কোনো চমক ছাড়াই টানা অষ্টমবারের মতো ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন পল বিয়া। গত সোমবার দেশটির নির্বাচন কমিশন ৯২ বছর বয়সী এই নেতাকে আবার বিজয়ী ঘোষণা করেছে। পল বিয়াই এখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ রাষ্ট্রপ্রধান। টানা ৪৩ বছর ধরে তিনি ক্যামেরুন শাসন করছেন।

১৯৮২ সাল থেকে ক্যামেরুন শাসন করা পল বিয়া এ বছর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের সংশয়ের কারণ ছিল পল বিয়ার বয়স ও স্বাস্থ্য।

শেষ পর্যন্ত সব সংশয়কে উড়িয়ে দিয়ে পল বিয়া নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। ১২ অক্টোবর ক্যামেরুনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয়।

এবারের নির্বাচনে পল বিয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ইসা চিরোমা বাকারি। ভোটের পর শোনা যাচ্ছিল যে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান খুব সামান্য হবে। ইসা চিরোমা বাকারি নিজের জয় দাবি করলে ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে বেশ নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সবাই চমকের অপেক্ষায় ছিলেন।

কিন্তু ফলাফল প্রকাশের পর কোনো চমকই পাওয়া যায়নি। বরং ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে আবার নির্বাচিত হন পল বিয়া। চিরোমা বাকারি পেয়েছেন ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ ভোট। ক্যামেরুনের অনেক ভোটার এই ফলাফলে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা একটি পরিবর্তন চাইছিলেন।

টানা সাত মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা পল বিয়া এ বছর আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিলে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। শুধু দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে নয়, তাঁর শাসনের ধরন নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

গত বছর সেপ্টেম্বরে চীন-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে পল বিয়া বেইজিংয়ে যান। তারপর প্রায় ছয় সপ্তাহ তাঁকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি।

বয়স ও স্বাস্থ্যজনিত কারণে পল বিয়া দেশ পরিচালনায় কতটা সক্ষম, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কেউ কেউ বলেন, সরকার পরিচালনাসংক্রান্ত অধিকাংশ সিদ্ধান্ত আসলে প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রী নেন। এমনকি প্রভাবশালী কর্মকর্তা সেক্রেটারি জেনারেল অব প্রেসিডেন্সি ফার্ডিন্যান্ড এনগোহ এনগোহ অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নেন কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে।

গত বছর আগস্টে ফ্রান্সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে অনুষ্ঠিত এক স্মরণ সভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন পল বিয়া। পরের মাসে চীন-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে তিনি বেইজিংয়ে যান। তার পর থেকে প্রায় ছয় সপ্তাহ তাঁকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি।

এ নিয়ে সরকারিভাবে কোনো ব্যাখ্যাও না দেওয়ায় পল বিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে নানান গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

সে সময় কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কথায় মনে হয়েছিল, পল বিয়া আবারও জেনেভায় গেছেন এবং নিজের কাজ করছেন। কিন্তু সঠিক কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে নানা জল্পনা-কল্পনা বাড়ছিল।

অবশেষে প্রেসিডেন্টের রাজধানী ইয়াউন্দে ফেরার খবর আসে। সমর্থকেরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন, এমন কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়।

এ বছর ভোটের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে আবারও জেনেভায় যান পল বিয়া। খুব সম্ভবত তিনি সেখানে চিকিৎসা নেন।

পল বিয়ার জেনেভা যাত্রার মতো তাঁর দেশ পরিচালনার ধরনও খানিকটা রহস্যে ঘেরা থাকে। তাঁকে পূর্ণ মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক বৈঠক ডাকতে খুব একটা দেখা যায় না, তিনি জটিল বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করেন না। তাঁর প্রশাসনের লক্ষ্য ও নীতিনির্ধারণবিষয়ক কৌশলও অনিশ্চয়তার ছায়ায় ঢাকা থাকে।

দীর্ঘ শাসনামলে অন্য দীর্ঘমেয়াদি শাসকদের মতো পল বিয়াকেও মাঝেমধ্যে বিরোধী মত দমন করতে দেখা গেছে। তিনি তাঁর সমালোচকদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টাও করে গেছেন।

তবে শুধু এই কৌশলে পল বিয়া এত বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছেন, এমনটা বলা যাবে না। এমনকি এগুলো তাঁর দীর্ঘ ৪৩ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার মূল কারণও নয়।

পল বিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর ছেলে ফ্র্যাঙ্কের নাম দিন দিন জোরাল হচ্ছে। যদিও রাজনীতি বা সরকারের প্রতি তাঁর তেমন কোনো আগ্রহ এখনো দেখা যায়নি।

বরং এটা বলা ভালো যে পল বিয়া একটি অনন্য রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তিনি এমন একটি দেশে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা বেশ জটিল।

ক্যামেরুনে সামাজিক, আঞ্চলিক ও ভাষাগত ভিন্নতা ব্যাপক। যেমন দেশটির দক্ষিণাঞ্চল ঘন জঙ্গলে ভরা, উত্তরাঞ্চল তৃণভূমি। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ফরাসি ভাষায় কথা বলে। তবে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকজন ইংরেজিভাষী, এমনকি তাদের শিক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্যও ভিন্ন।

