ফুটেজে কী দেখা গেল, আদালতে কী বললেন খতিব মোহেববুল্লাহ
Published: 29th, October 2025 GMT
গাজীপুরের টঙ্গীর একটি মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ মোহেববুল্লাহ মিয়াজী (৬০) পঞ্চগড়ে উদ্ধার হওয়ার পরপরই দাবি করেছিলেন যে তাঁকে অপহরণ করা হয়। মুহূর্তেই খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়। এ ঘটনায় মামলার পর পুলিশ তদন্তে নেমে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জানতে পারে, অপহরণ নয়, পুরো ঘটনাটা ছিল সাজানো নাটক। পরে আদালতেও বিষয়টি স্বীকার করেন ওই খতিব।
মোহেববুল্লাহ মিয়াজীর বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামে। তিনি গাজীপুরে টঙ্গীর বিটিসিএল টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব। ২৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে পঞ্চগড় সদর ইউনিয়নের সিতাগ্রাম হেলিপ্যাড এলাকায় পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের পাশ থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় তাঁর দুই পা শিকল দিয়ে একটি কলাগাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল। পরে তাঁকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মামলায় কী অভিযোগ করেছিলেন খতিবউদ্ধার হওয়ার পর মোহেববুল্লাহ মিয়াজী দাবি করেন, ২২ অক্টোবর সকালে টঙ্গীর বাসা থেকে হাঁটতে বের হয়ে তিনি নিখোঁজ হন। এ নিয়ে টঙ্গী পূর্ব থানায় তিনি বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এজাহারে উল্লেখ করেন, হাঁটতে বের হওয়ার পর টঙ্গী শিলমুন এক্সেস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভারশন সেন্টারের সামনে টঙ্গী-কালীগঞ্জগামী আঞ্চলিক সড়কে একটি অ্যাম্বুলেন্স তাঁর পথরোধ করে দাঁড়ায়। এ সময় তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ করে অজ্ঞাতনামা চার থেকে পাঁচজন জোর করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠান। পরে কালো কাপড়ে তাঁর চোখ বেঁধে নির্যাতন করতে থাকেন এবং গাড়ি বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে।
এ ছাড়া পঞ্চগড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোহেববুল্লাহ মিয়াজী একই ঘটনা উল্লেখ করে দাবি করেছিলেন যে ১১ মাস ধরে তাঁকে বেনামি চিঠি দিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এসব চিঠিতে তাঁকে অখণ্ড ভারত ও ইসকনের পক্ষে কথা বলতে বলা হচ্ছিল।
সিসিটিভিতে কী দেখা গেলটঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ২২ অক্টোবর সকাল ৬টা ৪৯ মিনিটে খতিব মোহেবুল্লাহ বাসা থেকে বের হচ্ছেন। এ সময় তিনি সাদা পাঞ্জাবি ও মাথায় কালো পাগড়ি পরে ছিলেন। আরেকটি ফুটেজে ৬টা ৫৩ মিনিটে তাঁকে মসজিদের পাশের রাস্তায় হাঁটতে দেখা যায়। এ সময় এক ব্যক্তি তাঁকে সালাম দেন এবং তিনি সালামের জবাব দেন।
শিলমুন এক্সেস লিংক সিএনজি ফিলিং স্টেশনের বিভিন্ন দিকের তিনটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সকাল ৭টা ১৭ মিনিটে তিনি একাই রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছেন। তিন ঘণ্টার বেশি সময় ওই ফুটেজে ওই রাস্তায় কোনো অ্যাম্বুলেন্স দেখা যায়নি। এমনকি সন্দেহভাজন কাউকে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি।
উত্তরবঙ্গে যাওয়ার গাড়িগুলো সাধারণত বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় যাত্রাবিরতি দেয়। ২২ অক্টোবর বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে বগুড়ার শেরপুর পেন্টাগন হোটেলের একটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, তিনি হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন।
ঘটনার তদন্তে নেমে অপহরণ নাটকের বিষয়টি জানতে পেরে মামলার বাদী মোহেববুল্লাহ মিয়াজীকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হওয়ার কথা স্বীকার করে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪-এর বিচারক যুবায়ের রশীদের কাছে জবানবন্দি দেন তিনি। বিচারক তাঁকে পুলিশের মাধ্যমে পরিবারের জিম্মায় দেওয়ার নির্দেশ দেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে যে মোহেববুল্লাহ আদালতে বলেছেন, ২২ অক্টোবর সকালে টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি বাসা থেকে হাঁটতে বের হওয়ার সময় জিন-জাদু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অবচেতন মনে তিনি মাজুখান এলাকার দিকে যেতে থাকেন। মাজুখানে যাওয়ার পর তাঁর মাথায় আরও এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে। এরপর মাজুখান থেকে অটোরিকশায় তিনি পুবাইল থানার মীরের বাজারে গিয়ে নামেন এবং সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাসন থানার ভোগরা বাইপাস এলাকায় যান। গরম লাগায় মাথার পাগড়ি খুলে তিনি অটোরিকশার আসনের পেছনে রেখে আসেন। তখন তাঁর মাথায় টুপি, গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবি (জোব্বা) ছিল। মুখে ইসলামি ফাউন্ডেশন লিখিত সবুজ রঙের মাস্ক ছিল। চোখে চশমা ছিল।
আরও পড়ুনখতিব মোহেববুল্লাহ স্বেচ্ছায় নিখোঁজের কথা আদালতে স্বীকার করলেন২৮ অক্টোবর ২০২৫আদালতে খতিব উল্লেখ করেন, ভোগড়া বাইপাস থেকে একটি বাসে তিনি ঢাকার শ্যামলীতে যান এবং সেখান থেকে আরেকটি বাসে গাবতলীতে পৌঁছান। মাঝখানে কারও সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি এবং কেউ তাঁকে কিছু খেতে দেননি। বেলা দুইটার দিকে তিনি গাবতলী থেকে শ্যামলী পরিবহনে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বাসটি বগুড়ার শেরপুর পেন্টাগন হোটেলে মাগরিবের নামাজে যাত্রাবিরতি দিলে তিনি নেমে নামাজ পড়ে দ্রুত বাসে ওঠেন। রাত আনুমানিক ১১ থেকে ১২টার দিকে পঞ্চগড়ে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া সোনালি রঙের একটি ছোট তালাযুক্ত শিকল আমি অবচেতন মনে পায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি বা অচেতন হয়ে যাই। ঘুম থেকে জেগে আমি নিজেকে পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে দেখতে পাই।’
পুলিশ কী বলছেএ নিয়ে গতকাল গাজীপুর মহানগর পুলিশের সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে অপহরণের প্রমাণ পায়নি এবং খতিব নিজেই নিজের পায়ে শিকল লাগিয়ে শুয়ে ছিলেন বলে জানায়।
আরও পড়ুনখতিব মোহেববুল্লাহ শিকল লাগিয়ে নিজেই অপহরণের নাটক সাজান: পুলিশ২৮ অক্টোবর ২০২৫পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, খতিব নিখোঁজ হওয়ার পর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশ জানতে পারে, পঞ্চগড়ে যাওয়া পর্যন্ত তিনি সব সময় মুঠোফোনে কারও না কারও সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি অপহৃত হলে সারাক্ষণ মুঠোফোনে কথা বলতে পারতেন না। তা ছাড়া পুলিশ দুজনকে সাক্ষী হিসেবে পেয়েছে, যাঁরা তাঁকে বাসে যেতে দেখেছেন।
পুলিশ কর্মকর্তা তাহেরুল হক চৌহান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজেই যেহেতু মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী, তাই তাঁকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছে। পাশাপাশি আরও অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে।
আরও পড়ুনটঙ্গী থেকে নিখোঁজ ইমামকে পঞ্চগড়ে শিকলবাঁধা অবস্থায় উদ্ধার, বিক্ষোভ২৩ অক্টোবর ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম হ বব ল ল হ ম য় জ খত ব ম হ ব হওয় র পর মসজ দ র র হওয় র উদ ধ র এ সময় র একট
এছাড়াও পড়ুন:
দুবাই থেকে বিমানবন্দরে নেমেই উড়ালসড়কে অপহরণের শিকার প্রবাসী
হাসপাতালে শয্যাশায়ী অসুস্থ বাবাকে দেখার জন্য ছেলে ইমরান মুন্না ছুটে আসেন আরব আমিরাতের দুবাই থেকে। গতকাল সোমবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে নেমে বাড়ির উদ্দেশে ওঠেন সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। অটোরিকশাটি পতেঙ্গা উড়াল সড়কে ওঠার পর অস্ত্রের মুখে মুন্না ও তাঁর এক আত্মীয়কে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল এই ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে, তবে অপহরণকারী ব্যক্তিদের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি।
পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী সুলতান মোহাম্মদ আহসান উদ্দিন রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল পতেঙ্গা হলেও ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় উদ্ধার হন। সেখানে মামলা করার কথা বললে অপহরণের শিকার ইমরান রাজি হননি, তবে তাঁকে বুঝিয়ে মামলা করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নুর ইসলাম রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ইমরান মুন্নার গ্রামের বাড়ি হাটহাজারী নজুমিয়াহাট এলাকায়। বিমানবন্দরে নেমে তিনি গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য অটোরিকশায় ওঠেন। সঙ্গে ছিলেন সুলাইমান নামের তাঁর এক আত্মীয়। তাঁদের বহনকারী অটোরিকশা শহীদ ওয়াসিম আকরাম উড়াল সড়কে ওঠার পর একটি প্রাইভেট কার এসে গতি রোধ করে। এরপর দেশি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাঁদের বায়েজিদ বোস্তামী থানার আতুরার ডিপো এলাকার একটি পরিত্যক্ত কটন মিলের ভেতরে নিয়ে যায়।
অপহরণের বিষয়টি গোপনসূত্রে জানতে পারে পতেঙ্গা থানা–পুলিশ। পরে বায়েজিদসহ বিভিন্ন থানায় বিষয়টি জানায় তারা। এরপর খবর পেয়ে বায়েজিদ থানা–পুলিশ ঘটনাস্থলে অভিযান চালায়। পুলিশ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে দেখে অপহরণকারী ব্যক্তিরা পালিয়ে যায়। উদ্ধার করা হয় প্রবাসী মুন্নাকে। পরে তাঁর আত্মীয় সুলাইমানকেও পাওয়া যায়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় প্রবাসীর লাগেজও।
অভিযানে থাকা বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই মোহাম্মদ মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, দুই ভুক্তভোগী ও অটোরিকশাচালকের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত নেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত থানায় বোঝানো হয়। কিন্তু তাঁরা কিছুতে মামলা করতে রাজি হচ্ছেন না।
প্রবাসী ইমরান মুন্নার মুঠোফোনে রাতে যোগাযোগ করা হলে এই বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।