নিকট প্রতিবেশী উত্তর-পূর্ব ভারত ভ্রমণ (শেষ পর্ব)
Published: 26th, October 2025 GMT
কোহিমা দর্শন শেষে একটু বেলাবেলিই রওনা দিলাম আমরা ভারতের প্রথম পরিবেশবান্ধব পল্লী তথা ‘গ্রিন ভিলেজ’ খনোমার উদ্দেশ্যে। সদ্যসমাপ্ত বর্ষা মৌসুমের প্রকোপে, এমনিতেই জরাজীর্ণ পার্বত্য রাস্তার অবস্থা নাকি আরও শোচনীয় আকার ধারণ করেছে, তাই এই সাবধানতা। বাস্তবেও এর সত্যতা মিলল; দু’য়েক জায়গায় তো ভয়ঙ্কর ভূমিধসের জন্য বিকল্প পথেই যেতে হলো আমাদের। তবে গোটা পথের নিসর্গদৃশ্যরাজি ছিল ভারি মনোরম! সূর্য ডোবার ঠিক আগে আগে খনোমা পৌঁছে, বিশেষ করে আমাদের রাত্রিযাপনের ডেরা, পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত সরাইখানা ডোভিপাই ইন-এর সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতায় আমরা পথশ্রমের ক্লান্তি ভুলে গেলাম মুহূর্তেই।
খনোমা পাঁচশ বছরের পুরনো একটি পার্বত্যপল্লী, যার লোকসংখ্যা সাকুল্যে সাড়ে তিন হাজার এবং যাদের অধিকাংশই আঙ্গামি আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য, একদা যাদের কুখ্যাতি ছিল নরমুণ্ডশিকারী হিসেবে। অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশদের দ্বারা বিজিত হবার পর তাদের সিংহভাগই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং ক্রমে নরঘাতকের কুখ্যাতি ঘুঁচিয়ে শিক্ষিত, শান্তিকামী, সৌন্দর্যপ্রিয় ও প্রবলভাবে প্রকৃতিপ্রেমিক একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে; এতটাই যে, এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারত সরকার খনোমাকে দেশের প্রথম প্রকৃত ‘পরিবেশবান্ধব পল্লী’ ঘোষণা দেয়।
এই পল্লীতে বন্যপ্রাণী শিকার ও বৃক্ষনিধন নিষিদ্ধ; এখানে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে যাবতীয় চাষাবাদ হয়; কৃষিকাজে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জুমের পরিবর্তে ধাপচাষের প্রচলন হয়েছে এবং সর্বত্রই পরিচ্ছন্নতা ও উদ্যানচর্চাকে উৎসাহিত করা হয়। ফলে খনোমার চতুষ্পার্শ্বে অফুরন্ত সবুজের সমারোহ আর এন্তার পুষ্প ও বিহঙ্গের হাতছানি; এর জল ও বায়ু শতভাগ বিশুদ্ধ; এর আকাশে-বাতাসে ছড়ানো এক অপার্থিব শান্তি ও স্নিগ্ধতার সার্বক্ষণিক অনুভূতি। এহেন এক প্রাকৃতিক স্বর্গরাজ্যে, প্রিয়জন সান্নিধ্যে, গান, গল্প ও কবিতায়, একটি অপরূপ রাত্রিযাপনের আস্বাদন আমাদের ভ্রমণাভিজ্ঞতায় নতুন ও অমূল্য এক মাত্রা যোগ করে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ নদী-দ্বীপ মাজুলি
খনোমার অনিন্দ্যসুন্দর পার্বত্যপল্লীতে একটি অনাস্বাদিতপূর্ব রাত্রি কাটিয়ে পরদিন প্রসন্ন ভোরে আমরা রওনা করি দূর আসামের সমতলের দিকে, যেখানে বিপুল ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে আছে, সম্প্রতি ইউনেস্কো থেকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী-দ্বীপ মাজুলি, সার্বক্ষণিক নদীভাঙনের পরও যার আয়তন এখনও প্রায় চারশ বর্গমাইলের মতো।
