আমি জন্মের আগে থেকেই ভিতুর ডিম রে বাবা। স্বাধীনতার আমি কী বুঝি? মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই যে ভয়ের চোটে আম্মার পেটের মধ্যে ঢুকছিলাম, ’৭২–এর আগে বের হই নাই!
সাদাফ হাসছিল। এবার স্বাধীনতা দিবস রোজার মধ্যেই পড়েছে বলে মেলবোর্নের বাংলাদেশ সমিতি একই সঙ্গে ইফতার আর স্বাধীনতা পালন সারছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কীভাবে এবং কতটা গুরুত্বের সঙ্গে ২৬ মার্চ পালন করা উচিত, সেটাও বুঝে উঠতে না পারায় এই পদ্ধতি—সব রকম চেতনা, স্পিরিট এবং স্পিরিচুয়ালিটির সাপ্লাই তো আছেই, সঙ্গে মুচমুচ করা বেগুনি, পেঁয়াজু, ছোলার টানও কম নয়; যার যাতে মজে মন—বিড়াল ভাবলে বিড়াল, রুমাল ভাবলে রুমাল!
পাশে বসা জেরিনের বাড়িয়ে ধরা প্লেট থেকে একটা বেগুনি তুলে নিয়ে কামড় বসাতে বসাতে সাদাফ আবার বলে ওঠে, ওরেব্বাস! এই শিল্পকর্ম কে করছে রে? কী সুন্দর কুড়কুড়া হইছে। তেল যে একটা বস্তু, তার মাঝে ডুবসাঁতার দিয়েই যে বেগুনির আত্মপ্রকাশ ঘটছে, তার কোনো আলামতই তো টের পাওয়া যাইতেছে না! এই জিনিসের প্রশংসা করার জন্য মুজতবা আলীরে তলব করতে হবে!
শারমিন জবাব দেয় হাসতে হাসতে—সাদাফ আপু, এখনো তোমার মুজতবা আলী প্রেম গেল না? সেই যে ইউনিভার্সিটিতে ইফতেখার ভাইকে ডায়ালগ দিছিলা, ‘আমার মিলনে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না, আমার বিরহে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না!’
আরে রাখ তোর ইফতেখার ভাই। সেই ব্যাটার ভুঁড়ির ওপরে এখন উকুন মারা যায়, টাকও ভালোই এবং তার একটা নাতিও হইছে! এখন ওই সব প্রেমট্রেমের চেয়ে বেশি মনে পড়ে শবনমের ডিমভাজা, হলুদও না, খয়েরিও না, সোনালি…ইশ্!
ভুঁড়িওয়ালার খবর তো দেখি সবই রাখো!
প্লেট রিফিল করার জন্য পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে পলাশ, উত্তর শোনার জন্য দাঁড়ায় না।
নীলা ওর পিঠের দিকে হুকুম ছুড়ে মারে—হুই পলাশ! আরও কয়েকটা বেগুনি আর পেঁয়াজু নিয়া আয়!
খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে পলাশ তাকে ভেংচি দেখায়।
শারমিন আর সাদাফের মাঝখানের খালি চেয়ারটার দখল নিতে নিতে আসিফ বলে, দেখছ সাদাফ আপা, শুধু পুরান প্রেমিকেরা বুড়া বয়সে ভুঁড়িদার হয় না, প্রেমিকারাও বউ হওয়ার পরে নীলা হয়! আগে কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলত, ওই বেচারারে মনে আছে? সে যে মোড়ক উন্মোচনের পর এ রকম ঝাঁসি কি রানির রূপ ধারণ করবে, কে ভাবছিল?
থাক থাক, তোমার আবার জামাইকুলের ওকালতি করতে হবে না। নিজে তো বউ একটা পাইছিস মাশা আল্লাহ। কখন তুই এসে চেয়ারে বসে তার জীবন ধন্য করবি, এই আশায় হাতে ফলের বাটি ধইরা বসে আছে!
শারমিন সত্যিই ফলের বাটি হাতে বসে ছিল। আসিফ হেসে ফেলল সেই দিকে তাকিয়ে। ফলের বাটি থেকে উঁকি দিচ্ছে তরমুজ, রক মেলন, আঙুর, সিজন ফুরানোর আগে গ্রিক, চীনা অথবা ভিয়েতনামের সবজি দোকানগুলোতে যে স্বাদ-গন্ধহীন পাকা আম পাওয়া যায়, তার কয়েক টুকরা এবং কুইন্সল্যান্ড থেকে আগত মহার্ঘ্য পেয়ারার স্লাইস।
পেয়ারা দেখে সুচিনকে মনে পড়ল। লাট্রোব ইউনিভার্সিটিতে তার সহপাঠী আর ডরমিটরির ফ্লোরমেট। ৩৫ বছর আগে সাদাফ যখন লাট্রোব ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিল স্কলারশিপ নিয়ে, তখন তার ১৮ বছর বয়স। বলা যায়, আম্মার কোল থেকে ছিটকে এসে পড়েছিল সে চিজল্ম কলেজের বক্স রুমে। সেই অ্যানালগ দুনিয়ায় ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন অথবা ভিডিও কলের ধারণার সীমানা ছিল সাইফাই মুভি পর্যন্ত। তার বক্স রুমের ছোট জানালার ওই পাশে সারবাঁধা ইউক্যালিপটাসের আড়ালে স্বচ্ছ সাদা মেঘের আকাশ, ইটবিছানো পায়ে চলা রাস্তা, চোখের দৃষ্টিসীমানায় ছোট একটা লেক, আর খোলা আকাশের নিচে গোলাকার থিয়েটার, যেখান থেকে কখনো ভেসে আসত গানের সুর, কখনো নাটকের সংলাপ—এই সবকিছুকেই অনাত্মীয় মনে হতো তার। তখন পরিচয় সুচিনের সঙ্গে। সুচিন বড় হয়েছে কুইন্সল্যান্ডে। চীনা পরিবারের মেয়ে। কয়েক পুরুষ আগে মাইগ্রেট করে অস্ট্রেলিয়া এসেছে। এখন একটা বিশাল অর্চার্ডের মালিক তাদের পরিবার। সেখান থেকে তার জন্য বাক্স ভর্তি করে নানা রকম ফল আসত। একবার সুচিন তার জন্য আসা ঝাঁকাভর্তি পেয়ারা থেকে একটা পেয়ারা তুলে দিয়েছিল সাদাফের হাতে।
সেই কচি সবুজ পেয়ারার স্পর্শে, গন্ধে কতটা বেঁচে উঠেছিল সেই দিন সে, তা সাদাফই শুধু জানে।
আম্মার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় সপ্তাহে দুইটা করে অ্যারোগ্রামের চিঠি। কালেভদ্রে দুই–তিন মিনিটের ফোনালাপের জন্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হতো—আজিমপুরে আম্মার বাড়িতে ফোন ছিল না যেহেতু আর প্রতিবেশী কারও বাড়িতেই যাওয়া–আসাও ছিল না। ফোনে কথা বলতে হলে আম্মাকে যেতে হতো আজিমপুর গার্লস স্কুলের তার কোনো কলিগের বাড়িতে। যত ছোটই হোক, কারও কাছ থেকে উপকার নিতে আম্মার যে মনের সঙ্গে বিশাল বোঝাপড়া করতে হতো, সাদাফ সেই বয়সেও টের পেত। আরও বহু কিছু সে টের পেত, পায়—যা মুখ ফুটে কোনো দিনই বলা হয় নাই।
আজিমপুর কলোনিতে তাদের একতলার দুই রুমের দুনিয়ায় সে জড়িয়ে থাকত আম্মাকে। সজল-সুরভিকে সঙ্গে নিয়ে বুজি আর দুলাভাই প্রায় দিনই আসত। আর কোনো আত্মীয় ছিল না তাদের। স্কুলের পরিচিত কিছু মুখ ছিল, ঢালাওভাবে যাদের বন্ধু বলা হতো। তবে সাদাফের সত্যিকার বন্ধু ছিল বাড়ির উঠানে বড় হওয়া শিউলি, কদম, কাঠগোলাপ ফুলের গাছেরা, জানালার সামনে খসখসে সুরভিত পাতা নিয়ে বেড়ে ওঠা পেয়ারাগাছটা, ঘরের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়েই যার ডাল ছোঁয়া যেত। একটা সাদা-কালো বিড়াল আসত রোদ পোহাতে, ধীরে ধীরে ভাব হয়েছিল তার সঙ্গে, সাদাফ যখন জামগাছের ডালে ঝোলানো দড়ির দোলনায় দোল খেতে খেতে বই পড়ত কিংবা ম্যাচের বাক্সে ভর্তি করে আনা বিট লবণ আর মরিচের গুঁড়ার ভেতরে কষ্টা পেয়ারা অথবা কাঁচা আম ডুবিয়ে খেত, বিড়ালটা হয় তার কোলের দখল নিত, নয়তো মাটিতে বসে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার দোল খাওয়া দেখত। এমনকি কলোনির দেয়ালের ধার ঘেঁষে, কবরস্থানের এই পাশে যে বিশাল কড়ইগাছটা ছিল, তার কোটরে লুকিয়ে থাকা তক্ষক সাপটাকেও বন্ধুই মনে হতো।
প্রতিদিন মাগরিবের সময় যখন মাথার ঠিক ওপর ঘূর্ণিঝড়ের মতন মশারা উড়ত চক্রাকারে আর ঝিঁঝির শব্দে বাতাস ভারী হয়ে উঠত, ঠিক তখনই ‘তক্কে তক্কে’ ডাকে সাপটা তার উপস্থিতি জানান দিত। বাইরে থেকেই দেখা যেত ভেতরের ঘরে আলো জ্বলে উঠল, সেই আলো ছড়াত বারান্দার গ্রিল পর্যন্ত। সাদাফ ভেতরে ঢুকে অজু করত। আম্মা হয়তো তখন বিছানায় বসে ডাঁই করে রাখা পরীক্ষার খাতা থেকে একটা একটা করে তুলে নিয়ে পড়ছে, নম্বর দিচ্ছে। চোখে পুরু কালো ফ্রেমের চশমা, মাথার কোঁকড়া চুলের অর্ধেক সাদা। তার ১২-১৩ বছর বয়সেই আম্মার বয়স ৫৩–৫৪, তখন থেকেই কেমন ক্ষয়ে যাচ্ছিল আম্মা। সে গিয়ে জড়িয়ে ধরত আম্মাকে। চাইত, আম্মার গায়ের গন্ধ তার সমস্ত শিরা-উপশিরা, রক্তকণায় প্রবাহিত হতে হতে মন থেকে সমস্ত ভয়, সন্দেহ সরিয়ে দিক।
তবু বিভিন্ন দিক থেকে ধাবমান নানা রকম প্রশ্নের বাণ তাকে কিছুতেই রেহাই দিত না—তার আব্বা খন্দকার আলী আজমান কীভাবে মারা গেছে? কেন তাদের বাড়িতে কেউ আসে না? কেন বুজির সঙ্গে তার বয়সের এত পার্থক্য? তাদের বাড়িতে কোনো পুরোনো অ্যালবাম ছিল না। আব্বার ছবিও কোনো দিন দেখে নাই সাদাফ। কথা প্রসঙ্গে শুনেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মির গুলিতে শহীদ হয়েছে তার আব্বা, তত দিনে সে চলে এসেছে আম্মার পেটে। দিনাজপুরে থাকত তখন আব্বা, আম্মা আর বুজি। তারপর আর্মির কবল থেকে কীভাবে বেঁচে ফিরল আম্মা? দিনাজপুর থেকে আজিমপুরের এই লম্বা রাস্তা কীভাবে পেরিয়ে এল? এ রকম কত প্রশ্ন মনে এসেছে সাদাফের। সে কখনো জবাব খোঁজে নাই; বরং চেয়েছে মনের ভেতরেই প্রশ্নগুলোর দাফন করতে। তার সহজাত অনুভূতিতেই টের পেত, কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে হয় না।
আবছা কিছু স্মৃতি চেষ্টা করলেও মোছে না তবু। সত্তর দশকের শেষভাগ। বুজির বিয়ে হয়ে গেছে তত দিনে। সাদাফের হয়তো ৪–৫ বছর বয়স। আবছা মনে পড়ে, একটা লোক এসেছিল বাড়িতে। সারা রাত আম্মা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। সেই মানুষটা পরে আর কোনো দিনও আসেনি। আরও অনেক দিন পর, ’৯০ সালে যখন মেলবোর্ন আসার তোড়জোড় করছে সাদাফ, পুরোনো ট্রাংকের তলায় একটা খাম পেয়েছিল। তাতে বেশ কিছু কাগজপত্রের সঙ্গে হলুদ হয়ে যাওয়া একটা ছবি। ছবি থেকে হাসিমুখে তার দিকে চেয়েছিল কম বয়সী আম্মা, সামনের ১০–১১ বছরের মেয়েটা যে বুজি, বুঝতে সমস্যা হয়নি, তার চেয়ে কয়েক বছরের বড় সুন্দর দেখতে এক তরুণ ছিল আম্মার কাঁধে আলতো হাত রেখে। চোখ আর হাসি একদম আম্মার মতো। আর আম্মার অন্য পাশে সস্নেহ মৃদু হাসির মানুষটাই নিশ্চয়ই আব্বা। সেই একই খামে একটা ডেথ সার্টিফিকেটও ছিল খন্দকার আলী আজমানের, মৃত্যুসন ১৯৬৪। কিছুই বলেনি কাউকে সাদাফ। শুধু চুপি চুপি ছবিটা নিয়ে এসেছিল, একটা কিছু তো থাকুক তার কাছে!
ইয়াল্লাহ এখন আবার রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে শুনতে হবে?
জেরিনের হাসি উপচানো প্রশ্নে বর্তমানে ফেরে সাদাফ। খাওয়ার পালা শেষ, এবার শুরু হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান। দেখল, মঞ্চে উঠছেন হাওলাদার আঙ্কেল।
দেখতে দেখতে সে–ও হেসে ফেলল। কী রে, উনি এখনো খাণ্ডব দাহন থেকে বের হন নাই?
আরে, এইবার ‘স্বাধীনতা তুমি’ শুনবা জুলাই ২০২৪ ফ্লেভারে। দেখো না, এইবার মুজিব কোট পরে নাই, গোল টুপি পরছে? এইবার আর খাণ্ডব দাহন না, এইবার আসবে পিতার কোমল জায়নামাজ!
একসঙ্গে হেসে উঠল সবাই। বহু বছর পর এদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগছিল সাদাফের। ইফতেখারের সঙ্গে বিয়েটা হতে গিয়েও হলো না। তাদের তুমুল প্রেম হোঁচট খেল অতীতের প্রশ্নে। ইফতির বাবা–মা দেশে গিয়েছিলেন আম্মার সঙ্গে কথা বলতে। কী কথা হয়েছে, জানতে চায়নি সাদাফ। শুধু জেনেছে, কিছু কিছু ক্ষত এক প্রজন্মে সারে না। বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর ওকলির দিকে আর আসেনি সাদাফ। ১৭–১৮ বছর তো হবেই। কোথাও কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এড়িয়ে গেছে।
আজকের দেখা হওয়াটা কাকতালীয়। সাদাফ লাট্রোব ইউনিভার্সিটিতে তুলনামূলক সাহিত্য পড়ায়। তার এক ছাত্রী এখানে একটা কবিতার বই নিয়ে কথা বলবে। সে খুব অনুরোধ করাতেই আসা। এখন মনে হচ্ছে, ভালোই হয়েছে। ওদের দেখলে যে অস্বস্তিকর অবস্থা কল্পনা করেছিল সাদাফ, সে রকম মোটেই হয়নি। এ রকমভাবে ওরা কথা বলছে, যেন প্রায়ই দেখা হয়।
মঞ্চে উঠেছে তার ছাত্রী সাবিনা। সে বলতে শুরু করল—
‘১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হয়েছিল, সে সময় রণকৌশল হিসেবে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশি মহিলাদের ধর্ষণ করেছে। প্রায় ৯ মাসের এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২ লাখ থেকে ৪ লাখ বাংলাদেশি মহিলাকে ধর্ষণ অথবা অপহরণ করেছে।
‘২০১০ সালে কবি তারফিয়া ফয়জুল্লাহ ঢাকায় গিয়েছিলেন এই নৃশংসতা পেরিয়ে আসা মহিলাদের সাক্ষাৎকার নিতে, নতুন সরকার যাদের নাম দিয়েছিল বীরাঙ্গনা, যার আক্ষরিক অর্থ “সাহসী নারী”। তবে ভাবানুবাদ হতে পারে “যুদ্ধের নায়িকা”.
