ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ পেশ দুপুরে
Published: 28th, October 2025 GMT
‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’-এর বাস্তবায়ন কাঠামো ও আইনি ভিত্তিসংক্রান্ত চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরি করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে সরকারের কাছে এই চূড়ান্ত সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করবে কমিশন।
কমিশনের সুপারিশে সনদ বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই আদেশের ওপর গণভোট নেওয়া হবে। গণভোটে জনগণ ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেবে আগামী সংসদ। এজন্য সংসদ সদস্যদের নিয়ে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাস্তবায়ন শেষ হলে পরিষদ বিলুপ্ত হবে, তবে সংসদ কার্যক্রম চলমান থাকবে। বহুল আলোচিত ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ও গণভোটের সময়সীমা নির্ধারণ করবে সরকার।
রাজনৈতিক সমঝোতা হলেও জটিলতা আইনি ভিত্তি ঘিরে
কমিশন-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সনদের মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হলেও, সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন কাঠামো নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। আইনি ভিত্তির প্রশ্নে সব দল গণভোটে একমত হলেও, গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে অভিন্ন মত পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় কমিশন সনদ ও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দুটি পৃথক সুপারিশ হিসেবে সরকারকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কমিশনের এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংস্কার প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টি দল স্বাক্ষর করেছে, তবে ৫টি দল আপাতত স্বাক্ষর করেনি। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত ছাত্র-তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জানিয়েছে, আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। কমিশন তাদের উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়ে আশ্বস্ত করেছে যে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সংসদ ভবনে দীর্ঘ পর্যালোচনা ও বিশেষজ্ঞ মতামত
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর থেকেই এর বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কাঠামো নির্ধারণে কাজ করছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সোমবারও সংসদ ভবনের কমিশন কার্যালয়ে বৈঠক করেন সদস্যরা। সেখানে সনদের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ, ভুলত্রুটি শনাক্ত ও সংশোধনের পাশাপাশি আইন বিশেষজ্ঞ, বিচারপতি ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়। বাস্তবায়নের সাংবিধানিক ও আইনি দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। দলগুলোর জমা দেওয়া মতামতও বিশ্লেষণ শেষে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়, যাতে ভবিষ্যতে কোনো আইনি জটিলতা না হয়।
চূড়ান্ত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস
সোমবার (২৭ অক্টোবর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত কমিশনের সমাপনী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের উপস্থিতিতে সরকারকে এই সুপারিশ হস্তান্তর করা হবে। পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
কমিশন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের কাছে সুপারিশ হস্তান্তরের পাশাপাশি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ও গণভোটের সময় নির্ধারণ বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ জানানো হবে। সরকার গণভোটের আগে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ–২০২৫’ নামে একটি সাংবিধানিক আদেশ জারি করবে। ওই আদেশের ওপরই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে—যেখানে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে নাগরিকদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে। জনগণ ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে, নতুন সংসদ একযোগে আইনসভা ও সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। সংবিধান সংশোধন, পরিমার্জন ও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্পন্ন হলে পরিষদ বিলুপ্ত হবে, তবে সংসদ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
সংস্কারই জাতীয় ঐকমত্যের প্রতিফলন
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দল, আইনজ্ঞ, বিচারপতি, শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে।” বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি। কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু বিষয়ে বিকল্প প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যেই সরকার তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা কমিশনের গঠন থেকে চূড়ান্ত সুপারিশ প্রদান পর্যন্ত সব নথি, ভিডিও, অডিও ও আলোকচিত্র সংরক্ষণের ওপর জোর দেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জা“তি হিসেবে আমরা কীভাবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি এগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মূল্যবান দলিল। এসব নথি ক্যাটাগরি অনুযায়ী সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে গবেষকরা তা ব্যবহার করতে পারেন। টেলিভিশনে প্রচারিত আলোচনা, বৈঠকের ভিডিও ও চিঠিপত্র সবকিছু সংরক্ষিত থাকলে তা হবে ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।”
সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি আহ্বান
বৈঠকে কমিশনের সদস্যরা জুলাই সনদের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নেও সরকারের উদ্যোগ চেয়েছেন জানিয়ে সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা এমন এক কাঠামো তৈরি করেছি যা একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করবে।” তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি মূল দায়িত্বের (বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন) একটি ছিল কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন। রাজনৈতিক দলগুলো পার্থক্য সত্ত্বেও সংস্কারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল এটাই বড় প্রাপ্তি।
কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ৩১ অক্টোবর। এরপরও সরকারের প্রয়োজনে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কমিশন সদস্যরা।
সাহসী সিদ্ধান্ত না নিলে এই সুযোগ হারাব: বদিউল আলম মজুমদার
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারের দৃঢ়তা ও সাহসিকতা এখন জরুরি। গণঅভ্যুত্থানে যে ত্যাগ ও রক্ত ঝরেছে, সেই আত্মত্যাগ যেন অর্থবহ হয়। এই সুযোগ হারানো যাবে না।”
বিচারপতি এমদাদুল হক বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, কমিশনের আলোচনাগুলোতেও একই আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যের প্রতিফলন দেখা গেছে।”
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে আলোচনা করেছে। ভবিষ্যতেও যেন এই সৌহার্দ্য বজায় থাকে—এটাই প্রত্যাশা।”
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান ড.
শহীদ পরিবারের প্রত্যাশা: সংস্কার নিশ্চিত হোক
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার জানান, যত শহীদ পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা সবাই বলেছে সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে তাদের প্রিয়জনদের ত্যাগ বৃথা যাবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সরকার জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যাত্রা ও অগ্রগতি
চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দীর্ঘ আলোচনার পর রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের মতামতের ভিত্তিতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়।
গত ১৭ অক্টোবর ঐতিহাসিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল ও জোট সনদে স্বাক্ষর করে। দুই দিন পর, ১৯ অক্টোবর গণফোরামও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করে। কমিশনের আশা, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া স্পষ্ট হলে এনসিপিসহ বাকি দলগুলোও সনদে স্বাক্ষর করবে।
ইতিহাসের পথে নতুন অধ্যায়
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে বলেন, “এই সনদ কেবল রাজনৈতিক চুক্তি নয়, এটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তি স্থাপনের দলিল।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জাতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই সংস্কার সফল হলে বাংলাদেশ নতুন ইতিহাসের সূচনা করবে।”
ঢাকা/এএএম/ইভা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণঅভ য ত থ ন র প রস ত ব জ ল ই সনদ গণভ ট র সরক র র ন র পর অন ষ ঠ অন য য় মত মত দলগ ল সনদ র
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই শহিদ পরিবারের আক্ষেপ: ‘আদর্শ পূরণ হয়নি, আমরা এখনও বঞ্চিত’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জুলাই শহিদ পরিবারের বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে শহিদ পরিবারের সদস্যরা জানান, তাদের সন্তানেরা যে আদর্শ ও উদ্দেশে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা আজও পূরণ হয়নি।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া এবং জাতীয় ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
শহিদ পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন দপ্তরে তারা নানাভাবে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। তারা জানান, নিজেদের সমস্যাগুলো জানাতে চাইলেও অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতার কারণে তা সম্ভব হয় না।
পরিবারবর্গের অভিমত, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’-এর একটি আইনি ভিত্তি থাকা জরুরি, যাতে তাদের সন্তানদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। উপস্থিত সব পরিবার এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জুলাই ফাউন্ডেশন এ বিষয়ে কাজ করছে। তবে শহিদ পরিবারবর্গ যে প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না, তা কমিশনের জানা ছিল না। কমিশন আশ্বস্ত করে, উত্থাপিত সব বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
এছাড়া, শহিদ পরিবারবর্গ যখন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কমিশন তাদের এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
বৈঠকে ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলে উপস্থিত ছিলেন— আলহাজ্ব শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া (শহিদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা), মীর মোস্তাফিজুর রহমান (শহিদ মুগ্ধর বাবা), মোঃ মহিউদ্দীন (শহিদ ইয়ামিনের বাবা), কবির হোসেন (শহিদ জাবির ইব্রাহিমের বাবা), মোহাম্মদ আবদুল মতিন (শহিদ শাহরিয়ারের বাবা), মোঃ গোলাম রাজ্জাক (শহিদ রিয়ানের বাবা), মোঃ গাউছ উল্লাহ (শহিদ আব্দুল্লাহর ভাই), সাইফ আহমেদ খান (শহিদ আব্দুল হান্নানের ছেলে), মোঃ ওবায়দুল হক এবং সৈয়দ গাজীউর রহমান (শহিদ মোন্তাসিরের বাবা)।
ঢাকা/এএএম//