Samakal:
2025-10-03@10:07:00 GMT

কদম ফুলের রোদন

Published: 23rd, June 2025 GMT

কদম ফুলের রোদন

ট্রেন থামে আচমকা, যেন কোনো অদৃশ্য নির্দেশে। স্টেশনের নামটা ধরা যায় না শুরুতে। জানালার কাচে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা মুছে সাকান চোখ রাখে বাইরে। গাছপালা ঝাপসা হয়ে আছে। একটু দূরে, ভিজে ওঠা মাটির পাশ দিয়ে দুটো কদম গাছ মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে। পাতাগুলো যেন মাথা নিচু করে কোনো পুরোনো অপেক্ষার ভার বইছে।
সাকানের স্ত্রী লাবণী সঙ্গেই ছিল। কাপ থেকে চায়ের শেষ চুমুকটা নিয়ে সে বলে, ‘এই জায়গাটা কত শান্ত! দেখ না কদম গাছগুলো কেমন সুন্দর করে দাঁড়িয়ে আছে।’
সাকান তাকায়। গাছ দেখে না, সে দেখে স্টেশনের সাইন বোর্ডটা। জলে ভেজা কালো অক্ষরে লেখা নামটা তার ভেতরটাকে ঠান্ডা করে দেয়। নামটা খুব চেনা। ঠিক যেন বহু বছর আগে শোনা কোনো ডাকনামের মতো।
একটা পুরোনো কণ্ঠস্বর, বহু বছর আগের, খুব নিচু স্বরে তার কানে বাজে– ‘এই স্টেশন থেকে নামলেই পাবে কদম গাছের জোড়া, কদম ফুলে ভরে যায় বর্ষায়। ওখানে একটা পুরোনো মিষ্টির দোকান আছে। বাবা পছন্দ করতেন ওদের কালোজাম। তুমি এলে নিয়ে যেও, বাবার খুব ভালো লাগবে। জান, আমার ঘরের জানালা ঠিক ওই কদম গাছের দিকেই খোলে।’ সাকান থেমে যায়। ঝড়জলের শব্দের ভেতরেও কণ্ঠটা যেন স্পষ্ট শুনতে পায়। একটা মেয়ের কণ্ঠ। নামটা মনে পড়ে না, কিন্তু কণ্ঠটার মধ্যে যে ভবিষ্যৎটুকু ছিল, তা আজও বর্তমান।
সাকান তখন কলেজে, কোনো এক ট্রেনিংয়ের ছুতোয় অচেনা এক মফস্বল শহরে গিয়েছিল। আবছা মুখ, একটা লাল ছাতা আর ওই কণ্ঠ। মেয়েটি প্রতিদিন স্টেশনের কাছ দিয়ে হেঁটে যেত। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার ঘর কি ওই কদম গাছগুলোর দিকেই?’
মেয়েটি হেসে বলেছিল, ‘হুম। তুমি যদি কোনোদিন ফিরে আস, এ কদম গাছের নিচেই দাঁড়িও। আমি জানালা দিয়ে দেখব। যদি দেখি তুমি মেরুন শার্ট পরে এসেছ, বুঝে নেব তুমি আমায় দেখতে আসনি।’ সেই কণ্ঠটি বারবার ফিরে আসে। কিন্তু সাকান কোনোদিন ফেরেনি। চাকরি, সংসার, দায়িত্ব সব একত্রে তাকে টেনে নিয়েছিল অন্যদিকে। 
লাবণী বলে, ‘এই শহরটার একটা নরম গন্ধ আছে, না? বর্ষায় আরও বেশি মনে হয়।’
সাকান মাথা নাড়ে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে, কাঁধে ছোট ব্যাগ। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চেয়ে আছে ট্রেনের দিকে। সাকানের মনে হয়, মেয়েটা যেন তারই কোনো গল্পের পাতার চরিত্র। ট্রেন হুইসেল দেয়। প্ল্যাটফর্মের ভেজা ছাউনি কাঁপে শব্দে। সাকানের কণ্ঠ থেমে আসে গলায়। লাবণী বলে, ‘জায়গাটা একটু ঘুরে দেখি।’
লাবণী তাকিয়ে থাকে। সাকানের চোখে সে কোনোদিন দেখেনি এমন নীরবতা। কিছুক্ষণ পর তারা নেমে পড়ে। স্টেশনের পাশের কাঁচা রাস্তা ধরে তারা যায় পুরোনো মিষ্টির দোকানটায়। দোকানের বুড়ো মালিক এখনও মনে রাখে, ‘আপনি আগে এসেছিলেন না? সেই.

.. কদম গাছের সময়।’
সাকান চমকে তাকায়। দোকানদার হেসে বলে, ‘আমার সব পুরোনো ক্রেতা মনে থাকে। আপনার সঙ্গে এক মেয়ে ছিল...।’
এই মুহূর্তে সাকান বোঝে, সে যতই দূরে থাকুক, কিছু গল্প তার জন্য অপেক্ষা করে। কিছু ফুল শুধু বর্ষার জন্যই ফোটে আর কিছু চোখ, জানালার ওপাশ থেকে তাকিয়ে থাকে সারাজীবন।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে এক পুরোনো ব্যঞ্জনার মতো। সাকান জানে, এই বৃষ্টি তাকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। হয়তো এবার সে ভুল করবে না। v
সুহৃদ ঢাকা

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স হ দ সম ব শ কদম গ ছ র

এছাড়াও পড়ুন:

স্বামীকে ফিরে পেতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলেন ‘র‍্যাঞ্চোর’ স্ত্রী গীতাঞ্জলি

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সোনম ওয়াংচুকের মুক্তির দাবিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো। গতকাল বৃহস্পতিবার শীর্ষ আদালতে তিনি হেবিয়াস কর্পাস (আসামিকে আদালতে হাজির করা) আবেদন দাখিল করেছেন।

আবেদনে গীতাঞ্জলি বলেছেন, এক সপ্তাহ কেটে গেলেও এখনো পর্যন্ত তাঁর স্বামী সোনম ওয়াংচুকের স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থা নিয়ে তাঁকে কিছুই জানানো হয়নি। কেন তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়েও তাঁকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর হিংসাত্মক ঘটনার দুই দিনের মাথায় সোনম ওয়াংচুককে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (এনএসএ) গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরেই তাঁকে লেহ্ থেকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজস্থানের যোধপুর কারাগারে। সোনমের গ্রেপ্তারি ‘বেআইনি’ দাবি করে শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপ দাবি করেন গীতাঞ্জলি।

সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়াও গীতাঞ্জলি চিঠি লিখেছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, লাদাখের উপরাজ্যপাল কবীন্দ্র গুপ্ত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘাওয়ালকে।

প্রতিটি চিঠিতেই গীতাঞ্জলি স্বামীর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে জানতে চেয়েছেন, জনগণের স্বার্থকে সমর্থন করা অন্যায় ও পাপ কি না। সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়টি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও জানিয়েছেন। বলেছেন, এত দিন হয়ে গেলেও স্বামী কেমন আছেন, তা তাঁকে জানানো হয়নি। তাঁর সঙ্গে কথা বলানো হয়নি। বরং বেশ কিছুদিন ধরেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো দিয়ে তাঁদের নানাভাবে হয়রান করা হচ্ছে।

সোনমকে নিয়েই আমির খান তৈরি করেছিলেন ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমা। জনপ্রিয় সেই সিনেমায় সোনমের নাম ছিল ‘র‍্যাঞ্চো’। লাদাখের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনেছেন সোনম। প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশ–বান্ধব উদ্ভাবনী ক্ষমতার মধ্য দিয়ে তিনি সমাজের যে উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, সারা দেশ তার স্বীকৃতি দিয়েছে। উপকৃত হয়েছেন হিমালয়ে দিন ও রাত কাটানো ভারতীয় সেনা সদস্যরা।

কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার সোনমের পরামর্শ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি কিছুদিন আগেও ছিল তাঁর গুণমুগ্ধ। সোনমও সপরিবারে বিজেপিকে সমর্থন করে এসেছেন।

২০১৯ সালে জম্মু–কাশ্মীরকে দুই ভাগ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলার পর সোনম প্রকাশ্যে সেই সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জয়গান করে লাদাখে মিছিল করেছিলেন। বিবৃতি দিয়েছিলেন।

অথচ সেই ব্যক্তিই ধীরে ধীরে হয়ে গেলেন বিজেপি সরকারের চোখের বালি। এতটাই যে জাতিসংঘের সহযোগিতায় পাকিস্তানের গণমাধ্যম ‘ডন’–এর উদ্যোগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামাবাদে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলন ‘ব্রিদ পাকিস্তান’–এ অংশ নেওয়ায় সরকারের চোখে তিনি ‘পাকিস্তানি চর’ হয়ে গেছেন।

লাদাখের শীর্ষ পুলিশ কর্তা এসডি সিং জামওয়াল সরাসরি সেই সন্দেহ প্রকাশ করে জানিয়ে দেন, আন্দোলনকারী যুব–জনতাকে সোনমই খেপিয়েছিলেন। হিংসা ছড়ানোর দায় তাঁরই।

শুধু তা–ই নয়, সোনম ওয়াংচুক যে কারণে সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত, তাঁর তৈরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সুনাম যে কারণে দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সরকারের তদন্তের আওতায় সেগুলোকেও টেনে আনা হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সোনমের আন্দোলন এমন কোনো স্বার্থে ঘা দিয়েছে, যা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শাসকের নয়নের মণি থেকে তাই তিনি হয়ে উঠেছেন চোখের বালি।

লাদাখের আপামর জনতা পৃথক রাজ্য গঠন, নিজস্ব বিধানসভা এবং গোটা অঞ্চলকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সোনম ওয়াংচুক সেই আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছেন। সে জন্য বারবার গান্ধীজির শেখানো পথে অনশন সত্যাগ্রহ আন্দোলন করছেন।

গত সেপ্টেম্বরেও সোনম এই দাবি পূরণে অনশন করছিলেন। হিংসাত্মক ঘটনার পর তার নিন্দা করে তিনি অনশন প্রত্যাহার করেন। অথচ একদিন পরেই তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সোনমের বক্তব্য, লাদাখের পরিবেশ রক্ষার একমাত্র উপায় উপজাতি অধ্যুষিত এই বিস্তীর্ণ এলাকাকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনা। কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতারা ২০১৯ সাল থেকেই এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। না হলে লাগামছাড়া ও পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের নামে লাদাখের পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট নষ্ট হয়ে যাবে। গোটা দেশের পক্ষে তা হবে মারাত্মক।

যদিও সরকার মনে করে, লাদাখের খনিজ সম্পদ ও নবায়নযোগ্য শক্তির উপযুক্ত ব্যবহার উন্নয়নের জোয়ার আনবে। বেসরকারি শিল্পপতিরা ইতিমধ্যেই সেখানকার বিপুল সৌর ও তাপবিদ্যুৎ সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। লিথিয়ামের মতো বিরল খনিজ সম্পদের সদ্ব্যবহারে তারা উৎসাহী। লাদাখ ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হলে তা সম্ভবপর না–ও হতে পারে।

সোনমের গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করেছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের লেহ অ্যাপেক্স বডি (এপিএল) ও মুসলিম প্রধান কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। দুই সংস্থা লাদাখের দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।

৬ অক্টোবর সেই বৈঠকের পরবর্তী দিন নির্ধারিত। কিন্তু ইতিমধ্যেই দুই সংগঠন আলোচনায় অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাদের দাবি, সোনমসহ গ্রেপ্তার সবার নিঃশর্ত মুক্তি ও সব অভিযোগ প্রত্যাহার ও সুপ্রিম কোর্টের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বরের সহিংসতার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।

জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (এনএসএ) কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তাঁকে টানা এক বছর বিনা বিচারে আটক রাখা যায়। এনএসএ, ইউএপিএ এবং এ ধরনের বিভিন্ন আইনে ধৃত বহু আন্দোলনকর্মীকে বছরের পর বছর বিনা বিচার ও বিনা জামিনে আটক রাখা হয়েছে। সোনম ওয়াংচুকের ভাগ্যও তেমন হবে কি না, তা শীর্ষ আদালত বিচার করবেন। ৬ অক্টোবর পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের ছুটি। গীতাঞ্জলির আবেদনের বিচার সম্ভবত তারপর।

সম্পর্কিত নিবন্ধ