সাদাফের মনে পড়ছে, এক প্রচণ্ড বৃষ্টির দুপুর। ক্লাস ফাইভে পড়ত সে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে কাকভেজা হয়ে। দেখে, উঠানের মাটির ওপর পা ছড়িয়ে বসে বুজি চিৎকার করে কাঁদছে। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে সারা শরীর। বৃষ্টি–কাদায় মাখামাখি হয়ে সে মাটির ওপর সর্বশক্তিতে আঘাত করছে অসম্ভব রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে। আম্মা নিথর বসে আছে তার সামনে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে, ভ্রুক্ষেপ করছে না কেউ। সাদাফ যে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাকেও তারা খেয়াল করেনি। অনেকক্ষণ পর বুজি যখন শান্ত হলো, আম্মা বলল, ‘শরীরে ময়লা লাগে না, পানিতে ধুইলেই চলে যায়, দেখিস না, হাঁসেরা কেমন কাদার মধ্যে মাখামাখি করে, পানি থেকে উঠে গা ঝাড়া দেয়?’ তারপর ধীরে ধীরে বাচ্চা মেয়ের মতো হাত ধরে তুলেছিল তাকে আম্মা, পরম যত্নে গা মুছে কাপড় বদলে দিয়েছিল। সেদিন বুজি জানতে পেরেছিল যে তার গর্ভে সজল এসেছে…
সাবিনা পড়ছে তারফিয়া ফয়জুল্লাহর কবিতার অনুবাদ—
‘তা ছাড়া, আমার ভিতরে, বাইরে অথবা
পাশে আমি কখনোই তার, অথবা তার কিংবা
তার সন্তান চাই নাই। মেয়েটা কখনোই
জানবে না যে তার মাথাটা হাতের মধ্যে নিয়ে
আমি খুব জোরে চেপে ধরতে
শুরু করেছিলাম, কিন্তু
থেমে গেছি। জানবে না তাকে মাটির মেঝেতে
সুতির চাদরে ঢেকে শোয়ানোর পর আমার
আঙুলের ডগায় তার
স্পন্দিত বুক ছুঁয়েছিলাম…’
২০২৪–এ যখন হেলিকপ্টার থেকে সমানে গুলি ছোড়া হচ্ছিল, বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে হত্যা করা হচ্ছিল পাখির মতন, যেদিন পুলিশের গাড়ি থেকে জীবন্ত ইয়ামিনকে ছুড়ে ফেলা হলো মেরে ফেলার জন্য, বুজি সেই দিন খুব অস্থির হয়ে ফোন করেছিল। বারবার বলছিল, ‘সাদাফ, তোকে সবকিছু বলা হয় নাই…।’ জবাবে সাদাফ শুধু বলেছিল, ‘বুজি, সবকিছু জেনে কী হয় বলো? আমি জানি, তুমি যদি আমাকে ভালো না বাসতা, আমি দুনিয়ায় আসতাম না…তোমাদের সবাইকে আমি ভালোবাসি বুজি, আমি ভালো আছি…’
শেখ হাসিনা যেদিন দেশ ছেড়ে পালাল, সেই দিন আলমারির কোনায় লুকিয়ে রাখা ছবিটা বের করেছিল সাদাফ—সেটাই একমাত্র পারিবারিক ছবি, যা সে আম্মার ট্রাংকের তলার থেকে চুরি করেছিল। ছবিটা ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে এখন তার ঘরের দেয়ালে অপেক্ষা করে। সে জানে, খোলা জানালা থেকে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে এখন সেখানে। একদিন নতুন চাঁদ উঠবে। যে অতীত ভয়ে, লজ্জায়, বিস্মৃতিতে কোণঠাসা হয়েছিল, তা নতুন আলোয় স্পষ্ট হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন ভ র স ট ত স ব ধ নত কর ছ ল আম ম র র জন য এইব র র বয়স
এছাড়াও পড়ুন:
মাগুরায় শিশু ধর্ষণ-হত্যা মামলায় সাক্ষ্য ৩ চিকিৎসকের
মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় চতুর্থ দিনের মতো সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বুধবার জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসানের আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
এ দিন শিশুকে চিকিৎসা প্রদানকারী তিন চিকিৎসক সাক্ষ্য দেন। তারা হলেন– মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালের ডা. সোহাস হালদার, নাকিবা সুলতানা এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. ইসরাত জাহান। তারা সবাই শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এর আগে সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মামলার ৪ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। বাদীপক্ষের আইনজীবী ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি মনিরুল ইসলাম মুকুল জানান, বিগত চার কার্যদিবস একটানা সাক্ষ্য গ্রহণ চলেছে। এ নিয়ে মোট ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। মামলায় মোট ৩৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হবে। আগামী রোববার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাদে অন্য সব সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন। বুধবার আসামিপক্ষের আইনজীবী স্বাধীনভাবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। তিনি আদালতে আসামিরা নির্দোষ বলে যুক্তি উপস্থাপন করেন। আসামিরাও নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন।
বেড়াতে এসে ৬ মার্চ রাতে মাগুরা সদরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুর হিটু শেখের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় ৮ বছরের শিশুটি। এই ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে ঢাকা সিএমএইচে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল। ১৩ মার্চ শিশুটি সেখানে মারা যায়। এ ঘটনায় শিশুটির মা আয়েশা আক্তার বড় মেয়ের শ্বশুর হিটু শেখসহ চারজনকে আসামি করে মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন। রিমান্ডে হিটু শেখ ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে।