Prothomalo:
2025-12-10@17:15:25 GMT

কুশিরোতে অচেনা উড়ন্ত জাহাজ

Published: 10th, December 2025 GMT

বউ টানা পাঁচ দিন টেলিভিশনের সামনে কাটায়। চেয়ে থাকে ভেঙে পড়া ব্যাংক আর হাসপাতালের দিকে, আগুনে পুড়ে যাওয়া পুরো ব্লকের দোকানপাট, ছিন্ন রেললাইন আর এক্সপ্রেসওয়ে পানে। তবে একটা কথাও বলে না। সোফার কুশনের গভীরে ডুবে, মুখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখে। কোমুরা কথা বললেও কোনো উত্তর দেয় না। না মাথা নাড়ে, না ঝাঁকায়। এমনকি কোমুরা যেসব কথা বলে তার শব্দ আদৌ বউয়ের কাছে পৌঁছায় কি না, তা কোমুরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারে না।

কোমুরার বউ অনেক উত্তরের দিকের ইয়ামাগাতা থেকে এসেছে এবং কোমুরা যত দূর জানে তাতে তার মনে হয়, বউয়ের এমন কোনো বন্ধু বা আত্মীয় নেই যারা কোবেতে ভূমিকম্পে আহত হতে পারে। তবু সে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টেলিভিশনের সামনে গেঁথে বসে থাকে। অন্তত কোমুরার উপস্থিতিতে বউ কিছু খায় না, কিছু পান করে না, এমনকি টয়লেটেও যায় না। মাঝে মাঝে চ্যানেল বদলে দেওয়ার জন্য রিমোট কন্ট্রোলটা সামান্য নেড়েচেড়ে দেখা ছাড়া সে প্রায় নড়াচড়াই করে না।

কোমুরা নিজে টোস্ট ও কফি বানিয়ে খেয়ে অফিসে চলে যায়। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ফ্রিজে যা পায়, তা দিয়ে নিজের জন্য একটু নাশতা তৈরি করে এবং একাই খেয়ে নেয়। আর যখন কোমুরার ঘুমোতে যায় তখনো দেখে তার বউ রাতের খবরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চারপাশে নিঃশব্দতার এক পাথরের দেয়াল গড়ে উঠেছে। তা ভাঙার চেষ্টাও করে না কোমুরা।

কিন্তু সেই রোববার, মানে ষষ্ঠ দিন, অফিস থেকে বাড়ি ফিরে কোমুরা দেখে—তার বউ উধাও।

কোমুরা টোকিওর আকিহাবারার ‘ইলেকট্রনিকস টাউন’-এ অবস্থিত সবচেয়ে পুরোনো হাই-ফাই যন্ত্রপাতির বিশেষায়িত দোকানগুলোর একটিতে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করে। সে দামি দামি পণ্য সামলায়, আর যখনই সে কোনো কিছু বিক্রি করে, তখনই মোটা কমিশন পায়। তার বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট ডাক্তার, স্বনির্ভর ধনী ব্যবসায়ী, আর প্রদেশের বিত্তশালী লোকজন। আট বছর ধরে সে এই কাজ করে আসছে এবং শুরুর দিক থেকেই তার আয় বেশ ভালো। অর্থনীতি তখন শক্তিশালী, রিয়েল এস্টেটের দাম বেড়ে চলছে, আর জাপান যেন টাকার স্রোতে ভাসছে। মানুষের মানিব্যাগ ১০ হাজার ইয়েনের নোটে ঠাসা, আর সবাই সেই টাকা খরচ করার জন্য মরিয়া। সবচেয়ে দামি জিনিসগুলোই তাই আগেভাগেই বিক্রি হয়ে যায়।

কোমুরা লম্বা, ছিপছিপে, আর রুচিশীল পোশাক পরা এক পুরুষ। মানুষের সঙ্গে তার ব্যবহারও ভালো। ব্যাচেলর থাকা অবস্থায় সে অনেক নারীর সঙ্গে ডেট করেছে। কিন্তু ২৬ বছর বয়সে বিয়ে করার পর তার যৌনক্রিয়ার আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ এবং রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়। পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে সে তার বউ ছাড়া আর কোনো মেয়ের সঙ্গে শোয়নি।