স্বাধীনতা–উত্তর ক্যামেরুনে শুরুর বছরগুলোয় যখন ফেডারেল ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক এবং জাতীয় ঐক্যের ধরন নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করেছিল, সেই সময় পল বিয়া বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে সরকার গঠন করেছিলেন।

পল বিয়াকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বৈদেশিক ঋণদাতাদের চাপও সহ্য করতে হয়েছে। এর মধ্যেও তাঁর সরকার ঋণসংকট এড়াতে সক্ষম হয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করেছে।

যদিও গত এক দশক বা তার বেশি সময় আগে থেকে পল বিয়া ক্রমেই একধরনের সাংবিধানিক রাজা বা প্রতীকী নেতা হয়ে উঠেছেন। কারণ, কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়া তিনি বেশির ভাগ রাজনৈতিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত অন্যদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।

ক্যামেরুনের শাসক দল পিপলস ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (সিপিডিএম) শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও ক্ষমতার শীর্ষে যাওয়ার লড়াইও পল বিয়ার এত দিন ক্ষমতায় টিকে থাকার বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। যত দিন তিনি আছেন, তত দিন উত্তরসূরি নির্ধারণের প্রয়োজন পড়ছে না।

তবে কোনো রাজনৈতিক উত্তরসূরি না থাকা বা কাউকে মনোনয়ন না দেওয়া দীর্ঘ মেয়াদে দলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং উত্তরসূরি বাছাই সংকট আরও জটিল করে তুলতে পারে।

পল বিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর ছেলে ফ্র্যাঙ্কের নাম দিন দিন জোরালো হচ্ছে। যদিও রাজনীতি বা সরকারের প্রতি ফ্র্যাঙ্কের তেমন কোনো আগ্রহ এখনো দেখা যায়নি।

কারণ, ক্যামেরুন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ হলেও জটিল সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে সেখানে প্রেসিডেন্টের জন্য উন্নয়ন ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের অভাব নেই।

আরও পড়ুনবিশ্বে সবচেয়ে কম বয়সীদের শাসন করছেন সবচেয়ে বেশি বয়সী যে ১০ নেতা ৪ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন পল ব য় ও র জন ত র জন ত ক পল ব য় র ক ষমত য় প রক শ মন ত র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বাবার কবরে শায়িত বিজ্ঞানী ও লেখক রেজাউর রহমান

বাবার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ড. রেজাউর রহমান। গতকাল বুধবার তাঁকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সলিমুল্লাহ রোড জামে মসজিদ কমপ্লেক্স কবরস্থানে বাবা ফজলুর রহমানের কবরে দাফন করা হয়। এর আগে বাদ আসর এই মসজিদে মরহুমের তৃতীয় জানাজা হয়।

ধানমন্ডির ১২/এ সড়কের তাকওয়া মসজিদে বাদ জোহর রেজাউর রহমানের প্রথম জানাজা সম্পন্ন হয়। এখানে মসজিদের মুসল্লিরা ছাড়াও মরহুমের আত্মীয়, সুহৃদ, অনুরাগী ও শুভানুধ্যায়ী, স্কুল–কলেজের সতীর্থদের অনেকে অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পরে দাফনেও অংশ নিয়েছেন। জানাজা ও দাফনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, শিল্পী রফিকুন নবী, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, শিল্পী আবুল বার্‌ক্‌ আলভী, মনিরুল ইসলাম, অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, প্রাণিবিজ্ঞানী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম, এথিকস অ্যাডভান্স টেকনোলজি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মুবিন খান, লেখক আনিসুল হকসহ কবি, শিল্পী, চিকিৎসকদের অনেকে।

প্রথম জানাজার পরে শেষবারের মতো রেজাউর রহমানের মরদেহ তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে আনা হয়। এখানে পরিবারের সদস্য, বিশেষত নারী আত্মীয়স্বজনসহ অনেকে শেষবারের মতো তাঁকে দেখতে আসেন। বাসভবন ছেড়ে যাওয়ার আগে এখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবেশী ও স্বজনেরা জানাজায় অংশ নেন। এরপর দাফনের জন্য মোহাম্মদপুর সলিমুল্লাহ রোড জামে মসজিদে আনা হয়।

রেজাউর রহমান ৮১ বছর বয়সে ২৬ অক্টোবর রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় ল্যাবএইড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

আরও পড়ুনরেজাউর রহমানের চলে যাওয়া শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়…২৭ অক্টোবর ২০২৫

ব্যক্তিগত জীবনে বিনয়ী ও সদাচারী ছিলেন রেজাউর রহমান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৬৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। পরে ১৯৭৯ সালে চেক একাডেমি অব সায়েন্সেস-প্রাগ থেকে কীটতত্ত্বে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর কাজ করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে। পেশাগত জীবনে কীটপতঙ্গ নিয়ে দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন তিনি।

পেশাগতভাবে বিজ্ঞানী হলেও লেখক

হিসেবে রেজাউর রহমান বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দেশের বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট স্থানে। বিজ্ঞানে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সাহিত্যচর্চা ও বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি দেশের বিজ্ঞানচর্চার বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন রেজাউর রহমান।

আরও পড়ুনগ্রহান্তরে ভালো থাকবেন ড. রেজাউর রহমান২৮ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