কুড়ি টাকা ধার করতে এসে বন্ধুর হলে আটকা পড়ে গেল মতিউর। চারদিকে ভয়, আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর সন্দেহ। কদিন ধরেই বাতাসে গুঞ্জরিত হচ্ছে নানা খবর। এর মাঝে হলের ডাইনিং এক সপ্তাহ যাবৎ বন্ধ। আতঙ্কে অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি চলে গেছে। রয়ে গেছে কেবল তারাই, যাদের ধরাবাঁধা টিউশনি আছে। টিউশনির মায়া তাদেরকে আটকে রেখেছে এই আতঙ্কের নগরীতে। মতিউরও কদিন ধরে বাড়ি যাব যাব করছিল। কিন্তু ঢাকা থেকে বাড়ির যে দীর্ঘ পথ, এত লম্বা পথ পাড়ি দেয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা তার কাছে নেই। আর এ কারণেই, বাড়ি যাওয়ার কুড়িটা টাকা ধার করতে সে আজ বিকেলে বন্ধুর কাছে এসেছে। আর এসেই, বন্ধুর হলে আটকা পড়ে গেছে। আর বেছে বেছে সেই হলেই, নেমেছে কেয়ামত।
মতিউর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র। জিন্নাহ হলে তার সিট। আর তার বন্ধু মৃত্যুঞ্জয়, সে থাকে সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দকৃত জগন্নাথ হলে। মতিউর এখন সেই হলেই আটকা।
আরো পড়ুন:
ইতিহাসের পাতায় ২৫ মার্চ ১৯৭১
চারদিকে ঘটনার এমন ঘনঘটা, মতিউর ভুলেই গিয়েছিল আজ সন্ধ্যা থেকে কারফিউ। কিংবা হতে পারে মনে ছিল, কিন্তু কারফিউকে সে গুরুত্ব দেয়নি। মার্চের শুরু থেকেই দফায় দফায় কারফিউ চলছে। আর যা ঘনঘন ঘটে, সন্তান জন্মদানের মতো তীব্র রোমাঞ্চকর ঘটনা হলেও তা এক সময় তাৎপর্যহীন হয়ে যায়। ফলে মতিউর কারফিউটাকে ভেবেছিল ভোতা, তাৎপর্যহীন অথবা টাকা ধারের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই টাকা ধারের উদ্দেশ্যে বিকেলের দিকে সে এসেছিল বন্ধুর কাছে, জগন্নাথ হলে। কিন্তু সন্ধ্যার পর ধারের টাকাটা পকেটে পুরে নিজের হলে যাওয়ার জন্য সে যখন পথে বেরোয়, বুঝতে পারে, এই কারফিউ মোটেও ভোতা কিংবা তাৎপর্যহীন কারফিউ না। বরং এই কারফিউ কোরবানির গরু জবাই করা ছুরির মতোই ধারালো।
মতিউরের গা শিউরে ওঠে! আর্মিদের মুখভঙ্গি অত্যন্ত কঠোর। রাস্তায় মানুষ দেখলেই ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটিয়ে ফেলার মতো কঠোর। মতিউয়ের মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের শীতল একটা স্রোত পায়ের দিকে নেমে যায়। সে ফিরে আসে। জগন্নাথ হলের গেট থেকে, আর্মির উত্থিত বন্দুকের নল দেখে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারায় বন্ধুর কাছে ফিরে আসে। বন্ধুকে জানায়―আজ রাতটা সে এখানেই, এই জগন্নাথ হলেই, তার কামরায় থেকে যেতে চায়।
জগন্নাথ হলের ২০৩ নম্বর কামরায় মৃত্যুঞ্জয় আর অজয় ভাগাভাগি করে থাকে। মতিউরের তুলনায় কারফিউ রাতের ভয় তাদের অনেক বেশি। কারণ তাদের পিতৃপ্রদত্ত নাম। মৃত্যুঞ্জয় আর অজয়ের মতো নাম যাদের জীবনের সাথে লেপ্টে আছে, আজকাল তাদের ভয়টা একটু বেশিই। তারপরও, গলা অবধি আতঙ্ক সত্ত্বেও, বন্ধু মতিউরকে তারা এক রাতের জন্য অভ্যর্থনা জানায়।
দুই অথবা ততোধিক মানুষ, হোক তারা নারী কিংবা পুরুষ, থাকুক তারা ভয় কিংবা ভালোবাসার শহরে, ফুরসত পেলেই তাদের মাঝে উঁকি মারে গল্প। অন্যভাবে বললে, মানুষের অস্তিত্বই গল্পের প্রতিবিম্ব। গল্পই মানুষের আদিম সঙ্গী। ফলে, সেই গল্পের বাতাস, এই ভয়ের রাতেও, তাদের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। তবে মতিউর খেয়াল করে, এর আগে তারা যতবার কথা বলেছে, গল্প করেছে, তাদের গল্পরা হাঁটাহাঁটি করেছে অতীত এবং ভবিষ্যতে। অতীতের স্মৃতি আর ভবিষ্যতের ভাবনা ছিল তাদের গল্পের প্রধান জনপদ। কিন্তু আজ কথা বলতে গিয়ে না অতীত না ভবিষ্যৎ―সবটুকু জুড়ে থাকে বর্তমান। আরো স্পষ্ট করে বললে, আজ রাতের বর্তমান। বাতাসে যা গুঞ্জরিত হচ্ছে, তা-ই কি সত্যি হবে! আচমকা সান্ধ্য-কারফিউ জারি করায় মতিউরের সন্দেহটা আরো গাঢ় হয়। সে বলে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজ ভরে সৈন্য ও গোলাবারুদ ঢাকায় আসছে। ক্যান্টনমেন্টে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। এগুলো তো ভালো লক্ষণ না।
এই দেশে তো যুদ্ধ চলছে না। তাহলে কীসের এত সামরিক প্রস্তুতি! আমার খুব অস্থির লাগছে। ভয় ঝরে পড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের কণ্ঠে।
অজয় বলে, আমার মনে হচ্ছে শিগগিরই এখানকার রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
তার জন্য ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান? মতিউর বিদ্রূপ করে।
তারা জানে, নেতাদের গ্রেপ্তার করলে জনগণ ফুঁসে উঠবে। হতে পারে এগুলো সম্ভাব্য সেই বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি। অজয় যুক্তি দেয়।
কিন্তু বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে ওদের তৎপরতা বেশি। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মৃত্যুঞ্জয়।
এখানকার অনেক ছাত্রনেতাও গ্রেপ্তার হবে। তাই জন্য এদিকে ওদের এত আনাগোনা।
কথার পিঠে নানা কথা উঠতে থাকে। তবে তাদের ভয় ও ভাবনা, তাদের শঙ্কা ও অনুমান কল্পনার নাগালের মাঝেই ঘুরপাক খায়। মূলত জন্মের সূচনা লগ্নেই বাস্তবতার নির্যাস দিয়ে মানুষের কল্পনার একটা সীমা বেঁধে দেয়া হয়। শত চেষ্টা করেও, মানুষ সেই কল্পনার দেয়াল ভাঙতে পারে না। ভাঙতে পারে না বলেই মতিউরদের সকল অনুমান কিংবা ধারণা সহিংসতা, গণগ্রেপ্তার, কারফিউ, বড়জোর দু’চারটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মাঝে ঘোরাঘুরি করে। তারা ধারণাও করতে পারে না, কেয়ামতসম কী এক ভয়াল রাতের মুখোমুখি তারা হতে চলেছে।
বিক্ষিপ্ত দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা আর অস্থিরতার মাঝেও জগন্নাথ হলের ২০৩ নম্বর কামরায় হাজির হয় আরেক আদিম বস্তু―ক্ষুধা। ক্ষুধার যে কোনো জাত-পাত-ধর্ম নেই, সময়জ্ঞান নেই, তা আরো একবার বুঝিয়ে দিতে দশটা বাজতে বাজতে মতিউরের পেটের ভেতর ক্ষুধার ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। কিন্তু ডাইনিং বন্ধ। বন্ধ দোকানপাটও। ফলে এই দুঃসময়ে মৃত্যুঞ্জয়ের মায়ের হাতের নাড়ু আর মুড়িই একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে। মৃত্যুঞ্জয় চৌকির তলা থেকে মুড়ির কৌটা বের করে আনে। আলগা করে দেয় নাড়ুর বয়ামের মুখ। এবার তিনজনের কথার সঙ্গী হয়ে ওঠে নাড়ু-মুড়ি। এগারোটা বাজতে বাজতে হাই তোলা শুরু করে অজয়। ওর হাই সংক্রমিত করে বাকি দুজনকেও। তিন বন্ধু ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু বাইরে কারফিউ, আর্মির টহল আর গুঞ্জন―এর মাঝে কীভাবে ওদের ঘুম হতে পারে! ওরা ঘুমায় না। ওরা বরং জানালায় বসে রাতের আকাশে এই ভূখণ্ডের ভাগ্যরেখা পড়ার চেষ্টা করে।
ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। মার্চের মনোরম হাওয়ায় মৃত্যুঞ্জয়ের জানালার পর্দা দোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায়, কারফিউ অগ্রাহ্য করে, কুকুরের ডাক প্রবল হয়। হলের সামনে শিরীষ গাছে রাতের নিয়ম ভেঙে একটি কাক কা কা করে উঠলে এদেশের ভাগ্যললাটে বেদনার এক গভীর ক্ষত বিধিবদ্ধ হয়ে যায়। রাত এগারোটার দিকে নিশ্চুপ রাস্তায় জেগে ওঠে সাঁজোয়া যানের শব্দ। সেই শব্দে মতিউরের মনে কু ডাকতে শুরু করে। সাঁজোয়া যানের বিকট শব্দ অশনি সংকেত হয়ে বাজতে থাকে তার কানে। জানালার পর্দা সরিয়ে সে বাইরের রাস্তার দিকে তাকায়। অন্ধকারের অপ্রত্যাশিত প্রাচীরে সজোরে ধাক্কা খায় তার চোখ। কী এক অদ্ভুত কারণে শহরকে আজ অন্ধকারে ডুবিয়ে নিভে গেছে সকল সড়কবাতি। মতিউরের গা ছমছম করে। বন্ধুদের আড্ডায় কত রাতই তো সে বাইরে বাইরে থেকেছে। কিন্তু রাস্তার এমন অদ্ভুতুড়ে রূপ সে আগে কখনো দেখেনি। একটুখানি আলোর জন্য রাস্তার দুই মাথায় সে বারবার তাকাতে থাকে। আর তখনই খেয়াল করে, সার্চ লাইটের চোখ ঝলসানো তীব্র আলো এসে পড়ল জগন্নাথ হলের গেটে। আলোও যে কখনো এমন গভীর অন্ধকার হয়ে হাজির হতে পারে জীবনে, এর আগে কি কখনো ভেবেছিল মতিউর?
খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে মনে হয়। সাপের চোখের মতো শীতল কণ্ঠে বলে মতিউর।
খারাপ কিছু মানে? মৃত্যুঞ্জয় ও অজয় চাপা গলায় চিৎকার করে ওঠে।
ওই দেখ পাকিস্তানি সৈন্য। ট্যাংকও নেমেছে।
কই কই!
পুকুর পাড়ে দুটো কুকুর ঝগড়া করছে। প্রতিদিন এ সময় শিরীষ গাছের মাথার ওপর চক্কর খায় একটি বাদুড়। আজ কি সে চক্কর কাটছে নাকি ভয়ে অন্য কোনো শহরে পালিয়েছে? হঠাৎ কুকুরদের কণ্ঠ চাপা দিয়ে চাকায় কর্কশ শব্দ তুলে পূর্ব দিকের দেয়াল ভেঙে হলের সামনে এসে থামে একটি সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক। কুকুরের ঘেউ ঘেউ এবং ইঞ্জিনের ভৌতিক শব্দে গা শিরশির করে তিন বন্ধুর। মৃত্যুঞ্জয় এবং অজয় ছুটে যায় দ্বিতীয় জানালার কাছে। আলগোছে কপাট সরিয়ে চোখ রাখে বাইরে। শুধু ওরাই নয়, হলের প্রায় সকল জানালার কপাটে তখন ভয়ার্ত শিক্ষার্থীদের চোখ। মৃত্যুঞ্জয়রা দেখে, দানবের মতো ভয়ংকর এক সাঁজোয়া যান এসে দাঁড়িয়েছে হলের সামনে।
সেই শিরীষ গাছ, যা হলের খোলা চত্বরকে ছায়া দিয়ে রাখে সবসময়, সে কি একটু কেঁপে ওঠে ভয়ে? কিংবা শঙ্কিত হয়? এই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য? শিরীষ গাছ কাঁপুক অথবা না কাঁপুক, তিন বন্ধু বদ্ধ ঘরে ঠিকই কাঁপতে থাকে। বুঝতে বাকি থাকে না ওদের, ওরা আক্রান্ত হতে চলেছে। এ সময় বাড়ির কথা মনে পড়ে সবার। মায়ের কথা মনে পড়ে। আতঙ্কে অবশ ওদের মাথায় এই প্রথম পালানোর ভাবনা আসে। কিন্তু পালাবে কীভাবে! সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে নির্ঘাত গুলি। ইতোমধ্যে সিঁড়ির মুখে কয়েক জনের আখেরি চিৎকার শুনেছে ওরা। পালানোর চিন্তা তাই বাদ দিতে হয়। তারচেয়ে বদ্ধ কামরায় নিয়তির জন্য অপেক্ষা এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ভালো।
ওরা যখন এইসব ভাবছে, ততক্ষণে সাঁজোয়া যান থেকে একদল সৈন্য ঝুপঝাপ নেমে পড়েছে। গুলি করতে করতে তারা এগিয়ে আসছে হলের দিকে। পুরো হলজুড়ে এবার হুলস্থুল পড়ে যায়। কেউ কেউ দোতলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পালাতে চায়। তারা পালাতে পারে, নাকি পতিতজনিত আঘাতের ভারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে দেয়ালের গা ঘেঁষে, অন্ধকারে বোঝা যায় না। অজয় ও মৃত্যুঞ্জয় পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। মতিউর মুসলমান। এই বিভীষিকা তাকে স্পর্শ নাও করতে পারে। তার কালেমা আছে। সেই কালেমা তাকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় অজয়ের রক্ষা নেই। কারণ তারা হিন্দু। আর হিন্দুদের মারার জন্যই ওরা এই জগন্নাথ হল বেছে নিয়েছে, যেটা অমুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ। মতিউর বাধা দেয় ওদের। পুরো হল ঘিরে রেখেছে আর্মি। দোতলার বারান্দায়ও উঠে আসছে তারা। এমতাবস্থায় পালাতে যাওয়া মানে সবার আগে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা।
আচ্ছা পালালাম না। কিন্তু এইখানে থেকে লাভটা কী? ক্ষিপ্ত গলায় বলে ওঠে মৃত্যুঞ্জয়।
কিছু সময় বেশি বাঁচতে পারবে। এইটাই লাভ। থমথমে গলায় বলে মতিউর।
মা, আমি হয়তো আর বাঁচব না। মায়ের উদ্দেশে কান্না শুরু করে অজয়। তার কান্না সংক্রমিত করে বাকি দুজনকেও। ওরাও মায়ের কথা ভেবে চোখ মোছে।
দুই মিনিটের মাথায় দোতলার দরজায় দরজায় করাঘাত পড়তে শুরু করে―খটখটখট। যেন আজরাইলের পাখার আওয়াজ। বুক হিম হয়ে যায় মতিউরদের। ভয়ে ওরা চৌকির নিচে পালায়। সিঙ্গেল চৌকির তলা। মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যায়। পা ঢাকলে মাথা। তাদের মুখে তখন শুধুই আল্লাহ ও ভগবানের নাম। সৈন্যদের পায়ের খটখট শব্দ সিঁড়ির দিক থেকে ধীরে ধীরে রুমের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। শব্দটা যখন সত্যি সত্যি ওদের দরজায় আছাড় খায়, মতিউরদের বুক ধড়াশ করে ওঠে। ওরা পরস্পরের হাত শক্ত করে চেপে নিশ্বাস বন্ধ করে রাখে। যেন নিশ্বাস বন্ধ রাখলেই সৈন্যরা টের পাবে না তাদের উপস্থিতি। সৈন্যরা কতক্ষণ কর্কশ কণ্ঠে ডাকাডাকি করে। সাড়া না পেয়ে ওরা ভেঙে ফেলে দরজা। দরজার ভারী কপাট হুড়মুড় করে পড়ে যায় কামরার ভেতর।
‘নিকলো, নিকলো’ করতে করতে দুই সৈন্য প্রবেশ করে দরজা ভাঙা কামরায়। ওরা মতিউরদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনে চৌকির নিচ থেকে। দাঁড় করায় বারান্দায়। মতিউর দোতলার বারান্দা থেকে দেখে, অনেকগুলো ছাত্রকে শিরীষ গাছের তলায় সার ধরে দাঁড় করানো হয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে তাদের সংখ্যা। আর কয়েকজন সৈন্য তাদের বুক বরাবর তাক করে আছে রাইফেল। গায়ে ঝটকা লাগে মতিউরের। বুঝে নেয়, মৃত্যু বড্ড নিকটে। এখান থেকে বেঁচে ফেরার কোনো উপায় নেই। হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে―মুঝে মাত মারো। মুঝে মাত মারো। হাম মুসলমান।
মুসলমান! ইস হল মে মুসলমান! অদ্ভুত দৃষ্টি হানে সৈন্যটি। তার চোখে যুগপৎ বিস্ময় ও সন্দেহ। কালেমা বোল। মতিউর কালেমা বলে। বিশুদ্ধ স্বরেই বলে। কিন্তু বিশুদ্ধ কালেমাও তার মুসলমানিত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়। ওরা মতিউরকে প্যান্ট খুলতে বলে। মতিউর অসহায় চোখে চারপাশে তাকায়। তারপর দ্বিধা নিয়ে কোমর থেকে ধীরে ধীরে প্যান্ট নামায়। এক সৈন্য মতিউরের পুরুষাঙ্গের ওপর টর্চের আলো ফেলে। অবাক হয়ে সে সঙ্গীকে বলে, এ লাড়কা তো সাচ বোলে। এ সাচ্চা মুসলমান হ্যায়।