হাজার বছরের পুরনো এই দ্বীপটির বৈশিষ্ট্য, এটি একটি সমতলভূমি, প্রায় নদীভাসা অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও, মূলত নানাগোত্রের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাসভূমি, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাতিটির নাম মিশিং। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ মহাঋষি শঙ্করদেবের নেতৃত্বে নববৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা এই অপরূপ, শান্তশ্রী, জলসিঞ্চিত, চিরসবুজ, বিহঙ্গমুখর দ্বীপটিতে এসে আশ্রয় নেয়।
মূলত এই বৈষ্ণবীদের ব্যতিক্রমী, সৌন্দর্যপ্রিয় জীবনচর্যার প্রভাবেই এই নিরিবিলি দ্বীপটি ক্রমে আসামের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে আদিবাসী সংস্কৃতি ও জীবনধারার মিশ্রণ এবং অনবদ্য নিসর্গরূপ আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রের সমাবেশে এটি আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। সংবৎসর যা মুখরিত থাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় আর নানাবিধ লোকজ উৎসবের সুনন্দ কলরবে।
দিনভর গাড়িতে বসে আমরা ডিমাপুর হয়ে আসামের জোড়হাট পৌঁছে, দিনের শেষ ফেরি ধরে উত্তাল ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে, রক্তিম সূর্যাস্ত শেষে ভরসন্ধ্যা নাগাদ এসে পৌঁছুই বহু প্রতীক্ষিত মাজুলি দ্বীপে। আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয় মিশিং স্থাপত্যে নির্মিত ছিমছাম বাঁশের টংঘরে। স্থানীয় বুনো কুক্কুটের মাংসসহযোগে পরম তৃপ্তির নৈশাহার সেরে ক্লান্ত শরীরে অতঃপর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়তে বিশেষ বিলম্ব হয় না কারোরই।
পরদিন লোভনীয় প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়ি দ্বীপভ্রমণে। সত্র নামে পরিচিত একাধিক প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্মাশ্রম পরিদর্শন, একটি নান্দনিক মুখোশ নির্মাণকেন্দ্র ঘুরে দেখা, আদিবাসী বয়নগৃহ থেকে কিঞ্চিৎ কেনাকাটা, দুপুরে এনচান্টিং মাজুলি নামে দারুণ একটি নবনির্মিত রিসোর্টে স্থানীয় লোহিত নদীর সুস্বাদু মৎস্য দিয়ে আনন্দ-আহার সমাপন, মাজুলির স্নিগ্ধসবুজ, শ্বেতবকের বিচরণধন্য প্রকৃতির মাঝখানে উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়ানো, বিকেলে আদিবাসী মিশিংপল্লী দর্শন শেষে ফিরে আসি আমাদের যারযার চিলতে টংঘরে।
তারপর ধড়াচূড়া ছেড়ে, মহানন্দে নৈশভোজ গ্রহণ ও গভীর রাত অব্দি প্রাণখোলা সম্মিলিত আড্ডার ভেতর দিয়ে শেষ হয়ে আসে আমাদের দেহমন সতেজ করা স্মরণীয় মাজুলি ভ্রমণ।
নামেরি অভয়ারণ্যে তাঁবুঘরে রাত্রিযাপন
