আমাদের সময়ে একজন সুপারস্টার নির্মাতা ছিলেন। পুরো শৈশব-কৈশোর রাঙিয়ে দিয়েছিলেন বহুবার, বারবার। যাঁর নাম শুনে সিনেমা হলে দৌড়ে যেতাম। যাঁর সিনেমা প্রথম দিন না দেখতে পারলে, কবে যাব, এই নিয়ে বুক হাঁসফাঁস করত। আমাদের দেখা সেই ‘লড়াকু’ দিয়ে শুরু। এই লড়াকুর লড়াই আজীবন চলছে, আর থামাথামি নেই। কতদিন স্বপ্নে দেখছি তাঁকে! নায়ক রুবেলের সঙ্গে তাঁর নাম সমানভাবে উচ্চারিত হতো। অদ্ভুত জুটি। সিনেমায় জুটি হয় নায়ক-নায়িকার সঙ্গে, আর রুবেলের জুটি একজন পরিচালক। কী দুর্দান্ত সব কাজ, বুঁদ হয়ে থাকা আর উল্লাস নিয়ে তাদের ভিউ কার্ড কেনা, পোস্টার কেনা। কিনে যত্ন করে পড়ার টেবিলের সামনে টাঙিয়ে রাখা, পড়তে পড়তে দেখা, দেখতে দেখতে পড়া। এমন উন্মাদনা এনে দিয়েছিলেন যিনি, তিনি শহীদুল ইসলাম খোকন। 

বহু গুণে গুণান্বিত এ পরিচালক তাঁর সময়ের সেরা তো ছিলেনই, আমি মনে করি, এখনও সেরা। সেই সময়ের প্রভাব এখনও বিদ্যমান, কারণ তাঁকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি কেউ। ডেঞ্জারাস সব কাজ করে গেছেন, মার্শাল আর্টকে গল্পের সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়েছে, যা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। এই উপমহাদেশে তাঁর মতো সফল পরিচালক (অ্যাকশন জনরা) দ্বিতীয়টি নেই, এখনও নেই। আরেকজন খোকন আসেননি, আরেকজন রুবেল আসেননি, আরেকজন সোহেল রানা আসেননি। ভারতে জ্যাকিপুত্র টাইগার শ্রফসহ আরও দু-একজন যে ধরনের অ্যাকশন করে গেছেন, বিশ্বাস করেন, রুবেলের ধারেকাছেও নেই। আর এই অ্যাকশন সিনেমা নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করেছিল এই খোকন। 

খোকনের অন্য অনেক গুণের মধ্যে দুটো বড় দিক হলো– রুবেল আর হুমায়ুন ফরিদীকে বিচিত্র চরিত্রে উপস্থাপন করা এবং মারাত্মক সফল হওয়া। আর বাণিজ্যের কথা বাদ দিলাম। কোন সিনেমার নাম নেব, লড়াকুতো সব ভাসিয়ে দিয়ে গেছে, যে জোয়ার সৃষ্টি করেছিল, তা এখনও বিদ্যমান আমাদের মনে। আমরা ভিসিআর সেট আর ক্যাসেট ভাড়া করে এনে কতবার যে দেখেছি, তার হিসাব নেই। নৌকার গলুইয়ে দু-পা দিয়ে ক্যাঁচকি মেরে শরীরটা পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে যে শট রুবেল নিছে! মাগো মা! তখন তো বুঝতাম না, এখন শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। এই দৃশ্যে কোনো রকম ডামি ব্যবহার করে নাই, কোনো রকম প্রটেক্ট করে নাই। পা ফসকে গেলে সোজা মাছধরা ট্রলারের নিচে, প্রপেলারে দেহ টুকরা টুকরা হয়ে যেতে পারত। কোনো রকম প্রটেক্ট ছাড়া এমন সব মরণঝুঁকি দৃশ্য জ্যাকিচান ছাড়া আর কারও করতে দেখিনি। 
বিচিত্র গল্পের, বিচিত্র চরিত্রের সিনেমা আমাদের মুগ্ধ করেছে বারবার। কোনটা বলব? বজ্রমুষ্ঠি, বিষদাঁত, সন্ত্রাস, বীরপুরুষ, টপ রংবাজ, ঘাতক, ম্যাডাম ফুলি, কমান্ডার, বিপ্লব, বিশ্বপ্রেমিক, ভন্ডসহ ৩০টার বেশি সিনেমা আমাদের সম্মোহিত করে রেখেছিল। (অবশ্য শেষের ২০০৫ এর পর কয়েকটা সিনেমা বাদ দিতে হবে, যখন খোকন ভাই অসুস্থতাসহ নানাবিধ জটিলতায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন।) খোকনের সবগুলো সিনেমা সুপার হিট। তাঁর সিনেমা সুপার হিট হবে, এটা সবাই জানত। আর আমরা অপেক্ষা করতাম।

ভাবা যায়, শৈশবে আমরা সিনেমার গল্প অডিও ক্যাসেটে শুনতাম। টপ রংবাজের গল্প কতবার যে শুনেছি, মনে করতে পারব না। কী সংলাপ! ওই ওই নাটকির পো, মান্দার পো, এই সংলাপ তখন মানুষের মুখেমুখে। কী ক্যারেক্টারাইজেশন, কী গান.

. বর্ণনা করার মতো না। শহীদুল ইসলাম খোকনকে নিয়ে আলাদা গবেষণা হওয়া উচিত। এই বঙ্গে একজন সুপারস্টার পরিচালক ছিলেন, যিনি দুটি প্রজন্মের (১৯৮৫ থেকে পরিচালনা শুরু ২০১২ তে শেষ) প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নির্মাণ করেছেন প্রায় ৪০টির মতো সিনেমা। 
খোকনের গুরুভক্তি কেমন, একটা গল্প জানি, তাঁর সিনেমার গুরু সোহেল রানা অসুস্থ হয়ে পড়লে সিনেমার শুটিং রেখে গুরুর সঙ্গে বিদেশ চলে যান। বর্তমানে সোহেল রানার বাসার ড্রইংরুমে মোজাইকের যে ছবিটি আছে, সেটি খোকন বানিয়ে দিয়েছেন। সোহেল রানা বেশির ভাগ ইন্টারভিউ এই ছবিকে পেছনে রেখে দেন, এটাও তাঁর শিষ্যের প্রতি ভালোবাসা। 

আমার স্বপ্ন ছিল, শহীদুল ইসলামের সহকারী হওয়ার। খোঁজ নিয়ে একদিন গেলাম তাঁর অফিসে। কয়েকবারের চেষ্টায় তাঁর দেখা পেলাম। দেখি, অভিনেতা খলিলের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। আমি সোজা তাঁর সামনে। 
বললেন, কী চান?
ডিগ্রি পরীক্ষা দিছি, পড়াশোনা খারাপ না। ফিল্ম নিয়ে আমার ধারণা শক্ত। ইতোমধ্যে ছায়াছন্দ পত্রিকায় দু-একটা লেখাও ছাপছে। আমি ভয়ে ডর দমিয়ে শরীরের চিকন ঘাম লুকিয়ে সহজ করে বললাম, আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। আপনার টিমে।
খোকন ভাঙা কণ্ঠে চড়া গলায় বললেন, আমার তো এখন প্রয়োজন নেই।
আমি বললাম, আমি আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ চাই।
তিনি আবারও চড়া গলায় বললেন, আমার প্রয়োজন না হলে কেন নেব? 

তিনি নেননি, কিন্তু আমি তাঁকে এখনও ছাড়িনি। আজও মনে পড়ে খোকন স্যার। আপনাকে মনে রেখেছি। মনে রেখেছি, একদিন বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে আপনি গিয়েছিলেন এবং আমার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ সিনেমা, শিল্প সাহিত্য নিয়ে তুমুল আড্ডা হয়েছিল, আপনি অসুস্থ ছিলেন, তারপরও আমার সঙ্গে কথা চালিয়ে গেছেন এবং আরও কিছুক্ষণ থাকতে চেয়েছিলেন। সিনেমা নিয়ে আমার বোঝাপড়া দেখে আপনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। আপনার সেই হাসিখুশি মুখটুকু আমি মনে রাখব। এখনও মনে পড়ে। আজ আপনার চলে যাওয়ার দিন। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল, মাত্র ৫৮ বছর বয়সে চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। আমরা আপনার নাম লইয়া এখনও মন খারাপ করি, মন ভালো করি। আপনি আমাদের সময়ের নায়ক। 

লেখক: মোস্তফা মনন
নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার
 

 

 

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র আম দ র র সময় আপন র সময় র

এছাড়াও পড়ুন:

হামজাদের কোচিং স্টাফ বাড়ছে

পাঁচজন ডাটা অ্যানালিস্টের সঙ্গে সহকারী ফিজিও আছেন চারজন। প্রধান কোচ, সহকারী কোচসহ সিঙ্গাপুর দলের কোচিং স্টাফের সংখ্যা ১৯। তাদের বিপরীতে প্রধান কোচসহ বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ মাত্র পাঁচজন। এর মধ্যে ফিজিও আছেন একজন। অনেক সময় একসঙ্গে কয়েকজন ফুটবলার ইনজুরিতে পড়লে বেকায়দায় পড়তে হয় একমাত্র ফিজিওকে। সিঙ্গাপুর দলের কোচিং স্টাফের সংখ্যা দেখে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও এই দিকে মনোযাগ দিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ দলে কোচিং স্টাফ বাড়ানোর কথা শনিবার মিট দ্য প্রেসে বলেছেন বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল।

বাংলাদেশের কোচিং স্টাফের তালিকা খুবই ছোট। প্রধান কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার সঙ্গে সহকারী হিসেবে আছেন জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার হাসান আল মামুন এবং স্পেনের ডেভিড গোমেজ। গোলরক্ষক কোচ মিগুয়েল অ্যাংগেল এবং ফিটনেস কোচ হিসেবে আছেন পেলো। তারা দু’জনই স্পেনের। ফিজিও আবু সুফিয়ান সরকারকেই ফুটবলারদের চোট এবং খেলার সময় আঘাত পেলে দৌড়ে মাঠে যেতে হয়। 

একটা দেশের জাতীয় দলে এত কম সংখ্যক কোচিং স্টাফ থাকতে পারে না বলে মনে করেন তাবিথ, ‘যখন আমরা কোনো অফিসিয়ালদের তালিকা তৈরি করি, তখন নানা রকমের অভিযোগ এবং কথা শুনতে হয় যে এত মানুষ কেন যাচ্ছে। তারা ঘুরতে যাচ্ছে কিনা, তাদের কাজটা কী? এসব প্রশ্নও শুনতে হয়। আসলে আপনারা বিশ্লেষণ করে জানবেন যে ২৩ জন প্লেয়ারের পেছনে কিন্তু আরও অনেক অফিসিয়াল দরকার হয়। একটা প্লেয়ার ইনজুরিতে পড়লে কিংবা খেলার পরে তাঁর ম্যাসাজ দরকার হয়। একজন ফিজিও দিয়ে কী আমরা ১৮ ফুটবলারকে সহযোগিতা করব? তাই আমাদের কোচিং স্টাফ, টেকনিক্যাল স্টাফ এবং অ্যাসিসট্যান্স স্টাফ বাড়াব। টিমকে আমরা জোরালোভাবে সাপোর্ট দিয়ে যাব যেন আমরা কোনোভাবেই অন্য ইন্টারন্যাশনাল দলের তুলনায় পিছিয়ে না থাকি। এতে আমাদের কোয়ালিটিও বাড়বে আর র‍্যাঙ্কিংও বাড়বে।’

শুধু কোচিং স্টাফ বাড়ানোই নয় নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবলে। বিশেষ করে, ফুটবলারদের তথ্য পেতে গেলে সমস্যা পড়তে হয় সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে ফুটবলপ্রেমীদের। তাই এবার বাফুফে চালু করতে যাচ্ছে মোবাইল অ্যাপ। এই অ্যাপ ছাড়াও আগামী ছয় মাসের মধ্যে খেলোয়াড়দের তথ্য সমৃদ্ধি করতে চায় দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আর নতুন একটা সফটওয়্যার নিয়ে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে বাফুফে টেকনিক্যাল কমিটি। যে সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১০ জুন সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে বাংলাদেশের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার কাজ করছে বাফুফে। কয়েকদিনের মধ্যেই তা জানাবে ফেডারেশন। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চট্টগ্রামে করোনায় আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু
  • আমি কারো সঙ্গে পাল্লা দিতে আসিনি: অপু বিশ্বাস
  • হামজাদের কোচিং স্টাফ বাড়ছে
  • সাকিবকে এখনও দেশের সবচেয়ে বড় তারকা মানেন তামিম
  • সাকিবকে এখনও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা মানেন তামিম
  • ইরানের পাল্টা আঘাতে কাঁপল ইসরায়েল
  • জাফলংয়ের পাথর কোয়ারিতে এখনও রাজনৈতিক ছায়া
  • আলীকদমে ২ পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনায় ‘ট্যুর এক্সপার্টের’ বর্ষা গ্রেপ্তার
  • ইরানে এখনও হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল: আইডিএফ
  • স্বপ্নে হলো দেখা