ক্ষমতাপ্রত্যাশীরা নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে চায় না
Published: 28th, February 2025 GMT
আজকাল কারও সঙ্গে দেখা হলেই কতগুলো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে? নির্বাচন কি হবে? মিলিটারিরা কি ক্ষমতা নিয়ে নেবে? ইত্যাদি। নির্বাচনের কথা উঠলেই আগে বলতাম,
—ভাই, আপনি কি ক্যান্ডিডেট?
—না।
—আমিও না। তাহলে নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? যারা নির্বাচন করবে, তারা এ নিয়ে থাকুক।
এখন আর এ রকম বলতে পারছি না। দেশে একটা সরকার আছে। অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু সরকারটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশ যে কে চালায়, বোঝা মুশকিল। একটা কথা আমি প্রায়ই বলতাম, দেশটা আল্লাহ চালায়। এই যে একটা দেশ, সতেরো কোটি মানুষ, দুই শর বেশি দল, কারও সঙ্গে কারও বনিবনা নেই। পাঁচজন লোক একসঙ্গে বসলে পাঁচটা মত হয়। দল যত ছোট, তার নেতা তত বেশি। তারা প্রায়ই ভাঙে। তারপর শুরু করে ঐক্যপ্রক্রিয়া। এটি করতে গিয়ে দলগুলো আবারও ভাঙে। ঐক্য আর হয় না।
ইতিহাস বলে, আমরা একটা জনগোষ্ঠী হিসেবে কখনো ঐক্যবদ্ধ ছিলাম না। অনেকেই বলেন একাত্তরের কথা। তখন নাকি জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। এটাও একটা মিথ। নানা দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে সম্প্রতি আমি একটি বই লিখেছি ১৯৭১: কলকাতা কোন্দল। দেখা গেছে, আমাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়েও আমরা একমত হতে পারিনি। কলকাতায় প্রবাসী সরকারের মধ্যে ছিল দলাদলি-কোন্দল। সেটি ছড়িয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগের মধ্যেও। মন্ত্রীদের কারও কারও মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত হতো না।
আমরা সবাই গণতন্ত্র চাই। গণতন্ত্র কী—এ নিয়ে আমাদের ধারণা অনেকটা অস্পষ্ট ও বায়বীয়। কারণ, এ দেশে সত্যিকার গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি। চেষ্টা হলেও তা বারবার হোঁচট খেয়েছে। তারপর আমরা দেখলাম দীর্ঘ সময় ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসন। অসামরিক ও সামরিক স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্রের লেবাসে পারিবারিক অলিগার্কি এবং শেষমেশ চোরতন্ত্র। এখন আমরা মবতন্ত্রের জমানায় আছি।
১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এরপর ভুট্টো একটা মজার ব্যাপার ঘটালেন, যার নজির নেই। তিনি ভোর চারটায় মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তাঁকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি রাত তিনটায় সংবাদ সম্মেলন করে রেকর্ড বইয়ে নাম ওঠালেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটা নাজুক হয়ে পড়েছিল যে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য তাঁর ছিল না। তাঁর এই সংবাদ সম্মেলনে পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি। তারপর এল সেনাপ্রধানের কড়া বার্তা। এ নিয়ে এখন কাটাছেঁড়া চলছে। ফেসবুকে নানান বিশেষজ্ঞ মতামত পাচ্ছি এবং আরও বিভ্রান্ত হচ্ছি।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কড়া গলায় বলেছেন, এনাফ ইজ এনাফ। দেশে চলছে একটা ‘ফ্রি ফর অল’ ব্যাপার। একদল লোক বলছে, এটা মানি না। আরেক দল বলছে, অমুকদের নিষিদ্ধ করতে হবে। এক নেতা তো বলেই বসেছেন, তাঁর নেতার নাম মুখে আনার আগে অজু করতে হবে। চাটুকারিতা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এটি তার একটা উদাহরণ।
কথা হচ্ছিল এক তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে। সম্প্রতি ছাত্ররা তথা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা একটি রাজনৈতিক দল তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন। এ নিয়ে কথা হলো। সাংবাদিকের নানা প্রশ্ন। জবাব দিতে গিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি। আসলে কী বলব? অনেক কিছুই তো জানি না, বুঝি না। একটা সবজান্তার ভাব ধরে থেকে কাঁহাতক আর নিজের অজ্ঞানতা কিংবা নির্বুদ্ধিতা লুকিয়ে রাখা যায়?
—আচ্ছা, বলুন তো, এই যে সমন্বয়কেরা নতুন দল তৈরি করছে, সরকার কি এটাকে প্রশ্রয় দিয়ে একটা কিংস পার্টি গড়ার নজির সৃষ্টি করছে না?
—আমার তো সে রকম মনে হয় না।
—এই যে মুহাম্মদ ইউনূস তাঁদেরকে সুযোগ করে দিতে চাইলেন, এর মধ্য দিয়ে আমরা কী বুঝব?
—মুহাম্মদ ইউনূস তো সবাইকেই সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন। এত বছর বিএনপি কোথায় ছিল? দৌড়ের ওপর ছিল। আজ তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জামায়াত তো মার খেতে খেতে পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। নিষিদ্ধ হয়েছিল। এখন তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বড় বড় জনসভা করছে। ৫ আগস্ট না হলে আর ইউনূস হাল না ধরলে তো তারা এই সুযোগ পেত না। তিনি ছাত্রদের জন্যও সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন, তাঁদের নতুন দল তৈরির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। এতে দোষের কী আছে।
—এই যে কিংস পার্টির ব্যাপারটা?
—আমাদের দেশে আমরা প্রথম কিংস পার্টি দেখি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে। সেই মডেল অনুসরণ করে জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের সময় গোয়েন্দাদের দিয়ে দল বানালেন। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জেনারেল এরশাদও ক্ষমতায় থেকে একই পদ্ধতিতে দল বানালেন।
—ইউনূস তো একই কাজ করছেন।
—না। যদ্দুর জানি, ইউনূস দল বানাচ্ছেন না। তরুণদের তিনি উৎসাহ দিচ্ছেন। আমার মনে হয়, তিনি নিজে এই দলে যাবেন না।
—তাঁর প্রশ্রয় ও সমর্থন নিয়ে যা হচ্ছে, সেটাই তো কিংস পার্টি।
—আমার তা মনে হয় না। এগুলোর মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য আছে। অতীতের কিংস পার্টিগুলো ছিল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ, এক ব্যক্তির দল। নতুন দলের উদ্যোক্তারা বলছেন, তাঁরা পরিবারতন্ত্র নয়, যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন। তারপরও জনমনে সন্দেহ আছে, এটাও একটা কিংস পার্টি।
—বুঝতে পারছি, আপনি এই ছাত্রদের পক্ষে।
—দেখুন, আমি তাঁদের কাউকে চিনি না। তাঁরাও আমাকে চেনেন না। আমি জুলাই অভ্যুত্থান দেখেছি। মোটাদাগে এর দুটি দিক আছে। প্রথমত, হাসিনা হটাও। তো হাসিনার পতন হলো। এখন কী হবে? আমরা তো গত পাঁচ দশক ধরে একটা গণতান্ত্রিক কাঠামোর স্বপ্ন দেখেছি। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করে যদি একটি দল দাঁড়াতে পারে, এটি রাজনীতিতে নতুন স্রোতোধারা তৈরি করতে পারবে। তাঁরা সফল হবেন কি না, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল।
—এরা তো এখনই গোলমাল শুরু করে দিয়েছে। কমিটি করা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। একটা সমঝোতার কমিটি হচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে।
—এটা ইতিবাচক মনে করি। এক ব্যক্তি একটি দল বানিয়ে তাঁর খেয়ালখুশিমতো কমিটিতে লোক ঢোকাচ্ছেন না। সমঝোতা করে তাঁরা একরকম যৌথ নেতৃত্বের সূচনা করতে চাইছেন। আমি তাঁদের সাধুবাদ দেব।
—সামনের দিনগুলোতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা কেমন হবে? মাঠে তো তাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাতে তো পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখছি না।
—সামরিক বাহিনী এখনো সহায়ক শক্তির ভূমিকায় আছে। এ দেশে সরাসরি সামরিক শাসনের সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে এটাও পরিষ্কার যে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা বা সমর্থন ছাড়া সরকারের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়।
—ছাত্রদের দল করা প্রসঙ্গে আবার আসি। তাদের সম্পর্কে অন্য কয়েকটি দল, বিশেষ করে বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে, সরকারের সঙ্গে তাদের যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছে।
—এ দেশে তরুণেরা বরাবরই ভিন্ন স্রোতে গেছে। ১৯৪৯ সালে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রবীণ মাওলানা ভাসানী ছায়া দিলেও নেতৃত্ব ছিল শামসুল হক, খন্দকার মোশতাক, শেখ মুজিব এবং পরে অলি আহাদ, তাজউদ্দীনের হাতে। তাঁদের বয়স তখন ২৫-৩০-এর কোঠায়। এর পুনরাবৃত্তি দেখলাম ১৯৭২ সালে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তরুণেরা তৈরি করেছিলেন জাসদ। এবারের জুলাই অভ্যুত্থানের পর তরুণেরা আবার এ রকম উদ্যোগ নিয়েছেন। ক্ষমতাসীনেরা বা ক্ষমতাপ্রত্যাশী অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। আগেও দেখেছি, মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগের ওপর এবং পরে আওয়ামী লীগ জাসদের ওপর চড়াও হয়েছিল, নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল।
তবে এটা ঠিক, গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরি করতে হলে একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত যাচাই করা দরকার। সেই নির্বাচনের জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা এখন খুবই জরুরি।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র সরক র র আম দ র দল ব ন ইউন স ক ষমত আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সুষ্ঠু ভোটে বাধা হতে পারে
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানে এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এটি শুধু প্রচলিত কারচুপির পদ্ধতিগুলোকেই আরও সফিসটিকেটেড বা কৌশলী করে তুলবে না; বরং আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে জনগণের বিশ্বাস, সেটিই নষ্ট করে দিতে পারে।
নির্বাচনে এআইয়ের প্রভাব কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি একটি বাস্তব ঝুঁকি। এআই-চালিত টুলগুলো ব্যবহার করে রাজনৈতিক নেতা বা কর্মকর্তাদের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ‘ডিপফেক’ (ভুয়া অডিও, ভিডিও এবং ছবি) তৈরি করা সম্ভব।
এই ডিপফেকগুলো সহজেই মিথ্যা কেলেঙ্কারি ছড়াতে পারে, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই-চালিত বটগুলো সেকেন্ডের মধ্যে এমন সব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য ব্যাপক জনসমর্থনে বা বিরোধিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
যখন জনগণ দেখতে পাবে, তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, তা বোঝা কঠিন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিষয়ে সন্দেহ ঢুকে যাবে। এটি একটি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
এআই অ্যালগরিদমগুলো বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট ভোটারদের লক্ষ করে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দুর্বলতা অনুযায়ী রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে। এই ‘মাইক্রো টার্গেটিং’-এর মাধ্যমে ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ভোটদানের সময় বা স্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখাও সম্ভব।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবেএআই শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি নির্বাচনী পরিকাঠামোর ওপর সাইবার হামলাও জোরদার করতে পারে। এআই-চালিত টুলগুলো আরও সফিসটিকেটেড ফিশিং আক্রমণ তৈরি করে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে বা এমন ম্যালওয়্যার তৈরি করতে পারে, যা প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে সক্ষম। এ ধরনের আক্রমণ ভোটার ডেটাবেজ বা ভোটিং মেশিনকে লক্ষ্য করে করা যেতে পারে। সেটি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন বা পুরো প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিপত্তির সমাধান কী? এ প্রশ্নের জবাব হিসেবে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, এই গুরুতর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই (এক্সএআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এআই মডেলের সিদ্ধান্তগুলো মানুষের কাছে বোধগম্য করে তোলে এক্সএআই। এটি এআইয়ের স্বচ্ছতা বাড়ায়।
ডিপফেক শনাক্তকরণ: এক্সএআই ব্যবহার করে এমন টুল তৈরি করা সম্ভব, যা কেবল ডিপফেক শনাক্ত করে না; বরং কেন একটি বিষয়বস্তু জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেয়। এর ফলে মানব ফ্যাক্ট-চেকাররা বিশ্লেষণ যাচাই করতে পারেন এবং জনগণের আস্থা তৈরি হয়।
প্রচারণার নিরীক্ষা: এক্সএআই রাজনৈতিক প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নিরীক্ষা করতে পারে। এটি বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারে, কীভাবে একটি অ্যালগরিদম তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পক্ষপাতদুষ্ট বা কারসাজিমূলক টার্গেটিং কৌশলগুলো প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
নিরাপত্তা বৃদ্ধি: সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক্সএআই হুমকির শনাক্তকরণ সিস্টেমকে উন্নত করতে পারে। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে, কেন একটি নির্দিষ্ট কার্যকলাপকে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে।
অংশগ্রহণকারীদের করণীয়: এআইয়ের হুমকি মোকাবিলায় সব গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারীকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতাদের প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তাঁরা প্রতারণামূলক এআই জেনারেটেড কনটেন্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রচারে জড়িত হবেন না। তাঁদের উচিত এআইয়ের যেকোনো বৈধ ব্যবহার সম্পর্কে স্বচ্ছ থাকা এবং এআই জেনারেটেড কনটেন্টে সুস্পষ্ট লেবেল ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রচারে এআই ব্যবহারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিয়ম ও প্রবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করতে হবে। তাদের উচিত এআই-চালিত টুলগুলোতে বিনিয়োগ করা এবং ভোটারদের সচেতন করার জন্য বড় আকারের প্রচার চালানো।
এ ছাড়া একটি যৌথ গবেষণা ও উন্নয়ন দল গঠন করা প্রয়োজন, যারা নির্বাচনের আগপর্যন্ত কমিশনকে এআই এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকে এআইয়ের হুমকি সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুত মোকাবিলা করার জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রটোকল স্থাপন করা জরুরি। সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের উচিত ফ্যাক্ট-চেকিং এবং জনগণের মধ্যে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
আমাদের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই নতুন প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এআইয়ের ক্ষমতা যেমন বিশাল, তেমনি এর অপব্যবহারের বিপদও কম নয়।
জনগণের বিশ্বাস এবং একটি ন্যায্য নির্বাচনের অধিকার নিশ্চিত করতে এখনই আমাদের সবাইকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, বাংলাদেশ সরকারের একটি সম্মিলিত গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দল এআই-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো ক্রমাগত বিশ্লেষণ ও অনুমান করবে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।
অধ্যাপক ড. আলমগীর হোসেন এআইয়ের সাবেক অধ্যাপক, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত এআরআইটিআইয়ের সাবেক পরিচালক