গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ছিল। আশা ছিল, সাংবাদিকেরা কলম খুলে লিখবেন। কিন্তু এখন মবের ভীতি। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো আলামত দেখতে পাচ্ছি না।’

‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংস্কার: সুপারিশ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে কামাল আহমেদ এসব কথা বলেন। আজ বুধবার প্রথম আলো কার্যালয়ে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

কামাল আহমেদ বলেন, ‘গণ–আন্দোলনের মাধ্যমে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটার পরে দেশ ও জাতির মধ্যে একটা বড় ধরনের প্রত্যাশা ছিল যে সত্যিই একটা বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন হবে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে পাব। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও সে রকমই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। দেশে একটা অত্যন্ত ভাইব্রেন্ট মিডিয়া আমরা তৈরি করতে পারব, যা গণতন্ত্রকে সাহায্য ও সমৃদ্ধ করে।’

কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে কামাল আহমেদ  বলেন, ‘সংবাদমাধ্যম তখনই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, যখন তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হবে। যদি আর্থিক স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। সেই নির্ভরশীলতার কারণেই যতটুকু আমি নির্ভরশীল হব, ততটুকুই আমার স্বাধীনতা ছাড় দেব। কম্প্রমাইজ করব খর্বভাবে।’

সুপারিশ প্রতিবেদন গত মে মাসেই জমা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, ‘প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরে আমাদের বলা হলো যে আশু করণীয় ঠিক করে দেন, যেগুলো খুব দ্রুত করা যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই করে দিলাম সেটা। তারপর তো ডেফিনেটলি (নিশ্চিতভাবে) আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে অন্তত আশু করণীয়গুলোর ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হবে এবং কিছু করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো যে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু দৃশ্যমান হয়নি। আর দৃশ্যমান না হওয়াটা কমিশনের সদস্যদের জন্য খুব বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে গেছে।’  

সাংবাদিকতার সুরক্ষা আইনের বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, ‘কমিশন থেকে সাংবাদিকতার সুরক্ষা আইন করার জন্য বলেছিলাম। যাতে আইনের কাজটা খুব দ্রুতগতিতে সরকার করতে পারে, সে জন্য একটা খসড়াও তৈরি করে দিয়েছিলাম। অধ্যাদেশটা সরকার যদি শুধু তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দিত জনমত নেওয়ার জন্য, তাহলে এত দিনে সেই মে মাস থেকে আজকে অক্টোবর শেষ.

..তাহলে এর মধ্যে কিন্তু সেটা সম্ভব হতো। কোথায় কী ত্রুটি আছে, সেই খসড় আইনের ভাষায় অথবা কোথায় কী পরিবর্তন দরকার, সেগুলো সবকিছুই।’

কিন্তু সেটা মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয় জানিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁদের নিজেদের মধ্যে ওটার মূল্যায়ন করার একটা উদ্যোগ নিয়েছেন, মূল্যায়ন করেছেন। মূল্যায়ন করে তাঁরা যে পরিবর্তন প্রস্তাব করেছেন, তাতে আর ওই আইন না করাই ভালো। কারণ, ওই আইন করার যে উদ্দেশ্য ছিল, সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি খর্ব করে ওনারা এই নাম অপব্যবহার করে একটা আইন করতে চাইছেন।

কামাল আহমেদ আরও বলেন, ‘গতকালই ঢাকার জেলা আদালতে তিনজন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছেন। এই আইন যদি হতো, তাহলে এই সাংবাদিকদের রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হতো। তাঁদের হয়তো এই হয়রানি, এই দুর্ভাগ্য হতো না। এখন আসলে যেটা হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না, তার উল্টোটা হচ্ছে। আমরা সাংবাদিকেরা মনখুলে, কলমখুলে লিখব—এমন আশা ছিল, প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এখন কী হচ্ছে, একটা মবের ভীতি। এই মবের ভীতি কেন থাকবে? কারণটা হচ্ছে, সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি যেমন, ঠিক তেমনি এটা ঠেকানোরও চেষ্টা নেই।’

সংস্কারের সুপারিশের বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, ‘যতগুলো বিষয়ের পরামর্শ দিলাম, সেগুলোর কোনোটার ক্ষেত্রেই কোনো অগ্রাধিকার আমরা দিচ্ছি না। এর মধ্যে অনেকবার আমরা সরকারের তরফ থেকে বক্তব্য শুনেছি। বিশেষ করে তথ্য উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন যে তাঁরা এই সুপারিশমালা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেবেন। তিনি স্পষ্ট করে এই সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন সম্পর্কেই বলেছেন যে আর কিছু না হোক এটা তাঁরা করবেন।’

‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংস্কার: সুপারিশ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র ভরশ ল মব র ভ ত উদ য গ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকঢোল পিটিয়ে দিল্লিতে কৃত্রিম বৃষ্টি নামাতে পারল না বিজেপি সরকার

সাত মন তেল পুড়ল, কিন্তু রাধা নাচল না। ঢাকঢোল পিটিয়ে, ধুমধাম ও বিপুল খরচ করে অনেক আশা জাগিয়ে মেঘের মধ্যে রাসায়নিক ছড়িয়ে বৃষ্টি ঝরানোর চেষ্টা চালানো হলেও সব বিফলে গেল। বৃষ্টিস্নাত হলো না রাজধানী দিল্লি।

অথচ এ জন্য দিল্লির বিজেপি সরকার খরচ করল ৩ কোটি ২১ লাখ রুপি। কানপুর আইআইটি বলছে, বৃষ্টি হয়তো হয়নি, কিন্তু অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য তারা সংগ্রহ করতে পেরেছে।

কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরিয়ে রাজধানীর তীব্র দূষণের মাত্রা কমাতে ব্যর্থ হওয়ার পর সমালোচনার মুখে দাঁড়িয়েছে বিজেপি সরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে সাময়িক উপশমের পথে না হেঁটে সরকার বরং দূষণের উৎসে নজর দিক। যেসব কারণে প্রতিবছর হেমন্তের শুরু থেকে পুরো শীত মৌসুম দিল্লি বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে, সেই কারণগুলো বন্ধ করা হোক। এভাবে কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জলে ফেলার দরকার নেই।

দীপাবলির সময় বাজি পোড়ানো বন্ধ করতে পারেনি দিল্লির কোনো সরকারই। তবু আগের আম আদমি পার্টি (এএপি) সরকারের একটা চেষ্টা ছিল। চেষ্টা ছিল পরিবেশ আন্দোলন কর্মীদেরও। নানাভাবে চেষ্টা হয়েছিল মামলা করে বাজি পোড়ানো বন্ধের। সেই প্রচেষ্টা জন্ম দিয়েছিল দূষণহীন বাজির। তৈরি হয়েছিল ‘গ্রিন ক্র্যাকার’। যদিও তার আড়ালে দেদার বিক্রি হয়ে এসেছে দূষণকারী বাজিও। ফলে দূষণ সৃষ্টি হয়েছে যথারীতি।

দিল্লিতে ক্ষমতাসীন হয়ে বিজেপি সরকার সেই প্রচেষ্টাতেও জল ঢেলেছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বাজি পোড়ানোর সঙ্গে সনাতন ধর্মকে জুড়ে প্রচার শুরু করে দেয়, যারা বাজি বন্ধের উদ্যোক্তা, তারা সনাতন ধর্মবিরোধী। সেই প্রচার প্রভাব ফেলেছিল কি না অন্য কথা, দেখা গেল সুপ্রিম কোর্টও পুরোপুরি বাজি নিষিদ্ধ করতে পারলেন না। ফলে প্রতিবছরের মতো এবারও দিল্লির আকাশ-বাতাস দীপাবলির পর ঢেকে গেল গভীর ধোঁয়ার আস্তরণে। দূষণ হয়ে দাঁড়াল মাত্রাছাড়া।

এই দূষণ থেকে নিস্তার পেতেই কৃত্রিম বৃষ্টির আয়োজন। এই উদ্যোগ আম আদমি সরকারও নেওয়ার কথা ভেবেছিল, কিন্তু রূপায়ণ করতে পারেনি। বিজেপি তা করে ফেলল। রাজ্য সরকার তিন কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করে এই প্রকল্পে। দায়িত্ব দেওয়া হয় কানপুর আইআইটিকে।

গতকাল মঙ্গলবার কানপুর আইআইটি দুই দফায় কয়েকবার সেসনা বিমান নিয়ে উড়ে বেড়ায় দিল্লির আকাশে। মেঘের ভেতর জলকণা সৃষ্টি করতে উড়োজাহাজ থেকে মেঘের মধ্যে ঢালা হয় ড্রাই আইস, সিলভার আয়োডাইড, আয়োডাইজড লবণ ও রক সল্টের রাসায়নিক মিশ্রণ। সেই জলকণা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে রাজধানীর আকাশ থেকে।

গতকাল সেই কাজেই নেমেছিল কানপুর আইআইটি। অথচ দিনভর প্রতীক্ষাই সার হলো। দিল্লিতে বৃষ্টির ছিটোফোঁটাও দেখা পাওয়া গেল না। দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তর প্রদেশের নয়ডায় বৃষ্টি হয় শান্তিজল ছিটানোর মতো। পরিমাণ ০ দশমিক ১ মিলিলিটার।

আইআইটির বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এই ‘ক্লাউড সিডিং’, যা কিনা কৃত্রিম বৃষ্টির প্রক্রিয়া, তা শেষ হওয়ার ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি হবে। কখনো কখনো ২ ঘণ্টা পরও হতে পারে। তবে বৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতির জন্য বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি থাকা দরকার।

তবে সারা দিন প্রতীক্ষার পরও বৃষ্টির দেখা কেন মিলল না, তার ব্যাখ্যায় কানপুর আইআইটির পরিচালক মনীন্দ্র আগরওয়াল এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, গতকাল দিল্লির বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ খুবই সামান্য, তাই বৃষ্টি হয়নি।

মনীন্দ্র বলেন, আজও ওই প্রক্রিয়া চালানো হবে। তাঁদের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ তা বলা যাবে না। তাঁরা এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তাঁদের পরীক্ষা একেবারেই যে ব্যর্থ, তা নয়। বৃষ্টি হয়নি ঠিকই, কিন্তু ১৫টি নিরীক্ষণ কেন্দ্রে দেখা গেছে, বাতাসে মিশে থাকা সুক্ষ্ম ধূলিকণা, যাকে পিএম ২ দশমিক ৫ বলা হয়, তার পরিমাণ ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

মনীন্দ্র আগরওয়াল ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, দিল্লি দূষণের মোকাবিলার উত্তর কৃত্রিম বৃষ্টি হতে পারে না। এই ব্যবস্থা নিতান্তই সাময়িক। দিল্লিতে যে হারে দূষণ বেড়ে চলেছে, তা কমানোর একমাত্র উপায় দূষণের উৎস বন্ধ করা। একই কথা বলেছেন বিভিন্ন পরিবেশবিদ। ঘটনা হলো, কী করা দরকার, তা সবার জানা হলেও কেউই তা করতে পারছে না।

উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের খেতগুলোতে ফসলের গোড়া জ্বালানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। দীপাবলিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়ি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের সময় দেদার বাজি পোড়ানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। নির্মাণকাজ থেকে ওড়া ধুলাবালু বাতাসে যাতে না ছড়ায়, সেই ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কলকারখানার বর্জ্য যমুনায় ফেলা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

চীন পৃথিবীর প্রথম দেশ, যেখানে ‘ক্লাউড সিডিং’ সফল হয়েছে। বেইজিংসহ শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে তারা এই পদ্ধতিতে বৃষ্টি ঘটাচ্ছে। চীন ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবেও এই পদ্ধতিতে বৃষ্টি ঝরানো হয়েছে।

পাকিস্তানও লাহোরের মতো দূষণযুক্ত শহরে এই পদ্ধতিতে কিছুটা সাফল্য পেয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিতে ভুলছেন না, এটা সাময়িক উপায়। বড়জোর দুই–তিন দিন এর রেশ থাকে। তারপর যে অবস্থা ছিল, তেমনই হয়ে যায়। তা ছাড়া এই ব্যবস্থা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ।

আরও পড়ুন দিল্লির আকাশে কৃত্রিম মেঘ, অপেক্ষা বৃষ্টির২১ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