মাজুলির পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নামেরি ইকোক্যাম্প, যা মূলত আসামের একটি বিখ্যাত বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যের মাঝখানে অবস্থিত পর্যটক অবকাশ কেন্দ্র। এর অন্যতম আকর্ষণ সুনসান আরণ্যক পরিবেশে বিশেষভাবে তৈরি তাঁবুঘরে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা। তো, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, রাস্তার ধারের ধাবায় বসে বিচিত্র সব খাদ্যবস্তু আস্বাদন এবং পথে পথে নানাবিধ বিপত্তি মোকাবিলা করে অবশেষে যখন সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের উদ্দিষ্ট গন্তব্যে এসে পৌঁছানো গেল, তখন তার অভূতপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর সবুজে ঢাকা, ছায়াঘন, নৈঃশব্দ্য-নিমজ্জিত পরিবেশের আবেশে মুহূর্তে পথশ্রমের ক্লান্তি ভুলে আমাদের দেহমন চাঙা হয়ে উঠল।
আরও ভালো লাগল আমাদের থাকার জন্য নির্ধারিত অভিনব, রীতিমতো রোমান্টিক তাঁবুঘরগুলো দেখে। অতঃপর ঝটপট পোশাকবদল করে, স্নান ইত্যাদি সেরে আমরা বসে পড়ি নৈশভোজ পূর্ববর্তী ক্ষুধাবর্ধক আড্ডায়। আড্ডা শেষে, লাগোয়া লোকজ রেস্তোরাঁয় আয়েশি উদরপূর্তির পর, আরেক প্রস্থ হুল্লোড়ে টেবিলটকে এন্তার রাজাউজির মেরে আমরা রাত নিশুতির আগেই ফিরে যাই যারযার তাঁবুতে, নিদ্রাদেবীর আরাধনায়।
পরদিন ভোরে উঠে আমাদের সম্মিলিত প্রাতঃভ্রমণ, তাঁবু-বারান্দায় বসে সকালের চা-পান, অবকাশ কেন্দ্রের কাছেই অবস্থিত ব্রহ্মপুত্রের বিখ্যাত, কিন্তু অধুনা বিলুপ্তপ্রায়, মহাশোল মাছের পুনরুজ্জীবন প্রকল্প পরিদর্শন, ষোড়শপচারে সজ্জিত রাজকীয় প্রাতরাশ গ্রহণ, সেখানে সদ্য অরুণাচল-ফেরত, কোলকাতার এক উষ্ণ ও আন্তরিক তরুণ বাঙালি দম্পতি দেবাংশু-বিদিশার সঙ্গে পরিচয় ও প্রাণের আলাপ সাঙ্গ করে অতঃপর আমরা আমাদের পরবর্তী অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেবার জন্য আঁটঘাট বেঁধে প্রস্তুত হই।
স্বপ্নের অরুণাচল স্বপ্নই থেকে গেল
সত্যি বলতে কি, আমাদের উত্তর-পূর্ব ভারত, তথা সপ্ত-ভগিনী ভ্রমণের প্রধান লক্ষ্যই ছিল সুদূর উত্তরে অবস্থিত, একেবারে চিনের সীমান্তবর্তী সুউচ্চ প্রদেশ, বরফঢাকা শ্বেতশুভ্র অরুণাচল দর্শন; অতি সম্প্রতি যাকে নিষেধের অবগুণ্ঠন তুলে সর্বসাধারণের জন্য শর্তসাপেক্ষে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আমরা শর্তানুযায়ী, আগেভাগেই অরুণাচল সরকারের কাছে যথাযথ আবেদনও করে রেখেছিলাম। কিন্তু, অজানা কারণে, আমাদের অরুণাচল প্রবেশের নির্ধারিত দিনের আগমুহূর্তেও সেই কাঙ্ক্ষিত ছাড়পত্র হাতে পাইনি আমরা। তবুও স্বপ্নের অরুণাচলের এত কাছাকাছি এসে ফিরে যেতে মন চাইল না আমাদের।
নামেরি থেকে পরদিন সকালে তাই সাহস করে আমরা নিকটবর্তী অরুণাচল সীমান্ত চেকপোস্ট ভালুকপংয়ের উদ্দেশে রওনা হই, যদি অন্তত আমাদের করা আবেদনপত্রখানির কপি দেখিয়ে, সমবেত অনুনয়-বিনয়ের মাধ্যমে সীমান্তরক্ষী মহাশয়ের করুণার উদ্রেক করে প্রবেশের অনুমতি সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু, হাঁ হতোস্মি! আমাদের এত জনের এত অনুরোধ, উপরোধেও আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটাতে সম্মত হলেন না, তাঁর আবাসভূমিটির মতই শীতল ও প্রস্তরবৎ সীমান্তপ্রহরী মহাশয়। সান্ত্বনা এটুকুই, এই কদিনের উদ্দাম অভিযানের ধকল সইতে না পেরে ঠিক অই মুহূর্তেই আচমকা আমার জুতো ছিঁড়ে গেলে, অরুণাচলের এই সীমান্তশহরের খানিকটা অভ্যন্তরে হেঁটে গিয়ে জুতো মেরামত করিয়ে নেবার সদয় অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল। এই সুবাদে এ যাত্রায় আপাতত এইটুকু অরুণাচল দর্শনের সৌভাগ্য হলো আমার।
ব্যর্থ ও বিফল মনোরথ আমরা অতঃপর সিদ্ধান্ত নিই, রাতটা এই ভালুকপং সীমান্তশহরেই অবস্থিত প্রশান্তি নামক সুন্দর, সরকারি পর্যটনকুটিরে কাটিয়ে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজে নেওয়ার, এবং প্রায় পাথরছোড়া দূরত্ব থেকে অধরা অরুণাচলের পার্বত্য আকাশরেখা অবলোকন করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করব। জায়গাটা সত্যি বেশ দৃষ্টিনন্দন ও প্রশান্তিময়; আঙিনা থেকেই দেখা যায় অরুণাচলের শান্ত, সবুজ নিসর্গদৃশ্য আর তার একেবারে গা ঘেঁষে বয়ে গেছে খুবই কাব্যিক নামের এক বিখ্যাত পাহাড়ি নদী, জিয়া ভরলি।
দুপুরে ভরপেট আহার এবং তৎপরবর্তী সংক্ষিপ্ত দিবানিদ্রা শেষে আমরা পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে, একখানা পাথরভরা স্বচ্ছতোয়া পার্বত্য ঝরনাধারা অতিক্রম করে, সুবিস্তীর্ণ শুভ্র কাশবন পাড়ি দিয়ে, বিকেলের মায়াময় জিয়া ভরলির জল ছুঁয়ে আসি। তখন সূর্যদেব সবে পাটে বসেছেন, কিন্তু পাহাড়ি ঐরাবত দলের আচমকা আগ্রাসনের ভয়ে আমরা তাঁর অস্তগমনের দৃশ্য পুরোপুরি উপভোগ না করেই অপরূপ অপার্থিব এক গোধূলি-আলোর আভা গায়ে মেখে তড়িঘড়ি ফেরার পথ ধরি। অবশ্য, ফেরার পথে আশ্রয়পল্লীর লাগোয়া, জনৈক হাসিখুশি আদিবাসী দম্পতির ঘুপচি দোকানে বসে, সুস্বাদু মোমো আর ধোঁয়া ওঠা চা-পানের সঙ্গে একপ্রস্থ সান্ধ্য আড্ডার পাশাপাশি, চরাচর উদ্ভাসিত করে উদিত হওয়া, লক্ষ্মী পূর্ণিমার পূর্ণশশীর শোভা উপভোগ করতে ভুলি নি আমরা।
রাতে, আমাদের ভোজনালয়ের সন্নিকটেই দেখি আসামের কিংবদন্তিতুল্য সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার সুবিশাল প্রতিকৃতিতলে, লক্ষ্মী পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বসেছে উদ্দাম নৃত্যগীতের আসর; তাতে সোৎসাহে যোগ দিয়ে, নিজেরাও কয়েক পাক নেচে আমরা অবশেষে ফিরে আসি আপন ডেরায়। তারপর ফের গল্প আর গান আর হাসির তোড়ে ভুলে যাই আমাদের অরুণাচল যেতে না পারার আক্ষেপ আর আহাজারি। এবং আরেকটি নতুন ভোরের স্বপ্ন নিয়ে একসময় তলিয়ে যাই সুখনিদ্রার কোলে।
ভ্রমণশেষের ভাঙা হাট, গুয়াহাটিতে দুইরাত
অরুণাচল প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে আমরা অতঃপর আসাম প্রদেশের রাজধানী গুয়াহাটি চলে আসি। উদ্দেশ্য দ্বিবিধ: গুয়াহাটিতে অবস্থিত অরুণাচল সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দপ্তর প্রধানের সঙ্গে দেখা করে ছাড়পত্র আদায়ের শেষ চেষ্টা করা এবং অন্যথায়, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে, অর্থাৎ মন্দের ভালো হিসাবে গুয়াহাটি এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো যতটা পারা যায় দেখে নিয়ে সেখান থেকেই আমাদের উত্তর-পূর্ব ভারত ভ্রমণের ইতি টানা।
যেই কথা সেই কাজ। একটানা গাড়ি চালিয়ে দুপুর নাগাদ গুয়াহাটি পৌঁছে, ছোট্ট ছিমছাম বুটিক হোটেল পালাসিওতে বাক্সপ্যাটরা ও অপর সহযাত্রীদের গচ্ছিত রেখে, আমাদের অঘোষিত দলপতি ও কোষাধ্যক্ষ্যা, যথাক্রমে মুরাদ ভাই ও মধুমিতাকে নিয়ে আমরা দৌড় দিই উদ্দিষ্ট সেই সরকারি দপ্তর অভিমুখে। সেখানে কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, নতুনভাবে আবেদনপত্র পূরণ ও নির্ধারিত মাশুল প্রদান করে, আশা ও আশ্বাস নিয়ে বিকেল নাগাদ ফিরে আসি হোটেল কক্ষে।
হোটেলে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম ও বিশ্রম্ভালাপ সেরে, বিকেলে সদলবল বেরিয়ে পড়া গেল গুয়াহাটির শহরকেন্দ্র অভিমুখে, তার আলো ঝলমল সান্ধ্যরূপ দর্শনের লক্ষ্যে। শহরের বিখ্যাত সেন্ট্রাল মলের অভ্যন্তরে খানিক ঘোরাঘুরি এবং ফুডকোর্টে পিৎজা ভক্ষণ শেষে আমরা এক পর্যায়ে ওপরতলার সিনেপ্লেক্সে ঢুকে পড়ি সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত, সোনালী বসু পরিচালিত বলিউডি ছবি ‘পিঙ্ক ইন দ্য স্কাই’ দেখার বাসনায়। দীর্ঘ ও কিছুটা ক্লান্তিকর ছবি শেষ হতে হতে প্রায় মধ্য রাত হয়ে গেলে, বিধ্বস্ত শরীরে হোটেলে ফিরে আর অযথা বাক্যব্যয় না করে সোজা সেঁধিয়ে যাই অপেক্ষমাণ নিদ্রাশয্যায়।
পরদিন সকালটাও কাটে অরুণাচল দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ ও দেনদরবারে, আমাদের সেই PAP (Protected Area Permit) নামধারী অধরা সোনার হরিণের পিছু ধাওয়া করে। অবশ্য, দুপুর নাগাদ আমরা মোটামুটি জেনে যাই যে, মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিক হওয়ার অপরাধে এবং ভারত সরকারের সাম্প্রতিক অভিবাসনবিধি, বিতর্কিত এনআরসির অদৃশ্য খড়্গরে কোপে পড়ে এবার আর অরুণাচলের শিকে ছিঁড়বে না আমাদের কপালে। ফলে আর কালক্ষেপণ না করে, বাকি সময়টুকু আমরা গুয়াহাটির যতটুকু সম্ভব দেখে নিতে তৎপর হই।
একটু বেলা পড়ে আসতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে যাই ছোট্ট সুন্দর সংস্কৃতিকেন্দ্র ‘মাটি’ দর্শনে, সেখান থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে হস্তশিল্পবিপণী ‘পূর্বশ্রী’তে। এরপর গুয়াহাটির বিখ্যাত ফ্যান্সি বাজারের কাছাকাছি এক জনাকীর্ণ শ্রী লেদারের শোরুম থেকে অবধারিত শস্তার পাদুকা ক্রয় এবং রাতের ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী উদ্যান ও শতবর্ষী প্রমোদপোত আলফ্রেস্কো গ্রান্দের ঘাট প্রাঙ্গণে বেড়িয়ে এবং সবশেষে এক বাঙালি দম্পতি পরিচালিত চিলেকোঠার রেস্তোরাঁয় মাছেভাতে উদরপুজো সেরে তাড়াতাড়িই হোটেলের পথ ধরি।
হোটেলে ফিরে আমরা যারযার মতো ‘এক্সিট প্ল্যান’ প্রণয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দেখা গেল, ইমাম ভাই কালবিলম্ব না করে পরদিনের বিমানেই ঢাকা ফিরে যেতে বদ্ধপরিকর; জেরিনা আপা, মুরাদ ভাই আর হোসনে আরা আপা সড়ক পথে শিলং ও সেখান থেকে দুদিন বাদে সীমান্ত পেরিয়ে সিলেট প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী, এবং মধুমিতা আসন্ন ভাইফোঁটা উৎসবে যোগ দিতে কলকাতা যেতে উদগ্রীব। মাঝ নদীতে হালভাঙা নৌকার মতো দিশেহারা আমরাও অগত্যা মধুমিতার লেজুড় ধরি। ঠিক হয়, পরদিন দুপুরে আমরা তিনজন মিলে উড়াল দেব কল্লোলিনী কলকাতার পথে। বিমানবন্দরে আমাদের সদানন্দ সহভ্রামণিক ইমাম ভাইয়ের দেখা পেয়ে এমন আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম আমরা যে, প্লেন মিস হবার উপক্রম হয়েছিল। মাইকে নিজেদের নাম ঘোষণা শুনে, পড়িমরি ছুটে গিয়ে বিশেষ বাসে চড়ে বিমানে পৌঁছে শেষ রক্ষা হয়েছিল আমাদের। অতঃপর, নটে গাছটি মুড়োলো, আমাদের উত্তর-পূর্ব ভারত ভ্রমণের গল্পখানিও ফুরোলো।
ঢাকা/তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ন দর য অবস থ ত ত ভ রমণ উদ দ শ র জন য পর ব শ র উদ দ আম দ র আস ম র পরদ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বিলুপ্ত নদীর তথ্য কি হারিয়ে যাবে
নদী যখন ভাঙে, তখন পাড়ে যা কিছু আছে, সবকিছুই গ্রাস করে। বাড়িঘর, গাছগাছালিসহ কোনো কিছুই বাদ যায় না। এই ভাঙনে অন্য নদীকেও গ্রাস করে ভাঙনপ্রবণ নদী। প্রাকৃতিকভাবে নদী পথ পরিবর্তন করলে পুরোনো প্রবাহ অনেক সময় বিলুপ্ত হয়। কৃত্রিমভাবে নদী মারা হয়। যেভাবেই নদী বিলুপ্ত হোক না কেন, তার তথ্য রাখা সরকারের দায়িত্ব। বাস্তবে সরকার এখন পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেনি। বিলুপ্ত নদী কেমন ছিল, সেখানে নৌযোগাযোগ ছিল কি না, জলজ কী কী প্রাণী ছিল—এ রকম যত তথ্য পাওয়া যায়, সবটাই সংগ্রহ করতে হবে।
একবার সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) রেকর্ড ধরে তিস্তা নদীর পূর্ববর্তী অবস্থান অনুসন্ধান করছিলাম। সিএস রেকর্ডে দেখলাম, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলায় সূতী নামে একটি নদী আছে। আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) রেকর্ডে দেখলাম সূতী নদী এখন তিস্তা নদীর গর্ভে চলে গেছে।
প্রথমে এক নদীর গর্ভে অন্য নদী দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। পরক্ষণেই ভেবেছি, ২ কিলোমিটারের তিস্তা নদী যখন দুপাশে ভেঙে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত সরে গেছে, তখন এই অংশের নদী তো নদীর গর্ভে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
কুড়িগ্রাম জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়তে গিয়ে জানতে পারি, এ জেলার চিলমারী উপজেলায় আইরমারী নামে একটি নদী আছে। এই নদীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জড়িয়ে আছে। নদীটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারি, এটি ব্রহ্মপুত্র নদের গর্ভে চলে গেছে অনেক আগে। কেবল আইরমারী নদী নয়, ওই স্থান থেকে আরও কয়েক কিলোমিটার নদী ভেঙেছে।
