গ্রামীণফোনের ডিজিটাল প্রশিক্ষণে রাজশাহীর শ্রাবণী, মল্লিকাদের আয়ের পথ খুলছে
Published: 29th, October 2025 GMT
ছবি-গ্রামীণফোনের লোগো বা পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ নারীর মুখের ফাইল ছবি
শ্রাবণী কর্মকারের (২৪) জগৎটা ছিল মূলত ঘর আর সেলাই মেশিন ঘিরে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম প্রেমতলীর এই গৃহিণী সাংসারিক কাজের পাশাপাশি দরজির কাজ করেন। স্মার্টফোন থাকলেও ইন্টারনেট দুনিয়াটা ছিল তাঁর কাছে অজানা। এক প্রশিক্ষণ তাঁর ভাবনার জগৎটাকেই যেন খুলে দিয়েছে।
চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে শ্রাবণী বলেন, ‘আগে জানতাম, সরকার শুধু মেয়েদের স্কুলের জন্য উপবৃত্তি দেয়। এখন জেনেছি, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ কত সুযোগ-সুবিধা আছে। সরকারি অফিসে না ঘুরে ঘরে বসেই অনেক কিছুর জন্য আবেদন করা যায়। এমনকি অনলাইনে নিজের বানানো পোশাকও বিক্রি করতে পারব, এই সাহসটা এখন হয়েছে।’
একই গ্রামের মল্লিকা কর্মকারের (৪০) ইন্টারনেট নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। অথচ তাঁর হাতে ফোটে অসাধারণ নকশিকাঁথার ফুল। প্রশিক্ষণের পর এখন তাঁর চোখে নতুন স্বপ্ন। মল্লিকা বলেন, ‘আপারা বলেছেন, আমার বানানো নকশিকাঁথা অনলাইনে বিক্রি করে ভালো আয় করা সম্ভব। বাড়ির কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের একটা পথ তো হয়। আমি এখন সেই চেষ্টাটাই করতে চাই।’
শ্রাবণী ও মল্লিকার মতো প্রেমতলীর বহু নারীর কাছেই ডিজিটাল পৃথিবীটা ছিল অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা। পরিবারের পুরুষদের আপত্তি, ফেসবুকের পাসওয়ার্ড অন্যের হাতে থাকা কিংবা অনলাইন প্রতারণার ভয়—এই সংকোচ আর জড়তা ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু গ্রামীণফোন, টেলিনর ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ ‘পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি’ প্রকল্পটি তাঁদের সেই ভয়কে জয় করার গল্প শোনাচ্ছে।
এই উদ্যোগের আওতায় একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা যেন তাঁদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখানে তাঁরা শুধু অনলাইন নিরাপত্তাই শিখছেন না বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের জীবনকে আরও সহজ ও সমৃদ্ধ করার আত্মবিশ্বাস অর্জন করছেন।
প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া কলেজশিক্ষার্থী জবা রাণী চৌধুরীর কাছে ফেসবুক ছিল কেবলই ছবি বা ভিডিও দেওয়ার জায়গা। তিনি বলেন, ‘ছবি দিলে ভালো মন্তব্যের পাশাপাশি অনেক বাজে কথাও শুনতে হতো। তখন খুব খারাপ লাগত। এখন আমি জানি, কীভাবে এসব ব্যক্তিকে ব্লক বা রিপোর্ট করতে হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়গুলো শেখার পর অনলাইনে নিজেকে অনেক বেশি সুরক্ষিত মনে হচ্ছে।’
এই প্রশিক্ষণে শুধু নারীরাই নন, অংশ নিয়েছেন তরুণেরাও। শ্রী নিত্যানন্দ নামের এক তরুণ জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা, সরকারি সেবার জন্য অনলাইনে আবেদন এবং সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন, যা তাঁর ভবিষ্যৎ পথ চলায় সহায়ক হবে।
কী প্রশিক্ষণআয়োজকেরা জানান, ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে নারীদের কাছে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়া এবং অনলাইন দুনিয়ায় তাঁদের নিরাপদ বিচরণ নিশ্চিত করা। প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের আটটি প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রায় ৩৩ লাখ মানুষের কাছে ডিজিটাল সাক্ষরতা ও অনলাইন নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ পৌঁছেছে, যার ৬৮ শতাংশই নারী। প্রশিক্ষণের আগে যেখানে মাত্র ৬৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন, এখন তা বেড়ে ৮১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে অংশগ্রহণকারীদের কেউই ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারি সেবা পেতেন না, এখন ৭৯ শতাংশই জন্মনিবন্ধন, ভর্তির আবেদনসহ বিভিন্ন সেবা অনলাইনে গ্রহণ করছেন।
প্রকল্পটি আগামী তিন বছরের জন্য দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করছে। এই ধাপে সাধারণ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অংশগ্রহণকারীদের জন্য আয়মূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে, যা তাঁদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে।
প্রকল্পটিতে জাতিগত সংখ্যালঘু, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি, চা-বাগানের শ্রমিক, ট্রান্সজেন্ডার ও নারীপ্রধান পরিবারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণে মূলত চারটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ছোট ব্যবসার ধারণা, ইন্টারনেটে আর্থিক সেবার নিরাপদ ব্যবহার, অনলাইনে সরকারি সেবা পাওয়ার পদ্ধতি এবং সার্বিকভাবে সাইবার নিরাপত্তা।
প্রশিক্ষণের শেষ দিনে গত রোববার এই বদলে যাওয়ার গল্প শুনতে প্রেমতলী গ্রামে ছুটে আসে গ্রামীণফোন, টেলিনর এশিয়া ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল। গ্রামের মেঠোপথে হেঁটে তাঁরা একটি উঠান বৈঠকে যোগ দেন এবং অংশগ্রহণকারী নারীদের অভিজ্ঞতা শোনেন।
গ্রামীণফোন, টেলিনর ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগ ‘পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি’ প্রকল্পে প্রশিক্ষণের শেষ দিন গত রোববার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী গ্রামে ছুটে আসে গ্রামীণফোন, টেলিনর এশিয়া ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল। তাঁরা স্থানীয়দের পরিবেশনা উপভোগ করেন.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনগ ষ ঠ প রকল প ব যবহ র প র মতল র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কারাবন্দী সাংবাদিক মনজুরুল আলমকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান আরএসএফের
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দী সাংবাদিক মনজুরুল আলমকে (পান্না) অবিলম্বে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠনটি বলেছে, মনজুরুল আলমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আনা ‘মিথ্যা অভিযোগ’ অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে।
মঙ্গলবার আরএসএফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মনজুরুল আলম ‘মানচিত্র’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করেন। গত ২৯ আগস্ট ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান নিয়ে আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে তাঁকে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখান থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে কাজ করা ‘মঞ্চ ৭১’ নামের নাগরিক সমাজের একটি প্ল্যাটফর্ম ওই বৈঠকের আয়োজন করেছিল। হঠাৎ একদল ব্যক্তি সেখানে ঢুকলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ বলে অভিযোগ তোলেন তাঁরা। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটেছিল ২০২৪ সালে কয়েক সপ্তাহের ব্যাপক বিক্ষোভে রক্তক্ষয়ী দমন–পীড়ন চালানোর পরে।
গোলটেবিল বৈঠক ঘিরে পরিস্থিতির অবনতি হলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য পুলিশ ডেকেছিলেন মনজুরুল আলম। সেখানে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের বদলে মনজুরুল আলমসহ গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তার পর থেকে মনজুরুল আলমসহ গ্রেপ্তার গোলটেবিলের অন্য অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রের’ ভিত্তিহীন অভিযোগে কারাবন্দী রয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের কাছে এ বিষয়ে বক্তব্য চেয়েছিল আরএসএফ। তবে তিনি তাতে সাড়া দেননি।
আরএসএফের দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের প্রধান সেলিয়া মারসিয়ে বলেছেন, ‘সাংবাদিক মনজুরুল আলমকে আটক বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী আচরণকে তুলে ধরেছে। এই সরকার সমালোচনাকারীদের কণ্ঠ রোধের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করছে। কেবল নিজ দেশের ইতিহাস নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য একজন সাংবাদিককে সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করা হবে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা তাঁর বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগগুলো তুলে নেওয়ার এবং অবিলম্বে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’
আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৪ সেপ্টেম্বর জামিনের জন্য মনজুরুল ইসলামের করা আবেদন খারিজ করা হয়। এখন পর্যন্ত এ মামলার বিচারের কোনো দিনও ধার্য করা হয়নি। জামিনের আবেদন শুনানির সময় মনজুরুল আলমের সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া দুই সাংবাদিক একজন আইনজীবীর আক্রমণের শিকার হন। তাঁদের মধ্যে সময় টিভির আসিফ হোসাইনকে মারধর করেন ওই আইনজীবী। এ ছাড়া বাংলা আউটলুকের সাংবাদিক মুকতাদির রশিদকে হুমকি দেন তিনি।
মনজুরুল আলম ছাড়াও বাংলাদেশে আরও পাঁচ সাংবাদিককে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে আরএসএফের প্রতিবেদনে। তাঁরা হলেন ফারজানা রূপা, শাকিল আহমেদ, মোজাম্মেল বাবু, শাহরিয়ার কবির ও শ্যামল দত্ত।