অনলাইন জীবন আমাদের আসল সম্পর্কগুলোকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে
Published: 16th, September 2025 GMT
সময়টা এখন পুরোপুরি ডিজিটাল। হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন, ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেট—এই বাস্তবতা ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। দূরের মানুষকে কাছে টেনে আনা, কাজের গতি বাড়ানো, জ্ঞান আহরণের সহজ পথ তৈরি করা—এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে। তবে এই একই জীবন আমাদের সম্পর্কের ভেতর অদ্ভুত এক ফাঁকও তৈরি করছে। প্রশ্ন উঠছে—আমরা কি আসলেই কাছের মানুষকে কাছে পাচ্ছি, নাকি কেবল পর্দার ভেতরে হারিয়ে ফেলছি?
সংযোগের নতুন দিকডিজিটাল জীবনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সহজ সংযোগ। প্রবাসে থাকা সন্তান প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অনলাইনে হার্ভার্ডের লেকচার শুনছে, কিংবা চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা ফেসবুক পেজ থেকে পুরো ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলছে—এসব চিত্র এখন আমাদের কাছে সাধারণ।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, ২০২৫ সালের শুরুতে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ কোটি। এ সংখ্যাটা শুধু প্রযুক্তি ব্যবহারের অগ্রগতি নয়, বরং সম্পর্ক ও জীবনের মানচিত্রও পাল্টে দিচ্ছে।
ডিজিটাল জীবন আমাদের জীবনে অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে—
* দূরত্বের সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা এখন অনেক সহজ। প্রতিদিন ভিডিও কলে হাসিমুখ দেখা যায়।
* শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন হয়েছে অনেক সহজলভ্য। অনলাইন মাধ্যম থেকে হাজারো মানুষ নতুন নতুন বিষয় শিখছে।
* সামাজিক আন্দোলন বা মানবিক উদ্যোগেও অনলাইন বড় ভূমিকা রাখছে। বন্যা বা দুর্যোগে অনলাইন তহবিল সংগ্রহ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
* ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ফেসবুক-ভিত্তিক ব্যবসা এক নতুন যুগের সূচনা করেছে।
এই দিকগুলো বলছে, ডিজিটাল জীবন আমাদের সামনে অফুরন্ত সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে।
তবে অন্য বাস্তবতাও কম চোখে পড়ে না। আগে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে আড্ডা ছিল নিয়মিত। এখন তারা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মিম শেয়ার করে হাসাহাসি করে। আগে রাতে পরিবারের সবাই মিলে বসে গল্প করত, এখন প্রত্যেকে ব্যস্ত নিজের ফোনের পর্দায়।
বাস্তব উদাহরণ দিই। এক বন্ধুর বিয়ে হলো ঢাকায়। আমি তখন বিদেশে। পুরো অনুষ্ঠান মেসেঞ্জারে লাইভ দেখলাম। মনে হলো আমি তাঁদের সঙ্গেই আছি। কিন্তু সত্যিই কি তাই? হাসির শব্দ, গানের তালে নাচ, ফুলের ঘ্রাণ—এসব কি ফোনের পর্দায় ধরা যায়?
অন্ধকার দিকডিজিটাল জীবনের এই উল্টোপিঠটা উপেক্ষা করা যায় না।
* মানসিক চাপ ও হিংসা: ফেসবুকে অন্যদের সুখী ছবি দেখে অনেকে ভাবে, তার জীবন নষ্ট। এতে হতাশা ও বিষণ্নতা বাড়ছে।
* আসক্তি: জরিপ বলছে, বাংলাদেশের তরুণেরা প্রতিদিন গড়ে ৩-৪ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটায়।
* পারিবারিক দূরত্ব: একসঙ্গে বসেও পরিবারে প্রত্যেকে মোবাইলে ডুবে থাকে। চোখের ভাষা, আন্তরিক আলাপ হারিয়ে যাচ্ছে।
* গোপনীয়তার ঝুঁকি: অনলাইন আসক্তি শুধু সম্পর্ক নয়, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
