দেবতাদের অহংকার ভেঙেছিলেন জগদ্ধাত্রী
Published: 30th, October 2025 GMT
জগদ্ধাত্রী নামের মধ্যেই জগতকে ধারণ করার ইঙ্গিত রয়েছে। বর্ষাশেষে পর স্বর্গে যখন অসুরদের ভয়ানক তাণ্ডব চলছে, স্বর্গরাজ্যের অধিবাসী দেবদেবীরা যখন সেই তাণ্ডবলীলায় নাজেহাল ওপর্যুদস্ত, তখন সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনীরূপে দেবী দুর্গা অসুরদের নিধন করতে রণক্ষেত্রে নেমেছিলেন। স্বর্গমর্ত্যপাতাল সেদিন কেঁপে উঠেছিল এই মহাযুদ্ধে। শেষে দশভূজা দেবী দুর্গার কাছে পরাস্ত হন মহিষাসুর। অবশেষে স্বর্গ সেদিন শান্ত হয়। পুরাণ বলছে, মহিষাসুর বধের পর স্বর্গের দেবতারা আনন্দে শুধু আত্মহারাই হননি, তাঁরা তখন খুব অহংকারী হয়ে ওঠেন। তাঁরা তখন ভুলেই গেছিলেন কার মায়ায় এবং শক্তিতে স্বর্গের দেবতারা পরাক্রমশালী অসুরদের পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা আনন্দে ভুলেই যান যে দেবী জগদ্ধাত্রীর শক্তিতেই তাঁরা এত শক্তিশালী হয়েছেন। এই দেবী জগদ্ধাত্রী হলেন দুর্গারই আরেক রূপ। তিনিও দুর্গার মতো সিংহবাহিনী, তবে দশভূজা নন। চতুর্ভূজা।
দেবতারা যখন আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন, দেবী জগদ্ধাত্রী একদিন ঠিক করলেন যে দেবতাদের এই অহং বিনাশ করতে হবে। সরাসরি তো আর তাঁদের শক্তি পরীক্ষা নিতে পারবেন না। ফলে কৌশলের মাধ্যমে তাঁকে সেই পরীক্ষা নিতে হলো। আসলে স্বর্গের দেবতারা, ভাবতেন দেবী দুর্গা তাঁদেরই সবার সম্মিলিত রূপ, তাই মহিষাসুরকে নিধনের কৃতিত্ব আসলে কমবেশি সকলেরই। যেহেতু ব্রহ্মা নির্দেশ দিয়েছিলেন যে মহিষাসুর বধের জন্য একটি নারীদেহের প্রয়োজন এবং তবেই তিনি বর দেবেন, তাই দেবতারা দেবী দুর্গাকে নির্বাচিত করেছিলেন অসুর নিধনের জন্য। আসলে এটি খানিকটা দেবতাদের দর্পচূর্ণ করার জন্য দেবীর এই রূপের সৃষ্টি করেছিলেন ব্রহ্মা।
আরও পড়ুনরাখিবন্ধন: ভেদাভেদ ভুলে মানবতার উৎসব০৯ আগস্ট ২০২৫তাই অসুরবধের পর যখন অহংকারে দেবতাদের পা যেন আর স্বর্গের মাটিতে পড়ছিল না তখন কার কেমন শক্তি দেবী জগদ্ধাত্রী প্রত্যেককে তা পরীক্ষা করে বুঝিয়ে দেওয়া শুরু করলেন। দেবতাদের অহংকার চূর্ণ করতে এবং তাঁদের শক্তি পরীক্ষা করতে দেবী জগদ্ধাত্রী তখন তাঁদের দিকে একটি তৃণখণ্ড ছুঁড়ে দিলেন। কী আশ্চর্য! দেখা গেল ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু বা বরুণ দেবতাদের কেউই সেই তৃণখণ্ডটিকে নিজেদের শক্তি দিয়ে আটকাতে পারছেন না। সকলেই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। কারণ ইন্দ্র তাঁর কঠিন ভয়ঙ্কর বজ্র দিয়ে তৃণখণ্ডকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেন। অগ্নিদেব সেই তৃণখণ্ডকে বাধা দিয়ে তাকে দগ্ধ করতে পারলেন না। বায়ুদেবও সেই তৃণখণ্ডকে তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কোথাও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি। বরুণদেব ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামালেন ঠিকই, তবে তাতে তৃণখণ্ডকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারলেন না এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। এমন যখন বেকায়দায় পড়েছেন দেবকুলের রথী-মহারথীরা তখন তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হলেন স্বয়ং দেবী জগদ্ধাত্রী। একটি ক্ষুদ্র তৃণখণ্ডকে যে দেবতারা সরাতে পারেন না, তাঁরা মহিষাসুরকে কীভাবে, কীসের বলে, কোন শক্তিতে বধ করলেন,তা তাঁদের কাছে জানতে চান তিনি। তাঁদের নিরুত্তর দেখে তিনি তখন বলেন, তাঁরই শক্তিতে দেবী দুর্গা এই মহৎ কাজটি করতে সক্ষম হন এবং তিনিই দুর্গার আরেক রূপ ও সমগ্র জগতের ধারিণী শক্তিও।
সনাতন ধর্মে দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী বা সরস্বতী পূজার মতো জগদ্ধাত্রী পূজা তত বেশি জনপ্রিয় না হলেও বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে বেশ অনেককাল আগে থেকেই ইতিহাসের পাতায় জগদ্ধাত্রী পূজার সংবাদ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের আখরগ্রন্থ জীমূতবাহন রচিত কালবিবেক গ্রন্থে দেখা যায় কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ। বরিশালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মাটি খনন করে অষ্টম শতকে নির্মিত দেবী জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পেয়েছেন, যা এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজত্বকালে শান্তিপুরের জলেশ্বর ও রাঘবেশ্বরের শিবমন্দিরের গাত্রে টেরাকোটার ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি দেখা যায়।
জগদ্ধাত্রীও দেবী দুর্গার মতো সিংহকে বাহন হিসেবে রেখেছেন। দশ হাতের বদলে চার হাতে রয়েছে বামদিক থেকে যথাক্রমে শঙ্খ ও শার্ঙ্গধনু এবং ডানহাতে চক্র ও পঞ্চবান। দেবীর গায়ের রং প্রভাতের সূর্যের মতো রক্তবর্ণা কমলা। তিনি সালঙ্কারা। তিনি ত্রিনয়না। উপনিষদে তাঁকে আদিশক্তিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
আরও পড়ুনভাই-বোনের মধ্যকার অনিন্দ্যসুন্দর সম্পর্ক ঘিরেই প্রচলিত ভাইফোঁটা ০৩ নভেম্বর ২০২৪তবে, চণ্ডীতে আছে তিনি মহামায়া দেবী দুর্গার ভিন্ন একটি রূপ। মহিষাসুর যখন দেবতাদের নাস্তানাবুদ করার জন্য মায়াবলে নানা ছদ্মরূপে হাজির হচ্ছিলেন দেবতাদের সামনে তখন তিনি হাতির রূপও ধারণ করেছিলেন। তখন হস্তীরূপী অসুরকে বধ করতে দেবী দুর্গা জগদ্ধাত্রী রূপে আবির্ভূত হয়ে চক্র দ্বারা হাতির শূঁড় ও মাথা ছেদ করে পরাস্ত করেন।
বর্তমানে একসময়ের ফরাসি উপনিবেশ ফরাসডাঙায় নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সুহৃদ ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন করেন। আজ চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আয়োজন ও জৌলুস বিশ্বখ্যাত। সেখানকার বেশ কয়েকটি পুজো শতাব্দীপ্রাচীন। তবে কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা গ্রন্থে কলকাতায় জগদ্ধাত্রী পুজোর সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘বারোইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু—ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মূর্তি—সিঙ্গির গায়ে রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া। ঠাকরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আদল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু,মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে জোড়হাত ক’রে স্তব কচ্চেন।’
কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রীর পূজা সম্পন্ন হয়। তবে পূজার নিয়ম কিছুটা স্বতন্ত্র বলা যায়। কোথাও কোথাও সপ্তমী অষ্টমী ও নবমী তিথি পালন করে তিনদিনই পূজা করা হয়। আবার কেউ কেউ শুধু নবমীর দিনই তিন বার পূজার আয়োজন করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা সম্পন্ন করেন।
আরও পড়ুনমনসা: বাংলার লোকপ্রকৃতির দেবী১৬ জুলাই ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জগদ ধ ত র র স বর গ র ইন দ র পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
রিকশার গ্যারেজে তৈরি হচ্ছিল নকল ‘ডেটল’ সাবান
বাইরে থেকে দেখতে রিকশার গ্যারেজ। তবে এর আড়ালে সেখানে চলছিল নকল সাবান তৈরির কাজ। রাত হলেই সেখানে ডেটল, সলিড, লিফোর্ডসহ বিভিন্ন ব্যান্ডের ছাঁচ ও মোড়ক নকল করে এসব সাবান তৈরি হতো। আজ রোববার দুপুরে অভিযান চালিয়ে নকল সাবান তৈরির কারখানাটি সিলগালা করে নকল সাবান জব্দ করা হয়।
আজ দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের ইউনুছ মার্কেট এলাকায় ওই কারখানায় অভিযান পরিচালনা করেন র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু হাসান এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরিদর্শক আবদুর রহিম। অভিযানে র্যাব-৭–এর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
র্যাব জানায়, সরকারি অনুমোদন ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে একটি কারখানায় অবৈধভাবে সাবান উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছিল। কারখানাটি ইউনিয়ন পরিষদের একটি ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করলেও বিএসটিআইয়ের অনুমোদন বা মান নিয়ন্ত্রণ সনদ ছিল না। সেখানে ডেটল সাবান তৈরির ছাঁচ ও মোড়ক পাওয়া গেছে। হুবহু নকল এসব মোড়কে ভুল তথ্য দিয়ে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হতো। কারখানাটি সিলগালা করা হয়েছে।
র্যাব-৭–এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, রিকশার গ্যারেজের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে কিছু ব্যক্তি এখানে নকল সাবান তৈরি করছে; এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালায় র্যাব-৭। এসব নকল সাবানে বিভিন্ন নামী কোম্পানির লোগো ব্যবহার করে বাজারজাত করা হচ্ছিল। এসব সাবানে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর কোনো অনুমোদন নেই।