আজ ২৯ অক্টোবর। বিশ্ব অর্থনীতির এক বিশেষ দিন। ১৯২৯ সালের ২৯ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে ঘটে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ধস, যা ‘ব্ল্যাক টিউসডে’ বা কালো মঙ্গলবার নামে এর পরিচিতি। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের অন্যতম সূচক ডাও জোন্স ১২ শতাংশ পড়ে যায়। আতঙ্কে বিক্রি হয়ে যায় ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি শেয়ার।

এই বিপর্যয় শুধু এক দিনের নয়; এর মধ্য দিয়ে ‘রোরিং টোয়েন্টিজ’-এর আপাত সমৃদ্ধির যুগের অবসান হয়েছিল। সেই সঙ্গে শুরু হয় মহামন্দার সূচনা। এই মহামন্দার কারণে পরবর্তী দশকজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মার্কিন বাণিজ্যনীতিতেও তার গভীর প্রভাব পড়েছিল। শেয়ারবাজার পতনের পেছনে নানা কারণ ছিল। তখনকার বিনিয়োগ সংস্কৃতি ছিল অতিমাত্রায় ঋণনির্ভর। মানুষ দালালদের কাছ থেকে ধার করে শেয়ার কিনত এবং জামানত হিসেবে রাখত সেই শেয়ার। এতে অর্থনীতি চাঙা মনে হলেও বাস্তবে তা ছিল না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের স্মুথ হাওলি ট্যারিফ অ্যাক্টসহ নানা সুরক্ষা নীতি। এই আইনের মাধ্যমে আমদানি পণ্যে বিপুল হারে শুল্ক আরোপ করা হয়। ফলাফল ছিল বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিপর্যয়। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে গিয়েছিল প্রায় ৬৬ শতাংশ।

এই ধসের অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ‘নিউ ডিল’ কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থনীতি পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে ব্যাংক সংস্কার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সহযোগিতার নতুন পথ খোঁজেন তিনি। তবু বাজার পুরোপুরি পুনরুদ্ধার হয় না; আগের উচ্চতায় পৌঁছাতে সময় লাগে দীর্ঘ ২৫ বছর। অবশেষে ১৯৫৪ সালে শেয়ারবাজার আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসে।

‘ব্ল্যাক টিউসডে’ তাই শুধু অর্থনৈতিক ঘটনা নয়, ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা এটি। এ ঘটনায় বোঝা যায়, বিনিয়োগের উন্মাদনা, ঋণনির্ভর ঝুঁকি ও সুরক্ষা নীতির মিশ্রণ কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

ব্ল্যাক টিউসডের অর্থনৈতিক প্রভাব

ব্ল্যাক টিউসডের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সমৃদ্ধির যুগের সমাপ্তি হয়েছিল। শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত স্থায়ী মহামন্দা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত পরাশক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিবর্তে নিজেদের শিল্প রক্ষায় মনোযোগ দেয় তারা। গাড়ি, ইস্পাতসহ উদীয়মান শিল্প খাতগুলোকে রক্ষা করতে সরকার আমদানি করা পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছিল। ইউরোপ যুদ্ধোত্তর সময়ে আবার কৃষি উৎপাদন শুরু করলে কৃষিপণ্যের দাম পড়ে গিয়েছিল। কৃষকদের রক্ষায় আমেরিকা শুল্ক বাড়ালেও মানুষের আয় ও জমির দাম কমতে থাকে। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বড় অংশ শহরমুখী হয়।

রোরিং টোয়েন্টিজ নামে পরিচিত সে দশকটি ছিল সমৃদ্ধির যুগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মন্দা আর আসবে না—এই বিশ্বাসে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিনিয়োগের জোয়ার বয়ে যায়। ১৯২১ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত শেয়ারের মূল্য বেড়েছিল প্রায় পাঁচ গুণ। সাধারণ মানুষও এই প্রথম শেয়ারবাজারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেক দালাল ক্রেতাদের শেয়ার কেনার মূল্যের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ঋণ দিত, সেই শেয়ারই জামানত হিসেবে থাকত। এভাবে ঋণনির্ভরতার ওপর ভর করে গড়ে উঠেছিল অস্থির অর্থনৈতিক বুদ্‌বুদ। একই সঙ্গে আয়বৈষম্যও বাড়তে থাকে। তৎকালীন হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল দেশটির মোট সম্পদের ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

১৯২৯ সালের মাঝামাঝি থেকেই অর্থনীতিতে দুর্বলতার লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করে। মানুষের বাড়ি ও গাড়ি কেনার প্রবণতা কমে যায়; কেননা অধিকাংশ ভোক্তা ঋণের চাপে ক্লান্ত। শিল্পোৎপাদন বিশেষ করে ইস্পাতে মন্দাভাব দেখা যায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে আবার কৃষি উৎপাদন শুরু হলে কৃষকদের রক্ষায় মার্কিন কংগ্রেস শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এদিকে ইউরোপে ভালো ফসলের খবর বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। এতে কৃষিপণ্যের দাম আরও পড়ে গিয়েছিল।

পরিস্থিতি সামলাতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস স্মুথ হাওলি শুল্ক আইন পাস করে। শুধু কৃষিপণ্য নয়, শিল্পপণ্যের আমদানিতেও বিপুল শুল্ক আরোপ করা হয়। ইউরোপসহ অন্যান্য দেশও পাল্টা শুল্কনীতি গ্রহণ করে। এর ফল ছিল ধ্বংসাত্মক।

ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র শ য় রব জ র হয় ছ ল ইউর প

এছাড়াও পড়ুন:

তিউনিসিয়ার গুপ্তহত্যা, ওসমান হাদিকে গুলি ও বিপজ্জনক রাজনীতি

গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী তিউনিসিয়ায় প্রথম নির্বাচন হয় ২০১১ সালে। নির্বাচনের পরে, বেশ অস্থিতিশীল একটা সরকারের সময়, কয়েক মাসের ব্যবধানে চকরি বেলাইদ ও মোহামেদ ব্রাহিমি ‘মোটরসাইকেলে চড়ে আসা’ আততায়ীর গুলিতে গুপ্তহত্যার শিকার হন। আজ এটা স্বীকৃত যে, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে এই দুটি হত্যাকাণ্ড তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের যে স্বপ্ন ছিল, সেটি যে আজ প্রায় ধ্বংসের পথে, তার জন্য দায়ী।

টার্গেট শরিফ ওসমান হাদি হবেন কি না সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছিল না, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা যে ঘটবে, সেটার যৌক্তিক অনুমান করা যাচ্ছিল। এর প্রাথমিক কারণ, দেশে-বিদেশে থাকা কিছু শক্তি চায় না বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাক।

এটাও আমরা জানি, একটা রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার যেকোনো অপচেষ্টা নস্যাৎ করা সম্ভব হয় যদি সেই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সততা এবং পেশাদারির সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে যায়। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দক্ষতার স্বাক্ষর তো রাখতে পারেইনি, খুব সাধারণ পারফরম্যান্সও দেখাতে পারেনি। কিছুদিন আগে প্রথম আলোর মাধ্যমে পরিচালিত জনমত জরিপেও দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের ওপরে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ অসন্তুষ্ট।

গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের গতিপথ তিউনিসিয়ার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই মেলে। সে কারণেই আমাদের সুযোগ ছিল তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভুলগুলো এড়িয়ে যাওয়ার। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পারিনি সেটা।

দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো হবে, এটা প্রত্যাশা আমরা করিনি। শেখ হাসিনার অপশাসনের ফলে প্রায় পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত পুলিশ বাহিনী তার মনোবল ফিরে পেতে সংগ্রাম করেছে। কিন্তু এই বাস্তবতা মেনে নেওয়ার পরও বলতে হবে, আইনশৃঙ্খলার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, বিশেষ করে এমন একটা সময়ে যখন সেনাবাহিনীও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে আছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল, এমনটিও মনে হয়নি অনেক সময়।  

দীর্ঘকাল স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিক্রিয়ায় কোনো দেশে গণ-অভ্যুত্থান হলেই অভ্যুত্থানকারীরা সফল হবেনই এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক দেশে এ ধরনের গণ-অভ্যুত্থান গড়ে ওঠার সময়টায় (আরব বসন্ত) অন্তত তিনটি দেশ (সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন) দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

আরও পড়ুনওসমান হাদিকে হামলা: গুলির লক্ষ্য একজন না, লক্ষ্য নির্বাচন?১৮ ঘণ্টা আগে

আর কর্তৃত্ববাদী শাসকের পতন ঘটানোর সাফল্য এসেছিল যে দেশগুলোতে (তিউনিসিয়া, মিসর) সেগুলো গেছে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। একটা স্বৈরাচারী সরকার তার ক্ষমতায় থাকাকে নিশ্চিত করার জন্য ভেঙে ফেলে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান, ফলে স্বৈরশাসকের অনুপস্থিতিতে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো সেই অর্থে ক্রিয়াশীল থাকে না।

এমন প্রেক্ষাপটে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর সবচেয়ে জরুরি কাজ অত্যন্ত কঠিন হলেও নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতকে খুব খারাপ পর্যায়ে নিয়ে না যাওয়া। বিশেষ করে নিজেদের মধ্যে মতাদর্শগত বিভেদ যতটা সম্ভব এড়ানো।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যে চিন্তা, কর্মসূচি এবং মতাদর্শগত পার্থক্য থাকবেই এবং সেটা নিয়ে বিতর্ক তো বটেই ঝগড়াবিবাদও হতে পারে। কিন্তু দল এবং শক্তিগুলো পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি তৈরি করে।

আর গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী প্রায় ভেঙে পড়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন প্রবণতা ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে, যা এমনকি গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান হাদি। শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১২ ডিসেম্বর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রথম আলোর জরিপ: সংখ্যার ভেতর চমক ও শঙ্কা
  • তিউনিসিয়ার গুপ্তহত্যা, ওসমান হাদিকে গুলি ও বিপজ্জনক রাজনীতি
  • সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সব কার্যক্রম স্থগিত