একবার ভাবুন—আপনার পরদাদা নিজের রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে একটি ছোট্ট পান্থশালা গড়ে তুলেছিলেন। শতাব্দীপ্রাচীন সেই পান্থশালা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তবে নিছক ইটপাথরের ভবন হিসেবে সেটি টিকে আছে, এমন নয়। এটি যুগের পর যুগ মানবসেবায় নিয়োজিত এমন এক আশ্রয় হিসেবে টিকে আছে, যার দরজা কখনো কোনো অনাহারী বা পথহারা মানুষের জন্য বন্ধ হয়নি। 

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আপনি আর আপনার পরিবার অগণিত মানুষের সেবায় এই আশ্রয়স্থলটাকে টিকিয়ে রেখেছেন। তারপর একদিন নির্বিকার এক ঘূর্ণি বাতাসে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। রাতারাতি সব বদলে গেল। একটা নতুন আইন পাস হলো।

কলমের এক নিঃশব্দ আঁচড়ে আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা বাদ দিয়ে দেওয়া হলো।

বহুদূরের কোনো এক দপ্তরের কোনো এক চেয়ারে বসা একজন সরকারি কর্মকর্তা ভুরু নাচিয়ে একটা ফাইলের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ওটা’। তারপর ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে আপনাকে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘এই জমি বা বাড়িটা আপনার পরিবারকে কেউ দান করেছিল বা যে মহৎ কাজে আপনি এটি ব্যবহার করছেন, সেটি জমির দাতা তা ঠিক করে দিয়েছিলেন—আমার তো তা বিশ্বাস হয় না।’

এরপর সেই কর্মকর্তা ঠান্ডা গলায় জানিয়ে দিলেন—এই জমি এখন সরকারের। আপনি এক নিমেষেই ‘দখলদার’ হয়ে গেলেন। এখন থেকে এই জমির ওপর আপনার আর কোনো অধিকার থাকল না। সরকার এর দায়িত্ব নিয়ে নিল।

আপনার পরিবার যে পান্থশালাটা প্রজন্ম ধরে আগলে রেখেছে, দান আর সেবায় ব্যবহার করেছে, সেটা আর আপনার হাতে রইল না। আপনি সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আপত্তি তুললেন। বিচার দাবি করলেন। কিন্তু এখানে কোনো সঠিক বিচারপ্রক্রিয়া নেই। কর্মকর্তারা শুধু বলে দেন, পরে তদন্ত হবে। কিন্তু তদন্ত কবে হবে, তার কোনো তারিখ বা সময়সীমা তাঁরা বলেন না। 

এ অবস্থায় আপনি শুধু আপনার সেই পান্থশালার ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারেন। কারণ, এখন আপনাকে আপনার নিজের পূর্বপুরুষদের বানানো বাড়িতে ঢুকতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এই কথা শুনে আপনার হয়তো মনে হবে, এটি কোনো কল্পনার জগতের এক ভয়াবহ দুনিয়ার কথা বলছি। কিন্তু ভারতের ওয়াক্ফ সংশোধন আইন অনুযায়ী সে দেশের মুসলমানদের জন্য এটিই এখন বাস্তব জীবন। এই আইন মালিকানা, ন্যায্য বিচারপ্রক্রিয়া আর ধর্মনিরপেক্ষতার মতো মূলনীতিগুলোকেই উপড়ে ফেলেছে। 

আরও পড়ুনভারতে ওয়াক্‌ফ বিল: হিন্দুত্ববাদী টোটাল কন্ট্রোলের নবতম অধ্যায়০৮ এপ্রিল ২০২৫হ্যাঁ, পান্থশালাটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে; এর দেয়াল অক্ষত; দরজা এখনো খোলে। কিন্তু আল্লাহর নামে দান করা এই সব সম্পত্তি কে ভোগ করবে, তা এখন পুরোপুরি সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আমরা যা দেখছি, তাকে অন্ধকারে চুরি বলা যাবে না; এটি আরও সূক্ষ্ম কিছু। এটি মালিকানা পরিবর্তনের একটা প্রক্রিয়া। আর সেই প্রক্রিয়া কোনো গোপন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে নয়, বরং সরাসরি রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে ঘটছে।

ওয়াক্ফ শব্দের মানেই হলো আল্লাহর নামে চিরস্থায়ী দান। এর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দানের মতো সমাজকল্যাণের জন্য কাজ করা। ওয়াক্ফ কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটি একজন মোতোওয়ালির (অভিভাবক বা তত্ত্বাবধায়ক) হাতে আমানত হিসেবে থাকে এবং রাষ্ট্র এর সুরক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু ওয়াক্ফ সংশোধন আইন, ২০২৫ এই ধারণাকেই পাল্টে দিয়েছে।

আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল, যেখানে বলা হয়েছিল—যদি কোনো জমি অনেক দিন ধরে দান বা সেবামূলক কাজে ব্যবহৃত হয়, তাহলে সেটিকে ওয়াক্ফ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং সেটি যেকোনো ধরনের অবৈধ দখল বা দাবি থেকে রক্ষা পাবে। এখন সেই ধারা মুছে ফেলা হয়েছে। তার বদলে এসেছে একতরফা সরকারি নিয়ন্ত্রণ। এর ফলে এখন একজন সরকারি কর্মকর্তা একাই ঠিক করে দিতে পারেন—এই জমি ওয়াক্‌ফর নাকি সরকারের মালিকানাধীন। 

এ সিদ্ধান্ত নিতে তার কোনো প্রমাণ দেখানোর দরকার নেই, কোনো সঠিক বিচারপ্রক্রিয়া মানার দরকার নেই, এমনকি কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ারও দরকার নেই। একটা মতামত। একটা নোটিশ। আর তারপর পুরো সম্পত্তি আইনি পদ্ধতিতে কেড়ে নেওয়া। এটাই এখন সেখানকার বাস্তবতা। আর আপিল করার প্রক্রিয়া? সেটিও মজার—আপনি যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, সেই একই দপ্তরেই আপনাকে আপিল করতে হবে।

সংশোধিত আইনে এক চমকপ্রদ ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ নাটক সাজিয়ে এখন ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিমদের রাখার বাধ্যবাধকতা তৈরি করা হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মীয় ট্রাস্টের জন্য এমন কিছু করতে বলা হয় না। মন্দির পরিচালনা কমিটিতে কখনো কোনো ইমামকে রাখতে বলা হয় না। চার্চ কমিটিকেও কোনো নাস্তিক বা অন্য ধর্মাবলম্বীকে নিতে বলা হয় না। কিন্তু এই বিভ্রান্তিকর সংশোধিত আইনের অধীনে মুসলিম ওয়াক্ফগুলোর ক্ষেত্রে এমন লোকজনকে ব্যবস্থাপনায় রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাঁদের ইসলামি বিশ্বাস, ঐতিহ্য বা শিক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। 

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, কখন অন্তর্ভুক্তির নামে আসলে মৌলিকত্ব নষ্ট করা হয়? এই নামে যে ‘সমতা’ আনা হয়েছে, তা আসলে মনে হয় নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের ওপর ইচ্ছেমতো হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়। 

এরপর আসে নিরীক্ষা (অডিট) ইস্যু। সংশোধিত আইন অনুযায়ী এখন কেন্দ্রীয় সরকার নিজের নিয়োজিত নিরীক্ষকের মাধ্যমে ওয়াক্ফ সম্পত্তির হিসাব পরীক্ষা করতে পারবে।

সরকার বলছে, ওয়াক্ফ বোর্ডের ভেতরের দুর্নীতি ধরার জন্য ‘স্বচ্ছতা’ আনার উদ্যোগ হিসেবে এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু একটু ভালো করে তাকালে দেখা যাবে, এটি আসলে এমন এক নজরদারি, যেখানে কোনো ভারসাম্য বা নিরপেক্ষতা রাখার ব্যবস্থাই নেই। কারণ, পাহারাদার যদি মালিকের আদেশে চলে, তাহলে তার নিরপেক্ষতা কতটুকু থাকবে, তা বুঝতে বিশেষ কষ্ট হয় না। 

এটি সরাসরি কোনো আক্রমণ নয়। এটি নিঃশব্দে একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া। কোনো বুলডোজার নেই। কোনো শিরোনাম নেই। শুধু নোটিশ, ফুটনোট আর সংজ্ঞা পরিবর্তন। এতেই এখন সবকিছু ‘আইনসম্মত’।

হ্যাঁ, পান্থশালাটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে; এর দেয়াল অক্ষত; দরজা এখনো খোলে। কিন্তু আল্লাহর নামে দান করা এই সব সম্পত্তি কে ভোগ করবে, তা এখন পুরোপুরি সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।

আমরা যা দেখছি, তাকে অন্ধকারে চুরি বলা যাবে না; এটি আরও সূক্ষ্ম কিছু। এটি মালিকানা পরিবর্তনের একটা প্রক্রিয়া। আর সেই প্রক্রিয়া কোনো গোপন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে নয়, বরং সরাসরি রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে ঘটছে।

এটি সংস্কার নয়। এটি ধীরে, নীরবে এবং সম্পূর্ণভাবে সম্পদের দখল। এটি ঘটছে কাগজপত্রের মাধ্যমে, অস্ত্রের মাধ্যমে নয়। 

ইনসিয়া বাহনবতী একজন ভারতীয় লেখক, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার, ঘৃণার রাজনীতি ও গণতন্ত্রবিষয়ক গবেষক


আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত আপন র পর ব যবস থ সরক র র র জন য র ওপর এখন স র আপন

এছাড়াও পড়ুন:

এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা

জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলো প্রায়ই আমাদের গভীরতম শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও—যারা বিপদে পড়ে বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)

আমার পিতার মৃত্যুপথের যাত্রা আমাকে ধৈর্য, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা আমি আমার পরিবার এবং আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই শিক্ষাগুলো যে কাউকে তাদের মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের যত্ন নিতে সাহায্য করবে।

১. এটাই জান্নাতের পথ

এক বছর আগে, আমার পিতা দারুস সালামের একটি মসজিদের সিঁড়িতে পড়ে যান। এ দুর্ঘটনা তাঁকে হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ করে এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য আমরা দুবাইয়ে চলে আসি। একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’

এই কথা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। যত্ন নেওয়ার কষ্টকে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করি। এটি আমাকে কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।

আরও পড়ুনবাবা-ছেলের আশ্চর্য বিদায়ের ঘটনা০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’

২. আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি

বাবা যেদিন পড়ে যান, সেদিন থেকে আমি অনুভব করি, তাঁর সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের মুসলিম চ্যাপলেইন শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদের সঙ্গে কথা বলি।

তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর সঙ্গে যা বলতে চাও, বলে নাও। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও। তাঁর সম্পত্তি, দাফন এবং সাদাকার ইচ্ছা জেনে রাখো। শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো। এই সময় ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন।’

এই পরামর্শ আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করেছে এবং আমার দায়িত্ব স্পষ্ট করেছে।

৩. দিনগুলো দীর্ঘ, বছরগুলো ছোট

মৃত্যুপথযাত্রী একজন পিতার যত্ন নেওয়া শিশুপালনের মতো। দিনগুলো ক্লান্তিকর—খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, বহন করা। আমার মা এই দায়িত্বের বেশির ভাগ পালন করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন। কখনো মনে হতো, এই কষ্ট কি শেষ হবে? আবার পরক্ষণেই ভয় হতো, শেষটা কি খুব কাছে?

এই দ্বন্দ্ব আমাকে বর্তমানে থাকতে এবং প্রতিটি মুহূর্তের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে শিখিয়েছে।

৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলা

পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। চিকিৎসা, অর্থ বা মানসিক চ্যালেঞ্জ—ঢেউ থামানো যায় না, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভেসে চলা যায়। আমি এটাকে ‘সার্ফ-মোড’ বলি। এই মানসিকতা আমাকে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই না করে তাদের গ্রহণ করতে শিখিয়েছে।

৫. কষ্টের মধ্যে স্বস্তি

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে’ (সুরা শারহ: ৫)। পিতার অসুস্থতার মধ্যেও আমরা আল্লাহর রহমত দেখেছি—সঠিক চিকিৎসা দল, সময়মতো সঠিক মানুষের আগমন এবং ছোট ছোট অলৌকিক ঘটনা। এই ‘খায়ের’ আমাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছে।

আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও।শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদ, মুসলিম চ্যাপলেইন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়

৬. পিতার সেবা একটি ‘জিহাদ’

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার পিতা–মাতার সেবাই তোমার জিহাদ’ (বুখারি, হাদিস: ৫৯৭২)। পিতার যত্ন নেওয়া সহজ ছিল না। তাঁর বিরক্তি, দুশ্চিন্তা এবং ক্রমাগত চাহিদা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে। কখনো হতাশা বা রাগ অনুভব করেছি, কিন্তু কোরআনের আয়াত—‘তাদের সঙ্গে “উফ” বলো না’ (সুরা ইসরা: ২৩)—আমাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই জিহাদ আমার নফসের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল।

আরও পড়ুনএক বৃদ্ধ নবী যেভাবে বাবা হলেন০৪ জুন ২০২৫

৭. পালিয়ে যাওয়া

ডাক্তারের জন্য, চেকআপের জন্য বা পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। কিন্তু এটি আমার নফসের দুর্বলতা ছিল। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি। এটি আমাকে পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং বর্তমানে থাকতে শিখিয়েছে।

৮. সহনশীলতার খেলা

পিতার যত্ন নেওয়া একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। সাইক্লিং ও দৌড় থেকে শিখেছি, সহনশীলতার জন্য বিশ্রাম, খাওয়া এবং ব্যায়াম প্রয়োজন। যখন আমি দৌড়াতে যেতাম বা ঘুমাতাম, তখন অপরাধবোধ অনুভব করতাম। কিন্তু নিজের যত্ন না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে যত্ন দেওয়া সম্ভব নয়। এটি আমাকে ভারসাম্যের গুরুত্ব শিখিয়েছে।

৯. অস্বস্তিকর আলাপ

মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পত্তি, ঋণ বা দাফনের ইচ্ছা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমরা পিতার সম্পত্তি নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু তাঁর অছিয়ত (উইল) নিয়ে পুরোপুরি আলোচনা করতে পারিনি। এটি আমাকে শিখিয়েছে, আমাদের সবাইকে মৃত্যুর আগে অছিয়ত স্পষ্ট করে রাখতে হবে। একবার এই আলাপ হয়ে গেলেই হয়ে গেল। অন্য সময় নাহয় স্মৃতি বা পরামর্শ শেয়ার করার জন্য তোলা থাক।

১০. অনিশ্চিত সময়ে পরিকল্পনা

পিতার অবস্থা কখনো উন্নত, কখনো সংকটাপন্ন ছিল। এই অনিশ্চয়তায় জীবন পরিকল্পনা করা কঠিন। আমি ‘বাগানের মালির মানসিকতা’ গ্রহণ করি—গাছের যত্ন নিয়ে ফুল-ফসল আল্লাহর হাতে ভাবেন তাঁরা। তেমনি আমি ইস্তিখারা পড়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিই। এটি আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ত্যাগ করে ভাগ্যের ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।

পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি।

১১. নিয়ত অনুযায়ী আল্লাহর ব্যবস্থা

গত রমজানে আমি দোয়া করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার পিতা–মাতার সেবা করার সুযোগ দাও।’ তখন আমি আমেরিকায় স্থায়ী ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ অপ্রত্যাশিতভাবে দুবাইয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন—১০ বছরের ভিসা, কাজ এবং স্থানীয় সুবিধা। এই বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সুবিধা আমাকে আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।

১২. নিয়তের পবিত্রতা

কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার রব তোমার অন্তরের কথা জানেন। যদি তুমি সৎ হও, তিনি তওবাকারীদের ক্ষমা করেন।’ (সুরা ইসরা: ২৫)

যখন লোকে আমার প্রশংসা করত, আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, আমি কি আল্লাহর জন্য এটি করছি, নাকি মানুষের প্রশংসার জন্য? হতাশার মুহূর্তে আমি নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। এটি আমাকে আন্তরিকতার গুরুত্ব শিখিয়েছে।

১৩. জিকিরের মাধ্যমে কষ্ট সহ্য করা

পিতা সারা বছর তাঁর ব্যথার মধ্যেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, দরুদ শরিফ এবং তিলাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জিকির আমাকে একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে একজন শায়খ বলেছিলেন, ‘রোগী যদি একটি তাসবিহও বলতে পারেন, তবে তাঁর জীবন রক্ষার চেষ্টা করো।’ পিতার প্রতিটি জিকির তাঁর মর্যাদা বাড়িয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।

আরও পড়ুনপিতা-মাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু১১ আগস্ট ২০১৬

১৪. আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন

একবার একজন নিরাপত্তারক্ষী পিতাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, তাই তিনি আপনাকে পরীক্ষা করছেন।’ এই কথা আমাকে ইমাম মালিকের হাদিসের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘একজন মুসলিমের ওপর যেকোনো ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা ব্যথা আসে, এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিঁধে, তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে আল্লাহ তা দিয়ে তার পাপ ক্ষমা করে দেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৮২৮)

এটি আমাকে কষ্টের পেছনের হিকমত বুঝতে সাহায্য করেছে।

মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম

১৫. দুশ্চিন্তা মোকাবিলা

চিকিৎসা ব্যয় এবং বাবার অবস্থা নিয়ে আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একজন বন্ধু আমাকে ইমাম শাফিঈর কবিতা পাঠান: ‘যা ছিল, তাতে আল্লাহ তোমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন; যা হবে, তাতেও তিনি যথেষ্ট দেবেন।’

এ কথা আমাকে দুশ্চিন্তা কমাতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।’

১৬. মায়ের শক্তি

আমার মা ছিলেন আমাদের পরিবারের মেরুদণ্ড। তিনি বাবার পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া এবং আরামের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁর ধৈর্য ও ভালোবাসা আমাকে একজন স্ত্রী ও মায়ের অপরিসীম শক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি দোয়া করি, আমরা তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মতোই যত্ন নিতে পারি।

১৭. চিকিৎসা বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত

আতুল গাওয়ান্দের বই ‘বিয়িং মর্টাল’ আমাকে শিখিয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা কষ্ট বাড়াতে পারে। আমরা একটি ‘প্রাকৃতিক মৃত্যুর অনুমতি’ ফর্ম স্বাক্ষর করি, যা পিতার জন্য শান্তিপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এটি আমাকে মৃত্যুকে সম্মান করতে শিখিয়েছে।

১৮. মৃত্যুর মুহূর্ত

মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম এবং বললাম, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ এই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত আমাকে আল্লাহর মহিমার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

১৯. ব্যক্তিগত ও উম্মাহর কষ্ট

পিতার মৃত্যু আমাদের ব্যক্তিগত কষ্ট ছিল, কিন্তু গাজার ভাই-বোনদের দুঃখ আমাকে আরও বেশি ব্যথিত করেছে। তাদের অনেকে প্রিয়জনের যত্ন নেওয়ার বা দাফনের সুযোগ পায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাকে উম্মাহর জন্য কাজ করার প্রেরণা দিয়েছে।

২০. কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ব

এই যাত্রা আমাকে আল্লাহর রহমত, আমার মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে। মহানবী (সা.)-এর উম্মাহ হিসেবে আমরা মৃত্যুকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা শিখেছি। আমি দোয়া করি, আল্লাহ আমার পিতাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সুন্দর পরিণতি দিন।

সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম। অনুবাদ: মনযূরুল হক

আরও পড়ুনমারা গেলে নয়, সব সময় বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করা২০ মার্চ ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খামেনিকে হত্যায় ইসরায়েলি পরিকল্পনা আটকে দেন ট্রাম্প
  • সাংবাদিক পরিচয়ে গেস্ট হাউসের কক্ষে কক্ষে তল্লাশি, দম্পতির কাছে বিয়ের প্রমাণ দাবি
  • ডেঙ্গু-করোনায় দুই মৃত্যু, আক্রান্ত ২৭৫ জন
  • চলতি মাসের ১৫ দিনে করোনায় ৪ জনের মৃত্যু
  • গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে প্রপাগান্ডার সয়লাব
  • কারাগারে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
  • ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রাক-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত ১
  • রাতারাতি তারকা হলে দীর্ঘ সময় দর্শকের মনে থাকা কঠিন: রিচি
  • গুম করা হতো তিনটি ধাপে 
  • এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা