কতটা এগোল বাংলা কবিতা-কতটা এগোল বাংলাদেশ? এই প্রশ্নের উত্তরে কি আশাবাদের দেখা মেলে; নাকি কেবল হতাশায় প্রতিধ্বনিত হয়? সেই কবে আহসান হাবীব ‘আমার সন্তান’ কবিতায় লিখেছিলেন-“ও পথে নিশ্চিত মৃত্যু বলে আমি যখন আবার/অসহায় শিশুর মতোই কাঁদতে থাকি/ তখন বয়স্ক কোনো পিতার কণ্ঠস্বওে খোকা বলে/ ‘মৃত্যুই জীবন’। এবং সে আরো বলে/তুমি আর হাতের আড়ালে রেখো না আমার হাত/ভয়ের কাফনে জড়িয়ে রেখো না আর/অন্ধকার ছড়িয়ে রেখো না/আমার দু চোখে পিতা/তোমার চারপাশে বড় অন্ধকার তাই/ সামনে যাব/আরো সামনে/সূর্যোদয়ে যাব।” আমাদের সূযোদয়ে যাওয়া কতদূর? নিদেনপক্ষে আমরা কি ধাবমান আছি সূর্যোদয়ের পথে? বাংলা ভাষায় নতুন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের কি দেখা মিলল?

স্বাধীনতাত্তোর বাংলা কবিতায় এখনও স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ের কবিদের প্রাধান্য, রাজর্ষি রূপে বিরাজমান। কবিতার প্রসঙ্গে, আলাপেসালাপে, গবেষণায় এখনও উনারাই কেন্দ্রীয় স্রষ্টা। সর্বত্র উনাদেরই আনাগোনা, গতায়াত। অথচ কবির সংখ্যা স্বাধীন বাংলাদেশে অপ্রতুল নয় মোটেই। কাকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমলেও, কবির সংখ্যা হ্রাস নিয়ে-নেই উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। উল্টো বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন ওঠানো যেতে পারে পরিবার-পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে, যৌক্তিকভাবেই। হতে পারে সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল, অবরোধ-অনশন ও স্মারকলিপি পেশ, সঙ্গতকারণেই।

আরো পড়ুন:

পেটমোটা হটপট 

‘লেখক হয়ে উঠতে পারা বড় সাধনার বিষয়’

বাংলা ভাষার এখনকার কবিরা সৃষ্টির আনন্দ খুঁজে দশকের বৃত্তে, সমগ্রতায় নয়। অথচ ত্রিশের দশক (গত শতাব্দীর তিন-এর দশক) একাই ভেংচি কেটেছিল পূর্ববর্তী সকল কবিদের বিরুদ্ধে। না, কোনো অসূয়ক বৃত্তিতে নয়, নতুন সৃষ্টির আনন্দে। পুরাতনের মধ্যে পুনরাবৃত্তি নয়, পুরাতনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে। পুত্র যেমন পিতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে দান করে গর্ব ও গৌরব, ঠিক তেমনি। কিন্তু সেই ঐশ্বর্যের ধারক হয়েও বাংলা ভাষার বাংলাদেশের কবিরা আজ সূর্যোদয়ে যাওয়ার অভীপ্সা ধারণে অনীহ।

‘বিপজ্জনক’ কবিতায় আবু হেনা মোস্তফা কামাল লিখেছেন: ‘যেসব সাহসী সারস অনন্ত জলাভূমি পেরিয়ে/ নতুন মহাদেশের খোঁজে উড়ে যাবে বলে কথা ছিলো/ নিজেরাই ডানা ছেঁটে তারা ইদানীং/বারান্দায় আড্ডা দেয় সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে/মোতিঝিলের বেশি কেউ এগোতে পারেনি।/আমি কিছু আগুনেরা শিখাকে ফুঁসে উঠতে দেখেছিলাম/মনে হয়েছিলো চৈত্র এলো মাইল মাইল অন্ধকার গিলে খাবে/লণ্ঠনের গর্ভস্থ হয়ে তারা আজকাল/ভারী সুখী/বড়ো শান্ত/এবং মোটেই বিপজ্জনক নয়।’ আবু হেনা মোস্তফা কামাল কি ‘বিপজ্জনক’ কবিতাটা কবিদের নিয়ে লিখেছিলেন? ‘মোতিঝিল’ শব্দবন্ধকে তিনি প্রতীকি অর্থে ব্যবহার করেছেন ‘দশক’ এর বদলে? মোতিঝিলের বেশি কেউ এগোতে পারেনি অর্থ হল ‘দশক’ এর বাইরে কেউ যেতে পারেনি। কবিদের নিয়ে একজন কবির চমৎকার এই উপমার মধ্যে বাংলা ভাষার কবিতার-বাংলাদেশের কবিতার আদ্যপান্ত স্পষ্ট হয়েছে। কবিতা ‘বিপজ্জনক’ বাংলাদেশের কবিতার আয়না বিশেষ। এই বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে তর্ক-বিতর্কও হতে পারে। কিন্তু একে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া বা অস্বীকারের সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের কবিতার এই ‘দশক’ বাসের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হলেন রেজাউদ্দিন স্টালিন, যার কবিতায় আছে দশক ছাড়িয়ে যাওয়ার অভীপ্সা ও সমগ্রতার ঘণ্টাধ্বনি। ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’ কবিতায় লিখেছেন-“কেন জানি না আজ বহুদিন পর কারাকক্ষের অন্তরালে বসে
মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে
মা বলতেন-জানিসতো কবিতা লিখে ভাত হয় না
আমি লজ্জায় অবনত হয়ে থাকতাম

কিন্তু আজ আমার সময় হয়েছে
আমি সাহসী সন্তানের মতো প্রশ্ন করতে পারি
মা যারা কবিতা লেখে না
তাদেরও কি ভাত হয়

.

..  এখন আমি এগিয়ে যাচ্ছি বধ্যভূমির দিকে
আমার ফাঁসি হবার মাত্র এক মিনিট বাকি
এরই মধ্যে আমি পতনপ্রবণ এক জাতির জন্যে
অগ্নিগর্ভ মৃত্যুর উদাহরণ ছাড়া আর কী রেখে যাবো”

আপাদমস্তক একজন কবি, রেজাউদ্দিন স্টালিন। জন্মেছেন গত শতাব্দীর ছয়-এর দশকে, প্রায় প্রারম্ভিকলগ্নে। কবিতার যাত্রা আট-এর দশকে। শৈশব-কৈশোরে হাত মক্শো করেছেন বটে। তবে, পাকাপাকিভাবে কবিতায় অশ্বারোহণ যখন তিনি আঠারোয়। বাংলা কবিতায় ‘১৮’ সংখ্যার রয়েছে ভিন্ন এক তাৎপর্য। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় যা মহিমান্বিত হয়েছে, এভাবে-
“আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।”

কবির আঠারোয়-বাংলাদেশের রাজনীতি পাল্টে যাচ্ছিল, আমূল। ইতিহাসের গতিরেখায় ঘটছিল বাঁক বদলের পালা, অবনমন। দশকের শুরুতেই খুন হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ক্ষমতার মসনদে আবির্ভূত হয় স্বৈরশাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। ঠিক তখন দৃপ্ততার প্রস্তুতি নিয়ে কবিতায় হাজির হন একজন তরুণ। ‘আঠারো বছর বয়স’-এর প্রতিপাদ্যে জারি রাখতে চান ‘বাংলাদেশের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রত্যয় ও বিনির্মাণের প্রতীতি। যার ইহজাগতিকতার শুরু এই ভূখণ্ডের প্রথম স্বৈর শাসক আইয়ুব খানের চোখ রাঙানিয়া সময়ে। তিনি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবিতায় ‘বাংলাদেশের অভিজ্ঞান’ নির্মাণের স্রষ্টা। স্বাতন্ত্র্যধর্মী এক কাব্য নির্মাণ কারিগর। দশকের ভূগোল পেরিয়ে সমগ্রকে আলিঙ্গন করার দ্রষ্টা। ‘সূচনাপর্ব’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“যখন পৃথিবীতে কিছুই ঘটছে না
তখন সময় কি জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো থিতু
আমি কি শুধু মৃত্যুর ভয়ে সময়কে সনাক্ত করতে চাই

একজন জীবাশ্মবিদেও কাছে এক হাজার বছর কিছু নয়
জ্যোতির্বিদের কাছে এক শতাব্দীও তুচ্ছ
দার্শনিকের কাছে অর্বুদবর্ষ নিমেষকাল মাত্র
... আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত
মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা
আমার জন্মের আগে পৃথিবীতে কোনো লগ্ন ছিলো না
আমার চিৎকারই পৃথিবীর প্রথম সূচনা”

রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় দশক ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। যার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট যে সেখানে সমগ্রতার ঘণ্টাধ্বনি রয়েছে। এখানে সমগ্রতার অর্থ হল দুটি-এক. এর মধ্যে দিয়ে সকল দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কবির ভূমিকা পালন করেছেন।যা উনার কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। দুই. এই সমগ্রতার অপর নাম ‘বাংলাদেশ’। স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় দশকে এবং বাংলা কবিতা বিচারে গত শতকের আট-এর দশকে স্টালিনের আবির্ভাব। তার পর থেকে আজোবধি তিনি সৃষ্টিশীল।এই সৃষ্টিশীলতার ভেতর দিয়ে কবিতায় বাংলাদেশকে প্রতিবিম্বিত করার চেষ্টা করে গেছেন। এ দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষা-অভীপ্সার মৌলস্বরকে কবিতাময় করে তুলেছেন। এ কারণে, স্টালিনের কবিতাকে সুনির্দিষ্ট করে বললে ‘বাংলাদেশেল অভিজ্ঞান’ও বলা যায়, সেটাই শ্রেয় হয়। যেমন, তিনি লিখেছেন-
এক.
‘ফেলানী ফেলনা নয় ফেলানী মেঘের বোন নদীর হৃদয়,
সারা বাংলাদেশ আজ ফেলানীর পিতৃ পরিচয়।

... ফেলানী ফেলনা নয় সারাদেশে আজ তার লক্ষ সহোদর,
বোনের রক্ত ছুঁয়ে আক্রোশে কামড়ে ধরে নিজের উদর।

সীমান্তের বৃক্ষ-নদী রাত্রি বলে ফেলানী নির্দোষ,
কান্নাভারানত বুকে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ দেখে কবন্ধ আপস।’
[ফেলানী বৃত্তান্ত]

দুই.
‘... হঠাৎ ঘনিয়ে এলো ঈশানের আক্রমণ। পূর্বপুরুষের বহু
মূল্যবান তৈজষ অনেক অভাবে যা’ ধরে রেখেছিলো; সেগুলো রক্ষা করতে
বন্দুকের সামনে দাঁড়ালো একে একে তিনটি সন্তান। আর কারাগারে বেঁচে
গেলো সর্বকনিষ্ঠ পুত্র আকাঙ্ক্ষা। মূল্যবান তৈজষ রক্ষাকারী সন্তানের
স্মৃতিতে বঙ্গভাষা বপন করলো তিনটি অমর বৃক্ষ, একত্রে নাম দিলো শহীদ
মিনার। বঙ্গভাষা অপেক্ষায় আছে তার কনিষ্ঠ সন্তান আকাঙ্ক্ষা মুক্তি পেলে
একদিন সংসারের সব দায় তার কাঁধে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো বেরুবে
বিশ্বদর্শনে।’
[বঙ্গভাষা]

‘বাংলাদেশের অভিজ্ঞান’ আদতে কী? কীভবে, কীরূপে তিনি এই শব্দবন্ধের মর্মার্থকে ধারণ করলেন কবিতায়? কেনো, রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা ‘দশক ছাড়িয়ে সমগ্রতার ঘণ্টাধ্বনি’-কোন্ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এই সিদ্ধান্ত, সেসব খোলতাই ও উন্মীলনের চেষ্টা জারি রয়েছে এই লেখায়।

‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।’
সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো রেজাউদ্দিন স্টালিনও দেখেছেন স্বদেশের ক্ষুব্ধতা, হয়েছেন অবাক ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবশ্য এই বিস্ময়ের জায়গায় ছাড়িয়ে গেছেন সম্ভবত পূর্বসূরিকেও। কারণ সুকান্ত জন্মেছিলেন ১৯২৬ এর ১৫ আগস্ট। মারা যান ১৩ মে ১৯৪৭। জীবনপঞ্জির পুরোটা সময়ে জুড়ে ছিল জগদ্দল পাথরের মতো পরাধীনতার ক্ষণ। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় চলছিল তখন বাঙালির ওপর-ভারতবর্ষের মানুষের প্রতি বিভীষিকাময় এক শাসন-শোষণ, অন্যায়-অত্যাচার ও নির্যাতনের ধারাবাহিকতা। দেশ জুড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন পরিণত হচ্ছিল উত্তুঙ্গ অবস্থায়। পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে সবাই তখন ক্ষুব্ধ, একাট্টা। তারপর একসময় সতিসত্যি স্বাধীনতা আসে, মুক্ত হয় স্বদেশ। ১৯৪৭-এ ১৪ ও ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারত বিভাজন করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভাগ হয় অবিভক্ত বাংলা। পশ্চিম বাংলা চলে যায় ভারতের সঙ্গে। পূর্ববাংলা থেকে যায় পাকিস্তান নামক এক নতুন রাষ্ট্রে।

