কিস্তি: ১
কিস্তি: ২
কামাল পাশা যখন যুদ্ধ শেষ করে এনেছেন, নজরুল তত দিনে ‘বিদ্রোহী’ ইত্যাদি কবিতা লিখে বাংলার বিদ্বৎ ও রসিক-সমাজে সাড়া ফেলেছেন। তখনো সেলবর্সী সাবেক সহকর্মী নজরুলের অনুরাগী। ১৯২২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কামাল পাশা গ্রিকদের আনাতোলিয়া থেকে তাড়িয়ে স্বদেশ শত্রুমুক্ত করেছেন। এদিকে ২৬ ভাদ্র ১৩২৯ (১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত ধূমকেতুর অষ্টম সংখ্যায় ফযলুল হক সেলবর্সী লেখেন:

৩৩, বেনেপুকুর রোড, কলিকাতা

ভাই কাজী সাহেব,
স্বয়ং বিশ্বকবি যাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ, তাঁকে আমার মতো লোকের ভক্তি নিবেদন করিতে যাওয়াও ধৃষ্টতা। সেই পরম পুরুষকে ধন্যবাদ; আজ মুসলমান বাংলার একটি দৈন্য দূর হইয়াছে। আজ সাহিত্যের পুণ্য আঙ্গিনায় আপনার সমাজ দাঁড়াইবার মত যে স্থানটি পাইয়াছে, তাহা আপনারই দয়ায়। আপনি আমার ভ্রাতা, আপনাকে তোষামদ করিব না। চির অন্ধকারের জীব আমরা, আঁধারে আলোর স্বপ্ন দেখাই আমাদের কাজ। দুর্দিনের ‘রাতের ভালে’ প্রতিভার আলোক দেখিয়া প্রাণে যে আনন্দ লাভ করিয়াছি, তাহাই একটু ব্যক্ত না করিয়া পারিলাম না।
                                              ফযলুল হক সেলবর্সী

সেলবর্সীর বহু লেখা ধূমকেতুতে প্রকাশিত হয়েছে। সেসব লেখা অবশ্য প্রবন্ধকারের দেখার সুযোগ হয়নি। স্পষ্টতই ১৯২২ সালেও তিনি নজরুলের অনুরাগী ছিলেন। তবে নজরুলের প্রতি মুসলমান সমাজের রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তত সন্তুষ্ট ছিলেন না। ওই মাসেই মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার ১৩২৯ সনের আশ্বিন সংখ্যায় (১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর) নজরুলকে ‘যবন-হরিদাস’ বলেন এবং ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’ শিরোনামে লেখেন ‘হিন্দুয়ানী মাদ্দায় উহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ’। নজরুলকে ‘নাস্তিক শয়তান’, ‘খোদাদ্রোহী নরাধম’ ও ‘শয়তানের পূর্ণ অবতার’ বলে অভিহিত করেন। মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন, শেখ হবিবর রহমান এবং মোহাম্মদী পত্রিকার নজির আহমদ চৌধুরী নজরুলের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেন। এই সব তাকফিরি বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে নজরুল পরে বলেছিলেন তিনি আদৌ ‘ইসলামের বিরুদ্ধবাদী’ নন। বরং ‘ইসলামের নামে যে কুসংস্কার মিথ্যা আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে—তাকে ইসলাম বলে না মানা’ তাঁর অবস্থান। ‘হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিলেই’ কেউ কাফের হয় না। (শাহাবুদ্দীন আহমদ, নজরুল-সাহিত্য বিচার) নতুন চাঁদ কাব্যের ‘আজাদ’ কবিতায় নজরুল লিখেছেন, ‘কাফের তারেই বলি, যারে ঢেকে আছে শত জরা। অজ্ঞান অন্ধকারে যাহারে রেখেছে আবৃত করি’, আর বিপরীতে ‘আল্লাহ আর তাহার মাঝারে কোনো আবরণ নাই, এই দুনিয়ায় মুসলিম সেই.