বাস্তব জীবনের চিত্রঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রী বলছিল—সে আর তার মায়ের মধ্যে এখন কথাবার্তা হয় কম। মা সারা দিন ফেসবুকে ব্যস্ত, আর সে টিকটক দেখে সময় কাটায়। একই ঘরে থেকেও যেন তাঁরা দুই ভিন্ন জগতের বাসিন্দা।
আরেক পরিচিতজনের অভ্যাস ছিল অফিস থেকে ফিরে ছেলেকে গল্প শোনানো। এখন ক্লান্তি কাটাতে সে ইউটিউবে ডুবে যায়। ছেলে অভ্যস্ত হয়েছে ট্যাব দেখে ঘুমাতে। এই ছোট্ট উদাহরণগুলোই আসল সমস্যার ইঙ্গিত দেয়—বাস্তব সম্পর্ক হারিয়ে গিয়ে ভার্চ্যুয়াল বিনোদন জায়গা দখল করছে।
দ্বিমুখী রূপতাহলে ডিজিটাল জীবন কি ভালো না খারাপ? উত্তরটা এত সরল নয়। এটা আসলে দ্বিমুখী রূপ। একদিকে আমাদের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিচ্ছে, কাজ সহজ করছে, নতুন দিক খুলছে। অন্যদিকে বাস্তব মানবিক সংযোগকে হালকা করে দিচ্ছে। অর্থাৎ ডিজিটাল দুনিয়া একদিকে আমাদের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, আবার অন্যদিকে আলগোছে টেনে নিচ্ছে।
করণীয়* ডিজিটাল সীমা নির্ধারণ: প্রতিদিন কতক্ষণ অনলাইনে থাকব, তার একটা সীমা ঠিক করতে হবে।
* পারিবারিক সময় ফিরিয়ে আনা: দিনে অন্তত আধঘণ্টা ফোন ছাড়া সবাই একসঙ্গে গল্প করা।
* বাস্তব যোগাযোগের চর্চা: বন্ধুদের শুধু অনলাইনে নয়, সামনে বসে আড্ডার অভ্যাস ফিরিয়ে আনা।
* মানসিক সচেতনতা: অনলাইনের ঝলমলে দুনিয়া দেখে নিজের জীবনকে ছোট মনে না করা।
উপসংহারডিজিটাল জীবন আমাদের জীবনকে সহজ ও গতিশীল করেছে—এটা সত্য। কিন্তু যদি এই জীবন আমাদের বাস্তব সম্পর্কগুলোকে দুর্বল করে দেয়, তবে সেটা বড় ক্ষতি। অনলাইন যোগাযোগ প্রয়োজনীয়, তবে মানবিক সম্পর্কের বিকল্প নয়।
দিনের শেষে একটা আলিঙ্গন, একসঙ্গে হাসাহাসি বা পাশে বসে চায়ের কাপ ভাগাভাগি করা—এসবই জীবনের আসল মানে। ডিজিটাল জীবন সেই বাস্তবতাকে পরিপূর্ণ করতে পারে, কিন্তু প্রতিস্থাপন করতে পারে না।
লেখক: শিক্ষক, সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড জ ট ল জ বন জ বন র ফ সব ক র জ বন
এছাড়াও পড়ুন:
একসঙ্গে জন্ম দেওয়া মোকসেদার ছয় সন্তানের পাঁচজনই মারা গেল
একসঙ্গে জন্ম দেওয়া মোকসেদা আক্তারের ছয় সন্তানের মধ্যে পাঁচজনই মারা গেল। গতকাল রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে জন্ম নেওয়ার পরপরই একটি শিশু মারা যায়। আজ সোমবার দুপুর পর্যন্ত চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে আরও চার নবজাতকের মৃত্যু হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কর্মকর্তা মো. ফারুক প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার খাজুরিয়া গ্রামের মোকসেদা আক্তার রোববার সকালে একসঙ্গে এই ছয় সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর স্বামী মো. হানিফ কাতারপ্রবাসী। মোকসেদা আক্তারের ননদ লিপি বেগম আজ প্রথম আলোকে বলেন, বেঁচে থাকা একমাত্র নবজাতকের অবস্থাও বেশি ভালো নয়।
ঢামেক হাসপাতালের গাইনি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মোকসেদা তিন ছেলে ও তিন মেয়েসন্তান প্রসব করেন। সন্তানেরা ২৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই জন্ম নেয়। জন্মের সময় প্রত্যেকের ওজন ছিল ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রামে মধ্যে। এ কারণে তাদের সবার অবস্থাই ছিল সংকটজনক।
আরও পড়ুনঢাকা মেডিকেলে একসঙ্গে ছয় সন্তানের জন্ম, নবজাতকদের অবস্থা সংকটাপন্ন২২ ঘণ্টা আগেঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক বিভাগে আইসিইউতে পর্যাপ্ত শয্যা খালি না থাকায় তিনজনকে অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে বেঁচে থাকা একমাত্র নবজাতকটি বেসরকারি হাসপাতালে আছে।