পঞ্চম সংসদে ৫ জন নির্বাচিত সহ ৩৫ জন নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপির এক তরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন। ৩০টি সংরক্ষিত আসন ছিল। ওই নির্বাচনটি বাতিল হয়ে ওই বছরের জুন মাসে (১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে) ৭ম সংসদ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে সরাসরি নির্বাচিত ৮ নারীসহ মোট নারী প্রতিনিধি ছিলেন ৩৮ জন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে ৭টি আসনে সরাসরি ও ৪৫টি সংরক্ষিত আসনসহ মোট ৫২ জন নারী সংসদ সদস্য হন। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদের নবম জাতীয় সংসদে ২১ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন। তবে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের মমতাজ ইকবাল মারা গেলে ওই আসনের উপ নির্বাচনে পুরুষ নির্বাচিত হন। ওই মেয়াদে নারী আসন বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়। মোট নারী সংসদ সদস্য হন ৭০ জন। আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪ এর দশম, একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন ছিল একতরফা ও বির্তকিত। দশম জাতীয় নির্বাচনে ১৮ জন সরাসরি সহ মোট নারী সংসদ সদস্য ছিলেন ৬৮ জন, ২০১৮ সালে ২৩ জন সরাসরি নির্বাচিতসহ মোট ৭৩ জন ও ২০২৪ সালে ১৯ জন সরাসরি নির্বাচিতসহ মোট ৬৯ জন নারী প্রতিনিধি ছিলেন।

দলগুলোর মনোভাব

নারী আসন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করতে হবে এবং আগের মতো করে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনসংখ্যার ভিত্তিতে দলগুলোর মধ্যে এসব আসন বিতরণ করতে হবে।

জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, তাঁরা পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংসদীয় আসন ৪০০টি এবং এর মধ্যে ১০০টি নারী আসনের বিষয়ে একমত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধিরা ১০০ নারী আসনে সারসরি নির্বাচনের পক্ষে। তবে পরে তাঁরা নারী আসনের বিষয়ে একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন। সেখানে বলেছেন, প্রতিটি দল ১০-১৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। তাতে ৩৫০-৪০০ নারী প্রার্থী পাওয়া যাবে। যাঁরা নির্বাচনে জয়ী হবেন, তাঁরা সংসদ সদস্য হবেন। আর যেসব নারী প্রার্থী পরাজিত হবেন, তাঁদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ১০০ জন হবেন সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য।

অন্যদিকে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা। এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা। সেসব আসনে নারী প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পরে জমা হওয়ায় তাদের সুপারিশ কমিশনের টার্মস অব রেফারেন্স বা কাজের পরিধিতে অর্ন্তভুক্ত করা যায়নি বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। ফলে দলগুলোর সঙ্গে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আবার সংসদের আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা এবং এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব দেশের বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলেও বিভিন্ন দলের নেতারা মনে করেন।

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, নারী আসনের বিষয়ে কোনো সম্মানজনক উপায় বের হয়নি, এটা দুঃখজনক। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থায় দলগুলোর অনাগ্রহের বড় কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা বা বেশিসংখ্যক নারীকে সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া—বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেই।

সামান্তা শারমিন বলেন, প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানির মাধ্যমে, দুর্নীতি করে, প্রচুর অর্থ খরচ করে নির্বাচনে জিতে আসেন অনেকে। আরেকটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক নারীকে সংরক্ষিত আসনে জায়গা দেওয়া হয়। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংসদে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা। এর মধ্যে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা। সেসব আসনে নারী প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে।‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটে সীমাবদ্ধ

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনগুলোর নাম ‘সংরক্ষিত মহিলা আসন’। ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। সংরক্ষিত আসনের সুবিধা প্রথমে ১০ বছরের জন্য রাখা হয়েছিল। পরে ১৯৭৮ সালে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৩০। একই সঙ্গে ১০ বছরের মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ বছর করা হয়। ১৯৮৭ সালে সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন ছিল না।