অবশ্য সুযোগ যে কখনো আসেনি, তা নয়—কিন্তু ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক বা এক রাতের সঙ্গের প্রতি তার আর কোনো আগ্রহ জাগেনি। সে বরং তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে স্ত্রীকে নিয়ে আরাম করে খাবার খেয়ে নিত। আর সোফায় বসে কিছুক্ষণ গল্প করে তারপর বিছানায় গিয়ে সঙ্গম করতে বেশি পছন্দ করত। এটাই ছিল তার একমাত্র চাওয়া।

তাই কোমুরার বৈবাহিক জীবন নিয়ে তার বন্ধু এবং সহকর্মীরা হতবাক হয়।

কোমুরা লম্বা, ছিপছিপে, আর রুচিশীল পোশাক পরা এক পুরুষ। ব্যাচেলর থাকা অবস্থায় সে অনেক নারীর সঙ্গে ডেট করেছে। কিন্তু ২৬ বছর বয়সে বিয়ে করার পর তার যৌনক্রিয়ার আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ এবং রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যায়।

পরিচ্ছন্ন, ক্ল্যাসিক সুদর্শন কোমুরার পাশে তার বউকে সাধারণের চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। তার হাত ছোট ও মোটা আর চেহারায় একধরনের বেদনাজনক নীরস ভাব। শুধু শারীরিকভাবেই সে এমন নয়, বরং তার ব্যক্তিত্বেও কোনো আকর্ষণ ধরা দেয় না। সে খুব কমই কথা বলে এবং সর্বদা কেমন যেন বিরক্ত, মৃদু এক ক্ষুদ্ধ ভাব নিয়ে থাকে।

তারপরও কোমুরা সব সময় অনুভব করে যে তার মানসিক চাপ কমে যায় যখন সে এবং তার বউ এক ছাদের তলায় একসাথে থাকে; এটি একমাত্র সময় যখন সে সত্যিই আরাম পায়। সে তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ঘুমায়, অতীতে যেসব অদ্ভুত স্বপ্ন তাকে কষ্ট দিয়েছিল, তা আর বিঘ্ন ঘটায় না। বরং তার যৌন উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে; তার যৌন জীবন উষ্ণ ও পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাই তার আর মৃত্যু ও যৌন সংক্রামক রোগের বা বিশাল মহাবিশ্বের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে চিন্তা করার দরকার হয় না।

অন্যদিকে তার বউ টোকিওর ভিড় একদমই পছন্দ করে না বরং ইয়ামাগাতায় ফিরে যেতে উদ্‌গ্রীব। সে তার বাবা–মা এবং দুই বড় বোনকে খুব ভালোবাসে। তাই মন চাইলে সে তাদের কাছে ছুটে যায়। তার বাবা–মা একটা হোটেল পরিচালনা করে। এ জন্য আর্থিকভাবে তারা বেশ সচ্ছল। তার বাবা ছোট মেয়েকে খুব ভালোবাসে এবং খুশিমনেই তার যাওয়া–আসার ভাড়া দেয়। একাধিকবার, কোমুরা অফিস থেকে ফিরে এসে দেখেছে যে তার বউ বাসায় নেই। আর রান্নাঘরের টেবিলে একটি নোট রাখা। তাতে লেখা যে বউ কিছুদিনের জন্য তার বাবা–মায়ের কাছে গেছে। এ নিয়ে কোমুরা কোনো দিন আপত্তি করেনি। বরং বউয়ের ফিরে আসার অপেক্ষা করেছে। আর সে ভালো মুড নিয়ে এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে ঠিকই ফিরে এসেছে।

কিন্তু ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পর এবার যে সে উধাও হয়েছে, তখন তার রেখে যাওয়া চিঠিটার ধরন একেবারে ভিন্ন। লিখেছে—‘আমি আর কখনো ফিরে আসব না।’ তারপর আবার সহজ কথায় কিন্তু স্পষ্টভাবে বলেছে যে কেন সে আর তার স্বামীর সঙ্গে একসাথে থাকতে চায় না।

সে লিখেছে, ‘সমস্যা হলো তুমি আমাকে কিছুই দাও না। আরও স্পষ্ট করে বললে, তোমার ভেতরে এমন কিছুই নেই, যা তুমি আমাকে দিতে পারো। তুমি ভালো, দয়ালু, সুদর্শন—কিন্তু তোমার সাথে থাকা মানে যেন একখণ্ড বাতাসের সাথে থাকা। অবশ্য পুরো দোষ তোমার নয়। অনেক নারীই তোমার প্রেমে পড়বে। কিন্তু দয়া করে আমাকে ফোন কোরো না। আমি যে জিনিসগুলো রেখে যাচ্ছি সেগুলো ফেলে দিয়ো।’

