ছাত্র–জনতা হত্যাকাণ্ডে ক্ষমা চাইলেন না শেখ হাসিনা
Published: 29th, October 2025 GMT
গত বছর গণ–অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গততাল বুধবার একযোগে শেখ হাসিনার তিনটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট। সাক্ষাৎকারগুলো নেওয়া হয়েছে ই–মেইলে।
সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যায় তাঁর দায়, আসন্ন নির্বাচন, দেশে ফেরা, ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এগুলোই পলাতক জীবনে তাঁর দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকার।
তিনটি সাক্ষাৎকারেই শেখ হাসিনা একই ভাষায় কথা বলেছেন। নিজে কোনো কিছুর দায় নেননি, কোনো কিছুর জন্যই অনুশোচনা করেননি। ছাত্র-জনতার হত্যার জন্য মাঠপর্যায়ে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়ী করেছেন। এমনকি তাঁর ভাষায়, সহিংস বিদ্রোহ দমনকে সাংবিধানিক অধিকার বলেও বর্ণনা করেছেন।
আবার নিজে পরপর তিনটি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করলেও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চেয়েছেন। নিজে প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে বিভেদ বাড়ালেও এখন বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে দেশে বিভেদ বাড়বে।
ক্ষমা চাইতে অস্বীকারদ্য ইনডিপেনডেন্ট তাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনে বলেছে, ১৫ বছরের বেশি সময় কঠোরভাবে দেশ শাসন করা হাসিনা এখন ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, গত বছর নিহত আন্দোলনকারীদের পরিবারের কাছে তিনি ক্ষমা চাইবেন কি না, তখন হাসিনা বলেন, ‘আমি আমাদের জাতি হিসেবে হারানো প্রতিটি সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করি এবং তা করতে থাকব।’
সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা গত বছরের বিক্ষোভ দমনের সময়কার কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেন। তবে তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তিগত দায় স্বীকার করেন না, আর ওই আন্দোলন ছিল একটি সহিংস বিদ্রোহ।
শেখ হাসিনার দাবি, বেশিসংখ্যক প্রাণহানির জন্য দায়ী ছিল ‘মাঠপর্যায়ে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন নেতা হিসেবে আমি অবশ্যই সামগ্রিক দায় স্বীকার করি, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে—যে আমি নিজে নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালাতে বলেছিলাম, এটা ঠিক নয়।’
শেখ হাসিনা দাবি করেন, প্রথম দিকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁর সরকারই একটি স্বাধীন তদন্ত শুরু করেছিল, কিন্তু পরে তা বন্ধ করে দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি একই কথা বলেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘চেইন অব কমান্ডের মধ্যে কিছু ভুল অবশ্যই হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে, সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত ছিল পরিমিত, সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এবং যতটা সম্ভব প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে।’ তিনি এ প্রসঙ্গে ইনডিপেনডেন্টকে আরও বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, যাঁদের সুপ্রতিষ্ঠিত কার্যক্রম পরিচালনাবিষয়ক নির্দেশিকা মেনে চলার কথা ছিল। এসব নির্দেশিকায় বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া ছিল। এমনটা হতে পারে যে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যেগুলো ভুল ছিল।’
নিজের বিচার প্রসঙ্গেআন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম চলছে শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের। শেখ হাসিনাকে ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করা হয়েছে। অভিযোগ হচ্ছে, হাসিনা ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ফলে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন।
শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, ছাত্র আন্দোলনের সময়ের ১ হাজার ৪০০ মৃত্যুর সংখ্যাটি ‘অতিরঞ্জিত’। তাঁর ভাষায়, ‘এই সংখ্যা ট্রাইব্যুনালের প্রচারণার কাজে লাগে, কিন্তু বাস্তবে তা বাড়িয়ে বলা।’