চিলমারী উপজেলার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই নদীতে প্রচুর আইড় মাছ পাওয়া যেত, তাই এ নদীর নাম হয়েছিল আইরমারী নদী। চিলমারীর প্রবীণ নাগরিক অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক দেলোয়ার হোসেন। অবসর গ্রহণেরও অন্তত ৩০ বছর হয়েছে। তাঁর কাছে জানতে পারি, কেবল আইরমারী নদী নয়, আরও দুটি ছোট ছোট প্রবাহ এ নদের গর্ভে বিলীন হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ দুপারে যে পরিমাণ ভেঙেছে, এতে আরও অনেক নদীকেই নিজের গর্ভে নেওয়া স্বাভাবিক।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নে উৎপন্ন হয়ে বুড়িতিস্তা-চারিষ্কার নদ প্রায় ৪০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে চিলমারী উপজেলার কাঁচকোল নামের স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হতো। এটি উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে উলিপুর উপজেলার থেতরাই নামের স্থানে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। বাঁক পরিবর্তনের স্থানে একটি কোণ সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা নদী বাঁ তীরে ভাঙতে ভাঙতে ওই কোণ ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছে। এতে বুড়িতিস্তা নদীটির প্রবাহ বদলে যায়। রাজারহাট ইউনিয়ন থেকে উৎপন্ন নদীটি থেতরাইয়ে গিয়ে এখন তিস্তা নদীতে মিলিত হয়েছে। আবার থেতরাই থেকে বাকি বুড়িতিস্তা নদী এখন কাঁচকোলে যায়। থেতরাইয়ে গিয়ে উজানের নদীটি এখন তিস্তার উপনদী এবং ভাটির অংশটুকু তিস্তার শাখানদীতে পরিণত হয়েছে। শাখানদীর মুখ এখন বন্ধ করে তিস্তা থেকে বুড়িতিস্তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ফলে এই নদীও বিলুপ্তির আশঙ্কা আছে। এ রকম ঘটনা অনেক নদীতে আছে।
লালমনিরহাটে সতী নদী এবং মরা সতী সম্পর্কে কাজ করতে গিয়ে চুঙ্গাদারা নামে আরেকটি নদীর সন্ধান পাই। নদীটি সিএস রেকর্ডে উল্লেখ আছে। লালমনিরহাটের সদর উপজেলায় গোকুণ্ডা ইউনিয়নে তিস্তা মৌজায় চুঙ্গাদারা নদীটি সরেজমিন খুঁজতে গিয়েছিলাম। সেখানে নদী না পেয়ে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ওই নামে এখন একটি বিল আছে, কোনো নদী নেই। অথচ সিএস রেকর্ডে স্পষ্টই একটি নদী দেখা যায়।
যে নদী অন্য নদীর সঙ্গে ভেঙে একীভূত হয়েছে, তার আলাদা পর্যবেক্ষণের বিষয় নেই। কিন্তু এ রকম কত নদী অন্য নদীর গর্ভে চলে গেছে, তার একটি তালিকা থাকার প্রয়োজন আছে। আমাদের নদীর বৈশিষ্ট্য কেমন, তারও ধারণা আমাদের জানা দরকার। আমি দীর্ঘদিন ধরে নদীর কাজ সরেজমিন করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছি। নয়তো আমারও জানা হতো না। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গেও হারানো নদীর সম্পর্ক আছে।
সরকার চাইলেই যে দ্রুত এই তালিকা করতে পারবে, এমনটি নয়। সুদূর অতীতের তথ্য হয়তো আর পাওয়াই যাবে না। যেমন মন্টোগোমারি মার্টিনের লেখা ‘দি হিস্টরি, অ্যান্টিকুইটিজ, টপোগ্রাফি, অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ বইয়ে কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় ‘ইছামতী’ নামে একটি নদীর উল্লেখ করেছেন। সেই বর্ণনা অনুযায়ী নদীটি অনেক অনুসন্ধান করেও আর পাইনি। আবদুস সাত্তার নামের এক সাংবাদিক রংপুর সদর উপজেলায় মডার্ন মোড়ে টেপা নামে একটি নদীর উল্লেখ করেছেন, যেটি বাস্তবে আর দেখা যায় না।
নদীর কাজ করতে মাঠপর্যায়ে অনেক স্থানে বলতে শুনেছি, ‘এখানে নদী ছিল, ওখানে নদী ছিল, এখন নেই।’ সিএস রেকর্ডে সব নদী রেকর্ডভুক্ত হয়নি। ফলে একমাত্র পুরোনো রেকর্ডই অনুসন্ধানের পথ নয়। ভূমিকম্পেও অনেক সময় নদীর মৃত্যু-জন্ম হতে পারে। নদীর গতিপ্রকৃতি বদলে যেতে পারে। প্রবল বন্যায়ও নদীর জন্ম-মৃত্যু হয়। প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম কারণেও নদী ভরাট হতে পারে। নদী দখল করে ভরাটকরণপূর্বক অবকাঠামো কিংবা অন্য কোনো কাজ করলেও নদী নিশ্চিহ্ন হতে পারে। যেভাবেই নদী নিশ্চিহ্ন হোক না কেন, তার তথ্য সংরক্ষণ কখনো কখনো জরুরি হতে পারে। প্রবল বন্যা ও ভূমিকম্প—দুই কারণে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র তার স্রোত হারিয়েছে। বাংলাদেশে ভূমিকম্প বিষয়ে গবেষণায় ব্রহ্মপুত্র নদের গতি পরিবর্তনবিষয়ক ঘটনার তথ্য কাজে লাগতে পারে।
জেমস রেনেলের ১৭৬৩ থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত সময়ে করা ম্যাপ আমাদের পুরোনো নদীর কিছুটা ধারণা দেয়। সিএস রেকর্ডেও প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো কিছু নদীর তথ্য পাওয়া যায়। পুরোনো বইয়ে বিশেষত আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর বইয়ে কিছু নদীর খোঁজ পাওয়া সম্ভব। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পুরোনো প্রবাহের কিছু ইমেজ পাওয়া সম্ভব, যার মাধ্যমেও কিছু নদীর তথ্য মিলবে। প্রবীণ ব্যক্তিরাও নদীর তথ্য দিতে পারেন। স্মৃতি থেকে ৬০ থেকে ৭০ বছর আগের নদী সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন।
সিএস রেকর্ড, রেনেলের ম্যাপ, পুরোনো বই, প্রযুক্তি, প্রবীণ ব্যক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত নদীর মধ্যে যেসব নদী বাস্তবে নেই, সেগুলোরও একটি তালিকা প্রণয়ন করা সরকারের অবশ্যকর্তব্য। সরকার বিলুপ্ত নদীর তথ্য সংগ্রহে বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন কিংবা ব্যক্তিরও সহায়তা নিতে পারে। এসবের জন্য সরকারের একটি কার্যকর উদ্যোগ ও সহজ পদ্ধতি থাকতে হবে। যতটা সম্ভব বিলুপ্ত নদীর তথ্য সংরক্ষিত থাকুক, এটাই প্রত্যাশা।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভাইভ পিপলের পরিচালক [email protected]