আসলে, সে তেমন কিছুই রেখে যায়নি। তার পোশাক, জুতা, ছাতা, কফির মগ, হেয়ার ড্রায়ার—সবই উধাও। নিশ্চয়ই সেগুলো সে সকালে কোমুরার অফিসে যাওয়ার পর বাক্সে গুছিয়ে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে। বাসায় ‘তার জিনিস’ বলে যা রয়ে গেছে, তা হলো বাজারে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা তার সাইকেল আর কয়েকটি বই। আর কোমুরা অবিবাহিত অবস্থায় বিটলস ও বিল ইভান্সের গানের যে সিডিগুলো সংগ্রহ করছিল, খোঁজাখুঁজি করে দেখে সেগুলোও অদৃশ্য।

পরদিন কোমুরা তার বউয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। তাই ইয়ামাগাতায় বউয়ের বাবা-মায়ের বাসায় ফোন দেয়। কিন্তু ফোনটা ধরে তার মা এবং সে জানায় যে কোমুরার সাথে তার বউ কথা বলতে চায় না। তবে তার মায়ের কথা বলার স্বর ছিল কিছুটা ক্ষমাপ্রার্থীর মতো। সে আরও জানায় যে শিগগিরই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হবে এবং তাতে সই-সাবুদ দিয়ে কোমুরা যেন সাথে সাথেই ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

জবাবে কোমুরা জানায়, হয়তো সে তা সাথে সাথেই পাঠাতে পারবে না। কারণ বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভেবে দেখার জন্য সে কিছু সময় চায়।

‘তুমি যদি চাও তাহলে এ নিয়ে ভেবে দেখতে পারো, তবে আমি জানি তাতে কিছুই পরিবর্তন হবে না,’ তার শাশুড়ি বলে।

‘সে হয়তো ঠিক বলেছে,’ কোমুরা নিজের মনে বলে। যতই ভাবি বা অপেক্ষা করি না কেন পরিস্থিতি আর আগের মতো হবে না বলে সে নিশ্চিত হয়।

ক্ল্যাসিক সুদর্শন কোমুরার পাশে তার বউকে সাধারণের চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। তার হাত ছোট ও মোটা আর চেহারায় একধরনের বেদনাজনক নীরস ভাব। শুধু শারীরিকভাবেই সে এমন নয়, বরং তার ব্যক্তিত্বেও কোনো আকর্ষণ ধরা দেয় না।

বউয়ের পাঠানো কাগজপত্রে সই-সাবুদ দিয়ে ফেরত পাঠানোর পরপরই কোমুরা বেতনসহ এক সপ্তাহের ছুটির আবেদন করে। ফলে তার বস কিছুটা বুঝতে পারেন যে একটা কিছু ঘটেছে। তবে এখন যেহেতু ফেব্রুয়ারি মাস, বছরের এ সময়টায় বেচাবিক্রিতে মন্দা যায়, তাই তিনি এতটুকু বিরক্ত প্রকাশ না করেই কোমুরাকে ছুটি দিয়ে দেন। এমনকি তিনি কোমুরাকে কিছু বলার উদ্যোগ নেন, তবে শেষ অবধি কিছু বলেন না।

সহকর্মী সাসাকি দুপুরের খাবারের সময় কোমুরার কাছে এসে বলে, ‘শুনেছি তুমি ছুটি নিয়েছ। কিছু করার প্ল্যান আছে?’

‘বুঝতে পারছি না এখন আমার কী করা উচিত?’ কোমুরা বলে।

কোমুরার থেকে তিন বছর ছোট সাসাকি অবিবাহিত। কোমল তার দেহের গঠন এবং চুল ছোট করে ছাঁটা। আর সে গোল্ড-রিমের সোনালি চশমা পরে। অনেকেই মনে করে সে বেশি কথার লোক এবং স্বভাবেও কিছুটা অহংকারী, তবে সহজ–সরল কোমুরার সাথে সাসাকির সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই।

‘ছুটি যেহেতু নিয়েছ, তাহলে ভালো একটা ট্রিপ করে নাও না কেন?’

‘কথাটা মন্দ বলোনি।’ কোমুরা বলে।

হ্যান্ডকর্চিফ দিয়ে চশমা মুছে, সাসাকি কোমুরার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন কোনো ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছে।

‘তুমি কি কখনো হোক্কাইডো গিয়েছ?’সে জিজ্ঞেস করে।

‘না, যাইনি তো কখনো।’

‘তাহলে কি যেতে চাও?’

