জীবনের প্রথম উপার্জন, তা–ও আবার বছরের পয়লা দিনে
Published: 19th, April 2025 GMT
আমার ছেলেবেলায় পয়লা বৈশাখের বড় একটা অংশজুড়ে ছিল কেনাকাটা। ১০-১৫ দিন আগে থেকেই বাবা আর কাকার সঙ্গে ‘এটা কিনে দাও, সেটা কিনে দাও’ বলে দেনদরবার চলত। এখনো বাড়িতে কেনাকাটার রীতি আছে। তবে এখন আর জোর করার প্রয়োজন হয় না। উল্টো যদি বলি, ‘লাগবে না, সেদিনই না কিনলাম’ বাবা রাগ করেন, শোনেন না। এবারও বিকাশে টাকা পাঠিয়ে বললেন, ‘কিছু কিনে নিও।’
পরপরই ফোনে মা আর বোনের হুমকি, ‘কিনে ছবি পাঠাবি। না কিনলে কিন্তু খবর আছে!’
বাড়ির একেবারে কাছেই বড় বটগাছটার নিচে বেশ কয়েকটা দোকান ছিল। একই পাড়ায় আমরা যাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়তাম, অনেকেই দলবেঁধে বটগাছের নিচে ক্রিকেট, হাডুডুসহ বিভিন্ন খেলা খেলতাম। সংগত কারণেই দোকানি কাকুরা আমাদের চিনতেন। পয়লা বৈশাখের দিন কোনো না কোনো দোকানে হালখাতা থাকতই। দোকানের সামনের দিকটা রঙিন কাগজ আর কাগজের ফুল দিয়ে সাজানোর দায়িত্ব আমাদের ওপর পড়ত। নববর্ষের দিন সকালে দলবেঁধে দোকান সাজানোর কাজ করতাম। বিকেলে বন্ধুরা মিলে মেলায় যেতাম। নাগরদোলা, গানবাজনা, ম্যাজিক শো—কত–কী যে থাকত, গেলেই প্রাণ জুড়িয়ে যেত।
বন্ধুরা মিলে একবার ঠিক করলাম, মেলায় আমরাও দোকান দেব। তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। কিন্তু দোকান দিতে হলে মেলার আয়োজকদের কাছ থেকে জায়গা বরাদ্দ নিতে হবে, তা ছাড়া দোকান নিতে হলে নির্দিষ্ট টাকাও দিতে হবে। শুরুতেই নিজেদের টিফিনের জমানো টাকা থেকে একটা তহবিল তৈরি করা হলো। কিন্তু অনুমতি?
সেবার মেলার মাতব্বর ছিলেন আমাদের বান্ধবী মৌবনী ভদ্রের কাকা। মৌবনীর সঙ্গে পড়ালেখা নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল। জানতাম, সে আমাকে ঈর্ষা করে। তাই কথাটা তাকে বলব কি বলব না যখন ভাবছি, তখনই বন্ধুরা এসে নিয়ে গেল মৌবনীর কাছে। শুরুতে যদিও বলেছিল, ‘ছোট্ট পোলাপানের আবার দোকান কি রে!’
কিন্তু পরপরই হেসে বলেছিল, ‘চিন্তা করিস না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে আমিও তোদের সঙ্গে থাকব। কাজ তেমন কিছু করতে পারব না। শুধু ভাগের টাকাটা দেব, পরে লাভ যা হবে, ভাগ দিবি।’
অগত্যা রাজি হতে হলো। ৫০ শতাংশ ছাড়ে মৌবনীর তরফে জায়গা বরাদ্দ পেলাম আমরা। দোকানের নাম রাখা হলো, ‘দুই দিনের দোকানি’।
আমার নিয়মিত বাজারে যাতায়াত ছিল। বাবার পরিচিত বড় দোকানও ছিল কয়েকটা। মেলার আগের দিন গিয়ে, বিক্রি না হলে ফেরত নেওয়ার শর্তে মালামাল নিয়ে এলাম। দোকানটাকে সবাই মিলে সাজালাম। ঝড়ের দিনে তালগাছ থেকে বাবুই পাখির বাসা নিচে পড়ত। সুমিতের সংগ্রহে ছিল। সুমিত নিয়ে এল। মৌবনী ভালো আঁকতে পারত। সুন্দর পাটির পরে ‘শুভ নববর্ষ/দুই দিনের দোকানির থেকে শুভেচ্ছা নিন’ লিখে দোকানের সামনে টানিয়ে দিল। মেলার ওই দুই দিন সেবার কি যে হইচই আর আনন্দে কেটেছিল, লিখে প্রকাশ করা কঠিন। আমাদের লাভও হয়েছিল। ৪২১ টাকা।
মৌবনী, সুমিত, রুদ্র সবাই কি খুশি! জীবনের প্রথম উপার্জন, তা–ও আবার বছরের পয়লা দিনে। চোখ বুজে পেছনে ফিরে তাকালে সব স্পষ্ট ভেসে ওঠে। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটার মতো প্রবল মায়ায় হৃদয় তখন সিক্ত হয়ে যায়।
আরও পড়ুনগামছা কীভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠল১৪ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের
কেবল বাংলা নববর্ষই নয়, যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।
মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে "বাংলা নববর্ষ: ইতিহাস, সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকার" শীর্ষক এক সেমিনারে বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অনুরোধ করেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, কেবল বাংলা নববর্ষই নয়, যেকোনো উৎসবকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখা জরুরি। রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্ক সঠিকভাবে গড়ে উঠলে কোনো উৎসবই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনার যে স্বকীয়তা রয়েছে, তা অক্ষুণ্ন রাখাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। বুদ্ধিভিত্তিক ও সচেতন উদ্যোগের মাধ্যমে ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। বাংলা নববর্ষের প্রতি জনগণের গভীর অনুরাগ রয়েছে, তাই এটিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
সেমিনারে আইআরডিসি’র সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হকের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন
আইআরডিসি-এর সভাপতি ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন।
সেমিনারে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. নাছির আহমেদ তার মূল প্রবন্ধে বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং নববর্ষ উদযাপনের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার নিয়ে দুই পর্বে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলা নববর্ষ কেবল বাঙালিদের উৎসব নয়, বরং এটি ধর্ম, গোত্র ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশির একটি সমন্বিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া, বাংলা সনের উৎপত্তি, এর অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মাত্রা নিয়েও তিনি গভীরভাবে আলোকপাত করেন।
এছাড়াও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. রইছ উদ্দীন এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলে এলাহি চৌধুরী প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁরা বাংলা নববর্ষের আন্তর্জাতিক ও সামাজিক সংহতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে এর ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। একইসাথে বাংলা নববর্ষের বহুমাত্রিক তাৎপর্য ও এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করেন।
এসময় সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক উপস্থিত ছিলেন।