কৃষকের কলাবাগানে জালের বেড়ায় আটকা পড়েছিল বড়সড় এক অজগর। লম্বায় প্রায় আট ফুট। বিশাল প্রাণীটিকে দেখে পাড়ার লোকজন খবর দিলেন শচীকুমার ত্রিপুরাকে। জঙ্গলে ছেড়ে দেবেন বলে সাপটি কৌশলে উদ্ধার করে কাঁধে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন শচীকুমার। পাহাড়ি ঝিরিপথের ধারে হঠাৎই অজগরটি তাঁকে পেঁচিয়ে ধরে। মুহূর্তে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে জ্ঞান হারান তিনি। পেছনেই ছিলেন ওই এলাকার পাড়াপ্রধান সুরেন্দ্রকুমার ত্রিপুরা। পেঁচিয়ে ধরা সাপটির মাথা কেটে উদ্ধার করেন অচেতন শচীকুমার ত্রিপুরাকে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মহামায়া হ্রদের তীরে দেড় বছর আগের ওই ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যান শচীকুমার। উপজেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এরপর বাড়িতে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। শরীরের হাড়ে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন। তবু ওই ঘটনার কথা মনে পড়লে মনটা বিষাদে ছেয়ে যায় তাঁর। নিজের শারীরিক ক্ষতির কারণে নয়, বরং তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে সাপটিকে হত্যা করতে হয়েছে বলে। মানুষের বাড়িতে ধরা পড়া সাপ উদ্ধার করে জঙ্গলে ছেড়ে দেন ৬৫ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ। ২৫ বছর ধরে এই কাজ করছেন। সাপ উদ্ধারের পর লোকজন খুশি হয়ে যা দেন, তাতেই সংসার চলে তাঁর। কিন্তু সাপ ধরাটা তাঁর কাছে নিছক পেশা নয়, বরং ভালোবেসে কাজটি করেন তিনি। লোকে না বুঝেই পিটিয়ে সাপ মেরে ফেলে বলে আক্ষেপ তাঁর। সাপের সৌন্দর্যে মুগ্ধ এই বৃদ্ধের কথা, সাপ কারও ক্ষতি করে না। কেউ বিরক্ত না করলে আক্রমণও করে না।

মিরসরাই উপজেলার তালবাড়িয়া ত্রিপুরা পাড়ার উঁচু একটি পাহাড়ের চূড়ায় জরাজীর্ণ টিনের ঘরে বসবাস করেন শচীকুমার। স্ত্রী মচাংতি ত্রিপুরা, এক ছেলে ও ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে সংসার তাঁর। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সাপ ধরার শুরু কীভাবে, জানতে চাইলে খুলে ধরেন গল্পের ঝাঁপি।

ছোটবেলা থেকেই ঝিরিপথ আর ঝোপঝাড়ে সাপ দেখে বড় হয়েছেন শচীকুমার ত্রিপুরা। যেখানে পাড়ার লোকজন সাপ দেখলে ভয় পেত, শচীকুমারের ক্ষেত্রে ঘটত তার উল্টোটা। তিনি সাপ দেখলেই ছুটে যেতেন। কখনো কখনো ধরেও ফেলতেন। শুরুতে বিষ নেই, এমন সাপ ধরে আবার ছেড়ে দিতেন তিনি। এভাবে বিচিত্র রকমের সাপ চিনতে শুরু করেন। যতই সাপের ধরন, স্বভাব বুঝতে পারছিলেন, ততই ভালোবাসা জন্মাচ্ছিল। একবার এক প্রতিবেশীর ঘরে একটি পদ্মগোখরা হানা দেয়। শচীকুমার ঘরে ঢুকে কৌশলে সাপটিকে আয়ত্তে নিয়ে বস্তা বন্দী করে দূরের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসেন। এ খবর তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর পর থেকে কোথাও সাপের উপদ্রব হলেই তাঁর ডাক পড়ত। দিনে দিনে সাপ ধরার সংখ্যা বাড়তে থাকল।

সাপ ধরার বিনিময়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের কোনো টাকা দাবি করেন না। তবে মানুষ খুশি হয়ে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দেন। সাপ ধরতে গিয়ে গত ২০ বছরে এ পর্যন্ত তিনবার ছোবল খেয়েছেন। তবু সাপের প্রতি রাগ নেই তাঁর। কোনো কোনো সাপের প্রতি মায়াও পড়ে যায়। অসুস্থ হয়ে পড়া সাপ ঘরে রেখে যত্ন নেন। পরে সেটি আবার ছেড়ে দেন।

বছরে ২০-২৫টি সাপ ধরেন শচীকুমার ত্রিপুরা। তিনি বলেন, বেশির ভাগ সাপই বসতঘরের ভেতরে ইঁদুরের গর্তে, হাঁস–মুরগির খোঁয়াড় ও গোয়ালঘরে আসে। সেখান থেকেই ধরেন সেসব। তারপর ছেড়ে দেন জঙ্গলে। বিষধর সাপগুলো ধরে লোকালয়ের বাইরে নিরাপদ জায়গায় ছাড়েন তিনি। সাপ ধরার বিনিময়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের কোনো টাকা দাবি করেন না। তবে মানুষ খুশি হয়ে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দেন। সাপ ধরতে গিয়ে গত ২০ বছরে এ পর্যন্ত তিনবার ছোবল খেয়েছেন। তবু সাপের প্রতি রাগ নেই তাঁর। কোনো কোনো সাপের প্রতি মায়াও পড়ে যায়। অসুস্থ হয়ে পড়া সাপ ঘরে রেখে যত্ন নেন। পরে সেটি আবার ছেড়ে দেন।

কিছুদিন আগের কথা। পাশের এলাকার একটি বাড়ি থেকে ধরা একটি অসুস্থ কিং কোবরা ঘরে এনে রেখেছিলেন। সেটি নিয়ে দু–একবার বাজারে ঘুরতে গেলে খবর পেয়ে বন বিভাগের লোকজন এসে সাপটি নিয়ে যান তাঁর কাছ থেকে। সাপটির সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাঁর। এখন সেই সাপের জন্য চিন্তা হয়। সাপটি কেমন আছে, সেই ভাবনা কাটিয়ে উঠতে পারেন না। শচীকুমার বলেন, সাপ খুব সুন্দর আর নিরীহ প্রাণী।

অজগর সাপের কবল থেকে বেঁচে ফেরার গল্প শুনতে চাইলে শচীকুমার ত্রিপুরা বলেন, দেড় বছর আগে মহামায়া হ্রদ এলাকায় একটি কলাবাগানে জালের বেড়ায় আটকে থাকা প্রায় ৮ ফুট দৈর্ঘ্যের ৩০ কেজি ওজনের একটি অজগর উদ্ধার করেন তিনি। সেটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে সাপটি তাঁকে পেঁচিয়ে ধরে শ্বাস রোধ করে ফেলে। একপর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এরপর তিন ঘণ্টা কী হয়েছে তিনি কিছুই জানেন না। জ্ঞান ফিরে দেখেন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। অজগর চাপ দিয়ে তাঁর শরীরের হাড়গোড় দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল। তখনকার পাড়াপ্রধান সুরেন্দ্র কুমার ত্রিপুরা অজগরটির মাথা কেটে তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন। সে যাত্রায় তিনি বাঁচলেও অজগরটির এমন করুণ পরিণতি তাঁকে আজও ব্যথিত করে।

শচীকুমার ত্রিপুরার স্ত্রী মচাংতি ত্রিপুরা পাশে বসে স্বামীর কথা শুনছিলেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমার স্বামীকে লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তাঁর প্রাণ যায় যায়। সে যাত্রায় বাঁচলেও শরীরে অজগরের আক্রমণের ধকল এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। তবু সাপের প্রতি তাঁর দরদ একটুও কমেনি।’

‘সেদিন আমার স্বামীকে লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তাঁর প্রাণ যায় যায়। সে যাত্রায় বাঁচলেও শরীরে অজগরের আক্রমণের ধকল এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। তবু সাপের প্রতি তাঁর দরদ একটুও কমেনি।’মচাংতি ত্রিপুরা, শচীকুমার ত্রিপুরার স্ত্রী

অজগরের আক্রমণের শিকার শচীকুমার ত্রিপুরাকে সেদিন চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল মিরসরাই উপজেলা সদরের সেবা আধুনিক হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক আব্দুর রহমান বলেন, দেড় বছর আগে অজগরের হামলায় গুরুতর আহত শচীকুমারকে এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। কিছুটা সুস্থ হলে এখান থেকে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যান পরিবারের লোকজন।

এ নিয়ে কথা হয় তালবাড়িয়া ত্রিপুরা পাড়ার বর্তমান পাড়াপ্রধান উত্তম ত্রিপুরার সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শচীকুমার ত্রিপুরাকে অজগর সাপ পেঁচিয়ে ধরার ভয়ংকর ঘটনাটি আমি নিজের চোখে দেখেছি। আর কিছুক্ষণ সময় পেলে তাঁকে মেরেই ফেলত অজগরটি।’

তালবাড়িয়া এলাকার বৃদ্ধ আবুল বাশার বসু শেখ ও শচীকুমার ত্রিপুরা একই এলাকার বাসিন্দা। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনিও। তিনি বলেন, ‘অজগর পেঁচিয়ে ধরে শচীকুমার ত্রিপুরাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। আমি সেখানে গিয়ে তাঁকে অচেতন অবস্থায় দেখেছিলাম। পরে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন তিনি। সাপের প্রতি শচীকুমারের অদ্ভুত ভালোবাসা রয়েছে। এমন মানুষ সমাজে বিরল।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের মিরসরাই রেঞ্জের রেঞ্জ কার্যালয় সহকারী সাজ্জাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শচীকুমার ত্রিপুরার সাপ ধরার বিষয়টি আমরা জানি। অনেক সময় উদ্ধার করা অজগরসহ কোনো সাপ অবমুক্ত করতে আমরা তাঁর সহযোগিতা নিই। কিছুদিন আগেও আমাদের রেঞ্জ অফিস এলাকা থেকে একটি বিষধর সাপ উদ্ধার করে দিয়েছেন তিনি।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম রসর ই র ল কজন অজগর র এল ক র র একট

এছাড়াও পড়ুন:

সবজিখেতের জালের বেড়ায় আটকে পড়ল অজগরের বাচ্চা

বসতবাড়ির পাশে সবজিখেতের জালের বেড়ায় আটকে পড়ে একটি অজগরের বাচ্চা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমে সাপটিকে দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার দেন গ্রামের কয়েকজন নারী। চিৎকার শুনে ছুটে আসেন বাড়ির মালিক নিবারণ কুমার, তাঁর পিছু পিছু আসেন আশপাশের লোকজনও। মুহূর্তেই পুরো গ্রামে অজগর ধরা পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে।

শনিবার দুপুরে খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের দিঘিরপাড় গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাপটি উদ্ধার করে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম (ভিটিআরটি) ও বন বিভাগের সদস্যরা।

উদ্ধারকাজে নেতৃত্ব দেওয়া বন বিভাগের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান বলেন, অজগরটি প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে সেটিকে উদ্ধার করেন। পরে সুন্দরবনে সাপটিকে অবমুক্ত করা হয়।

বাড়ির মালিক নিবারণ কুমার বলেন, ‘আমার সবজিখেতে বেড়া হিসেবে সুতার জাল টানানো আছে। সেই জালের ফাঁকে আটকে পড়ে অজগরের মাথার অংশ। বাড়ির নারীরা প্রথমে দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে থাকেন। আমিও দৌড়ে গিয়ে দেখি, সত্যিই একটা অজগর জালে আটকে আছে। আগে শুনেছি পাশের গ্রামে অজগর আসে; কিন্তু আমাদের এখানে কখনো আসেনি। এবার হঠাৎই এল।’

অজগর উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই আশপাশের গ্রাম থেকে কৌতূহলী মানুষ ভিড় করেন নিবারণ কুমারের বাড়িতে। কেউ মুঠোফোনে ভিডিও করেন, কেউ ছবি তোলেন।

বন কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান বলেন, অজগরটি সুস্থ অবস্থায় ছিল। সাধারণত খাবারের সন্ধানে বা উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে তারা লোকালয়ে চলে আসে। সুন্দরবনে খাদ্যের অভাব নেই, তবে অজগরের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল। তাই মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ে। তিনি আরও জানান, এর আগে গত ১৭ জুন কয়রার সুন্দরবন-সংলগ্ন ৬ নম্বর কয়রা গ্রাম থেকেও ১০ ফুট লম্বা একটি অজগর উদ্ধার করা হয়েছিল। এখন মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। আগে সাপ দেখলেই পেটানো হতো, এখন সবাই বন বিভাগে খবর দেয়। আজকের অজগরটিও সেই সচেতনতার কারণেই বেঁচে গেছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সবজিখেতের জালের বেড়ায় আটকে পড়ল অজগরের বাচ্চা