‘কেন জিজ্ঞেস করছ?’

সাসাকি চোখ ছোট করে তাকায়। শেষে গলায় কাশি দিয়ে বলে, ‘সত্য বলতে, আমার একটা ছোট প্যাকেট কুশিরোতে পাঠাতে হবে। তুমি যদি সেটা নিয়ে যাও তাহলে আমার ভীষণ উপকার হয়। এ জন্য আমি যাওয়া-আসার টিকিটের খরচ দিতেও রাজি। চাইলে কুশিরোতে তোমার হোটেলের খরচ দিতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।’

‘ছোট প্যাকেট?’

‘এ রকম আরকি,’ বলে সাসাকি তার হাত দিয়ে চার ইঞ্চি আকারের একটা বক্স তৈরি করে দেখায়। ‘ভারী কোনো কিছু নয়।’

‘অফিসের কোনো কিছু?’

সাসাকি মাথা নেড়ে বলে ‘অফিসের কিছু নয়, বরং এটা একেবারেই ব্যক্তিগত একটা জিনিস। আমি চাই না যে এটার সাথে কোনো কিছুর ধাক্কা লাগুক। এ জন্য ডাকে পাঠাতে পারছি না। তাই তুমি নিজে হাতে করে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিলে সবচেয়ে ভালো হয়। আমি নিজেই করতে পারতাম, কিন্তু হোক্কাইডো অবধি যাওয়ার সময় আমার নেই।’

‘এটা কি গুরুত্বপূর্ণ কোনো জিনিস?’

মুখ বন্ধ রেখে হালকা হেসে সাসাকি মাথা নাড়ে—‘না, এটা ভঙ্গুর কিছু নয়। এতে কোনো ক্ষতিকারকও কিছু নেই। চিন্তা করো না। বিমানবন্দরে এক্স-রে করলে তারা তোমাকে আটকাবে না। আমি নিশ্চিত করে বলছি, এটা তোমাকে কোনো সমস্যায় ফেলবে না। আর ওজন তো প্রায় শূন্যের কোঠায়। আমি শুধু চাই তুমি এটাকে অন্য কোনো জিনিসের মতোই সাথে নিয়ে যাও। আমি ডাকে পাঠাতে চাচ্ছি না, কারণ তাতে পাঠানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই।’

কোমুরা জানে, এখন ফেব্রুয়ারিতে হোক্কাইডোয় খুবই শীত। কিন্তু তার কাছে শীত বা গরম সবই এখন সমান।

‘তাহলে প্যাকেটটা কাকে দিতে হবে?’

‘আমার বোনকে। ছোট বোন। সে সেখানে থাকে।’

এবার কোমুরা সাসাকির কথায় রাজি হয়। সে এক সপ্তাহের ছুটি কীভাবে কাটাবে, তা নিয়ে তার কোনো ভাবনা ছিল না। এ নিয়ে কোনো প্ল্যান করাও তার কাছে অতিরিক্ত ঝামেলার কাজ বলে মনে হয়। তা ছাড়া হোক্কাইডো যেতে না চাওয়ার কোনো কারণও তার কাছে ছিল না।

কিন্তু ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পর এবার যে সে উধাও হয়েছে, তখন তার রেখে যাওয়া চিঠিটার ধরন একেবারে ভিন্ন। লিখেছে—‘আমি আর কখনো ফিরে আসব না।’ স্পষ্টভাবে বলেছে যে কেন সে আর তার স্বামীর সঙ্গে একসাথে থাকতে চায় না।

তাই সাসাকি এবার এয়ারলাইনসে ফোন করে কুশিরো যাওয়ারএকটা টিকিট বুক করে। দুই দিন পর বিকেলে সে ফ্লাইট ছাড়বে।

সাসাকি পরদিন অফিসে কোমুরার হাতে একটা বাক্স দেয়। মানবদেহের ভস্ম বহনের জন্য যে রকম ছোট বাক্স ব্যবহার করা হয়, আকারে সে রকম। তা আবার ম্যানিলা কাগজে মোড়ানো। হাতে নিয়ে সহজেই বোঝায় যায় যে সেটা কাঠের তৈরি। সাসাকি আগেই যেমন বলেছে সে রকমই ওজন প্রায় শূন্যের কোঠায়। কাগজের ওপর সারা বাক্সের চারপাশে প্রশস্ত সাদা টেপ লাগানো। কোমুরা তা হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড ধরে বোঝার চেষ্টা করে যে ভেতরে কী আছে। এমনকি নেড়েচেড়েও দেখে, কিন্তু ভেতরে কিছুর নড়াচড়া করার শব্দ শুনতে পায় না।