এরপর ১৯৯০ সালে ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ২০০১ সালে অষ্টম সংসদের শুরুতে সংরক্ষিত আসন ছিল না। পরে এই সংসদেই সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর (২০০৪ সালে) মাধ্যমে ১০ বছর মেয়াদে নারী আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়। ওই সময় সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়। সংসদে একটি রাজনৈতিক দলের কতজন প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই অনুপাতে ওই সংরক্ষিত আসনের কয়টি দল পাবে, তা নির্ধারিত হয়। দলগুলোর নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ভোট দিয়ে নিজ নিজ দলের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের নির্বাচিত করেন। নবম সংসদে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নারী আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়।

এবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারীর আসন নিয়ে পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নিলেন। খুব হতাশ হয়েছি যে একটি নারীকে জোগাড় করা গেল না আলোচনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য! এটাকে দলের ব্যর্থতা, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলব, বুঝতে পারছি না।রুমিন ফারহানা, সাবেক সংসদ সদস্য, বিএনপি

আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতোই মাসিক বেতন–ভাতা, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি কেনাসহ অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা পান।

বিগত সময়ে সংরক্ষিত আসনে যাঁরা নারী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, দু–একজন ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগের ভূমিকা সংসদে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দলের প্রতি আনুগত থাকা, বিরাগভাজন না হয়ে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আবারও মনোনীত হওয়ার সুযোগ খোলা রাখার জন্য বেশির ভাগ নারী সদস্য চুপ থাকাকেই ‘নিরাপদ’ বলে ভেবেছেন। এমনকি নারী নির্যাতনের আলোচিত ঘটনাতেও তাঁদের সংসদে খুব একটা সোচ্চার হতে দেখা যায়নি।

নারী আসনের বিষয়ে কোনো সম্মানজনক উপায় বের হয়নি, এটা দুঃখজনক। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থায় দলগুলোর অনাগ্রহের বড় কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা বা বেশিসংখ্যক নারীকে সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া—বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেই।এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন

একাদশ সংসদে (২০১৮ মেয়াদে) সংরক্ষিত আসনে বিএনপি মনোনীত একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন রুমিন ফারহানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫৩ বছর ধরে সময়ে–সময়ে নারী আসনসংখ্যা বাড়ানো হলো। কিন্তু নারী আসন কোনোভাবেই নারীর পথকে সুগম করেনি, প্রশস্ত করেনি। অনেক নেতা পরিবারের নারী সদস্যদের সেসব আসনে বসিয়ে সুবিধা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নারীর আসন নিয়ে পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নিলেন। খুব হতাশ হয়েছি যে একটি নারীকে জোগাড় করা গেল না আলোচনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য! এটাকে দলের ব্যর্থতা, নাকি নেতৃত্বের ব্যর্থতা বলব, বুঝতে পারছি না।’

নারীর প্রশ্নে গোষ্ঠীস্বার্থ না দেখে নারীর স্বার্থ দেখতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। তারা বলছে, জুলাইয়ে নারীরা ছিল সামনের সারিতে। এই নারীদের আর হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীকে রাখতে হবে। নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ রাখতে হবে।

নারী আসন নিয়ে নারীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে নারীদের জন্য আসন বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলা হলেও তারা তা শোনেনি। কমিশন রাজনৈতিক দলকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। নারী আসন নিয়ে নারীদের দাবি পূরণের আর সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ দাবি পূরণে এখন নাগরিক সমাজকে সক্রিয় হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংস্কার: বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে ঐকমত্য কমি
  • ‘আলংকারিক’ রাষ্ট্রপতিকে এভাবে ক্ষমতায়নের চেষ্টা নজিরবিহীন
  • নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে আবারও আলোচনায় বসতে হবে
  • প্রায় এক বছরেও নির্বাচন নিয়ে সংলাপের কোনো উদ্যোগ নেই: এবি পার্টি
  • নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘একটা অঘটন ঘটে গেছে’: বদিউল আলম মজুমদার
  • বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ভর করছে দলগুলোর ওপর
  • ঐকমত্য কমিশন বয়েজ ক্লাব: শাহীন আনাম
  • সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটে বাধা রাজনৈতিক দলগুলো
  • রাজনীতিতে পরিবর্তন ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আগামী সপ্তাহে আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন