আমার মেয়েই আমাকে এখানে ঢুকেই কিছুক্ষণ পরেই বলছিলো, ‘‘দেখেছো এখানে কোনো মেয়ে বাচ্চা নেই।’’ আমি তখন অবাক হয়ে মেয়ে শিশু খুঁজতে লাগলাম। মেয়েদের মতন জামা পরা এক বাচ্চা দেখে আমি ভেবেছিলার এটিতে ছেলে মেয়ে উভয়ই আছে। ফাউন্ডার এলে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘মেয়েরা কি এতিম হয় না, শুধু যে ছেলে বাচ্চা আপনার এখানে।’’ ওনার থেকে জানা গেলো মেয়েদের এতিমখানা খুব কম বাংলাদেশে। এটি আমার জানা ছিল না। 

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় আট হাজার সরকারি তালিকাভুক্ত এতিমখানা আছে। বাংলাদেশে মোট এতিম শিশুর সংখ্যা কত তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই।

আরো পড়ুন:

পাঁচটি উপকরণ দিয়ে তৈরি করা যায় ‘দোসা’

গর্ভবতী নারীদের জন্য যে কারণে বিড়াল  বিপদজনক

একটি পরিসংখ্যানে দেখলাম, দেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এতিমখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৩৬৪টি। তবে এতিম বিষয়য়ক অধিকাংশ সংখ্যা উপাত্ত তথ্যগুলো আমার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হলো।তথ্য তত্ত্ব তদারকি ব্যবস্থাপনাও যেন এতিম।

আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন অযথাই এক বাচ্চা আমার ওড়না টেনে ধরলো।কিছুই বললো না, শুধু ওড়না টেনে ধরলো। আমি জানি আমার হয়তোবা আর কখনো যাওয়া হবে না ওদের কাছে। আমেরিকাতে ফিরে গিয়ে আমি মহা ব্যস্ত হয়ে যাবো বহুবিধ কাজে, তবে এটা ঠিক ওই মুহূর্তে আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিতে। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা আমাদের অনেক আবেগকে সংবরণশীল করে তুলতে শিখিয়ে দিয়েছে। আমি একটু হেসে ওড়না ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত গাড়ির দিকে গেলাম। আমাদের ড্রাইভার এসে মাল তুলতে তুলতে বললো, ‘‘ওই দিকে দাঁড়িয়ে থাকা খাদেম টাইপের লোকদের একজন নাকি বাচ্চাটিকে শিখিয়ে দিয়েছে ওড়না ধরে  বলতে, আমাকেও সাথে নিয়ে যান।’’

৪/৫ বছরের বাচ্চাটি অবশ্য অতটা তোতাপাখির বুলি আওড়াতে পারেনি। এবার এতে আমার মন খারাপ হলো, বাচ্ছাটি কেন যে নিজের থেকে আমাকে এসে ওড়না ধরে টেনে থামালো না ভেবে আমার মন খারাপ হতে লাগলো। মানুষের মন অবশ্যই বড় বিচিত্র। একটু আগেই যে ওড়না আমি কঠিন হাতে ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম তাই কেন সেই বাচ্চাটি নিজের ইচ্ছাতে ধরেনি তাই ভেবে ব্যথিত হলাম। এজ ইফ সে তা করলে আমিও তাকে ছেড়ে আসতাম না।শিশুদের আপন হওয়া এতো সহজ না। সময় লাগে, সময় দিতে হয়।এবং আমাদের সবারই সময়েরই বড় অভাব।

আগেই জানিয়েছি মসজিদের পাশেই লাগোয়া এই এতিমখানাটি। আসরের আজান ভেসে আসছে। ভাবলাম এতিম শিশু ছুটে ছুটে ঢুকবে এতিমখানায়, কিন্তু কেও এলো না। দেখলাম ঢোকার মুখেই দেয়ালে একটি রেকের ওপর লেখা ‘‘আপনার অপ্রয়োজনীয় জিনিস রেখে যান।’’ পরের রেখে থাকা কিছু জিনিসের দেয়ালে লেখা ‘‘যার প্রয়োজন নিয়ে যান।’’ 

দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের জন্যই অতি উত্তম ব্যবস্থাপনা। আমি তাই দেখে খুব খুশি হয়ে বললাম, অলিতে গলিতে মোড়ে এই ধরনের কর্নার থাকা বেশ উপকারী। 

যেখানে সেখানেই ভিড়ভাট্টা, চারদিকেই মানুষ, তাদেরই কেউ একজন বললো, ‘‘বিদেশ থেকে আসলেই অনেক কিছু বদলে দিতে ইচ্ছে হয়, দুই দিন দেশে থাকলেই সবাই লাইনে চলে আসে।’’ সম্ভবত আমাকে ভাবছে বেলাইনের একজন। কি আর করা। তবে আমি খুব চাইলাম শুমা যেন এতো কিছু মন্তব্য না বুঝে। ওর কাছে আমি খুব সুন্দর একটা বাংলাদেশ তুলে ধরতে চাই।ও দেশে এসেছে ১৩ বছর পর, ওর এই অভিজ্ঞতা আনন্দময় হোক।

পেছন ফিরে বাচ্চাগুলোকে দেখলাম, ওদের মা নেই, এই দেশের ধুলা বালিতে গড়িয়ে গড়িয়ে ওরা বড় হয়ে যাবে, কোনো মা ওদের হৃদয়ের কাছে বাংলাদেশের সৌন্দর্য তুলে ধরবে না। 

ওদের কাছে বাংলাদেশ বুভুক্ষের দেশ, অনাহারের দেশ, এ কেমন জীবন ওদের! একজন জানালো, সরকারিভাবে শিশু সদস্যদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ দৈনিক ৬৬ টাকা। বেসরকারি এতিমখানায় বসবাসরত শিশুদের খাওয়া পরার জন্য দৈনিক মাথাপিছু সরকারি মঞ্জুরি মাত্র ৩৩ টাকা।  হায় এতো কম ! 

আমরা এরপর গেলাম স্বজনদের কবরস্থানে। আমার আব্বুর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আমারও মনে হলো আমিও একজন এতিম। তবে আমি একজন বয়স্ক এতিম, শিশু এতিম নই, তারপরও এতিমই তো, এতো বড় হয়ে গেছি তারপরও পরাণ পোড়ে পিতার জন্য, হারানো জনদের জন্য। মনে এলো, আমি মরে গেলে আমার মেয়েটিও এতিম হয়ে যাবে। মনের কথা আমি কি একটু জোরেই বলে ফেলেছি! না হলে পাশে থেকেইবা অচেনা এক পীর ফকির টাইপের একজন বলবেন কেন, বাবা মরলে এতিম হয়, মা মরলে এতিম বলা হয় না। 

আমি শুমের সামনে আমার অবস্থান নেমে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম, আমরা সবাই জীবনের বিভিন্ন সময়ে এতিম হয়ে যাই। তারপরও নিঃসন্দেহে শিশু বয়সে এতিম হয়ে যাওয়াটা বেশি কষ্টের।

এবার আমার বর বললেন, ‘‘প্রাপ্ত বযস্ক মানুষ এতিম হয় না।’’ আমি নাকি চাইলেও এখন আর এতিম হিসেবে গণ্য হবো না। মৃত পিতার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলি-আমি তো নিজেকে এতিম ছাড়া আর কিছু ভাবছি না। আমার চারদিকে যদিওবা প্রচুর এতিম বাচ্চা এতিমখানা থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু বুঝতে পারছি নিয়মানুযায়ী আমি ওদের দলভুক্ত নই। আমাকে এতিম হিসেবে গণ্য করা হবে না। এতে কি আমার খুশি হওয়া উচিত? কই হচ্ছি তো না। বরঞ্চ মনে মনে যে শিশু থাকে সবার মাঝে, আমার মাঝেও, তাই যেন আমাকে আজ আমার বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে উঠে বলতে ইচ্ছে করালো, আমিও একজন এতিম। যার বাবা নেই সেই জানে জীবনের সকল বয়সেই সে এতিম। বাবা না থাকাটা এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় না থাকা, আমার কেন জানি ওখানে দাঁড়িয়ে তাই মনে হতে লাগলো।

ঢাকা/লিপি

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আম র ম এত ম হ র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

কালো পতাকার মানুষ

সব গমনাগমনে কি তৈরি পথ লাগে! আলো, হাওয়া, শব্দ নিজেরা পথ তৈরি করে ছুটে চলে দিগ্বিদিক, যাদের ধরার তারা ধরে ফেলে। শব্দ আসার সম্ভাব্য ক্ষীণ পথগুলো কাপড়ের টুকরা বা কাগজের দলা দিয়ে বন্ধ করতে থাকেন ‘আম্মা’। বিছানায় ছেলেমেয়েরা ঘুমাচ্ছে। ওরা এভাবে গাদাগাদি করে শুতে অভ্যস্ত নয়। বড় ছেলেদের ঘর আলাদা, তারা নিজ নিজ বিছানায় হাত–পা ছড়িয়ে ঘুমায়। মেয়ে দুটো ছোট, তারা মায়ের ঘরে শুলেও তাদের আলাদা খাট। কিন্তু বড় মেয়েটা ভীতু হওয়ায় ও প্রায় সময় মায়ের কাছে ঘুমায়। আজও সে ছটফট করছে। ওর জন্যই জানালার পাল্লার চিকন, ক্ষুদ্র, ফাঁকও বন্ধ করার চেষ্টা করছেন তিনি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝমঝমানি ছাপিয়ে বাইরের খানকাঘরের বারান্দার সামনের তর্জন–গর্জন আর আর্তনাদের মিহিন ছিটেফোঁটা নিশুতি রাতে দ্বিগুণ হয়ে ঘরে আসছে। সেসব শব্দে তীব্র আতঙ্কে বাচ্চা মেয়েটা কেবল চমকে চমকে উঠছে। সন্তানের জন্য আম্মা শব্দের পথ একটা একটা করে বন্ধ করে চলেছেন।

শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। এত এত ঘর, প্রতিটি ঘরে মানুষ, বিপন্ন মানুষ, যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। আম্মারা নিজেরাও শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। এটি তাঁর শ্বশুরবাড়ি। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে। তাঁরা নিজেদের শোবার ঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা একটি ঘরে কোনো রকমে থাকছেন।

তাঁর স্বামী এলাকার মান্যগণ্য প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, নানা মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তাঁর বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য মানুষ আসবে, এটাই স্বাভাবিক।

রাত বেড়ে গভীর হচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেব মেয়ের পাশে উদ্বিগ্ন আধশোয়া স্ত্রীকে বলেন, ‘দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, আমি বাইরে যাচ্ছি, কখন ফিরব ঠিক নেই।’

যুদ্ধের পুরো সময়টা ফেরার ঠিক নেই, খাওয়া, ঘুমের ঠিক নেই। এভাবেই কাটছে তাঁদের।

শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে।২.

বাড়িতে দিনের বেলা খানসেনারা আসে মুক্তির খোঁজে। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের নানাবিধ কথা দিয়ে, ভালো খাবারদাবার দিয়ে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন, শান্ত করে বিদায় দেন। রাতের অন্ধকারে সুপ্ত আতশবাজির মতো আসে মুক্তির ছেলেরা। চেয়ারম্যান সাহেব এবং বাড়ির আম্মা তাদের বুক দিয়ে সহায়তা দিতে চেষ্টা করেন। তারা খেয়েদেয়ে কিছু রসদ, কিছু পরামর্শ নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এসব কাজে পাশে থাকেন তাঁর স্ত্রী, সবাই যাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকে। এভাবে সস্ত্রীক মানুষটি তাঁর নিজের এলাকা, এলাকার আতঙ্কিত মানুষগুলোকে রক্ষা করেন। যখন চারপাশের এলাকা যুদ্ধ নামক আগুনের করালগ্রাসে ভস্মীভূত হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিজ এলাকাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন প্রাণপণে।

মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায় সেই কুলাঙ্গারের বিচার করছে। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।

রাজাকারের নাম মকবুল। সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনকে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা মানুষদের ধরিয়ে দিত। আরেকটা কাজ সে নিষ্ঠার সঙ্গে করত, মিলিটারির হাতে নিহত মানুষদের শেষ সময়ে সবাইকে নিজের পেশাব খাওয়াত, সরাসরি মুখে পেশাব করে দিত। এ জন্য তার নাম হয়েছে ‘মুতিয়া মকবুল’। এ নাম পাওয়াতে সে এতই খুশি যে কেউ এ নামে ডাকলে খুশিতে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। মনে হয় সে খান বাহাদুর উপাধি পেয়ে গেছে। আজ আর মুখে হাসি নেই।

জসিম স্টেনগানের নলটা মাথায় ঠেকিয়ে বলে, ‘দেই? ওই শালা হারামি দেই ট্রিগার টিপে?’ ঘোড়েল মকবুল আজ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। ধরা সে পড়েছে কয়েক দিন আগে। লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ধরা পড়ার পরপরই চাচার কাছে খবর যায়। তিনি জানিয়ে দেন, একেবারে মেরে না ফেলে শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় কি না। তাঁর কড়া নির্দেশ—অহেতুক কোনো প্রাণ যেন নষ্ট না হয়। দুরন্ত ছেলেরা তাঁর নির্দেশ মেনে চলে।

তবে ছেলেরা মকবুলকে ভালো রকম শিক্ষা দিচ্ছে। মারধর তো করেছেই, ক্ষণে ক্ষণে গুলি করার হুমকি, এ ছাড়া খাবার, পানীয় কিছুই দেয়নি, ঠিক করেছে ওকে পানি দেওয়া হবে না। মিলিটারিরা এই বর্ষণমুখর রাতে আসবে না জেনে তারা এই বিচার বসিয়েছে। তাদের চাচা বাড়ি থেকে এখনো বের হননি। তিনি আসার আগেই ছেলেরা ওকে যা করার তা–ই করছে। হঠাৎ দেখা যায়, এক যুবক হনহন করে আসছে। এসে হিসহিস করে বলে, ‘খবরদার, এই কুত্তার বাচ্চাক গুলি কইরবা না। অরে আমি ধারালো ছুরি দিয়া কুচি কুচি কইরব। অরে পানি দেব না। অর মুখত মুতি দেব। শালা আমার ভাইয়ের মুখত মুতি দিছিল। পাকি কুত্তারা আমার ভাইটাকে গুলি করে ঝাঁঝরা করি দিছিল, আর এই হামার পড়শি, এই জানোয়ার, শেষ সময়ে তার মুখে মুতি দিছে।’

মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায়। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।

এই বলে সে মাটিতে থেবড়ে বসে হু হু করে কেঁদে ওঠে। আরও একবার সবাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। মন্টু বলে ওঠে, ‘আরে এত কথায় কাজ কী, দেই শালাক শেষ করে। এই এক বালের জন্য এত সময় নষ্ট।’ সোহরাব ফিসফিস করে ওঠে, ‘এই চাচা আসতেছে।’ গুঞ্জন থেমে যায়। এর মধ্যেই একজন সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি কষলে হাত বাঁধা মকবুল একদিকে কাত হয়ে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একজন ঘুষি মেরে সোজা করে দেয়, ‘হারামজাদা, সোজা হয়া বসি থাক।’

চেয়ারম্যান সাহেব এসে বসে সব কথা শোনেন। তিনি গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও। তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো।’ তিনি এখন জানেন, এই গাদ্দার এলাকার নারীদের ক্যাম্পে নিয়ে গেছে, এলাকার তরুণ–যুবকদের ধরিয়ে দিয়েছে। যে বাড়ির ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে সে বাড়ির মানুষজনকে মিলিটারির কাছে ধরিয়ে দিয়েছে। এমনকি তার পড়শিকেও নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে, হেনস্তা করেছে। চেয়ারম্যান সাহেব ওর দিকে একটা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে চলে যান।

এবারে ছেলেরা চাপা উল্লাসে জেগে ওঠে। ওরা ওকে হাত বাঁধা অবস্থায় হাঁটিয়ে নিতে থাকে।

মকবুল ঘাড়ের ওপর প্রেশার কুকারের সিটির মতো মৃত্যুর গরম নিশ্বাস অনুভব করে। পানির তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে; কিন্তু এরা তো পানি দিচ্ছে না।

চেয়ারম্যান চাচার বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে গেছে একটি শান্ত নদী। পাড় দিয়ে অগণন বৃক্ষের সারি। সেখানে সবাই এসে হাজির হয়। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বের হয়ে এসেছে।

মকবুলের হাত বাঁধা ছিল। এবারে পা–ও বেঁধে ওকে পানির কিনারে বসিয়ে দেওয়া হয়। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।

একজন গলা তুলে বলে, ‘ফায়ার কিন্তু আমি করব।’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘না, আমি ধরছি, ফায়ার আমি করব।’ আরেকটি কণ্ঠ শোনা যায়, ‘তার আগে হারামজাদার মুখটা কেউ তুলে ধর তো, আমি অর মুখত পেচ্ছাব করে দেই, তারপর গুলি না করে জবাই করা হোক।’

মকবুলের হাত বাঁধা। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।

মকবুল নিজের অবস্থা বুঝে কেঁপে কেঁপে ওঠে। এরা তো মারবেই। তা মরার সময় একটু পানিও খেতে পারবে না? ওর মনে পড়ে, ওরই বয়সের হামিদুলের কথা। হামিদুল মুক্তি। সে এসেছিল বাবা–মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে নিজে মিলিটারি ডেকে এনে ধরিয়ে দিয়েছে। গুলি খেয়ে পড়ার পর হামিদুল পানি পানি করছিল। তখন সে লুঙ্গি তুলে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা খেলার সাথি হামিদুলের মুখে ছরছর করে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। হামিদুল কী গভীরতর ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে শেষবারের মতো তাকিয়েছিল।

আজ এরা ওকে প্রস্রাবই দেবে। কিন্তু বুকটা তো ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি, হিমশীতল একটু পানি না খেলে হবে না। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে পানির জন্য হাহাকার জেগে উঠছে। জিবটা শুকনা খড়ের মতো রুক্ষ হয়ে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে, ভেতরে একটু থুথুও জমছে না। গলার ভেতরটা মরুভূমির বালুর মতো খসখসে, ঢোক গিলেতে গেলে কাঁটার মতো বিঁধছে। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে, এক ফোঁটা পানি, এক বিন্দু তরল যেন জীবনটাকে শীতল করে দিত। চোখ দুটো জ্বালা করতে থাকে, মাথার ভেতর হালকা ধোঁয়ায় ভরে যায়, ঘোর লাগে, মনে হয় এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিলে জীবনের সব যন্ত্রণা মুছে যেত। পানির পিপাসা যে এমন, তা মকবুল আগে বোঝেনি।

সে গুঙিয়ে ওঠে, ‘ভাই রে, তোমার আল্লাহর দোহাই, আমাক এনা পানি দেও। আমাক গুলি করো, জবাই করো, কিন্তু এক ফোঁটা পানি আমাক দেও। আমাক দয়া করো, তোমার পাও ধরি একনা পানি দেও...’

বৃষ্টি থেমে গিয়ে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বেরিয়ে এসে সবার ওপর সমানভাবে জ্যোৎস্না ছড়াতে থাকে।

ঠিক সে সময় বাড়ির খাস কাজের লোক স্বচ্ছ কাচের জগ ভর্তি টলটলে পানি আর ঝকঝকে একটি গ্লাস নিয়ে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘আম্মা কয়া দিছে অরে পানি খাওয়াইতে। যা করমেন করেন, কিন্তক পানি খাওয়ান।’

মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের মতোই আরেক যোদ্ধা এই আম্মাকে ভালোভাবে চেনে, জানে। আম্মা ঘরের ভেতর থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন নানাভাবে। তারা সবাই থির হয়ে যায়। জগের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে ওঠে। সবার চোখ জগের দিকে।

মুতিয়া মকবুলের খড়খড়ে জ্বলুনি চোখেও কি পানি জমে! সে পানি ভরা চোখে জগটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন একটা অপার্থিব দৃশ্য। সবার জোড়া জোড়া চোখের সামনে দৃশ্যটা একটা ঐশ্বরিক ফ্রেমে আটকা পড়ে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় হামাসের সিনিয়র কমান্ডার নিহত
  • যুদ্ধবিরতি নিয়ে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন জেলেনস্কি ও মার্কিন প্রতিনিধি
  • পরপর হিট গান, তারপরও ১৭ বছর কেন কাজ হয়নি হাবিব–অলিক জুটির
  • ক্যানসার, ৩৬ অস্ত্রোপচার—গানে ফেরার গল্প শোনাবেন ‘বেজবাবা’
  • সিদ্ধিরগঞ্জে ১১০ বোতল ফেন্সিডিলসহ কারবারি গ্রেপ্তার
  • পাবনায় বিষাক্ত মদপানে ২ যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ
  • রংপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁর স্ত্রীকে হত্যা মামলায় একজন গ্রেপ্তার
  • বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণাহীনতা: উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা
  • বেগম রোকেয়াকে নিয়ে রাবি শিক্ষকের মন্তব্য একাডেমিক নৈতিকতার লঙ্ঘন: আসক
  • কালো পতাকার মানুষ