‘আমার বোন তোমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসবে। আর সে তোমার থাকার জন্য হোটেলে রুমেরও ব্যবস্থা করে দেবে,’ সাসাকি বলে চলে ‘তুমি কেবল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে প্যাকেটটা হাতে ধরবে, তাহলেই সে তোমাকে চিনে ফেলবে। চিন্তার কিছু নাই ওখানকার এয়ারপোর্টটা খুব বেশি বড় নয়।’

যাত্রার দিন কোমুরা বাক্সটাকে একটা শার্ট দিয়ে মুড়িয়ে তার স্যুটকেসের ভেতর গুঁজে দেয়। বিমানে উঠে দেখে সে যতটা আশা করেছিল তার চেয়ে তাতে অনেক বেশি ভিড়। তাই সে অবাক হয়ে মনে মনে প্রশ্ন করে—‘এই শীতের মধ্যে এত মানুষ কেন টোকিও থেকে কুশিরো যাচ্ছে?’

বিমান ছাড়ার পর সকালের পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখে ভূমিকম্পের খবর দিয়ে তা ভরা। সে বিমানে বসেই পত্রিকারে আগামুড়া পড়ে ফেলে। ফলে বুঝতে পারে যে, মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। অনেক এলাকা এখনো পানি বা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে আছে। অগণিত মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিটি রিপোর্টেই নতুন কোনো বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোমুরার কাছে সে রিপোর্টগুলোকে কেমন যেন অগভীর মনে হয়। সব শব্দ তার কাছে দূরবর্তী, একরকম একঘেয়ে হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র যে বিষয়টির প্রতি সে সত্যিই মনোযোগ দিতে পারে, তা হলো তার বউ। তবে মনে হয় সে যেন ক্রমেই আরও দূরে সরে যাচ্ছে।

তারপরও সে যান্ত্রিকভাবে ভূমিকম্পের খবরের ওপর চোখ বুলিয়ে যায়। মাঝে মাঝে থেমে তার বউয়ের কথা ভাবে। তারপর আবার পত্রিকার পাতায় ফিরে যায়। এভাবে করতে করতে শেষে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন আবার চোখ বন্ধ করে সামান্য ঘুমিয়ে নেয়। আর ঘুম থেকে ওঠার পর আবারও তার বউকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে—হায়! বউ কেন সকাল থেকে রাত অবধি না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কেবল টিভিতে ভূমিকম্পের খবর এত আগ্রহের সাথে দেখত? তার ভেতরে সে কী দেখতে পেত?

বিমান থেকে নামার পর প্রায় একই ধরনের রং ও নকশাওয়ালা ওভারকোট পরা দুজন তরুণী এয়ারপোর্টে কোমুরার দিকে এগিয়ে আসে। একজনের গায়ের রং উজ্জ্বল, প্রায় পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা, তবে চুল ছোট করে কাটা। নাক থেকে ওপরের পুরু ঠোঁট অবধি অংশটুকু অদ্ভুতভাবে কিছুটা এগিয়ে। তা দেখে কোমুরার স্বল্প-লোমযুক্ত তৃণভোজী প্রাণীর কথা মনে পড়ে। আর তার সঙ্গিনী প্রায় পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি লম্বা। নাক এতটা ছোট না হলে তাকে বেশ সুন্দরই মনে হতো। তার লম্বা চুল সোজা কাঁধ অবধি নেমে গেছে। কান দুটো খোলা, আর ডান কানের লতিতে পাশাপাশি দুটি তিল একনজরেই চোখে পড়ে। কানে পরা দুলের কারণে তা স্পষ্ট হয়ে আছে। দুজনেরই বয়স মাঝকুড়ির কোঠায় বলে মনে হয়। তারা কোমুরাকে বিমানবন্দরের একটি ক্যাফেতে নিয়ে যায়।

‘আমি কেইকো সাসাকি।’ লম্বা মেয়েটা বলে। ‘আমার ভাই আমাকে বলেছে, তুমি তাকে অনেক সাহায্য করেছে। এ হলো আমার বন্ধু, শিমাও।’

