২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ হতেই কক্সবাজারের জেলেদের সামনে হাজির হয়েছে নতুন বিপদ—বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়েছে গভীর নিম্নচাপ। এর প্রভাবে সাগর এখন উত্তাল, ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কাও রয়েছে। প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও জেলেরা তাই সাগরে নামতে পারছেন না। এতে হতাশ ট্রলারের মালিক ও জেলেরা।

ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মা ইলিশ রক্ষায় ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ২২ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সরকার। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১২টায় সেই নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়। আজ রোববার ভোর থেকে সাগরে নামার প্রস্তুতি নিলেও নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় সব প্রস্তুতি থমকে গেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দক্ষিণ–পূর্ব বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে এবং এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। আজ সকাল ছয়টায় নিম্নচাপটির অবস্থান ছিল কক্সবাজার থেকে প্রায় ১ হাজার ২৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে। এটি উত্তর–পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ এ বি হান্নান বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি ২৮ অক্টোবর রাত অথবা ২৯ অক্টোবর সকালে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। কক্সবাজার উপকূলে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত নৌকা ও ট্রলারগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো.

দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে গতকাল মধ্যরাতে। জেলার টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সদর, পেকুয়া, চকরিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার জেলে সাগরে নামার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। জেলায় ছোট–বড় মিলে পাঁচ হাজারের বেশি ট্রলার রয়েছে। কিন্তু সাগর উত্তাল হওয়ায় কেউই নামতে পারছেন না।’

মো. দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, কক্সবাজারের জেলেদের বিপদ পিছু ছাড়ছে না। গত ছয় মাসে সাগরে তেমন ইলিশ ধরা পড়েনি। আগস্টে ছয়বার ও সেপ্টেম্বরে তিনবার নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এসব কারণে জেলেরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন দুর্যোগ কেন হচ্ছে, তা নিয়েও গবেষণা দরকার।

জেলেপল্লিতে হাহাকার

আজ সকালে শহরের নুনিয়াছড়া ফিশারি ঘাটের বাঁকখালী নদীর ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক ট্রলার নোঙর করে রাখা। জেলেরা ট্রলারে বসে আড্ডা দিচ্ছেন, কেউ গল্প করছেন।

মহেশখালীর কালারমারছড়ার জেলে আবদুল মজিদ (৪৫) বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময় ঘরে বসে কাটিয়েছি। দোকান থেকে বাকিতে চাল–ডাল কিনে সংসার চলেছে। বলা হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞা শেষেই সাগরে গিয়ে ইলিশ ধরব, তখন বাকি পরিশোধ করব। কিন্তু এখন নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ও নাকি আসবে। কী করব বুঝতে পারছি না।’

আরেক জেলে সাইফুল করিম (৪৫) বলেন, তাঁর ট্রলারে ২১ জেলে আছেন। সরকারি চাল সহায়তা পাননি তাঁরা। তিনি বলেন, ‘২২ দিন কোনো আয় ছিল না। এখন আবার নিম্নচাপের কারণে সাগরে যেতে পারছি না। ইলিশ না ধরতে পারলে পরিবার চালানো কঠিন হবে।’

ট্রলারের মাঝি ঈমান হোসেন (৫৫) জানান, ইলিশ ধরতে হলে ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গভীর সাগরে যেতে হয়। এক ট্রিপে খরচ পড়ে আড়াই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। দুর্যোগে ট্রলার ফেরত এলে খরচের অর্ধেকটাই জেলেদের গুনতে হয়।

আরও কয়েকজন জেলে বলেন, গত ছয় মাসে সাগরে তেমন ইলিশ ধরা পড়েনি, অন্য সামুদ্রিক মাছও কমেছে। জেলেপল্লিতে এখন অভাব ও হাহাকার চলছে। অনেকে এক বেলা খাবার জোগাড় করতেও হিমশিম খাচ্ছেন। ট্রলারের মালিকেরা লোকসানে পড়ে জেলেদের অগ্রিম টাকা দিতেও অনিচ্ছা দেখাচ্ছেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা বলেন, নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৬ হাজার ২৮০ জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। জেলার নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৪ হাজার ৪।

মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে কক্সবাজার জেলায় ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৪০ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) ইলিশ ধরা পড়েছে মাত্র ৭৯৯ দশমিক ৮৫ মেট্রিক টন, যা মাসে গড়ে ২৬৬ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪২ হাজার মেট্রিক টন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ট র ক টন প রস ত ত ২২ দ ন উপক ল

এছাড়াও পড়ুন:

‘ইয়াকিন’ কীভাবে অর্জন করা যায়

কোরআনে ইয়াকিনের গুরুত্ব

কোরআনে ইয়াকিনের বিশেষ গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে:

সফলতার মানদণ্ড: আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে ইয়াকিনকে হেদায়েত ও সফলতার কারণ বলেছেন, ‘এরাই তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর রয়েছে এবং এরাই সফলকাম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৫)

চিন্তা ও নিদর্শনের ভিত্তি: আল্লাহ বলেন, পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের (ইয়াকিনকারীদের) জন্য রয়েছে নিদের্শনাবলি, ‘এবং পৃথিবীতে ইয়াকিনকারীদের জন্য নিদের্শনাবলি রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ২০)

নেতৃত্ব লাভের উপায়: আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের নবী ও শাসকদের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘যখন তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল এবং আমাদের নিদের্শনাবলিতে দৃঢ়বিশ্বাস করত তখন আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা বানিয়েছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ দেখাত।’ (সুরা সাজদা, আয়াত: ২৪)

অবিশ্বাসের নিন্দা: যারা ইয়াকিন রাখে না, তাদের আল্লাহ নিন্দা করেছেন, ‘এবং যখন তাদের বলা হতো, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী—এতে কোনো সন্দেহ নেই, তখন তোমরা বলতে: কিয়ামত কী, তা আমরা জানি না; আমরা কেবল ধারণা করি, আমরা তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি না।’ (সুরা জাসিয়া, আয়াত: ৩২)

আরও পড়ুন‘ইয়াকিন’ অর্থ কী১৫ ঘণ্টা আগেহাদিসে ইয়াকিনের অবস্থান

নবীজি (সা.) বহু হাদিসে ইয়াকিনের গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন:

জান্নাতের সুসংবাদ: তিনি আবু হুরায়রাকে (রা.) বললেন, ‘তুমি তোমার এই দুটি জুতা নিয়ে যাও। এই দেয়ালের বাইরে যার সঙ্গে তোমার দেখা হবে এবং সে যদি তার হৃদয়ে দৃঢ়বিশ্বাস রেখে সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তবে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩)

দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত: তিনি বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা (আফিয়াত) প্রার্থনা করো। কেননা ইয়াকিনের পর আর কাউকে আফিয়াত (সুস্বাস্থ্য ও প্রশান্তি) অপেক্ষা উত্তম কিছু দেওয়া হয়নি।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৫৮)

ইয়াকিন অর্জনের উপায়গুলো

ইয়াকিন কোনো আশা বা অলসতার মাধ্যমে অর্জিত হয় না; বরং এটি আন্তরিক প্রচেষ্টা, ধৈর্য ও সুদৃঢ় ইমানি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।

১. জ্ঞান অর্জন

ইয়াকিনের প্রথম স্তর: ইয়াকিনের প্রথম সোপান হলো সহিহ জ্ঞান (ইলম) অর্জন করা। জ্ঞানই মানুষকে কর্মের দিকে চালিত করে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘স্মরণ ও জ্ঞান ইয়াকিনকে পূর্ণতা দান করে।’ (ইবনে তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ২৩৫)

জ্ঞান মানুষকে আল্লাহ ও আখিরাতের পুরস্কার সম্পর্কে নিশ্চিত করে, ফলে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর পথে অর্থ ও জীবন উৎসর্গ করে। ইয়াকিন অর্জনের মাধ্যমে জ্ঞান হৃদয়ে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে তা বান্দাকে কাজ করার জন্য বাধ্য করে।

২. আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান

আল্লাহর ইয়াকিন অর্জনের জন্য আল্লাহ তাআলার নাম ও গুণাবলি (আসমা ওয়া সিফাত) সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা অপরিহার্য। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:

আরও পড়ুনফরজে কিফায়া: একের পালন, সবার মুক্তি১০ জুলাই ২০২৫

রবুবিয়্যাত: আল্লাহ সবকিছুর প্রতিপালক, পরিচালক ও রিজিকদাতা—এই জ্ঞানে হৃদয় স্থির হয়ে যায়। ফলে বান্দা তার রিজিক, হায়াত ও ভাগ্যের ব্যাপারে চিন্তামুক্ত থাকে এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে।

উলুহিয়্যাত: আল্লাহই একমাত্র উপাস্য—এই জ্ঞানে হৃদয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও দিকে ফিরে তাকায় না বা কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না।

আসমা ওয়া সিফাত: আল্লাহ পরাক্রমশালী, সর্বশক্তিমান ও সদা তত্ত্বাবধানকারী—এই জ্ঞানে বান্দা একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করে এবং হারাম থেকে বিরত থাকে।

৩. নফস ও সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান

নিজের দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং সৃষ্টির অধীনতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখলে বান্দা কখনো নিজের ওপর বা সৃষ্টির ওপর ভরসা করে না।

শফিক ইবনে ইবরাহিম বলখি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে নিজের জ্ঞান জানতে চায়, সে যেন দেখে, আল্লাহ তাকে যা ওয়াদা করেছেন আর মানুষ যা ওয়াদা করেছে, কার ওয়াদার ওপর তার হৃদয়ের ভরসা বেশি।’ (আবু নুয়ায়েম, হিলয়াতুল আউলিয়া, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৬৪)

৪. অভ্যন্তরীণ জিহাদ

প্রবৃত্তি ও সন্দেহের মোকাবিলা: ইয়াকিন অর্জনের জন্য দুটি স্তরে শয়তানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত জিহাদ বা সংগ্রাম করতে হয়:

সন্দেহ ও ওয়াসওয়াসার জিহাদ: ইয়াকিনকে দুর্বল করে দেয় এমন সব সন্দেহ ও কুচিন্তা (শুবহাত) থেকে নিজেকে দূরে রাখা। সন্দেহ সৃষ্টিকারী বই পড়া বা তাদের সঙ্গে বিতর্কে জড়ানো থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মন্দ প্রবৃত্তি ও আকাঙ্ক্ষার জিহাদ: ইবনে তাইমিয়ার মতে, ধৈর্য (সবর) ও ইয়াকিনের মাধ্যমেই দ্বীনের ইমামত লাভ করা যায়। ধৈর্য সব অবৈধ প্রবৃত্তি ও আকাঙ্ক্ষা (শাহওয়াত) দমন করে, আর ইয়াকিন সব সন্দেহ ও অস্পষ্টতা (শুবহাত) দূর করে। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৩৫৮)

৫. সৎকর্মে সুদৃঢ় সংকল্প

নেক আমল, যেমন তওবা, দান বা সাওম—এগুলো দৃঢ়সংকল্প নিয়ে করতে হবে, জাগতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে। যে ব্যক্তি কেবল লাভের চিন্তা করে নেক আমল থেকে বিরত থাকে, সে ইয়াকিন অর্জনে ব্যর্থ হয়। মুমিনের একমাত্র লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি।

৬. প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হওয়া

প্রবৃত্তি ও নফসের আকাঙ্ক্ষায় ডুবে থাকলে ইয়াকিন অর্জন করা অসম্ভব। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘তাকওয়ার মূল হলো নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে দূরে থাকা, আর এর মানে হলো নফস (প্রবৃত্তি) থেকে দূরে থাকা। প্রবৃত্তির সঙ্গ ছেড়ে দিলে ইয়াকিন অর্জিত হয়।’ (মাদারিজুস সালিকিন, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৩৯৯)

আরও পড়ুনইমান: শক্তি ও শান্তির রহস্য০২ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