এ নিয়ে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ‘যদি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাতে আমি অবাক হব না বা ভয়ও পাব না। এটি একটি প্রহসনের বিচার, যার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কাজ করছে। এই ট্রাইব্যুনাল একটি প্রহসনের আদালত, যেটি পরিচালনা করছে আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে গঠিত একটি অনির্বাচিত সরকার। এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকেই আমাকে সরাতে যেকোনো কিছু করতে পারে।’
ইনডিপেনডেন্ট প্রতিবেদনে লিখেছে, আদালতে এমন অডিও রেকর্ডিং বাজানো হয়েছে, যেখানে হাসিনাকে বলতে শোনা যায় যে তিনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে বলছেন। তবে শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, এই রেকর্ডিংগুলো প্রসঙ্গের বাইরে কেটে নেওয়া ও বিকৃত করা হয়েছে। হাসিনা এ নিয়ে বলেছেন, ‘সহিংসতা ঘটেছে মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে, সরকারের আদেশে নয়।’
দ্য ইনডিপেনডেন্ট এ পর্যায়ে মন্তব্য করে বলেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা হবে এবং সম্ভবত তিনি জানেন ইতিহাস তাঁকে সদয়ভাবে বিচার করবে না। যদিও শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সহিংস বিদ্রোহের মুখে দেশ রক্ষায় সাংবিধানিক কর্তব্য পালনের জন্য গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত নয়।’
শেখ হাসিনা সব দায় অস্বীকার করলেও দ্য ইনডিপেনডেন্ট মন্তব্য করেছে যে গত বছর বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর যে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল, তা বিশ্বকে শোকার্ত করে তুলেছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উপ–আঞ্চলিক পরিচালক বাবু রাম পান্ত তখন বলেছিলেন, বাড়তে থাকা মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের বিক্ষোভকারী বা ভিন্নমতের প্রতি একেবারেই অসহিষ্ণুতাকে তুলে ধরেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক তখন বলেছিলেন, ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ বিশেষভাবে দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, এটি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে সহিংস ঘটনা। পাশাপাশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই হাসিনা সরকারকে বিরোধীদের দমন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার ও একতরফা নির্বাচনের জন্য অভিযুক্ত করেছিল।
দেশত্যাগ ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গেদেশত্যাগ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ায় তিনি চলে যান। তিনি বলেন, ‘থেকে গেলে আমার জীবন যেমন ঝুঁকিতে পড়ত, আশপাশের মানুষদের জীবনও তেমনি বিপদে পড়ত।’ তবে নির্বাসনে থাকলেও তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এখনো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর ভাষায়, ‘শুধু অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই দেশকে সুস্থ করতে পারে।’
রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোনো সরকার যদি এমন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়, যেখানে তাঁর দল থাকবে না, তবে তিনি সেই সরকারের অধীনে বাংলাদেশে ফিরবেন না। তিনি ভারতে থাকার পরিকল্পনা করেছেন।’
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ একদিন আবার বাংলাদেশের ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখবে, সরকারে থাকুক বা বিরোধী দলে। আর এই দল পরিচালনার জন্য তাঁর পরিবার দরকার নেই। তিনি বলেন, ‘এটা আমার বা আমার পরিবারের বিষয় নয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সংবিধান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না।’
তবে এ ক্ষেত্রে রয়টার্স উল্লেখ করে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী তাঁর ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ গত বছর রয়টার্সকে বলেছিলেন যে দল চাইলে তিনি নেতৃত্বের কথা বিবেচনা করতে পারেন।
