অর্ধশতাব্দীর বেশি আগে, ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার পাহাড়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টাইন বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার রাইফেল। কিন্তু তাঁর কথার প্রতিধ্বনি আজও আন্দিজ পর্বতমালা থেকে শুরু করে গাজার শরণার্থীশিবির—সমগ্র বৈশ্বিক দক্ষিণজুড়ে ধ্বনিত হয়।

আজ তাঁর মৃত্যুর ৫৮ বছর পর আবার যে প্রশ্নটা ফিরে আসে, কিউবার জঙ্গলে লড়া সেই আর্জেন্টাইন চিকিৎসক আর দীর্ঘ দশক ধরে দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে সম্পর্কটা কীভাবে গড়ে উঠেছিল? এই সম্পর্ক কি শুধু প্রতীকী ছিল, নাকি চে ফিলিস্তিনি বিপ্লবী চিন্তায় বাস্তব ছাপ রেখে গিয়েছিলেন?

চিকিৎসাশাস্ত্রের পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে চে গুয়েভারা এমন এক অভিযানে নেমে পড়েন, যেটিকে তিনি বলেছিলেন ‘অন্যায় থেকে পৃথিবীর আরোগ্য।’ লাতিন আমেরিকাজুড়ে তাঁর ভ্রমণ তাঁকে রূপান্তরিত করেছিল কিউবান বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নেতায়। ১৯৫৯ সালের সেই বিপ্লব মার্কিন–সমর্থিত বাতিস্তা শাসন উৎখাত করেছিল। কিন্তু কিউবা বিজয়ে চে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকারের বিপ্লবের কোনো সীমানা নেই। তাঁর ভাষায়, ‘প্রতিটি প্রকৃত বিপ্লবই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এক মুক্তির যুদ্ধ’।

আরও পড়ুনসাহসী, সুন্দরী যে ফিলিস্তিনি বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলেন০৯ এপ্রিল ২০২৫

এই আন্তর্জাতিকতাবাদী দর্শন শেষ পর্যন্ত চে ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি প্রতীকী সাক্ষাতের পথ প্রস্তুত করেছিল। ১৯৫৯ সালের জুনে, কিউবান বিপ্লবের বিজয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই চে গুয়েভারা গাজা উপত্যকায় এসেছিলেন। গাজা তখন মিসর প্রশাসনের অধীনে ছিল। তাঁর সফর যদিও মাত্র দুই দিনের ছিল, কিন্তু সেটি ছিল গভীর অর্থবহ। তিনি আল-বুরেইজ ও আন-নুসেইরাত শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং গাজা উপত্যকায় কয়েকটি প্রশিক্ষণশিবির পরিদর্শন করেন।

শরণার্থীশিবিরে তাঁকে ঘিরে তোলা ছবিগুলো দ্রুত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এটা ফিলিস্তিনকে ‘বৈশ্বিক মুক্তি আন্দোলন’–এর মানচিত্রে স্থান দেয়। চে গুয়েভারার এই সফর লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইকে মধ্যপ্রাচ্যের জায়নবাদী–উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল। চে গুয়েভারায় প্রথম বিশ্বনেতা, যিনি ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনকে নিছক মানবিক ইস্যু হিসেবে না দেখে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখেছিলেন।

আজও চে গুয়েভারার নাম ফিলিস্তিনের জনস্মৃতির সঙ্গে মিশে আছে। গাজা ও পশ্চিম তীরের রাস্তা ও ক্যাফেতে চের নাম রয়েছে। ম্যুরালে চে–কে দেখা যায় গামাল আবদেল নাসের ও ইয়াসির আরাফাতের পাশে। নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে রয়েছে চে গুয়েভারা কালচারাল ক্লাব। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে বামপন্থী তরুণেরা এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সম্ভবত এ কারণেই গাজার খান ইউনিসের একজন গ্রাফিতিশিল্পী চে গুয়েভারার প্রতিকৃতির নিচে লিখেছিলেন, ‘গুয়েভারা বলিভিয়ায় মারা যাননি…তিনি বেঁচে আছেন প্রতিটি রাস্তায়, যেখানে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চলছে।’

সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাহাড় থেকে শুরু করে গাজার শরণার্থীশিবির পর্যন্ত চে দেখিয়েছেন যে বিপ্লবের কোনো জাতীয়তা নেই এবং ন্যায়বিচারকে ভাগ করা যায় না। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘যেখানেই অন্যায় থাকবে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব।’

রাসেম বিশারাত পশ্চিম এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা বিষয়ে গবেষক ও বিশ্লেষক

মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ষাট ও সত্তরের দশকে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) চে গুয়েভারার চিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে শুরু করে। শরণার্থীশিবিরগুলোতে চে গুয়েভারার প্রতিকৃতি আঁকা হতো, সঙ্গে লেখা থাকত তাঁর অমর স্লোগান, ‘বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে’।

অনেক ফিলিস্তিনি কর্মী প্রশিক্ষণ নিতেন ফোকো তত্ত্ব অনুযায়ী (ফোকো মানে ছোট বিপ্লবী কেন্দ্র)। এই কৌশল চে গুয়েভারা কিউবা ও বলিভিয়ায় বিকশিত করেছিলেন। এর মানে হচ্ছে একটি ছোট ভ্যানগার্ড গোষ্ঠী গণবিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বালাতে পারে। লেবাননের কিছু ফিলিস্তিনি প্রশিক্ষণশিবিরের নামও ছিল ‘ক্যাম্প চে গুয়েভারা’।

আজও চে গুয়েভারার নাম ফিলিস্তিনের জনস্মৃতির সঙ্গে মিশে আছে। গাজা ও পশ্চিম তীরের রাস্তা ও ক্যাফেতে চের নাম রয়েছে। ম্যুরালে চে–কে দেখা যায় গামাল আবদেল নাসের ও ইয়াসির আরাফাতের পাশে। নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে রয়েছে চে গুয়েভারা কালচারাল ক্লাব। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে বামপন্থী তরুণেরা এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আরও পড়ুনকোথাও বিপ্লব নেই, কিন্তু চে গুয়েভারা আছেন১৪ জুন ২০২১.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শরণ র থ শ ব র ত কর ছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

চে গুয়েভারা গাজার রাস্তায় এখনো যেভাবে বেঁচে আছেন

অর্ধশতাব্দীর বেশি আগে, ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার পাহাড়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টাইন বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার রাইফেল। কিন্তু তাঁর কথার প্রতিধ্বনি আজও আন্দিজ পর্বতমালা থেকে শুরু করে গাজার শরণার্থীশিবির—সমগ্র বৈশ্বিক দক্ষিণজুড়ে ধ্বনিত হয়।

আজ তাঁর মৃত্যুর ৫৮ বছর পর আবার যে প্রশ্নটা ফিরে আসে, কিউবার জঙ্গলে লড়া সেই আর্জেন্টাইন চিকিৎসক আর দীর্ঘ দশক ধরে দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে সম্পর্কটা কীভাবে গড়ে উঠেছিল? এই সম্পর্ক কি শুধু প্রতীকী ছিল, নাকি চে ফিলিস্তিনি বিপ্লবী চিন্তায় বাস্তব ছাপ রেখে গিয়েছিলেন?

চিকিৎসাশাস্ত্রের পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে চে গুয়েভারা এমন এক অভিযানে নেমে পড়েন, যেটিকে তিনি বলেছিলেন ‘অন্যায় থেকে পৃথিবীর আরোগ্য।’ লাতিন আমেরিকাজুড়ে তাঁর ভ্রমণ তাঁকে রূপান্তরিত করেছিল কিউবান বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নেতায়। ১৯৫৯ সালের সেই বিপ্লব মার্কিন–সমর্থিত বাতিস্তা শাসন উৎখাত করেছিল। কিন্তু কিউবা বিজয়ে চে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকারের বিপ্লবের কোনো সীমানা নেই। তাঁর ভাষায়, ‘প্রতিটি প্রকৃত বিপ্লবই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এক মুক্তির যুদ্ধ’।

আরও পড়ুনসাহসী, সুন্দরী যে ফিলিস্তিনি বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলেন০৯ এপ্রিল ২০২৫

এই আন্তর্জাতিকতাবাদী দর্শন শেষ পর্যন্ত চে ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি প্রতীকী সাক্ষাতের পথ প্রস্তুত করেছিল। ১৯৫৯ সালের জুনে, কিউবান বিপ্লবের বিজয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই চে গুয়েভারা গাজা উপত্যকায় এসেছিলেন। গাজা তখন মিসর প্রশাসনের অধীনে ছিল। তাঁর সফর যদিও মাত্র দুই দিনের ছিল, কিন্তু সেটি ছিল গভীর অর্থবহ। তিনি আল-বুরেইজ ও আন-নুসেইরাত শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং গাজা উপত্যকায় কয়েকটি প্রশিক্ষণশিবির পরিদর্শন করেন।

শরণার্থীশিবিরে তাঁকে ঘিরে তোলা ছবিগুলো দ্রুত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এটা ফিলিস্তিনকে ‘বৈশ্বিক মুক্তি আন্দোলন’–এর মানচিত্রে স্থান দেয়। চে গুয়েভারার এই সফর লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইকে মধ্যপ্রাচ্যের জায়নবাদী–উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল। চে গুয়েভারায় প্রথম বিশ্বনেতা, যিনি ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনকে নিছক মানবিক ইস্যু হিসেবে না দেখে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখেছিলেন।

আজও চে গুয়েভারার নাম ফিলিস্তিনের জনস্মৃতির সঙ্গে মিশে আছে। গাজা ও পশ্চিম তীরের রাস্তা ও ক্যাফেতে চের নাম রয়েছে। ম্যুরালে চে–কে দেখা যায় গামাল আবদেল নাসের ও ইয়াসির আরাফাতের পাশে। নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে রয়েছে চে গুয়েভারা কালচারাল ক্লাব। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে বামপন্থী তরুণেরা এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সম্ভবত এ কারণেই গাজার খান ইউনিসের একজন গ্রাফিতিশিল্পী চে গুয়েভারার প্রতিকৃতির নিচে লিখেছিলেন, ‘গুয়েভারা বলিভিয়ায় মারা যাননি…তিনি বেঁচে আছেন প্রতিটি রাস্তায়, যেখানে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চলছে।’

সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাহাড় থেকে শুরু করে গাজার শরণার্থীশিবির পর্যন্ত চে দেখিয়েছেন যে বিপ্লবের কোনো জাতীয়তা নেই এবং ন্যায়বিচারকে ভাগ করা যায় না। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘যেখানেই অন্যায় থাকবে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব।’

রাসেম বিশারাত পশ্চিম এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা বিষয়ে গবেষক ও বিশ্লেষক

মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ষাট ও সত্তরের দশকে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) চে গুয়েভারার চিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে শুরু করে। শরণার্থীশিবিরগুলোতে চে গুয়েভারার প্রতিকৃতি আঁকা হতো, সঙ্গে লেখা থাকত তাঁর অমর স্লোগান, ‘বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে’।

অনেক ফিলিস্তিনি কর্মী প্রশিক্ষণ নিতেন ফোকো তত্ত্ব অনুযায়ী (ফোকো মানে ছোট বিপ্লবী কেন্দ্র)। এই কৌশল চে গুয়েভারা কিউবা ও বলিভিয়ায় বিকশিত করেছিলেন। এর মানে হচ্ছে একটি ছোট ভ্যানগার্ড গোষ্ঠী গণবিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বালাতে পারে। লেবাননের কিছু ফিলিস্তিনি প্রশিক্ষণশিবিরের নামও ছিল ‘ক্যাম্প চে গুয়েভারা’।

আজও চে গুয়েভারার নাম ফিলিস্তিনের জনস্মৃতির সঙ্গে মিশে আছে। গাজা ও পশ্চিম তীরের রাস্তা ও ক্যাফেতে চের নাম রয়েছে। ম্যুরালে চে–কে দেখা যায় গামাল আবদেল নাসের ও ইয়াসির আরাফাতের পাশে। নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে রয়েছে চে গুয়েভারা কালচারাল ক্লাব। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে বামপন্থী তরুণেরা এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আরও পড়ুনকোথাও বিপ্লব নেই, কিন্তু চে গুয়েভারা আছেন১৪ জুন ২০২১

সম্পর্কিত নিবন্ধ