মৃত্যুঞ্জয় ও অজয় এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এ তাদের বন্ধু মতিউর। যে বন্ধু ধর্মের ঢাল দিয়ে স্বার্থপরের মতো একা একা বাঁচার চেষ্টা করছে। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বন্ধুর স্বার্থপরতা ও নীচু মানসিকতা মৃত্যুঞ্জয়কে ফালাফালা করতে থাকে। সে যুগপৎ ব্যথা এবং ঘৃণাভরা চোখে মতিউরের দিকে তাকায়, যে মতিউর চামড়া কাটা শিশ্ন প্রদর্শন করে ইতোমধ্যে বেঁচে থাকার সনদ জুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু জীবনের প্রবাহ এতটাও সরলরৈখিক নয় যে এটুকু দেখেই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা যায়। বরং জীবনের এই পাঠ্যবইয়ে সরল বাক্যের পাশেই আসন পেতে বসে থাকে বহু বহু যৌগিক ও জটিল বাক্য। সরল বাক্যের সহজতায় তাই হুট করে জীবন থেকে হৃদয় গুটিয়ে নেয়া উচিত নয়। বরং সরলতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা জটিলতার ভাঁজও খুলে দেখা প্রয়োজন।
আর এ কারণেই, সৈন্যরা যখন মতিউরকে ছেড়ে দিয়ে হিন্দু মৃত্যুঞ্জয় ও অজয়কে চত্বরে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়, তখন পরবর্তী কৌশল প্রয়োগ করে মতিউর। সে সৈন্যদের মিনতি করে জানায়―তার এ দুই বন্ধু হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়েছে বলেই হিন্দু। আসলে ওরা মুসলমান হতে চায়। আর বন্ধু হিসেবে ওদের মুসলমান বানানোর দায়িত্বও এসে পড়েছে মতিউরের কাঁধে। এ কারণে প্রায় রাতেই সে এই হলে আসে, দুই বন্ধুকে ইসলামের বিধান শেখায়। আজও এ কারণেই সে এসেছিল এই হলে। না হলে সে মূলত থাকে জিন্নাহ হলে।
মতিউরের বক্তব্যে সৈন্য দুটোর মনে খটকা লাগে। হুট করে তারা বিশ্বাস করতে পারে না। আবার মতিউরের বক্তব্যে এমন প্রত্যয়, ফেলেও দেয়া যায় না। মতিউর কাতর মিনতি জানায়―ওরা মুসলমান হলে তো ইসলামেরই লাভ। আর ওদের মৃত্যু মানে দুজন সম্ভাবনাময় মুসলমানের মৃত্যু।
বন্ধুর অনাবিল অনর্গল মিথ্যায় যমদূতের সামনে দাঁড়িয়েও হকচকিয়ে যায় দুই বন্ধু। ওরা খেয়াল করে, বন্ধুর মিথ্যা গিলতে শুরু করেছে সৈন্যদ্বয়। তাদের চোখেমুখে আশ্বস্তের ছায়া।
এক সৈন্য দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ধমক মারে―কালেমা বোলে।
ওরা থতমত খায়। হিন্দু হলেও মুসলিম অধ্যুষিত সমাজে বসবাস করার কারণে ভাঙা ভাঙা কালেমা ওদেরও মুখস্থ। কিন্তু সেই ভাঙা ভাঙা কালেমা বন্দুকের নলের মুখে আরো ভেঙে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বন্দুকধারীদের আশ্বস্ত করবার মতো কালেমা ওদের পরিবেশন করা হয়ে ওঠে না। যে কারণে মৃত্যুই ওদের নিয়তি হয়ে ওঠে। মৃত্যুর সেই অনিবার্য নিয়তির সামনে দাঁড়িয়ে এই মার্চ মাসের ঈষৎ শীতল রাতেও ওরা দরদর করে ঘামতে থাকে। এ সময় ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় মতিউর। সে তড়িঘড়ি দুই বন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে বলে, কালেমা আমার সাথে সাথে বল। আমি যা বলি শুনে শুনে তা-ই বল। যেভাবে একটু আগে আমার সাথে রিহার্সাল করছিলি। বল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ।
হতবাক মৃত্যুঞ্জয়-অজয় অশ্রুসিক্ত চোখে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে কালেমা পড়ে। তাদের চোখের পানির সাথে টপকে টপকে পড়ে অপমান ও গ্লানি। একেকবার মনে হয়, এই গ্লানির ভারের চেয়ে মৃত্যুর বেদনা সহজ। মৃত্যুঞ্জয়দের কালেমায় সন্তুষ্ট হয় সৈন্যদ্বয়। ওরা মৃত্যুঞ্জয়দের ছেড়ে দিয়ে পাশের কামরায় যায় নতুন শিকারের আশায়। আর তখন তিন বন্ধু কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসে নিজেদের কামরায়, যে কামরার দরজা হাট করে খোলা। মৃত্যুঞ্জয় ও অজয় দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ফোঁপায়, অপমানের আগুনে দগ্ধ হয়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এখনো বেঁচে আছে দুজন। আর মতিউর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই এতটাই অবশ যে, কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারে না। কেউ কারো সাথে কথাও বলতে পারে না।
ওদিকে তখনো চিৎকার, কান্নাকাটি, গুলির শব্দ বেজে চলছে জগন্নাথ হলজুড়ে। ঘণ্টাখানেক পর হলের প্রায় পঞ্চাশের অধিক ছাত্র-কর্মচারী-শিক্ষক ও বস্তিবাসীকে দাঁড় করানো হয় শিরীষ চত্বরে। মানুষগুলো কাকুতি-মিনতি করে, জীবন ভিক্ষা চায়। কিন্তু তাদের কান্না, চোখের জল, কলজে ফাটা আর্তনাদ সৈন্যদের মনে দয়ার উদ্রেক ঘটায় না। তারা আনন্দ জ্বলজ্বল চোখে জঙ্গলে হরিণ শিকারের উত্তেজনা নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। সারিবদ্ধ জনতা গোড়াকাটা কলাগাছের মতো একে একে লুটিয়ে পড়ে সবুজ ঘাসের ওপর। কয়েকটি ব্যর্থ নিশানা শিস কেটে বিদ্ধ হয় হলের দেয়ালে।
জানালার কপাটে চোখ রেখে রুদ্ধশ্বাসে সেই রোমহর্ষক দৃশ্য দেখে চলে মতিউররা। গুলির শব্দ, নিহতের আর্তনাদ, কাঁচা রক্তের গন্ধ ওদের অসাড় করে তোলে। যে মানুষগুলো মারা গেল, তাদের অনেকের সাথেই ওদের চেনাজানা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। অনেকের সঙ্গে মিশে ছিল কয়েক বছরের স্মৃতি ও ভালোবাসার সৌরভ। সেই মানুষগুলো এক মুহূর্তে অন্য ভুবনের বাসিন্দা হয়ে গেল। আর কখনো কি দেখা হবে ওদের সাথে? তিন বন্ধু ফোঁপায়, অসাড় হয়, অপমানে ক্ষয় হতে থাকে। মতিউরের চেয়ে বাকি দুজনের বেদনা বেশি। মতিউরের মতো তারাও এ মাটির সন্তান। অথচ আজ জীবন রক্ষার প্রয়োজনে তাদেরকে ইসলাম ধর্মের বর্ম পরতে হয়েছে।
সৈন্যরা অনেক রাত অবধি বুলডোজার দিয়ে লাশ গণকবর দেয়। এ কাজে সাহায্য পেতে পাশের বস্তি থেকে ধরে আনা হয় বেশ কয়েকজন প্রৌঢ়কে। তারা চোখে নির্বিকারত্বের ঠুলি পরে রুদ্ধশ্বাসে হুকুম তালিম করে চলে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। চেনা চত্বরে গণকবর রেখে চলে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তবু অসাড়তা কাটে না জীবিত তিন বন্ধুর। ওদের শুধু মনে হয় এ বাস্তব নয়, এ দুঃস্বপ্ন। একটু পরেই ঘুম ভাঙবে আর সবকিছু মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে। বাস্তব কখনো এতটা ভয়ংকর আর বীভৎস হয় না! ওরা নির্ঘুম চোখে বাস্তবতার জন্য অপেক্ষা করে। যে বাস্তবতায় বারুদ ও রক্তের গন্ধ নেই। যেখানে আছে পড়াশোনা, টিউশন, খেলাধুলা ও জীবনের কোলাহলে পূর্ণ ছবি। কিন্তু কাকের ওড়াউড়ির সাথে পরদিন যখন আগুনপোড়া ভোর আসে ঢাকায়, ওরা বুঝতে পারে, এ দুঃস্বপ্ন নয়, বাস্তব। গতকাল রাতে যা ঘটে গেছে তার প্রতিটি অক্ষর সত্য। সৈন্যদের আগমন, আক্রমণ, গণহত্যা, মতিউরের শিশ্ন প্রদর্শন, মৃত্যুঞ্জয়দের কালেমা পাঠ―সব সত্য।
ভোরের আলোয় কামরা ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠলে দুই বন্ধুর দিকে আড়চোখে তাকায় মতিউর। বন্ধুদ্বয় তখনো হতবাক, বিমূঢ় ও বিপর্যস্ত। তাদের চোখে তখনো অপমানের জল। নিজেকে খুব ছোট, তুচ্ছ আর নীচ মনে হয় মতিউরের। একটা কথাই তার বুকে ক্রমাগত ছোবল হানতে থাকে―গতরাতে, পাকিস্তানি সৈন্যদের কারণে, তার ধর্ম ইসলামের সবচেয়ে বড় নৈতিক পরাজয় ঘটে গেছে। এই পরাজয়ের গ্লানি কাটিয়ে উঠে আর কোনোদিন সে মৃত্যুঞ্জয়দের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
ঢাকা/তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ২৫ ম র চ ছ টগল প ম ত য ঞ জয়দ র জগন ন থ হল র প রস ত ত দ ই বন ধ ত র জন য ত ন বন ধ ম সলম ন জ বন র র স মন বন ধ র অপম ন ইসল ম আতঙ ক
এছাড়াও পড়ুন:
পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী
কম্বোডিয়ার সীমান্তে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলা নতুন সংঘর্ষের পর পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েছেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আনুতিন চার্নভিরাকুল। একইসঙ্গে তিনি ৪৫ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন।
শুক্রবার প্রকাশিত এক রাজকীয় ডিক্রিতে প্রধানমন্ত্রী আনুতিন চার্নভিরাকুল তিন মাস আগে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তার সংখ্যালঘু সরকার যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে লড়াই করছে তার মধ্যে মারাত্মক সীমান্ত বিরোধের কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন, “সঠিক সমাধান হল পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া... যা জনগণের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার একটি উপায়।”
ব্যবসায়ী আনুতিন ২০২৩ সালের আগস্টের পর থাইল্যান্ডের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। সেপ্টেম্বরে ক্ষমতা গ্রহণের সময় জানিয়েছিলেন, তিনি জানুয়ারির শেষের দিকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেবেন। তবে, এখন অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়ে আগাম নির্বাচন ঘোষণা করেছেন।
গত মাসে দক্ষিণ থাইল্যান্ডে ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলার জন্য অনুতিন এবং তার ভুমজাইথাই দল তীব্র সমালোচিত হয়েছিল। বন্যার ফলে কমপক্ষে ১৭৬ জন নিহত হয়েছিল। কম্বোডিয়ার সাথে নতুন করে সংঘটিত লড়াইয়ের কমপক্ষে ২০ জন নিহত এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
থাইল্যান্ডের রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন অনুমোদিত ডিক্রিতে অনুতিন লিখেছেন, “দেশকে ঘিরে থাকা জরুরি সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের জন্য সরকার জনপ্রশাসনের সকল উপায় অবলম্বন করেছে... তবে দেশ পরিচালনার জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।”
ঢাকা/শাহেদ