স্বাধীন পাকিস্তান পূর্ববাংলার মানুষের কাছে নাগরিক অধিকারের-আকাঙ্ক্ষার মাপকাঠিতে ধরা দেয় না। নতুন রাষ্ট্রে এই জনপদ হয়ে ওঠে শাসন-শোষণ-অত্যাচার-লাঞ্ছনা-বঞ্চনার নতুন এক উপনিবেশ। পূর্ব বাংলার জনগণ দ্রুতই বুঝতে পারে এই স্বাধীনতা ‘মূলো’ বিশেষ। ব্রিটিশ আর পাকিস্তান তাদের কাছে যেই লাউ সেই কদু তুল্য। পাকিস্তানের এক দশক বয়স না পেরোতেই গদিনশিন হয় সামরিক স্বৈরাচার। পূর্ব বাংলায় শুরু হয় সামরিক জান্তা বিরোধী আন্দোলন।

ততদিনে এই ভূখণ্ডের মানুষকে যেতে হয়েছে মাতৃভাষার মর্যাদার রক্ষার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। দেখতে হয়েছে রাজনৈতিক মোর্চা ‘যুক্তফ্রন্ট’ বিজয়ী হয়েও দেশ পরিচালনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার করুণ অভিজ্ঞতা। নগ্নভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে পশ্চিম পাকিস্তানী ধনতন্ত্রী-ব্যবসায়ী, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং রাজনীতিকদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। সংগঠিত হতে শুরু করেছে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন। ঠিক সেই সময়ে জন্ম হয়েছে যে শিশুর, আগামি দিনের যে কবির। তিনি যেন সুকান্তের কবিতাকেই দেখতে পেলেন কোনকিছু বুঝে ওঠার আগে-‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি/জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।’

কবির শৈশব-কৈশোর ছিল এই জনপদের মানুষের নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম। প্রকৃত স্বাধীনতকে খুঁজে ফেরার লড়াই। আত্মসত্ত্বার অধিকার প্রতিষ্ঠার দুর্বার আন্দোলন। কবি বেড়ে ওঠেন। আন্দোলন-সংগ্রামও পরিণতির দিকে যেতে থাকে। কবি আর দেশ যেন হাত ধরাধরি করে জেগে উঠে তার পুঞ্জিভীত স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নির্মাণের লক্ষ্যে। চূড়ান্ত বিজয়ে পৌঁছাতে মরিয়া হয়ে ওঠে ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের জনপদবাসী। ’৫২-র ধারাবাহিকতায় আসে ’৫৪, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯, ’৭০ এবং সবশেষে ’৭১। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই, যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক নির্বাচন, শিক্ষা আন্দোলন, স্বাধীকার ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি, গণ-অভ্যুত্থান, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন-এসবের অভিজ্ঞতা ও বঞ্চনা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনিবার্য করে তোলে। মুক্তির প্রত্যায় ও প্রত্যাশায় ’৭১-এর নয় মাস রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রেজাউদ্দিন স্টালিনের-শৈশব ও কৈশোর এসবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সম্ভবত ঋদ্ধ ও মর্মন্তুদ এই অতীত অভিজ্ঞতার কারণেই কবির কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে রুঢ় এই সত্য-
‘‘এস্ট্রগন তুমি আর আর্তচিৎকার করো না
গডো নিশ্চয় কাল আসবেন
রাখাল বালকের কথা তুমি অবিশ্যি শুনেছো
বরং চিবিয়ে নাও শেষ সম্বল তোমার গাজর
পৃথিবীতে যখন মন্বন্তর তখন ভাবো
কেমন সৌভাগ্যবান তুমি
অন্ততঃ নিজের প্রিয় খাদ্যবস্তু করতলগত

...  এস্ট্রাগন তুমি আর আর্তচিৎকার করো না
আজও রাখাল বালকের কথা তুমি নিশ্চয় শুনেছো
কাল গডো অবিশ্যি আসবেন

... আহ্-এস্ট্রাগন
তুমি আর আর্তচিৎকার করো না
আর্তনাদ অপেক্ষার যন্ত্রণাকে দীর্ঘ করে তোলে
বরং এসো আমরা আজ রাতে বিচ্ছিন্ন হবার আগে
আরেকবার আলিঙ্গন করি’’
[‘বিচ্ছিন্ন হবার আগে’]

প্রত্যক্ষ এক যুদ্ধের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন হয় দেশ। জন্ম হয় ‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। নতুন স্বপ্ন-নতুন আকাঙ্ক্ষায় আগামীর স্বপ্ন বুনতে থাকে সবাই। সম্মিলিত স্বপ্নের মাঝে কবিও রেখে দেন নিজস্ব চিন্তা ও দর্শন। যূথপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে তৈরি করেন বাংলাদেশের আকাশের মাপে মাপে গড়া এক ক্যানভাস। কিন্তু সেই ক্যানভাস জুড়ে দেখা দেয় রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতার বেদনার রঙ ও রেখা- ‘জাতির পতাকা খামচে ধরেছ আজ সেই পুরোনো শকুন।/ স্বাধীনতা, সে আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-/ স্বাধীনতা, সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।/ ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।’

যে প্রশ্ন রেখেছিলাম আমরা এই লেখার শুরুতে, কতোটা এগোল বাংলাদেশ, কতোটা এগোল বাংলা কবিতা। এর উত্তরে আশাবাদ জাগানিয়া শব্দমালা নেই। কারণ এ জাতি তার নবজাগরণকে চিহ্নিত বা শনাক্ত করতে পারেনি। নবজাগরণের আলোয় এগিয়ে যাওয়ার যে প্রত্যয় ও প্রতীতি জাতির মননে থাকার দরকার ছিল তা সেইভাবে উপ্ত করা যায়নি। ফলে, জাতিগঠণের প্রশ্নে, রাষ্ট্রীয় সংহতি ধারনের লক্ষ্যে যা কিছু প্রয়োজন-তার অনেক কিছুতেই আমরা এখনও দ্বিধান্বিত, বিভাজিত, অসূয়ক মানসিকতা আচ্ছন্ন। এ কারণে আমাদের সূর্যোদয়ে যাওয়া হয় না। জন আকাঙ্ক্ষার, গণ প্রত্যাশার বাংলাদেশ নির্মাণ বা পুনর্গঠন কোনোটাই হয়ে ওঠে না। এখানে রাজা যায় রাজা আসে। গণ অভ্যুত্থান যায় গণ অভ্যুত্থান আসে। জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। তারা থেকে যায় তিমিরবাসী বাসিন্দারূপে। অথচ এই বাংলাদেশের ভূখণ্ডেরই স্বতন্ত্র একটা নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল। এই নবজাগরণ কিন্তু বাংলার নবজাগরণের সম্প্রসারণ বা ধারাবাহিকতা নয়। এটি ছিল সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভূ এক নবজাগরণ।

অথচ গভীরতর বেদনার বিষয় হল, নবজাগরণ বা রেনেসাঁ বললেই আমাদের মনে পড়ে ইউরোপীয় নবজাগরণ কিংবা ইতালীয় নবজাগরণের কথা। এরপর হাজির হয় বেঙ্গল রেনেসাঁ। বেঙ্গল রেনেসাঁ বা বাংলার নবজাগরণ যখন নানাবিধ সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপে অস্তায়মান তখন শুরু হয় বাংলাদেশের নবজাগরণ। যার ভরকেন্দ্র ছিল ঢাকা। পরিধি ছিল ১৯০৫-এর বঙ্গ বিভাজন কালের পূর্ববঙ্গ। যে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে লর্ড কার্জন চেষ্টা করেছিলেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী থেকে বেরিয়ে পৃথক একটা প্রদেশ গঠনের। যে চেষ্টা রহিত হয় ১৯১১-তে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের নবজাগরণের সূচনা কখন শুরু হয় তা নির্দিষ্ট করে বলা মুস্কিল। আমরা মনে করি, এর উন্মেষ ঘটতে থাকে ঊনিশ শতকের শেষাশেষিতে। বঙ্গ বিভাজনের চেষ্টা ও রদ করার ঘটনা এর উন্মেষকে দ্রুততর ও অনিবার্য করে তোলে। যার প্রেক্ষাপটে পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও বিকাশের দিকটা এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাগ্রত হতে থাকে। এই জাগ্রত হওয়ার সময় ১৯২১-এ প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যা বাংলাদেশের নবজাগরণের যথার্থ উন্মেষ ও বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

আমরা মনে করি, সেদিনের পূর্ববঙ্গের ঢাকায় খ্রিস্টাব্দ ১৯২১ থেকে বাংলাদেশের নবজাগরণ শুরু হয় এবং তিন পর্বে সেটা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায়। মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯২১-এ বাংলাদেশের নবজাগরণের শুরু হলেও সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের শেষাশেষি থেকে। বাংলাদেশের নবজাগরণ তিনটা পর্ব বা পর্যায়ে সংঘটিত হয়।

প্রথম পর্ব ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ অবধি।
দ্বিতীয় পর্ব ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ অবধি।
তৃতীয় পর্ব ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১।

প্রথম পর্বে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই নবজাগরণকে শক্তভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর পাশাপাশি প্রয়োজনানুগ নেতৃত্ব দিয়ে এর কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের নবজাগরণের প্রথম পর্বের নায়করা সংগঠিত হন ‘শিখা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সংঘবদ্ধতায়। দ্বিতীয় ধাপের নায়করা সংগঠিত হন ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, বাংলা ভাষার ন্যায্য মর্যাদার প্রশ্নে। তৃতীয় ধাপের নায়করা সংগঠিত হন স্বাধীকার আন্দোলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষায়।

বাংলা কবিতায় গত শতাব্দীর সাত-এর দশক সাক্ষী হয় ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই স্পষ্ট হয়ে যায়, এই স্বাধীনতা কেবলই কতিপয় ব্যক্তির, নির্দিষ্ট এক রাজনৈতিক দলের। অধরা থেকে যায় গণতন্ত্র, সুশাসন, সামাজিক সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, বাক্ স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নসমূহ। যার জন্য কোম্পানি শাসন আমলে, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছিল সবাই। কিন্তু সবই থেকে যায় সোনার পাথরবাটির মতো। সংবেদনশীল একজন মানুষ হিসেবে-কবিকে এসব আহত ও ক্ষতাক্ত করে শরবিদ্ধ পাখির মতো। ক্ষমতা থাকা অবস্থায় দুজন রাষ্ট্রপ্রধানের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। ক্ষমতার মঞ্চে হাজির হয় স্বৈরশাসক এরশাদ। আট-এর দশকের প্রায় পুরোটা জুড়ে বাংলাদেশকে লড়তে হয় একজন সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ যখন যুঝে যাচ্ছে স্বৈরশাসক হঠাতে। গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সাম্য, বাক্ স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের মুক্তির জন্য সবাই যখন এক-একজন নূর হোসেন। তখন একজন কবিও এই লড়াইয়ে শামিল হন সকলের কণ্ঠস্বর হয়ে। প্রথম থেকেই লক্ষ্য থাকে দশকের খুপরিতে নিজেকে ছড়িয়ে দেবেন সেসবের ঊর্ধ্বে। রেজাউদ্দিন স্টালিন কবিতায় এই কাজটি করেতে পেরেছেন যথার্থভাবে, প্রশংসা জাগানিয়া সার্থকতায়। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র এবং সব দর্শকের কাছেই ঈর্ষণীয় এক কবি প্রতিভা। ‘সময়ের গল্প’ নামক দীর্ঘ কবিতায় যার সহজিয়া উচ্চারণ-
‘‘এখন সম্রাটের পাশে পদলেহীদের আসন গ্রহণ প্রথার পর্যায়
মুখোশের পেছনে মুখোশ
ছদ্মবেশের নিচে আরো ছদ্মবেশ
চাঁদসদাগর চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ক্যাডারের পৃষ্ঠপোষক
প্রখর দুপুরে চম্পক বাংলায় গভীর রাত্রি
বিশল্যকরণীর খোঁজে হনুপতি আকাশের গলা থেকে
খুলে নিচ্ছে সূর্যহার
দারিদ্র্য দংশিত লখিন্দর গাঙুড়ের জলে ভাসে কলার মান্দাসে
লক্ষ লক্ষ শীর্ষনাগ তাড়া করছে নগরবাসীকে
তোষামোদকারীদের ভিড়ে প্রকৃতদেশপ্রেমীগণ বিরল প্রজাতি
বাজিগর প্রকাশ্যে জিতে নিচ্ছে তিতুমীরের অস্থি পূর্বপুরুষের স্মৃতির সম্ভ্রম

এই মৃত্যুদেশে নেতা হতে সময় লাগে না
মূক ও বধির সব জনতা সত্যামিথ্যা করতালি দেয়
... নিজে বাঁচলে পিতৃনাম
তবু শুরু করো ঈশ্বরের নামে

... এখন নিয়ম অনিয়ম হতে সময় লাগে না
আগুনের মধ্যে অনর্গল ধোঁয়া
বৃক্ষের বাকলে কেবলই জন্মাচ্ছে কাঁটা
ফলের কোষে কোষে বিষের বৈকুণ্ঠ
তবু দূরে আকাঙ্ক্ষার ডালে দু’একটি পাতার বিনয়
পথে পথে বৈশাখের পায়ের প্রশ্রয়’’

