নির্বাচন কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান একটি কর্মকাণ্ড থাকে জনগণের সামনে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বা ইশতেহার পেশ করা। নির্বাচিত হলে রাজনৈতিক দলটি কী করবে আগামী বছরগুলোয় কিংবা যারা আগেও নির্বাচিত হয়েছিল এবং এখন আবার নির্বাচিত হলে কী কী কাজ করবে, তার একটা দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করে। খুব জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের গণ্যমান্য মানুষের সামনে ইশতেহার দেওয়া হয়। বাংলাদেশে যেটা পরিলক্ষিত হয়, নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম এক বা দুই বছর ইশতেহার নিয়ে খুব তোড়জোড় থাকে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে ইশতেহার ফিকে হয়ে আসে।

ইশতেহারে অনেক জনবান্ধব কর্মসূচি থাকে, কিন্তু তার কতটা বাস্তবায়ন করা হয় বা হচ্ছে, তা জনগণের জানার সুযোগ থাকে না। সাধারণত ইশতেহার রাজনৈতিক দলগুলোর ওয়েবসাইটে আপলোড করা থাকে।

কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম করা যায় কি? ইশতেহারের জন্য আলাদা ওয়েবসাইট তৈরি করা, অ্যাপস তৈরি করা; যে ওয়েবসাইটে ইশতেহারের ডিটেইল থাকবে, কোন সময়ে কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তার আপডেট থাকবে এবং নাগরিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ থাকবে। এতে এক বা দুই বছর পর অথবা পাঁচ বছর পর ইশতেহারের কতটুকু বাস্তবায়িত হলো, তার একটি সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে।

রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিটি সেক্টরে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ইশতেহার প্রণয়ন কমিটি করে এবং তাদের ও তাদের চিন্তাভাবনার একটা বিরাট প্রতিফলন থাকে। যদিও ইশতেহারে বিস্তৃত সবকিছু ব্যাখ্যা করা কঠিন, তারপরও এবারের ইশতেহারে সংযুক্তি আকারে বিভাগভিত্তিক বা জেলাভিত্তিক কর্মসূচিগুলো যোগ করা যায় কি না, তা ভেবে দেখার অনুরোধ রইল। এতে প্রার্থী ও জনগণ নিজের জেলার ভবিষ্যৎ অগ্রগতি নিয়ে একটি বাস্তব ধারণা পাবে এবং পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে প্রশ্ন করতে পারবে।

রাজনৈতিক দলগুলো কি এবারের ইশতেহারে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের একটি কার্যকর উদ্যোগ নেবে? শুধু অবকাঠামো স্থানান্তর না করেও স্থানীয় পর্যায়ে সেবা বাড়িয়ে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ অনেকাংশে লাঘব করা যাবে।

আরও পড়ুন'তারুণ্যবান্ধব' ইশতেহারে সত্য-মিথ্যার জোড়াতালি২৩ ডিসেম্বর ২০১৮স্বাস্থ্য

প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশেষায়িত হাসপাতাল করার ব্যবস্থা করা। জেলায় না হলেও বিভাগীয় শহরগুলোয় অবশ্যই বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকতে হবে। যেমন হৃদ্‌রোগ, কিডনি অ্যান্ড ইউরোলজি, ক্যানসার, গ্যাস্ট্রো–এনটেরোলজি। এতে যেমন ঢাকার ওপর চাপ কমবে, ঠিক তেমনি মানুষ তাদের আয়ত্তের মধ্যে চিকিৎসা পাবে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত।

দেশের যে জেলাগুলোয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে, সেই হাসপাতালগুলোয় ইনস্ট্রুমেন্টের অপ্রতুলতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন কার্ডিওলজিতে এমডি করা চিকিৎসক আছেন, কিন্তু অ্যানজিওগ্রাম করার মেশিন নেই। কোলনস্কপি, এন্ডোস্কপি করার মেশিন নেই। প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ওয়েল ইকুইপড করতে হবে এবং সাধারণ রোগীরা যেন তাদের নাগরিক অধিকার অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা বিনা মূল্যে ওষুধসহ পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে পর্যায়ক্রমিকভাবে। উল্লেখ্য, এখন শুধু চিকিৎসা পাওয়া যায় বিনা মূল্যে, ওষুধ নয়।

স্বাস্থ্য খাতের যেকোনো বিষয় নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ দাখিল করা এবং এর প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

বাংলাদেশের প্রাণ কৃষি। কৃষিকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঠিক পরিকল্পনা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বহুলাংশে বৃদ্ধি করতে পারে। বাংলাদেশে কৃষকদের নিয়ে একটি বড় রাজনৈতিক দল অলরেডি একটি ইউনিক কর্মসূচির কথা বলছে। ফারমার্স কার্ড, যা বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ও কার্যকর উদ্যোগ হবে বলে মনে করি।

বিসিএস চিকিৎসকদের ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায়ে অন্তত আট বছর চাকরি করা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন সাধারণ মানুষ সুচিকিৎসা পায়। বিসিএস চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বৃত্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে।

প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে একটি কার্যকর ডিজিটালাইজড হেল্প ডেস্ক রাখতে হবে, যেন রোগীরা খুব সহজেই হাসপাতালের কোন ফ্লোরে কী কী সুবিধা আছে, তা জানতে পারে।

প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে স্বাস্থ্যশিক্ষার আওতা বাড়াতে হবে। ঢাকার ভেতরে যে জাতীয় হাসপাতালগুলো আছে, তার যথাযথ আধুনিকায়ন করা হবে। নতুন অবকাঠামো, জনবল, বিশেষায়িত চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হবে। ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের ব্যবস্থা করা, যার মাধ্যমে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে গণমানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া যায়। দেশে একটি টিকা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত।

রোগতত্ত্ব ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রকে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত লজিস্টিক ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্যের সুবিধাকে বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ অনেকাংশে কমানো যায়।

শিক্ষা

প্রতিটি জেলা বা বিভাগে বা দুই বা তিন জেলা মিলিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যায়। বিভাগে বিভাগে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যায়—যেমন ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি ইত্যাদি। কারিগরি শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ইনস্টিটিউট। প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় একাধিক মানসম্মত প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা।

শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা এবং তাঁরা যেন ছাত্রছাত্রীদের স্কুলেই পাঠদান করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের সমস্যাগুলো সমাধান করেন—এ জন্য পর্যাপ্ত কর্মশালার আয়োজন করা। বাংলাদেশে স্কুল–কলেজে যে পরিমাণ কোচিং ব্যবস্থার প্রচলন আছে, তা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিরল। স্কুল–কলেজে সঠিকভাবে পাঠদানের ব্যবস্থা করলে শিক্ষার্থীদের ওপরও বাড়তি মানসিক ও শারীরিক বোঝা কমবে।

শিক্ষার্থীদের স্টাডি ট্যুরের ব্যবস্থা করা, বিশেষ করে দেশের ভেতরে ও বিদেশে। এতে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ হবে। তাদের যেমন খুব শুরু থেকেই দেশপ্রেমবোধ জাগ্রত হবে, ঠিক তেমনিভাবে তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে জেনে নিজেদের আলোকিত করতে পারবে।

ছিন্নমূল শিশুদের সরকারিভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে ঢাকা শহরে বিভিন্ন ট্র্যাফিক পয়েন্টে শিশুরা ফুল ও অন্যান্য দ্রব্য বিক্রি করে। তাদের জন্য বিভিন্ন এনজিও নানা কার্যক্রম চালায়। কিন্তু সরকারিভাবে তাদের জন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। এই বস্তিবাসীকে যদি তাদের নিজ নিজ জেলায় কর্মের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা যায় তাহলে ঢাকার ওপর অতিরিক্ত মানুষের চাপ কমবে।

কৃষি

বাংলাদেশের প্রাণ কৃষি। কৃষিকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঠিক পরিকল্পনা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বহুলাংশে বৃদ্ধি করতে পারে। বাংলাদেশে কৃষকদের নিয়ে একটি বড় রাজনৈতিক দল অলরেডি একটি ইউনিক কর্মসূচির কথা বলছে। ফারমার্স কার্ড, যা বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ও কার্যকর উদ্যোগ হবে বলে মনে করি।

কৃষকদের জন্য সঠিক সময়ে সারের নিশ্চিত করা এবং এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা শুধু ওয়াদার মধ্যে না রেখে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত গার্মেন্টস। কিন্তু এখন আমাদের রপ্তানি খাতকে নতুনভাবে পুনর্বিন্যাস করা জরুরি। কৃষিজাত অনেক পণ্য আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারি এবং ক্ষেত্র উন্মোচন করতে পারি। কৃষকদের ফসল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয় এবং ব্যাংকঋণ দেওয়া হয়, যার আওতা অনেক অনেক বাড়ানো প্রয়োজন।

আর এসব ডেটা সংরক্ষণের জন্য বিবিএসের পাশাপাশি একটি ডেটা সেন্টার করা খুব প্রয়োজন, যে ডেটা সেন্টার প্রতিনিয়ত আপডেটেড থাকবে।

এ লেখার উদ্দেশ্য এ–ই নয় যে একটি ইশতেহারের সবকিছু লিখে দেওয়া। এই লেখার উদ্দেশ্য, ইশতেহার নিয়ে নতুন অনেক ইনোভেটিভ কাজের সুযোগ আছে। আমাদের আগামীর বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে তরুণদের প্রাধান্য দিয়ে, বাংলাদেশের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কীভাবে জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। কারওয়ান বাজার, মহাখালী বাস টার্মিনাল, সচিবালয়কে ঢাকা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে কীভাবে ঢাকাকে বাসযোগ্য এবং ঢাকার বাতাসকে নিশ্বাস নেওয়ার মতো নিরাপদ করার দিকে নজর দিতে হবে।

প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জন য পর য প ত র ইশত হ র ঢ ক র ওপর র ব যবস থ ইশত হ র র ক ল কল জ র জন য ব ক ষকদ র ব শ বব র একট

এছাড়াও পড়ুন:

চরাঞ্চলে মাষকলাই চাষ

২ / ৮বাড়ন্ত মাষকলাইয়ের গাছ

সম্পর্কিত নিবন্ধ