‘ইয়াকিন’ কীভাবে অর্জন করা যায়
Published: 11th, December 2025 GMT
কোরআনে ইয়াকিনের গুরুত্ব
কোরআনে ইয়াকিনের বিশেষ গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে:
সফলতার মানদণ্ড: আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে ইয়াকিনকে হেদায়েত ও সফলতার কারণ বলেছেন, ‘এরাই তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর রয়েছে এবং এরাই সফলকাম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৫)
চিন্তা ও নিদর্শনের ভিত্তি: আল্লাহ বলেন, পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের (ইয়াকিনকারীদের) জন্য রয়েছে নিদের্শনাবলি, ‘এবং পৃথিবীতে ইয়াকিনকারীদের জন্য নিদের্শনাবলি রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ২০)
নেতৃত্ব লাভের উপায়: আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের নবী ও শাসকদের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘যখন তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল এবং আমাদের নিদের্শনাবলিতে দৃঢ়বিশ্বাস করত তখন আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা বানিয়েছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ দেখাত।’ (সুরা সাজদা, আয়াত: ২৪)
অবিশ্বাসের নিন্দা: যারা ইয়াকিন রাখে না, তাদের আল্লাহ নিন্দা করেছেন, ‘এবং যখন তাদের বলা হতো, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী—এতে কোনো সন্দেহ নেই, তখন তোমরা বলতে: কিয়ামত কী, তা আমরা জানি না; আমরা কেবল ধারণা করি, আমরা তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি না।’ (সুরা জাসিয়া, আয়াত: ৩২)
আরও পড়ুন‘ইয়াকিন’ অর্থ কী১৫ ঘণ্টা আগেহাদিসে ইয়াকিনের অবস্থাননবীজি (সা.
জান্নাতের সুসংবাদ: তিনি আবু হুরায়রাকে (রা.) বললেন, ‘তুমি তোমার এই দুটি জুতা নিয়ে যাও। এই দেয়ালের বাইরে যার সঙ্গে তোমার দেখা হবে এবং সে যদি তার হৃদয়ে দৃঢ়বিশ্বাস রেখে সাক্ষ্য দেয় যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তবে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩)
দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত: তিনি বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা (আফিয়াত) প্রার্থনা করো। কেননা ইয়াকিনের পর আর কাউকে আফিয়াত (সুস্বাস্থ্য ও প্রশান্তি) অপেক্ষা উত্তম কিছু দেওয়া হয়নি।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৫৮)
ইয়াকিন অর্জনের উপায়গুলোইয়াকিন কোনো আশা বা অলসতার মাধ্যমে অর্জিত হয় না; বরং এটি আন্তরিক প্রচেষ্টা, ধৈর্য ও সুদৃঢ় ইমানি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।
১. জ্ঞান অর্জন
ইয়াকিনের প্রথম স্তর: ইয়াকিনের প্রথম সোপান হলো সহিহ জ্ঞান (ইলম) অর্জন করা। জ্ঞানই মানুষকে কর্মের দিকে চালিত করে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘স্মরণ ও জ্ঞান ইয়াকিনকে পূর্ণতা দান করে।’ (ইবনে তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ২৩৫)
জ্ঞান মানুষকে আল্লাহ ও আখিরাতের পুরস্কার সম্পর্কে নিশ্চিত করে, ফলে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর পথে অর্থ ও জীবন উৎসর্গ করে। ইয়াকিন অর্জনের মাধ্যমে জ্ঞান হৃদয়ে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে তা বান্দাকে কাজ করার জন্য বাধ্য করে।
২. আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান
আল্লাহর ইয়াকিন অর্জনের জন্য আল্লাহ তাআলার নাম ও গুণাবলি (আসমা ওয়া সিফাত) সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা অপরিহার্য। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:
আরও পড়ুনফরজে কিফায়া: একের পালন, সবার মুক্তি১০ জুলাই ২০২৫রবুবিয়্যাত: আল্লাহ সবকিছুর প্রতিপালক, পরিচালক ও রিজিকদাতা—এই জ্ঞানে হৃদয় স্থির হয়ে যায়। ফলে বান্দা তার রিজিক, হায়াত ও ভাগ্যের ব্যাপারে চিন্তামুক্ত থাকে এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে।
উলুহিয়্যাত: আল্লাহই একমাত্র উপাস্য—এই জ্ঞানে হৃদয় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও দিকে ফিরে তাকায় না বা কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না।
আসমা ওয়া সিফাত: আল্লাহ পরাক্রমশালী, সর্বশক্তিমান ও সদা তত্ত্বাবধানকারী—এই জ্ঞানে বান্দা একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করে এবং হারাম থেকে বিরত থাকে।
৩. নফস ও সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান
নিজের দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং সৃষ্টির অধীনতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখলে বান্দা কখনো নিজের ওপর বা সৃষ্টির ওপর ভরসা করে না।
শফিক ইবনে ইবরাহিম বলখি বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে নিজের জ্ঞান জানতে চায়, সে যেন দেখে, আল্লাহ তাকে যা ওয়াদা করেছেন আর মানুষ যা ওয়াদা করেছে, কার ওয়াদার ওপর তার হৃদয়ের ভরসা বেশি।’ (আবু নুয়ায়েম, হিলয়াতুল আউলিয়া, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৬৪)