ভোট বর্জনরয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে তাদের কোটি কোটি সমর্থক নির্বাচন বর্জন করবে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অবিচারই নয়, এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পরবর্তী সরকারের অবশ্যই নির্বাচনী বৈধতা থাকতে হবে। কোটি কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। এখন যে অবস্থা রয়েছে, তাতে তারা ভোট দেবে না। আপনি যদি একটি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চান, তাহলে আপনি কোটি কোটি ভোটারকে বঞ্চিত করতে পারেন না।’
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হবে সে আশা প্রকাশ করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্যান্য দলকে সমর্থন করতে বলছি না। আমরা এখনো আশা করি, বোধোদয় হবে এবং আমাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হবে।’
আর এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগসহ সব বড় রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাঁর দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা মানে দেশে ভবিষ্যৎ বিভেদের বীজ বপন করা।
গুম নিয়ে কথা বলেননিরয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাচ্যুতির পর তাঁর সমর্থকদের ওপর বড় ধরনের দমন অভিযান চালানো হয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে একটি অভিযানে হাজারো মানুষকে গ্রেপ্তার করে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা রাষ্ট্র অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে।
এ নিয়ে রয়টার্স সবশেষে বলেছে, তবে নিজের শাসনামলে গোপন আটককেন্দ্রে নিখোঁজ হওয়া শত শত মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে শেখ হাসিনা কিছুই বলেননি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব ক র কর হত য ক ণ ড ম ঠপর য য় ন র জন য র জন ত ক রয়ট র স ব যবহ র প রসঙ গ গত বছর বল ছ ল প রক শ পর ব র র পর ব বল ছ ন পর য য় কর ছ ন অপর ধ সরক র বছর র র ওপর আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
‘মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে’
১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতার উষালগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও দেশীয় সহযোগী আলবদর ও আলশামস বাহিনী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক দগদগে ক্ষত। ১৪ ডিসেম্বর ম্যাসাকারটি তীব্র হলেও মূলত এ নিধনযজ্ঞ চলেছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে। শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎস, প্রকৌশলী, কেউ এ হত্যাকাণ্ডের বাইরে ছিলেন না। এর লক্ষ্য ছিল বাঙালি বিদ্বৎসমাজের শিকড় সমূল উপড়ে ফেলা। হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীরা স্বমহিমায় ভাস্বর ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা নিয়ে এখনো গবেষণা বাকি আছে। প্রথমা প্রকাশন তাদের প্রকাশিত বই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ-এ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা এবং সারা দেশে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের অনুসন্ধান সমন্বয় করে ৩৫৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম-পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ শিরোনামে আলী মো. আবু নাঈম ও ফাহিমা কানিজ লাভার যৌথ সম্পাদনায় আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে ৪৭৭ জন বুদ্ধিজীবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক কামরুল ইসলাম মামুন ‘আ লস দ্যাট স্টিল হান্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২০২৪ সালের ১০ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টার-এ একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, ১৪ ডিসেম্বর রাতে ১ হাজার ১১১ জন বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়। এসব ব্যক্তির কেউ আর স্বজনদের কাছে ফিরে আসেননি।
সংখ্যার বিভিন্নতা যা-ই থাক না কেন, কোনো হত্যাকাণ্ডই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ যাকে যা দেয় না, তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার রাখে না। যেমন জীবন। জীবন কেউ কাউকে দেয় না, সুতরাং তা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। মানবাধিকারের এটিই মৌলিক শিক্ষা। ১৯৭১ সালে মানবাধিকারের মর্মবাণী পাকিস্তানি সেনাদের বুটের নিচে জায়গা পেয়েছিল।
এই হত্যাযজ্ঞের মূল কুশীলব এ এ কে নিয়াজি বা রাও ফরমান আলীসহ আলবদর ও আলশামস থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।১৪ ডিসেম্বর রায়েরবাজার ও মিরপুরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হওয়ার পর এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দায় সবাই মুখর হয়ে ওঠে। বিজয়লগ্নে এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে মানুষ শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। বিজয়ের আনন্দ ম্লান হয়ে ওঠে। কেমন ছিল সেই ভয়াবহতা? বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন এ হত্যাকাণ্ড দেখে সানডে টাইমস পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন পাঠান:
‘বাংলার বুদ্ধিজীবীরা এক খাদে মরে পড়ে আছেন।...বধ্যভূমিটি হচ্ছে ঢাকা শহরে মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডির কাছে একটি ইটখোলা। এটি একটি অদ্ভুত নির্জন জায়গা, যদিও নীলচে সাদা এঁদো জলাশয়গুলোতে কচুরিপানা ভেসে বেড়ায়। শত শত ঢাকাবাসী আজ এখানে এসেছিলেন মৃত দেহগুলো দেখার জন্য। কাদামাটির পাড় ধরে হাঁটতে থাকা লোকদের অনেকেই নিজেদের আত্মীয়স্বজনের লাশ খুঁজছিলেন।
‘...তাঁদের শরীরের ওপর জমেছে ধুলো-কাদা, দেহগুলো গলতে শুরু করেছে। একটি বাঁধের ওপর একটি কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। ঢাকার কুকুরগুলো নাটকীয়ভাবে দেহটাকে মাংসমুক্ত করে ফেলেছে। বাঙালী জনতা এই ডোবাগুলোতে এক অদ্ভুত শান্ত ভঙ্গিমায় চলাচল করছে। এখানে তাদেরকে ক্রোধান্বিত মনে হয় না। অন্যত্র তারা ক্রোধোমও। কিন্তু এখানে তারা হাঁটছে, মৃদু ফিসফিস করে কথা বলছে, তারা যেন গীর্জা পরিদর্শনরত পর্যটক।’ (বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য, মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯২)।
বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ল্যান্ডস্কেপ পুরোপুরি ধ্বংস করার ঘৃণ্য চক্রান্তের অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনারা এ হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর পেছনে মূলত কাজ করেছে হানাদারদের ইন্টেলেকচুয়াল ইনটলারেন্স বা বুদ্ধিবৃত্তিক অসহিষ্ণুতা। তাদের কাছে এটি পরিষ্কার ছিল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করতে বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ভাষার প্রশ্নে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত অগ্রগণ্য। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালন বাঙালি সংস্কৃতিচেতনা বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন আরেক বাঁকবদল। কারণ, এটি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। রাজনৈতিক সচেতনতা পরিস্ফুটন, স্বাধীনতাসংগ্রামকে সফল করতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৬৭ সালে জেনারেল আইয়ুব খান রবীন্দ্রসংগীতবিরোধী অবস্থান নিলে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল অংশ এর তীব্র প্রতিবাদ করে। এ আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতি ও স্বাধিকার চেতনা জাগিয়ে তোলে। ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিকেরা এ আন্দোলনে অংশ নেন।
এভাবে পূর্ব বাংলার বিদ্বৎসমাজের হাতে বাঙালি সংস্কৃতির এক স্বতন্ত্র স্বরূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, যা ছিল মূল সমন্বয়বাদ। সব ধর্ম, মত ও পথের মিলনে গড়ে উঠছিল বাঙালি সংস্কৃতির বহমান ধারা, যার ভেতর ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়। এ সূত্রপাত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার প্রশ্ন ছিল না, এর পেছনে ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণও।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দর্শনজাত স্বরাজের স্বপ্ন বাঙালিকে তাড়িত করেছে দীর্ঘ সময়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দর্শনগত ভিত নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল এ দেশের বিদ্বৎসমাজের হাতে। কিন্তু সেই আলো বেশি জ্বলেনি। নানা পথ মাড়িয়ে আজ তা চোরাগলিতে ঢুকছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে ১৯৬০-এর দশকে রেহমান সোবহানের টু ইকোনমিক থিওরি বা দুই অর্থনৈতিক তত্ত্বে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ বৈষম্য পূর্ব বাংলার মানুষকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে। মানুষ মুক্তিপিপাসু হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা প্রণয়নে আবুল মনসুর আহমদ, রেহমান সোবহান, ড. কামাল হোসেন ও অধ্যাপক নূরুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একুশ দফা, সত্তরের নির্বাচনসহ নানা আন্দোলনে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, লেখক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলী, সংস্কৃতিকর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা পাকিস্তানি সেনাদের নজরের বাইরে ছিল না। বিশেষ দেশাত্মবোধক গান, নাটক, কথিকা, স্লোগান এ দেশের মানুষের মুক্তি আন্দোলনে ছিল দারুণ অনুপ্রেরণা।
পূর্ব বাংলার বিদ্বৎসমাজ মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকে যৌক্তিক করে তুলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি বিশ্লেষণাত্মক জনমানস গঠনের মাধ্যমে মুক্তি বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নির্মাণ করেছে। আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে পরিচালনা করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বিদ্বৎসমাজের সম্পর্ক ছিল মিথোজীবিক। এক পক্ষ (বিদ্বৎসমাজ) মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সোপান গেড়েছে, অন্য পক্ষ (রাজনৈতিক পক্ষ) পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়েছে।
উল্লেখ্য, রাজনৈতিক নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতে অবস্থান করলেও বুদ্ধিজীবীদের বিপুল অংশ থেকে যান স্বদেশে। থেকে যান জীবনের পূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে। এ জন্য তাঁদের অশেষ মূল্য দিতে হয়। তাঁরা ত্যাগের মহিমা রেখে গেছেন।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ অভিধানে ‘দেশ’ শব্দের অর্থ নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নিশানা’ বা ‘গন্তব্য’। অর্থাৎ মানুষ জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা পেলে যেদিকে যাবে, সেটিই তার দেশ। দেশের নিশানা নির্মাণকারী বিদ্বৎসমাজ। বিদ্বৎসমাজকে নিঃশেষ করা গেলে দেশকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করা কঠিন নয়। পাকিস্তানিদের ভেতর জাত্যভিমান ছিল। নিজেদের পবিত্র ভাবত আর অন্যদের আলাদা করতে চাইত। বাঙালি সংস্কৃতিকে তারা হিন্দু সংস্কৃতির উপজাত ভাবত। এমন ঘৃণ্য একটি বোধ থেকে তারা নিধনে নামে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল।
এগুলো স্বাভাবিক হত্যাকাণ্ড ছিল না। বুদ্ধিজীবীদের যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের ধরনে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সমাজের গুণীজনদের ঘিরে মানুষের ভেতরে শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড হাজার হাজার মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। কারণ, সৃজনশীল, গুণী ব্যক্তিদের আদর্শে জন্ম নেয় অনেক ভাবাদর্শিক মানুষ। একজন সৃজনশীল, গুণী ব্যক্তিকে হত্যা করা মানে অসংখ্য মানুষের অনুভূতিকে খুন করা। বুদ্ধিজীবীদের কেবল নির্মমভাবে হত্যা করা হয়নি, তাঁদের পরিচয়হীন করে তোলা হয়েছিল। স্বজনেরা লাশ পর্যন্ত চিনতে পারেননি। স্পর্শ করতে পারেননি। বধ্যভূমিতে একসঙ্গে অনেকের জায়গা হয়েছিল। জীবন কখনো কখনো বিভক্ত করে, কিন্তু মৃত্যু সম্মিলিত করে।
এই হত্যাযজ্ঞের মূল কুশীলব এ এ কে নিয়াজি বা রাও ফরমান আলীসহ আলবদর ও আলশামস থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমাও চায়নি! বরং পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে একাত্তরের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর ‘দুবার সমাধান’ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশকে ‘হৃদয় পরিষ্কার’ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মৃত্যু শেষ কথা নয়, মৃত্যুর ভেতর থাকে নতুন প্রাণ, নতুন বার্তা। আমাদের অগ্রজেরা সেই নমুনা রেখে গেছেন। স্বাধীন, সার্বভৌম ও মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
‘মরণের হাত ধরে স্বপ্ন ছাড়া কে বাঁচিতে পারে।’ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা!
লেখক: যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক