শীতের আগেই সিরাজগঞ্জের চলনবিলের নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয় ও পুকুরে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটছে। জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনের পাশাপাশি নিরাপদ আবাস ও খাদ্যের প্রাচুর্য থাকায় চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত করতে কাজ করছেন প্রশাসন।

স্থানীয়রা জানান, শীত আসলেই উত্তরাঞ্চলের মৎস্যভাণ্ডার খ্যাত চলনবিলের তাড়াশ উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তরে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। তবে এবার শীতের আগেই উপজেলার বস্তুল, উলিপুর, পঁওতা, সোলাপাড়া, দিঘীসগুনা, কুন্দইল, সগুনা, লালুয়া মাঝিরা, মালশিনসহ ২০ থেকে ২৫টি গ্রামে নানা ধরনের অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে।

পাখির কিচিরমিচির শব্দে এলাকার পরিবেশ ধারণ করেছে অন্য রূপে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, নীলশির, শামুকখোল ত্রিশূল বক, রাতচরা, কোড়া, লালশির, বড় সরালি, ছোট সরালিসহ অনেক পাখি। 

এলাকার গাছে গাছে বাসা বেঁধেছে পাখিগুলো। মাঠজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ডাহুক, গাঙচিল, বক, ছোট পানকৌড়ি, বড় পানকৌড়ি, চখাচখি, কাদাখোঁচা, মাছরাঙাসহ নাম না জানা পাখি। 

এক সময় চলনবিলে পাখি শিকারির উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিকারির সংখ্যা কমে আসায় দিন দিনই এ অঞ্চলে অতিথি পাখির উপস্থিতি বাড়ছে।

তাড়াশের উলিপুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক বাবুল আকতার বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এবছর চলনবিলে বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার বৈচিত্র্যময় পাখির আনাগোনা বেড়ে গেছে। খাদ্যের সহজলভ্যতাসহ নানা কারণে শীত আসার আগেই চলনবিলে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। যেটা কয়েক বছর আগে দেখা যায়নি। বিস্তীর্ণ চলনবিলের নদী, খালবিল, জলাশয়, ধানের ক্ষেত, পুকুর ও ডোবায় পাখির ঝাঁকের হাঁকডাক, ওড়াউড়ির দৃশ্যসহ কিচিরমিচির শব্দে এ অঞ্চলের মানুষের মনোরম পরিবেশ অন্য রূপ নিয়েছে।”

চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির তাড়াশ উপজেলা শাখার আহব্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক রাজু বলেন, “পাখি শিকার করা দণ্ডনীয় যে অপরাধ, তা নিয়ে শিকারি বা ক্রেতাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভীতি নাই। চলনবিলের পাখি বাঁচাতে আইন প্রয়োগের পাশাপশি লোকজনের মধ্যে ব্যাপক হারে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। তাহলে এই অঞ্চল থেকে পাখি শিকার বন্ধ হবে ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।”

তাড়াশ উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, “শীতের আমেজ শুরু হওয়ায় বিভিন্ন জাতের পাখি আসছে। এই পাখিগুলো রাতের আধারে অসাধু কিছু শিকারি বেশিরভাগ শিকার করছে। এই বিশাল চলনবিলের মধ্যে তাদের খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে অসাধু পাখি শিকারিদের খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা চলছে।”

চলনবিলে পাখির আগমন বৃদ্ধির সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড.

এম নজরুল ইসলাম বলেন, “এ বছর চলনবিলে স্বাভাবিক বন্যা হয়েছে। এ কারণে বিলের জলাশয়ে প্রচুর খাবার মিলছে। খাদ্যের প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতাই বালিহাঁস, শামুকখোল এবং অন্য পরিযায়ী পাখির এই বিল অঞ্চলে আসতে উৎসাহিত করছে। তাই এখানে পাখির আনাগোনা অন্য কয়েক বছরের তুলনায় বেড়েছে।”

তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত জাহান বলেন, “মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সারাদেশেই অতিথি পাখির আগমন ঘটবে। একই সঙ্গে পাখি শিকারিদের অবস্থান জানা গেলে বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করা হবে। প্রয়োজনে যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে পাখি শিকারিদের আইনের আওতায় আনা হবে।”

ঢাকা/অদিত্য/এস

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ত ড় শ উপজ ল প খ র আগমন চলনব ল র র আগ ই

এছাড়াও পড়ুন:

খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রাজশাহীর মানুষ

দেশের উত্তরাঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার অন্য এলাকাগুলোর তুলনায় বেশি। সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতার মুখে আছে রাজশাহী বিভাগের মানুষ। এ বিভাগের প্রায় ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশ পরিবার মাঝারি বা মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার।

একই চিত্র ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে। অর্থাৎ এই তিন বিভাগে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে। অথচ এই তিন বিভাগ হলো দেশে ধান, সবজি ও মাছ উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র। এর মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয় ময়মনসিংহে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্য উৎপাদনের কেন্দ্রগুলোতেই নিরাপত্তাহীনতা বেশি হওয়ার মূল কারণ হলো, উৎপাদন মাথাপিছু সহজলভ্য না হওয়া এবং খাদ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ও কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘উৎপাদিত কৃষিপণ্য কতটা সহজলভ্য, সেটি একটি বিষয়। আর সহজলভ্য হলেও খাদ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা কতটা আছে, সেটাও আরেকটি বিবেচ্য।’ তাঁর মতে, উভয় কারণেই উৎপাদন এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হতে পারে। মূল্যস্ফীতির কারণে দাম বাড়লে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তাই উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি দাম স্বাভাবিক রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

** ধান, মাছ ও সবজি উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রেই মাঝারি থেকে গুরুতর নিরাপত্তাহীনতা বেশি। ** গ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ২৫.৭৫%, শহরে ২০.৯৪%; সিটি এলাকায় মাত্র ৭.৮৬%। ** রাজশাহীতে ৩২.৯০%, ময়মনসিংহে ৩২.৬২%, রংপুরে ৩০.৫৮%, সিলেটে ২৮.২৬%, ঢাকায় ১৭.৫০% ও চট্টগ্রামে ১৩.৩২% এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭.৮৬% মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ময়মনসিংহ বিভাগে উচ্চ মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। এখানে প্রায় ৩২ দশমিক ৬২ শতাংশ পরিবার মাঝারি বা মারাত্মকভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীন। এর মধ্যে ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ মাঝারি এবং শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থায়।

বিবিএসের কৃষি উৎপাদনের হিসাব বলছে, গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে দেশে মোট আমন ধান উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৫৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৯৫ টন। সেবার রংপুরে সর্বোচ্চ ৩১ লাখ ৬৪ হাজার টন ধান উৎপাদন হয়েছে। ২৩ লাখ ৯৫ হাজার টন আমনের উৎপাদন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাজশাহী। ময়মনসিংহে উৎপাদন হয় ১৫ লাখ ৭১ হাজার টন। ধান ছাড়াও মাছ, আলু, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন সবজির বড় জোগান আসে এই তিন অঞ্চল থেকে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে দেশে পুকুরে চাষ থেকে মোট মাছ উৎপাদিত হয়েছে ২৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪১ টন। এর মধ্যে শুধু ময়মনসিংহ বিভাগে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ১৭৫ টন উৎপাদিত হয়। এই অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস পুকুর, নদী, খাল–বিল মিলিয়ে এ বিভাগে মোট মাছ উৎপাদন হয় ৭ লাখ ২৪ হাজার টন, যা দেশে সর্বোচ্চ।

রংপুর বিভাগের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। এখানে মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবারের হার ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সিলেট বিভাগে ২৮ দশমিক ২৬ শতাংশ পরিবার মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে।

অন্যদিকে ঢাকা বিভাগে মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে এই হার আরও কম—১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।

মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবারগুলো খাবারের মান ও পরিমাণে ঘাটতির মুখে পড়ে। তারা যথেষ্ট খাদ্য পায় না, পছন্দসই খাবার বেছে নিতে পারে না, কখনো খাবারের মান কমাতে হয়, কখনো কম খেতে হয়—এমনকি খাবার নিয়ে অনিশ্চয়তাও থাকে।

গ্রাম–শহর তুলনা করলে দেখা যায়, গ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেশি। গ্রামীণ এলাকায় ২৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ পরিবার মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শহরে এই হার ২০ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

বিবিএসের এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরির ফোকাল পারসন হলেন সংস্থাটির কৃষি শাখার উপপরিচালক মেহেনাজ তাবাসসুম। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রশ্নমালা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করেছি। কোন এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেশি—এর কারণ জানতে আরও বিশ্লেষণ দরকার। হয়তো এসব এলাকার মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।’

২৯ হাজার ৭৬০টি খানা থেকে ২০২৩ সালের খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যানের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করে বিবিএস।

সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো। এ ধরনের এলাকায় মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা পরিবারের হার মাত্র ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আর গুরুতর নিরাপত্তাহীন পরিবার ১ শতাংশের কম।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশ গঠনে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য করার আহ্বান
  • খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রাজশাহীর মানুষ
  • চলতি বছর সবচেয়ে বেশি পর্যটক গেছেন ব্যাংককে, তালিকায় আর কোন শহর আছে