৪. অভ্যন্তরীণ জিহাদ
প্রবৃত্তি ও সন্দেহের মোকাবিলা: ইয়াকিন অর্জনের জন্য দুটি স্তরে শয়তানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত জিহাদ বা সংগ্রাম করতে হয়:
সন্দেহ ও ওয়াসওয়াসার জিহাদ: ইয়াকিনকে দুর্বল করে দেয় এমন সব সন্দেহ ও কুচিন্তা (শুবহাত) থেকে নিজেকে দূরে রাখা। সন্দেহ সৃষ্টিকারী বই পড়া বা তাদের সঙ্গে বিতর্কে জড়ানো থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মন্দ প্রবৃত্তি ও আকাঙ্ক্ষার জিহাদ: ইবনে তাইমিয়ার মতে, ধৈর্য (সবর) ও ইয়াকিনের মাধ্যমেই দ্বীনের ইমামত লাভ করা যায়। ধৈর্য সব অবৈধ প্রবৃত্তি ও আকাঙ্ক্ষা (শাহওয়াত) দমন করে, আর ইয়াকিন সব সন্দেহ ও অস্পষ্টতা (শুবহাত) দূর করে। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৩৫৮)
৫. সৎকর্মে সুদৃঢ় সংকল্প
নেক আমল, যেমন তওবা, দান বা সাওম—এগুলো দৃঢ়সংকল্প নিয়ে করতে হবে, জাগতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে। যে ব্যক্তি কেবল লাভের চিন্তা করে নেক আমল থেকে বিরত থাকে, সে ইয়াকিন অর্জনে ব্যর্থ হয়। মুমিনের একমাত্র লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি।
৬. প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হওয়া
প্রবৃত্তি ও নফসের আকাঙ্ক্ষায় ডুবে থাকলে ইয়াকিন অর্জন করা অসম্ভব। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘তাকওয়ার মূল হলো নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে দূরে থাকা, আর এর মানে হলো নফস (প্রবৃত্তি) থেকে দূরে থাকা। প্রবৃত্তির সঙ্গ ছেড়ে দিলে ইয়াকিন অর্জিত হয়।’ (মাদারিজুস সালিকিন, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৩৯৯)
আরও পড়ুনইমান: শক্তি ও শান্তির রহস্য০২ অক্টোবর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রব ত ত র জন য সন দ হ আল ল হ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
একঘেয়ে পড়াশোনা থেকে মুক্তি: ‘উইক প্ল্যান’ পদ্ধতিতে মেলে সফলতা
১৯৯৪ সালে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা’ ধারণা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। তিন দশকের বেশি সময় পরও প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা এখনো জটিল একটি বিষয়।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এখনো নানা ধরনের বঞ্চনার মুখোমুখি হয়। অনেক সময় তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খুব কমই মিশতে পারে। সহায়ক কর্মী বা প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাওয়ার কারণে অনেকের শিক্ষাজীবনও সীমিত হয়ে যায়। এতে শিক্ষকেরা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যময় চাহিদা পূরণে হিমশিম খেয়ে যান।
‘বিকল্প শিখনপদ্ধতি’র শিকড়বিংশ শতাব্দীর শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্টেসরি (ইতালি), সেলেস্তাঁ ফ্রেনে (ফ্রান্স), পিটার পিটারসেন (জার্মানি) ও হেলেন পারখার্স্ট (যুক্তরাষ্ট্র) প্রবর্তিত শিক্ষা আন্দোলনগুলোই আধুনিক বিকল্প শিক্ষা মডেলের ভিত্তি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত, একঘেয়ে ও বর্জনমূলক শ্রেণিকক্ষ পদ্ধতির বিকল্প তৈরি করা, যেখানে শিশুর শেখার স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘গড় শিক্ষার্থী’ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রেণিকক্ষে বিকল্প শিখনপদ্ধতি প্রয়োগ করলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও শেখার মান বাড়ে। এটি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আরও পড়ুনকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে ব্রিটেনে কারিগরি শিক্ষার উত্থান০৬ ডিসেম্বর ২০২৫‘উইক প্ল্যান ওয়ার্ক’: শিক্ষার্থীর হাতে নিয়ন্ত্রণএই আন্দোলনগুলো থেকে বিকশিত একটি পদ্ধতি হলো ‘উইক প্ল্যান ওয়ার্ক’, যেখানে শিক্ষার্থীরা এক সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে। শিক্ষক (কখনো শিক্ষার্থীর সহযোগিতায়) সাপ্তাহিক পরিকল্পনা তৈরি করেন—যেখানে শেখার লক্ষ্য, করণীয় কাজ ও ধাপগুলো নির্ধারিত থাকে।
কানাডায় পরীক্ষামূলক প্রয়োগঅন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ এক গবেষক নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্স রিজিওনাল এডুকেশন সেন্টারের শিক্ষক হ্যারিয়েট জনস্টনের সঙ্গে মিলে নবম ও একাদশ শ্রেণির ইংরেজি ক্লাসে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।
প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সপ্তাহের শুরুতে একটি ফোল্ডার দেওয়া হয়, যেখানে নির্দিষ্ট কাজ ও কার্যক্রমের তালিকা থাকে। তারা নিজের মতো করে কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারে—এককভাবে বা দলগতভাবে। সপ্তাহ শেষে কাজ মূল্যায়ন ও আলোচনা হয়।
এই পদ্ধতিতে শিক্ষক সরাসরি পাঠদান কমিয়ে ‘কোচ’ বা ‘মেন্টর’-এর ভূমিকা পালন করেন। এতে শিক্ষক একান্ত সহায়তার প্রয়োজন এমন শিক্ষার্থীদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে পারেন।
ছবি: কবির হোসেন