..’। কিংবা শেষ সওগাত গ্রন্থে বলেছেন ‘তাঁর সৃষ্টিরে ভালবাসে যারা তারাই মুসলমান।’ অর্থাৎ মুসলমান বনাম কাফিরের ধর্মতাত্ত্বিক ভেদের রাজনৈতিক ব্যবহারকে নাকচ করে নজরুল রাজনৈতিক-মানবীয় তাৎপর্যকে প্রধান করে তুলেছেন।

নজরুলের প্রতি মুসলমান সমাজের রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দীন আহমদ ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকায় নজরুলকে ‘যবন-হরিদাস’ বলেন এবং ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’ শিরোনামে লেখেন ‘হিন্দুয়ানী মাদ্দায় উহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ’।

এ কে ফজলুল হক বাদে, মুসলমান সমাজের রাজনৈতিক নেতারাও নজরুলের অনুকূলে ছিলেন না। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য অক্টোবর মাসেই গভর্নরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে জুডিশিয়াল অংশের মেম্বার স্যার আব্দুর রহিমের অনুমতিতে নজরুলের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হয়। ১৯২২ সালের নভেম্বরে নজরুল গ্রেপ্তার হন। (মুজফ্ফর আহমদ, ধূমকেতু প্রকাশের গোড়ার কথা) জেল খেটে ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পেলেন নজরুল।

আর এদিকে জেল খেটে বের হয়ে সেলবর্সী যুক্ত হয়েছেন মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায়। ১৯২৪ সালে আবুল মনসুর আহমদ যখন সে পত্রিকায় চাকরি নিলেন, সেখানে জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পেলেন সেলবর্সী ও মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে। ‘নবযুগ’–এ সেলবর্সীর কাজে অমনোযোগের সাক্ষ্য দিয়েছেন মুজফ্ফর। আর ‘মোহাম্মদীতে’ সাক্ষ্য দিয়েছেন মনসুর। তিনি লিখেছেন, সেলবর্সী ও ওয়াজেদ তাঁকে দিয়ে ‘প্রায় সব কাজ’ করিয়ে নিতেন এবং নিজেরা যথাসম্ভব কম লিখতেন। মনসুর তাতে বিশেষ বিরক্ত হননি, বরং সারা দিন ‘ভূতের মতো’ খাটতেন। ‘তাঁদের ছিল যেমন সিনিয়রের বোঝা জুনিয়রের কাঁধে ঢালিয়া দেবার অধিকার ও অভিপ্রায়, আমারও ছিল তেমনি “বড় বোঝা” বহিবার জন্য কাঁধ পাতিয়া দিবার আগ্রহ।’ বাড়তি দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁরা মনসুরকে বিশেষ তারিফও করতেন তা নয়। তবে মনসুরের খেদ ছিল না। নিজ গদ্যে তিনি সেলবর্সীর যুক্তিতর্ক-বিবর্জিত ও ‘হৃদয়স্পর্শী উচ্ছ্বাস’পূর্ণ শৈলী এবং ওয়াজেদ আলীর যুক্তিপূর্ণ ধরন এই দুই–ই আয়ত্ত করেছিলেন। (আহমদ, আত্মকথা) যা হোক, অচিরেই ওয়াজেদ আলীকে ছাঁটাই করে দেন আকরম খাঁ, আর সেলবর্সী হয়ে উঠলেন সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’র সম্পাদক। সেলবর্সী এ পত্রিকায় ১৯২৪ থেকে ১৯২৯ তক কাজ করেন। মনসুরও দ্রুতই চাকরি হারান সেখানে। তারপর মনসুর, ওয়াজেদ ও শামসুদ্দীন যুক্ত হন মুজিবর রহমানের ‘দি মুসলমান’ পত্রিকায়। ১৯২৬-২৭-এর দিকে শামসুদ্দীন ও মনসুর ‘সওগাত’–এও কাজ শুরু করলেন, তারপর সেখানেই চলে গেলেন। নজরুলও ভিড়লেন সেদিকে। (শামসুদ্দীন, অতীত দিনের স্মৃতি) এই সকল অদলবদল-ছাঁটাই-নিয়োগ আদতে এই সকল বুদ্ধিজীবীর ভাবাদর্শিক মেরুকরণ আকারেও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। দেখা যাবে যে আকরম খাঁ আর সেলবর্সীর রাজনৈতিক মত একদিকে থাকবে, মনসুর, ওয়াজেদ ও শামসুদ্দীনের থাকবে আরেক দিকে। আর নজরুল অনেকটা নিজেরই ধাতের মানুষ।

জেল খেটে বের হয়ে সেলবর্সী যুক্ত হয়েছেন মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায়। ১৯২৪ সালে আবুল মনসুর আহমদ যখন সে পত্রিকায় চাকরি নিলেন, সেখানে জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পেলেন সেলবর্সী ও মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীকে।মোল্লা ও তরুণ

একদিকে মুসলমান সমাজে মুদ্রণমাধ্যমের বরাতে নতুন ধরনের সম্পর্কজাল (নেটওয়ার্কিং) যেমন নিবিড় ও শক্তিশালী হচ্ছিল, একই সঙ্গে তাদের নিজ সমাজে সরদারি কে করবে সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছিল। সমাজের সরদার ও দিশারি কে হবে, সেই প্রশ্নেই মোল্লা বনাম তরুণ এই দ্বিধাবিভাজন প্রবল হলো। নজরুল আগে থেকেই গোঁড়াপন্থী মোল্লাদের প্রতি ক্রিটিক্যাল ছিলেন। কাব্য-আমপারার উৎসর্গপত্রে (১৯৩৩ সাল) মৌলবি সাহেবদের নায়েবে-নবি বলে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন নজরুল, কিন্তু কাঠমোল্লাদের প্রতি তাঁর ছিল অশ্রদ্ধা। সওগাত পত্রিকার রসাত্মক লেখা ‘চানাচুরে’ নজরুল বলেন, ‘মওলানা মৌলবি সাহেবকে সওয়া যায়, মোল্লাকেও চক্ষু-কর্ণ বুঁজিয়া সহিতে পারি। কিন্তু কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। ইসলামের কল্যাণের নামে ইহারা যে কওমের, জাতির, ধর্মের কি অনিষ্ট করিতেছেন, তাহা বুঝিবার মতো জ্ঞান নাই বলিয়াই ইহাদের ক্ষমা করা যায়। ইহারা প্রায় প্রত্যেকেই ‘মনে মনে শাহ ফরিদ, বগল-মে ইট’।… ইহাদের ফতুয়া-ভরা ফতোয়া। বিবি তালাক ও কুফরির ফতোয়া তো ইহাদের জাম্বিল হাতড়াইলে দুই দশ গণ্ডা পাওয়া যাইবে। এই ফতুয়াধারী ফতোয়াবাজদের হাত হইতে গরিবদের বাঁচাইতে যদি কেহ পারে তো সে তরুণ।... চোগা-চাপকান দাড়ি-টুপি দিয়া মুসলমান মাপিবার দিন চলিয়া গিয়াছে।’

কারা ছিল এই ‘তরুণ’? ইয়ং বেঙ্গল, ইয়ং জার্মানি ইত্যাদি ধারণার প্রায় এক শ বছর পর ইয়ং তুর্ক হয়ে পরে এল বাঙালি মুসলমানের ‘তরুণ’ দল। সে তরুণদের পরিচয় মেলে আবুল মনসুর আহমদের লেখায়। তিনি লেখেন যে কলকাতায় গিয়ে তাঁরা ‘দরিদ্র মেসের ভাঙ্গা চৌকির ময়লা-ছেঁড়া বিছানায় শুইয়া-বসিয়া… দুনিয়ার মুসলমানদের ভাগ্য আলোচনা’ করতেন। এই আলোচনায় তাঁরা মুসলমানের চিন্তা, বুদ্ধি ও জ্ঞানের সংকটকেই প্রধান সমস্যা শনাক্ত করলেন। মুসলমান আজ ‘ইসলামের ভাল আদর্শ ত্যাগ করিয়া’ শুধু নামাজ-রোজার মতো সওয়াব কামানোর ‘আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই ধর্ম সাধনাকে সীমাবদ্ধ করিয়াছে।’ এই ‘সার্বিক অধঃপতনের জন্য দায়ী মোল্লারা’, যারা ‘ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা’ করে ‘মুসলমান জনসাধারণকে অজ্ঞান ও দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবাইয়া রাখিয়াছে।’ তাদের মধ্যে পরলোকমুখিতা বাড়ার ফলে ইহলৌকিক ধনের আশা তারা ছেড়েছে। এই উপলব্ধি থেকে মনসুর ও তাঁর সমমনারা উঠে পড়ে লাগলেন পরিস্থিতি বদলের জন্য। ‘সবাই মোল্লাবিরোধী লেখা চালাইতাম। ডা. লুৎফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, হুমায়ুন কবির, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আমি চুটাইয়া মোল্লাবিরোধী অভিযান শুরু করিলাম।’ মৌলবি মুজিবর রহমান সম্পাদিত দি মুসলমান পত্রিকার সহকর্মী মৌলবি আবুল হায়াত, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সঙ্গে আবুল মনসুর ‘অ্যান্টি-মোল্লা লীগ’ গঠনে নামলেন। মৌলবি মুজিবর রহমান তাঁদের পরামর্শ দিলেন মোল্লা বিদ্বেষ না করে মোল্লাকির বিরোধিতা করতে। (আহমদ, আত্মকথা) কাছাকাছি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে শিখা গোষ্ঠী ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন শুরু করেছে।

বলা বাহুল্য তুরস্কে কামালের সংস্কার আর তার দেখাদেখি ইরান, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে যেসব সংস্কার আরোপ করা হচ্ছিল, তার ঢেউ এসে আলোড়ন তুলছিল বাঙালি মুসলমান সমাজে।

কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। ইসলামের কল্যাণের নামে ইহারা যে কওমের, জাতির, ধর্মের কি অনিষ্ট করিতেছেন, তাহা বুঝিবার মতো জ্ঞান নাই বলিয়াই ইহাদের ক্ষমা করা যায়।... এই ফতুয়াধারী ফতোয়াবাজদের হাত হইতে গরিবদের বাঁচাইতে যদি কেহ পারে তো সে তরুণ।... চোগা-চাপকান দাড়ি-টুপি দিয়া মুসলমান মাপিবার দিন চলিয়া গিয়াছে।’কাজী নজরুল ইসলাম

এভাবে সেলবর্সী যে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ছিলেন তাতে যাঁরা তাঁর সহকর্মী ছিলেন, যেমন আবুল মনসুর আহমদ ও মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, তাঁরাই হয়ে গেলেন অ্যান্টি-মোল্লা বা অ্যান্টি-মোল্লাকি লড়ুয়ে। সেলবর্সী কিন্তু সাবেক কলিগদের এই মোল্লাবিরোধী প্রবণতায় খাপ্পা হয়ে গেলেন। ১৯২৯ সালে সেলবর্সী নিজের সম্পাদিত নতুন পত্রিকা বের করলেন। পত্রিকার নাম ‘আল মুসলিম’। এ পত্রিকায় তিনি মোল্লা ও তরুণের দ্বন্দ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করে বললেন, কলকাতার ‘একদল তথা-কথিত মুসলিম তরুণ আলেম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কিছুদিন যাবৎ বিদ্রোহী হইয়া পড়িয়াছেন’ এবং ‘মোল্লা বিরোধী লীগ’ নামে একটি লীগ তৈরি করা হয়েছে। কারা এই তরুণ? সেলবর্সীর পত্রিকা লিখছে ‘কলিকাতার কয়েকখানি মুসলিম সংবাদপত্রের স্টাফ হইতেই এই “মোল্লা বিরোধী লীগের” অধিকাংশ সদস্য হইয়াছেন।’

কারা ছিল এই ‘তরুণ’? ইয়ং বেঙ্গল, ইয়ং জার্মানি ইত্যাদি ধারণার প্রায় এক শ বছর পর ইয়ং তুর্ক হয়ে পরে এল বাঙালি মুসলমানের ‘তরুণ’ দল।... তুরস্কে কামালের সংস্কার আর তার দেখাদেখি ইরান, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে যেসব সংস্কার আরোপ করা হচ্ছিল, তার ঢেউ এসে আলোড়ন তুলছিল বাঙালি মুসলমান সমাজে।

তরুণদের মোল্লাবিরোধিতাকে ‘আলেম-বিদ্বেষ’ আকারে অভিহিত করে সেলবর্সীর পত্রিকা ‘ইসলামের প্রধান পাঁচটী স্তম্ভই একমাত্র মোল্লাদের প্রচারের জন্য বাংলায় খাড়া হইয়া আছে।’ লেখা হয় ‘মওলানা মওলবীদের… ঔদাসীন্যের ফলেই আজ তুর্কির “গাজী” ও আফগানের “আলা হজরৎ” ইসলামের সঙ্গে সঙ্গে মোল্লাদেরও কচুকাটা করিতেছেন। এদেশেও যে সেদিন খুব শীঘ্রই আসিবে, “তরুণেরা” তার স্পষ্ট ঈঙ্গিত [হুবহু] দিয়া রাখিতেছেন।’ এর ফলে ‘বাংলার বুক হইতে পরোক্ষভাবে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা’ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

পত্রিকায় স্বরের বৈচিত্র্য ও সমন্বয়

এখানে একটা কথা বলা দরকার যে পত্রিকাগুলোর ভাবাদর্শ থাকত বটে, কিন্তু এগুলোর কর্মী ও লেখকেরা যে ওই দপ্তরি ভাবাদর্শের সহি অনুসারীই হতো তা নয়। আদতে একেকটা পত্রিকা আসলে ছিল নানা রকম স্বরের আখড়া, আর পত্রিকার সম্পাদকীয় কাজ ছিল সেই সব স্বরের ভাবাদর্শিক সঞ্চয়ন। একই ব্যক্তি একেক পত্রিকায় একেক স্বর নিয়ে হাজির হতে পারতেন।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন যেমন উদাহরণ দিয়েছেন যে নলিনীকিশোর গুহ ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায় ছিলেন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীর স্বর, আর ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় কংগ্রেস-বিরোধীর স্বর। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নায়ক’-এ ছিলেন কংগ্রেসী আর ‘বাঙালী’তে সরকার ঘেঁষা। (শামসুদ্দীন, অতীত দিনের স্মৃতি) তাছাড়া পত্রিকায় লেখকের স্বর তো অব্যবহিতভাবে পাঠকের কাছে যায় না, তাতে নানা সম্পাদনা আসে। মুজফ্ফর সেলবর্সীর গরম লেখা শুধরে নরম করতেন নবযুগে। আবুল মনসুর আহমদ বর্ণনা দিয়েছেন ‘মোহাম্মদী’ ধরনের পত্রিকায় তাঁরা কীভাবে হিন্দুয়ানি শব্দকে মুসলমানি শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতেন।

‘কলিকাতার সবগুলি বাংলা দৈনিক কাগজই ছিল হিন্দুদের সম্পাদিত ও পরিচালিত। কাজেই তাদের বাংলা ভাষাকেও আমাদের কিছুটা মুসলমানি করিয়া লইতে হইত। এই ধরুন, জলকে “পানি”, ঈশ্বরকে “আল্লাহ”, ভগবানকে “খোদা”, পিসাকে “ফুফা”, খোঁড়াকে “চাচা” করিতে হইত। এটা করিতে হইত এই জন্য যে হিন্দু লেখক-সাংবাদিকরা শুধু হিন্দু ব্যক্তিদের মুখ দিয়াই নয় মুসলমান ব্যক্তিদের মুখেও ঐ সব শব্দ ঢুকাইয়া দিতেন। এমনকি মুসলমান মৃত ব্যক্তিকেও “কাফন-দাফন” না করাইয়া “অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া” করাইতেন। ঈদের জামাতে মওলানা সাহেবদের দিয়া এমামতি না করাইয়া “পৌরোহিত্য” করাইতেন। বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন যুগের এটা ছিল সেই মুদ্দত যখন বাংলা সাহিত্যের হিন্দু মহারথীদের লেখা নাটক-নভেলে ও মঞ্চে পাঠান-মোগল বাদশা বেগম ও শাহযাদা-শাহযাদীরা পরস্পরকে “পিসা-পিসি”, “খোঁড়া-খোড়ী” সম্বোধন করিতেন। কাজেই মুসলমান পাঠকদের জন্য সাপ্তাহিক চালাইতে গিয়া ঐ সব ভাষিক সংশোধন আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল।’

সেলবর্সী সাবেক কলিগদের মোল্লাবিরোধী প্রবণতায় খাপ্পা হয়ে গেলেন। ১৯২৯ সালে সেলবর্সী নিজের সম্পাদিত নতুন পত্রিকা বের করলেন। পত্রিকার নাম ‘আল মুসলিম’। সেলবর্সীর পত্রিকা লিখছে ‘কলিকাতার কয়েকখানি মুসলিম সংবাদপত্রের স্টাফ হইতেই এই “মোল্লা বিরোধী লীগের” অধিকাংশ সদস্য হইয়াছেন।’