আট-এর দশকের কবিতার প্রধান প্রবণতাগুলো হল- দেশজ আবহকে খুঁজে ফেরা। শেকড়সন্ধানী হওয়া। গ্রাম মুখিতা-বিশেষ করে শব্দ ব্যবহারে। বিষয়ের চেয়ে ভঙ্গির ওপর গুরুত্বারোপ-ভঙ্গিমুখিতা। পরাবাস্তববাদে বিশেষ আগ্রহ। কবিতায় ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম ওপর গুরুত্বারোপ। কবিতায় নিরিক্ষাবাদী প্রবণতায় ঝোঁক। অধিকারের ব্যাপরে সচেতনতা। উপেক্ষা বা অস্বীকারের চেষ্টা। আত্মমুখিতাকে গুরুত্ব দেওয়া। নারী অধিকারে সোচ্চার হওয়া। রাজনীতিমুখিতা কিন্তু প্রত্যক্ষে নয়, আত্মমুখি, নিঃসঙ্গপ্রিয়তা, বক্তব্যধর্মী কিংবা শ্লোগানধর্মী কবিতা থেকে বেরিয়ে আসা, অস্থিরতা ও নৈরাশ্যপ্রিয়তা, অ্যাবস্ট্র্যাক্ট বা অ্যাবসার্ডিজমের দিকে ঝুঁকে পড়া ইত্যাদি। আট-এর দশকের প্রায় সকল কবিই কমবেশি এই প্রবণতায় জারিত। কিন্তু রেজাউদ্দিন স্টালিন সরাসরি এ পথে হাঁটেননি। প্রথম থেকেই বিকল্প পথ অনুসন্ধানী ছিলেন। এই অনুসন্ধান পৃথক সত্ত্বায় হাজির করেছে কবিকে। উনার শ্রেষ্ঠ কবিতার বইয়ে ঘটেছে সেই সত্যের প্রস্ফুটন। যেমন, ‘স্পেস’ কবিতায় লিখেছেন-
“সম্পাদক চেয়েছেন ছোট্ট কবিতা
হতে পারে দু’কলম দশ ইঞ্চি
পত্রিকায় স্পেসের অভাব খুব

এরকম স্পেসের জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ হচ্ছে ধনতন্ত্রীদের
ঘনবসতিপূর্ণ এই ব-দ্বীপ অঞ্চলে
ভূমিদস্যুদের স্পেসের লড়াই রীতিমতো জগদ্বিখ্যাত

... সম্পাদক আপনার অনুরোধে লেখা এই ছোট্ট কবিতা

শুধু কবির সামান্য দাবি
আর এক ইঞ্চি জায়গা বেশি চাই
আগামি সংখ্যায়”

প্রাবন্ধিক-কথা সাহিত্যিক আহমদ বশীর ছোট কাগজ ‘খেয়া’য় ‘আশির দশকের কবিদের কবিতা’  প্রবন্ধে লিখেছেন-“এই সময়ের বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধান প্রবণতাগুলি ছিল এরকম:  সেনাপতি এরশাদের স্বৈরশাসনের শৃঙ্খলে অন্তরীণ হয়ে ছিল দেশ প্রায় একযুগ ধরে। এই রাজনৈতিক ডামাডোলে দেশের বিত্তবানশ্রেণী তৈরী হওয়ার তিনটি প্রধান সূত্র কার্যকরী হয়েছিল সেসময়ই : শিল্পকারখানা প্রদর্শন করে ব্যাংকের মাধ্যমে জনগণের অর্থ লোপাটের মহোৎসব, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর সময় দরিদ্র মানুষের অর্থলোপাট, এবং সরকারী কর্মকাণ্ডের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের সরকারি অর্থ-ডাকাতি। এই তিনটি অপ-সংস্কৃতির মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটি পুঁজিবাদ।”

ওই প্রবন্ধে আহমদ বশীর আরো বলেন-“আশির দশকের প্রধান প্রবণতা যদি বলতে হয়, সম্ভবত এই সময়ের কবিদের সম্প্রসারিত দৃষ্টিকোণের কথাই প্রথম চোখে পড়বে। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের কবিদের থেকে এঁদের পার্থক্য হল-এঁরা বিষয়-বৈচিত্র্যে, শব্দ-ব্যবহারে এবং অঙ্গিক-নির্মাণে বিশাল বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন। তথাকথিত ‘নাগরিক কবি’ কিংবা ‘গ্রামীণ জীবনের কবি’-এরকম সীমাবদ্ধতার বাইরে এসে তাঁরা কাব্যের ভূগোল ও সমাজকে দেখতে চেয়েছেন। কল্পনাবিলাসের পরিবর্তে প্রত্যক্ষণের অভিজ্ঞতাই এদের কবিতার চালিকা শক্তি। তাঁদের কবিতার দার্শনিক ভিত্তিটি কোন ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আসেনি-কিন্তু কবিতা রচনার পরম্পরায় তারা যখন আত্ম-অনুসন্ধান, রাজনীতি, প্রেম এবং হতাশার প্রসঙ্গগুলি তুলে এনেছেন সেখানেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের এই সম্প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি।

... দেশের রক্ত-ঝরানো রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেননি এই কবিরা। কিন্তু রাজনীতির উচ্চকণ্ঠ বিবৃতিমূলক কবিতা নয়,  রাজনীতির দার্শনিক বিশ্লেষণই প্রাধান্য পেয়েছিল তাদের কবিতায়।

আশির কবিতার আরেকটি বিশেষত্ব হল বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ধারণ করেছে এই সময়ের কবিতা। বিষয়টির ঐতিহাসিক তাৎপর্য আরো ঋদ্ধ করেছে এই সময়ের কাব্য-আন্দোলনকে। আলাদাভাবে নারীদের কবিতাকে বিবেচনা করার পর্বটি এই সময়ে এসে শেষ হয়ে যায়। নারীবাদী চিন্তার স্ফুরণে যেমন কবিতা লেখা হয়েছে অনেক, তেমনি জেন্ডার-সচেতন কবিরাও লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে কবিতা লিখেছেন।”

কবিতায় রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রচলপথে ভাসিয়ে দেননি নিজেকে। উজানে হেঁটেছেন। বেছেন নিয়েছেন বিকল্প পথ। প্রশ্ন হল কবির বিকল্প পথটা কী, কীভাবে চেনা যায় সেসব? উনার ৩৫টা কাব্যগ্রন্থে দৃষ্টি রাখলেই সেটা ধরা দেয়া উজ্জ্বল এক আখরে-যার নাম অভিজ্ঞান বাংলাদেশ কিংবা দশক ছাড়িয়ে সমগ্রতার ঘণ্টাধ্বনি। আট-এর দশকের কবিদের মধ্যে যিনি ‘বাংলাদেশ’কে উচ্চকিত করেছেন অন্য এক মাত্রায়, বাস্তবতার সাথে যুঝাযুঝি সাপেক্ষে। এই প্রয়াস নৈপুণ্যে তিনি বাংলা ভাষায় যারা দশক পূজারি কিংবা দশক বেচে প্রদর্শন করে নিজেদের কৌলিন্য তাদেরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হয়ে উঠেছেন সকল দশকের প্রতিনিধিত্বশীল কবি প্রাণ। ‘দেয়াল’ নিয়ে লেখা দুটি কবিতা পাশাপাশি নিয়ে পাঠ করলে উপলব্ধি করা যায় সেই তাৎপর্য ও অন্তর্নিহিত অর্থবিশেষ। তিনি লিখেছেন-