১৯২১ সালে আকরম খাঁর ‘সেবক’ পত্রিকায় নজরুলের লেখা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অবিচুয়ারিতে আবুল কালাম শামসুদ্দীন ও ওয়াজেদ মিলে হিন্দুয়ানি ভাব মুছে মুসলমানি ভাব জুড়লেন, যেন আকরম খাঁ চেতে না যান। কিন্তু নিজের স্বরের এই সম্পাদিত বিকৃতির ফলে নজরুল এতই আহত হন যে আর ‘সেবক’-মুখী হননি।

অনেকে একাধিক পত্রিকায় লিখতেন, যেমন শামসুদ্দীন ‘দি মুসলমান’–এ কাজ করার সময় ‘সওগাত’-এও মুনলাইটিং করা শুরু করেন। আদর্শগত বিভেদ সত্ত্বেও পত্রিকা থেকে পত্রিকায় কর্মীদের চাকরি-বদল চলত। ১৯৩১ সালে ‘মোহাম্মদী’তে যোগ দিচ্ছেন শামসুদ্দীন। নব্যপন্থী শামসুদ্দীনের রক্ষণশীল দলের পত্রিকা ‘মোহাম্মদী’তে ফের যোগ দেওয়ার কথায় ওয়াজেদ যান রেগে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘নীতির বালাই নাই আপনার?’ শামসুদ্দীন জবাব দেন, ‘আমি গেছি সেখানে চাকুরী করতে।… এই যে বিভিন্ন কাগজে নানা লোক কাজ করছেন, তাঁরা কি সবাই সে-সব কাগজের মতাদর্শ সমর্থন করেন, না করতে পারেন? তবু তাঁরা বিরোধী মতাদর্শের কাগজে চাকুরী করতে বাধ্য হচ্ছেন নিজেদের দুস্থ অবস্থার গরজে।’

পত্রিকার সঙ্গে লেখকের সম্পর্কও অদলবদল হতে থাকত। যেমন নজরুলের সঙ্গে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার সম্পর্ক। ১৯২১-২২ সালের দিকে নজরুল ‘মোহাম্মদী’তে ‘কাতুকুতু’ নামে দারুণ জনপ্রিয় রম্য লেখা লিখতেন। ১৯২৮-২৯ সালের দিকে আবার ‘মোহাম্মদী’ নজরুলের তীব্র বিরোধী হয়ে নানা লেখা ছাপায়। ১৯৩১ সালের পরে শামসুদ্দীনের দূতিয়ালিতে নজরুল সে পত্রিকায় ফের লেখা দেওয়া শুরু করেন। (শামসুদ্দীন, অতীত দিনের স্মৃতি)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক র আর স লবর স র ভ ব দর শ র জন ত ক নজর ল র ন নজর ল ইসল ম র সহকর ম র র জন র জন য প রক শ কল ক ত বর স র র স বর স বর র মওল ন করল ন য হইয় শয়ত ন করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাবির ৩০ শিক্ষার্থীকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড ও বৃত্তি প্রদান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফার্মেসি অনুষদের ৩০ শিক্ষার্থীকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড ও শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।

বুধবার (১৯ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের হাতে এ অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়া হয়েছে।

আরো পড়ুন:

ঢাবিতে ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেলেন শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী

শাবিতে ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড পেলেন ৫ শিক্ষক

অনুষ্ঠানে ২০২২২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ব্যাচেলর অব প্রফেশনাল ফার্মেসি পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল অর্জন করায় ছয় শিক্ষার্থীকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখায় অনুষদের সাতজন শিক্ষককে ডিন সম্মাননা প্রদান করা হয়।

এছাড়া, দুই বিশেষ ব্যক্তিকে বাংলাদেশ ফার্মাসিটিক্যাল সোসাইটি (বিপিএস) স্বর্ণপদক ও দুইজনকে কথাশিল্পী সরদার জয়েনউদ্দিন স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।

অপরদিকে, ২০২২ ও ২০২৩ সালের বি.ফার্ম প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ ও চতুর্থ বর্ষ পেশাগত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ জিপিএ আটজন শিক্ষার্থীকে বদরুন্নেসা গফুর মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বৃত্তি এবং ১৬ জন শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশ ফার্র্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি (বিপিএস) বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।

ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সেলিম রেজার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান।

বিশেষ অতিথি ছিলেন, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য(শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে ডিনস অ্যাওয়ার্ড স্পিকার হিসেবে বক্তব্য রাখেন রেডিয়েন্ট ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী।

এ সময় বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউটের পরিচালক, প্রাধ্যক্ষ, অনুষদের শিক্ষকবৃন্দ ও অভিভাবকরা উপস্থিত ছিলেন।

ডিনস অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা হলেন- সাদিয়া আফরিন, ফাহিমা জান্নাত কলি ও আল আশিকুর রহমান আলিফ, মো. তৌহিদুল ইসলাম, রাফিউদ্দিন খান লাবিব ও রুম্মান রেজা।  

ডিনস অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ হলেন- অধ্যাপক ড. আবু আছাদ চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রাশেদুল হক, অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মুহিত, অধ্যাপক ড. শিমুল হালদার, ড. মো. আল আমীন সিকদার, ড. যোবায়ের আল মাহমুদ এবং ড. মো. রায়হান সরকার।

বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি (বিপিএস) স্বর্ণপদক পেয়েছেন সাদিয়া আফরিন ও মো. তোহিদুল ইসলাম। কথাশিল্পী সরদার জয়েন উদ্দীন স্বর্ণপদক পেয়েছেন সাদিয়া আফরিন ও রুম্মান রেজা।

বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি (বিপিএস) বৃত্তিপ্রাপ্তরা হলেন- রায়হানা হক জেবিন, তাহমিনা আক্তার তন্বী, জোবায়ের হাসান, মো. শেখ ফরিদ সরদার, ফারিয়া আনান সৃষ্টি, আজমাঈন ইশাত খান, মো. তৌহিদুল ইসলাম, রুম্মান রেজা, জেরিন আনজুম সিফাত, ফারজানা তাবসসুম, রায়হানা হক জেরিন, তাহমিনা আক্তার তন্বী, রাফি উজ জামান, শায়েলা হক শুচি, ফারিয়া আনান সৃষ্টি ও আজমাঈন ইশাত খান।

বদরুন্নেসা গফুর মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বৃত্তিপ্রাপ্তরা হলেন- রায়হানা হক জেবিন, জোবায়ের হাসান, ফারিয়া আনান সৃষ্টি, তৌহিদুল ইসলাম, জেরিন আনজুম সিফাত, রায়হানা হক জেবিন, রাফি উজ জামান ও ফারিয়া আনান সৃষ্টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, “পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব বাড়িয়েছেন। কোনো অর্জন একক নয়, এতে পরিবারের সদস্য, শিক্ষক ও সমাজের অবদান স্মরণ করেই প্রতিটি সফলতার মূল্যায়ন করা উচিত।”

তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত অগ্রগতি সমাজের অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে। অভিভাবক, শিল্পোদ্যোক্তা, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট সেক্টরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিকে সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কের শক্ত প্রমাণ। দেশের ফার্মাসিটিক্যাল শিল্পের সাফল্য দূরদর্শী জাতীয় নীতির ফল। আর ফার্মেসি অনুষদ একটি ছোট অনুষদ হয়েও গবেষণা, র‌্যাঙ্কিং ও শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।”

ঢাকা/সৌরভ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভূমিকম্পে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন তিন হলে ফাটল, নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ
  • অপহৃত স্কুল ছাত্রী উদ্ধার, অপহরণকারী গ্রেপ্তার
  • অবৈধভাবে আমদানি ও চোরাচালানকৃত ফোন বন্ধ করা হবে: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
  • ঢাবির ৩০ শিক্ষার্থীকে ডিনস অ্যাওয়ার্ড ও বৃত্তি প্রদান
  • জামায়াতসহ ৮ দল নির্বাচন করবে সমঝোতার ভিত্তিতে: হামিদুর রহমান আযাদ
  • সেই সংবাদ সম্মেলন করেছে ‘মোবাইল বিজনেস কমিউনিটি’, অভিযোগ তুলেছে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের বিরুদ্ধে
  • সাংবাদিক মিজানুরকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
  • সাংবাদিককে ডিবি তুলে নেওয়ার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
  • ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে মওদুদ আহমদের সমালোচনা নেই: মির্জা ফখরুল