এক.
‘‘রাজদ্রোহী যুবকের তীক্ষ্মস্বরে স্বপ্ন ভেঙে গেলো
এখনো মাথাটি আছে দেয়ালের ফাটলের কাছে
উপরের আকাশ শুধু ম্লান করে দিয়েছে পৃথিবী
নিচে আমি শূন্যতার ভয়ে দেয়াল জাপটে ধরি
হু হু করে কেঁদে উঠি উদ্বিগ্ন ম্যাকবেথের মতো।”
[‘দেয়াল ও শূন্যতা’]

দুই.
‘‘আমি জানি অত্যন্ত গোপনে আমার বন্ধুরা
সারারাত দেয়াল তুলছে

...  আমি ঘুমের ভেতরে দেয়াল তোলার শব্দে
শঙ্কিত, ভীত
এই শব্দের সাথে কবর খোঁড়ার দূরাগত সাদৃশ্য রয়েছে
আমি দুই হাতে কান চেপে দিগন্তের দিকে দৌড়ে যাই
হায়, দিগন্ত যে কতো দূরে
নক্ষত্রের মতো বিশাল দূরত্বে দাঁড়িয়ে
আমাকে ডাকছে
দেয়ালের হাত থেকে উজ্জ্বল উদ্ধার পাবি
আয়-আমার বিস্তৃতির মধ্যে
অসীম অদৃশ্যময়তায়”
[‘দেয়াল ও দিগন্ত’]

কবিতায় রেজাউদ্দিন স্টালিনের অর্জন প্রশংসা জাগানিয়া। জগৎ ও জীবনকে দেখার অনুশীলন, অধ্যাবসায় ও সাধনা নিমগ্নতা-এর নেপথ্য কারণ। কবির কবিতা পাঠ করলে বোঝা যায় স্বরস্বতী প্রীতি কতোটা প্রখর ও সম্ভ্রমে আবৃত। কোনো কোন শব্দের প্রথম দেখা মেলে; যা ব্যবহার্য গুণে হয়ে উঠেছে প্রিয় এক আহার্যবিশেষ।একদিকে, প্রাখর্যপূর্ণ অনুধ্যান। অন্যদিকে, আঠারো পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ-সময়কাল, ইতিহাসের টানাপড়েন এবং জাতিগঠণ ও রাষ্ট্র নির্মাণের দুঁদে ক্ষণকে আত্মীকরণ ও সাঙ্গীকরণের ফলে উনার কবিতা সাধারণ্যে ‘অসাধারণ’, স্বভাবজে ‘অস্বাভাবিক’  প্রথাগতে ‘ব্যতিক্রম’। এই ‘অসাধারণ’, ‘অস্বাভাবিক’, ‘ব্যতিক্রম’ প্রবণতা গুণে কবির পক্ষে হাজির করা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশকে। এ কারণে রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা মাত্রই বাংলাদেশের অভিজ্ঞান। ‘উত্তরাধিকার’ কবিতায় কবির দৃপ্ত ঘোষণা-

‘‘আজ থেকে পৃথিবীর সব প্রতিবাদের প্রতিশব্দ-নেলসন ম্যান্ডেলা
জোহান্সবার্গ বাগদাদ জেরুজালেম জুরিখ ও বাংলাদেশে
জন্ম নিচ্ছে যত শিশু প্রত্যেকের ডাক নাম-ম্যান্ডেলা
দক্ষিণ আফ্রিকা লাতিন আমেরিকা
এবং এশিয়ায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মহত্তম উচ্চারণ ম্যান্ডেলা
মানববিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণীর গর্ভে বড় হচ্ছে যে
সেনানায়ক তার নাম-ম্যান্ডেলা

... সব খনিজ ও মূল্যবান আকরিক
জ্বালানি ও গ্যাসের গভীরে নেমে পড়েছে পঙ্গপাল
লুট হয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের পর স্বপ্ন
মাঠের পর মাঠ
নির্ভীক যে কাকতাড়–য়া সারাজীবন সেখানে দাঁড়িয়ে
তার নাম ম্যান্ডেলা।

... তখনও পৃথিবীর নানা দেশ
বাগদাদ জেরুজালেম জুরিখ
ঢাকা ও জোহান্সবার্গের প্রতিটি প্রতিবাদ হবে
নেলসন ম্যান্ডেলার উত্তরাধিকার”

অভিজ্ঞান শব্দের অর্থ হল স্মারক চিহ্ন, পরিচায়ক বস্তু বিশেষ। অভিজ্ঞান বাংলাদেশ হল-বাংলাদেশের পরিচয় বা বাংলাদেশের স্মারক। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা পাঠ করলে স্পষ্ট হয়, জানা যায় বাংলাদেশের পরিচয়। যে বাংলাদেশের পরিচয়ে দৃশ্যমান হয়- এক. সম্প্রীতিধর্মী জাতীয়তাবাদের, দুই. গণতন্ত্র ও সুশাসনের; তিন. বাক্ স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের মুক্তির; চার, সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের; পাঁচ. নাগরিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদার; ছয়. অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের। সাত. সর্বধর্ম ও সর্বমতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান; আট. জাতীয় সংহতির; নয়. সকলের সংস্কৃতির প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও দৃষ্টিভঙ্গির; এবং দশ. নৈতিক ও মূল্যবোধ সম্পন্ন দেশ ও জাতিগঠনের।

‘বিকল্প’ কবিতায় আবু হেনা মোস্তফা কামালের উচ্চারণ- ‘‘আমি কী কী হতে চাই না, এমন কি স্বপ্নেও, তার/ সহজ তালি লিখে রাখি ... দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ; ধানমন্ডিতে নজরুল ইসলাম;/দোহাই ঈম্বর, আমি হতে চাই না- উজ্জ্বল রেডিওগ্রাম/ ... কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানী;  আজীবন শিশু মানে গবেষক/ মানে নর্দমার সচ্ছল জীবাণু; কিংবা চতুর কোকিল;/ আপাদমস্তক সুখে নিমজ্জিত শিল্প; নির্বিরোধ নীল/ আকাশ অথবা চোখ; হতে চাই না এসবের কিছুই ঈশ্বর-অন্তত অন্তিম শ্লোকে হতে পারি যদি অস্থির কবির কণ্ঠস্বর।’’ রেজাউদ্দিন স্টালিনের স্বার্থকতা হল তিনি কবির কণ্ঠস্বর হতে পেরেছেন। অন্তিম শ্লোকে নয় জীবদ্দশায়। তিনি দশকের খুপরিতে আবদ্ধ না থেকে স্বাধীনতত্তোর বাংলা কবিতায় সমগ্রের ঘণ্টাধ্বনি হয়েছেন। যে ঘণ্টা বেজে উঠলেই আমরা শুনতে পাই-

‘‘জীবনের বিরুদ্ধে যারা অত্যন্ত গোপনে
তারাও বিশ্বাস করে সুদিন আসবে।
একজন ভিখিরিও বিশ্বাস করে
দাতাদের অন্তর আরো দয়ার্দ্র হবে।

খরা কবলিত কৃষকের বিশ্বাস এই খাঁ খাঁ প্রান্তরে
বর্ষণ হবে একদিন।
মা ভাবে তার নিরুদ্দিষ্ট সন্তান
দিগন্তের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসবে, রংধনু।

পরাজিত নিরন্তভাবে, বন্দী শালার দেয়াল
অকস্মাৎ একদিন ভেঙে পড়বে।
[‘ভূমিকা’]

কবির এই আশাবাদই বাংলাদেশের সব মানুষের প্রত্যয় ও প্রতীতি। মানুষের ইতিহাস পরাজিত না হওয়ার ইতিহাস। মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়, দাঁড়াবেই। সূর্যোদয়েও যাবে। আজ হয়তো হচ্ছে না, কাল নিশ্চয় হবে। কবির স্বপ্ন কখনো বৃথা যায় না। এ কারণেই আট-এর দশকে বেদনাহত অভিজ্ঞতার পরও স্টালিন আশাবাদের রাজনৈতিক কবিতা আমাদের উপহার দেন। সূর্যোদয়ের প্রত্যাশাকে জিইয়ে রাখেন চরম নৈরাজ্যের মধ্যেও। কবির ধর্ম সত্য বলে যাওয়া। হৃদয়ের আওয়াজ অপরকে জানিয়ে দেওয়া। রেজাউদ্দিন স্টালিন মহোত্তম এই ধর্ম পালন করে চলেছেন ১৯৬২ থেকে আজোবধি। যদিও তিনি জানেন, ‘সূচনাপর্ব’র এই নিদারুণ সত্যকেও-

‘‘আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত
মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা

আমার জন্ম কোনো সময়কে ইঙ্গিত করে না
এমনকি ঘটনাগুলো মুহূর্তের শৃঙ্খলমুক্ত

যখন পৃথিবীতে কিছুই ঘটছে না
তখন সময় কি জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো থিতু

আমি শুধু মৃত্যুর ভয়ে সময়কে সনাক্ত করতে চাই।

ঢাকা/এসবি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর দশক র প র দশক ছ ড় য় এই সময় র বছর বয়স র জন ত ক স ব ধ নত র প রথম সময় র ক ব যবহ র র দশক র প রবণত র রক ত ব কল প স বদ শ র জন ম র র মত সন ধ ন ক ত কর র অর থ প র বব ন পর ব আম র স ত হয় ছ শত ব দ আম দ র র প রস র জন য সন ত ন কর ছ ন র সময় হওয় র সমগ র

এছাড়াও পড়ুন:

গাজার ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটি আসলে কারা চালাচ্ছে

যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা থেকে গত বৃহস্পতিবার সকালে ১৫৩ জন ফিলিস্তিনিকে নিয়ে একটি চার্টার্ড উড়োজাহাজ দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের কাছের একটি বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিল। তাঁদের অনেকের কাছেই প্রয়োজনীয় ভ্রমণ নথি ছিল না, যা দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তাদের ‘হতভম্ব’ করে দিয়েছিল।

প্রায় ১২ ঘণ্টা চেষ্টার পর স্থানীয় একটি দাতব্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে ওই ফিলিস্তিনি যাত্রীদের উড়োজাহাজ থেকে নামার অনুমতি দেওয়া হয়।

স্থানীয় দাতব্য সংস্থা ‘গিফট অব দ্য গিভার্স’ তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিলে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার তাঁদের উড়োজাহাজ থেকে নেমে আসার অনুমতি দেয়।

‘আল-মাজদ ইউরোপ’ নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে আরও তথ্য সামনে এসেছে। কর্মীরা অভিযোগ করছেন, এর মাধ্যমে ইসরায়েল গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে, তারা ‘সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল থেকে মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়ার’ কাজে সমন্বয় করে থাকে। গাজার এই ফিলিস্তিনি যাত্রীদের কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের অর্থও নিয়েছে বলে জানা গেছে।

এখন পর্যন্ত এই দলটির যাত্রা এবং ‘আল-মাজদ ইউরোপ’-এর পেছনে কারা আছে, সে সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

দক্ষিণ আফ্রিকায় কী ঘটেছিল

দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উড়োজাহাজটি প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে রানওয়েতে দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ, ফিলিস্তিনি যাত্রীরা গাজা ছাড়ার সময় তাঁদের পাসপোর্টে বহির্গমন সিল (এক্সিট স্ট্যাম্প) বা স্লিপ ছিল না। অভিবাসন কর্মকর্তারা তাঁদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা কোথায় থাকবেন বা কতদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতে চান—সে সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি।

এরপর স্থানীয় দাতব্য সংস্থা ‘গিফট অব দ্য গিভার্স’ তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিলে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার তাঁদের উড়োজাহাজ থেকে নেমে আসার অনুমতি দেয়।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২৩ জন ফিলিস্তিনি পরে অন্য দেশে চলে গেছেন। এর বাইরে আর বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত শুক্রবার বলেন, ‘এরা গাজার মানুষ। তাঁরা রহস্যজনকভাবে একটি উড়োজাহাজে করে কেনিয়ার নাইরোবি হয়ে এখানে এসেছেন।’

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘মনে হচ্ছে তাঁদের গাজা থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ দক্ষিণ আফ্রিকার গোয়েন্দা সংস্থা এই ঘটনাটির তদন্ত করছে।

ইসরায়েলের সংবাদপত্র হারেৎজ গত রোববার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই সংস্থাটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন টোমার জানার লিন্ড নামের একজন ইসরায়েলি-এস্তোনিয়ান দ্বৈত নাগরিক। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তরের দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একটি ইউনিটের সঙ্গে লিন্ড এমন বেশ কয়েকটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছেন।দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়েছে কোন প্রতিষ্ঠান

এই ফ্লাইটের পেছনে রয়েছে ‘আল-মাজদ ইউরোপ’ নামের ওই সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে।

ইসরায়েলের সংবাদপত্র হারেৎজ গত রোববার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সংস্থাটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন টোমার জানার লিন্ড নামের একজন ইসরায়েলি-এস্তোনিয়ান দ্বৈত নাগরিক। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তরের দায়িত্বে থাকা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একটি ইউনিটের সঙ্গে লিন্ড এমন বেশ কয়েকটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছেন।

এই ইউনিটের নাম ‘স্বেচ্ছাসেবী অভিবাসন ব্যুরো’। ফিলিস্তিনিদের তাঁদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করার নীতি কার্যকর করতে ২০২৫ সালের প্রথম দিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই ইউনিট গঠন করা হয়েছিল।

হারেৎজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লিন্ড ফিলিস্তিনিদের জন্য ফ্লাইটের ব্যবস্থা করার কথা অস্বীকার করেননি। তবে এ বিষয়ে তিনি আর কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।

রামাল্লার বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও শরণার্থী অধ্যয়নের সহযোগী অধ্যাপক ওরুব আল-আবেদ আল–জাজিরাকে বলেছেন, এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়।

আল–আবেদ বলেন, এটি দীর্ঘ ঔপনিবেশিক পদ্ধতির একটি অংশ। ইসরায়েলিরা সুসংগঠিতভাবে আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করছে। তারা বহুমাত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ভূমিকে তার আদিবাসী মানুষশূন্য করতে চায়।

আল-মাজদ ইউরোপ সম্পর্কে কী জানা গেল

আল–মাজদ ইউরোপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি ২০১০ সালে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর হোমপেজে একটি সতর্কবার্তা রয়েছে, যে কেউ তাদের এজেন্ট সেজে প্রতারণা করতে পারে। সেখানে ‘বৈধ প্রতিনিধিদের’ ফোন নম্বর দেওয়া আছে।

তবে ওয়েবসাইটে সংস্থাটির কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর নেই। কেবল অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাহতে একটি অবস্থান দেখানো হয়েছে। যদিও আল–জাজিরা সেখানে কোনো অফিস খুঁজে পায়নি।

আলমাজদইউরোপ ডট ওআরজি (almajdeurope.org) নামের ওয়েবসাইটটির ডোমেইন মাত্র এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিবন্ধন করা হয়েছে। সাইটের বেশ কিছু লিঙ্ক কাজ করে না। সাইটে দেওয়া ই–মেইল ঠিকানা ([email protected]) থেকেও স্বয়ংক্রিয় বার্তা আসছে, ঠিকানাটি অস্তিত্বহীন।

নেমচিপ নামের যে প্রতিষ্ঠান ডোমেইনটি নিবন্ধন করেছে, সাইবার নিরাপত্তা–সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রতিবেদনে অনলাইন জালিয়াতির ঘটনায় তাদের নাম এসেছে। কারণ, তাদের সাইন-আপ প্রক্রিয়া সহজ ও খরচ কম।

দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থিত ফিলিস্তিনি দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, একটি ‘অনিবন্ধিত ও বিভ্রান্তিকর’ সংস্থার মাধ্যমে এই ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গাজার জনগণের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়েছে সংস্থাটি।

আল–জাজিরা আরও জানতে পেরেছে, অনেক ব্যক্তিকে সংস্থার ব্যাংক হিসাবে নয়, বরং ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছিল।

ওয়েবসাইটটি মাত্র ১০ মাস আগে নিবন্ধন করা হলেও সেখানে আলেপ্পোর (সিরিয়া) ২৯ বছর বয়সী ‘মোনা’ সম্পর্কে একটি পোস্ট রয়েছে, যার তারিখ দেওয়া আছে ২০২৩ সালের ২২ মার্চ। মোনার জবানিতে লেখা সেই গল্পে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে লেবাননে পালিয়ে যাওয়ার পর যখন তাঁরা বিপদে পড়েছিলেন, তখন আল–মাজদ তাঁকে এবং তাঁর মাকে ‘নিরাপদ স্থানে’ সরিয়ে নেওয়ার কাজ করেছিল। এ জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

তবে ছবিতে যাঁকে দেখানো হয়েছে, সেই মানুষটির নাম আসলে আবির খায়াত। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে লেবাননের ত্রিপোলিতে সাংবাদিক ম্যাডেলিন অ্যাডওয়ার্ডস যখন ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৩। মিডল ইস্ট আইয়ের জন্য তিনি ওই ছবিটি তুলেছিলেন।

অনলাইন ফর্মে লেখা আছে—বর্তমানে শুধু গাজা উপত্যকার ভেতরে থাকা বাসিন্দাদের জন্য—‘আপনি কি ভ্রমণ করে নতুন জীবন শুরু করতে চান? আমরা আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।’

মানুষ কীভাবে সেই ফ্লাইটে উঠল

ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো প্রত্যেক শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য আল-মাজদকে ১ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ডলার দিয়ে ফ্লাইটে উঠেছিলেন। তবে তাঁদের চূড়ান্ত গন্তব্য জানা ছিল না। এই যাত্রীদের মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীও ছিলেন।

স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ফ্লাইটে ওঠা লোয় আবু সাইফ গত শুক্রবার আল–জাজিরাকে বলেন, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আল-মাজদের কথা জানতে পারেন।

সাইফ বলেন, তাঁদের গাজা থেকে কখন বের হতে হবে, তা তিনি মাত্র এক দিন আগে জানতে পেরেছিলেন। সে সময় তাঁকে বলা হয়েছিল, যাত্রীরা শুধু একটি ছোট ব্যাগ, একটি মোবাইল ফোন ও কিছু নগদ টাকা নিতে পারবেন।

যাত্রীদের গাজার দক্ষিণে অবস্থিত রাফা থেকে বাসে করে কারেম আবু সালেম ক্রসিংয়ে (ইসরায়েলে যা কেরেম শালোম নামে পরিচিত) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী তাঁদের তল্লাশি করে। এরপর ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের ভ্রমণ নথিতে কোনো স্ট্যাম্প না দিয়েই ইসরায়েলের রামোন বিমানবন্দরে স্থানান্তর করে।

উড়োজাহাজে কয়েক দিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় আসা এক ফিলিস্তিনি। এই ছবি জোহানেসবার্গের কোনো একটি এলাকা থেকে ১৪ নভেম্বর তোলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘রাজসাক্ষী’কে কি সাজা দেওয়া যায়
  • সংস্কৃতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান শিল্পী–সংস্কৃতিকর্মীদের
  • কুষ্টিয়ায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তদের গুলিতে কৃষক নিহত
  • পাবনা-৩: ‘বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তন না করলে চাচা-ভাতিজার একজন স্বতন্ত্র হব’
  • চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে প্রাইভেট কার ছিটকে পড়ে একজনের মৃত্যু
  • ফেনীতে পৃথক ঘটনায় ৩ জনের মৃত্যু
  • কামাল সিদ্দিকী: আমলাতন্ত্রের ঘেরাটোপ ভাঙা একজন দেশপ্রেমী
  • চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু
  • গাজার ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটি আসলে কারা চালাচ্ছে