‘তোমাকে দেখে ভালো লাগল,’ কোমুরা বলে।

জবাবে শিমাও ‘হাই,’ বলে।

‘আমার ভাই বলেছে, তোমার বউ কিছুদিন আগে মারা গেছে’ সম্মানসূচক ভঙ্গিতে বলে কেইকো সাসাকি।

কোমুরা উত্তর দেওয়ার আগে একটু থামে। তারপর বলে, ‘না, সে মারা যায়নি।’

‘পরশুদিনই তো ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। সে খুব স্পষ্ট করেই বলেছে যে তুমি তোমার বউ হারিয়েছ।’

‘হ্যাঁ, হারিয়েছি। কারণ সে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। তবে যত দূর জানি, সে বেঁচেই আছে এবং ভালোই আছে।’

‘এটা অদ্ভুত। আমি এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভুল শুনতে পারি না।’ সে কোমুরার পানে বেদনাভরা চোখে তাকায়। তবে কোমুরা কোনো কথা না বলে নিজের কফিতে সামান্য চিনি নিয়ে হালকাভাবে নেড়ে একটা চুমুক দেয়। পাতলা কফিটায় বিশেষ কোনো স্বাদ পায় না। তারপরও খেতে হবে বলে খেয়ে যায়। আর ভাবে—হায়! এখানে আমি কী করছি?

‘মনে হয়, আমি সত্যিই ভুল শুনেছি। এ ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা নেই,’ কেইকো সাসাকি বলে। স্পষ্টতই এখন সন্তুষ্ট। শেষে সে গভীর নিশ্বাস নেয় এবং নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘প্লিজ! কিছু মনে করবে না। খুবই অভদ্র কথা বলে ফেলেছি।’

‘চিন্তা করার কিছু নেই। কোনো না কোনোভাবে, সে তো চলেই গেছে।’

বউয়ের পাঠানো কাগজপত্রে সই-সাবুদ দিয়ে ফেরত পাঠানোর পরপরই কোমুরা বেতনসহ এক সপ্তাহের ছুটির আবেদন করে। তার বস কিছুটা বুঝতে পারেন যে একটা কিছু ঘটেছে। তাই এতটুকু বিরক্ত প্রকাশ না করেই কোমুরাকে ছুটি দিয়ে দেন।

কোমুরা এবং কেইকোর এসব কথা বলার সময় শিমাও চুপ করেছিল, কোনো কথা বলেনি তবে কোমুরার পানে তাকিয়ে হাসছিল। ফলে কোমুরা বুঝতে পারে, তাকে শিমাওয়ের পছন্দ হয়েছে। তার মুখ এবং শরীরের ভাবভঙ্গিতে সবকিছু ক্লিয়ার। তখন তিনজনের মাঝে কিছু সময়ের জন্য নীরবতা নেমে আসে।

‘যা–ই হোক, আমি তোমার জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ প্যাকেট নিয়ে এসেছি। সেটা এখন দিয়ে দিই।’ বলে কোমুরা তার স্যুটকেসের জিপ খুলে মোটা কাপড়ে বানানো একটা শার্টে মোড়ানো বাক্সটা বের করে বাড়িয়ে ধরে। তখন তার মনে হয়—আরে! প্লেন থেকে নেমে আসার সময় আমার তো এইটা হাতে রাখার কথা ছিল। এটা দেখেই তো আমাকে এদের চেনার কথা। তাহলে তা না করার পরও এরা আমাকে চিনল কীভাবে?

কেইকো সাসাকি টেবিলের ওপর হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নেয়। তারপর অনুভূতিহীন চোখে প্যাকটটার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ওজন পরীক্ষা করার পর কোমুরার মতো বাক্সটা কানের কাছে নিয়ে একটু নাড়ায়। এরপর কোমুরার পানে তাকিয়ে হালকা এক হাসি দিয়ে যেন বোঝায় যে সব ঠিক আছে। শেষে বাক্সটা তার বড় কাঁধের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়।

‘আমাকে একটা ফোন করতে হবে,’ সে বলে। ‘তাই একটু ওদিকে যেতে চাই?’

‘কোনো সমস্যা নেই, যাও।’ কোমুরা বলে।

কেইকো ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দূরের একটি টেলিফোন বুথের দিকে চলে যায়। কোমুরা তার হাঁটার ধরন লক্ষ করে। দেখে তার শরীরের ওপরের অংশ স্থির, কিন্তু কোমর থেকে নিচের অংশ বড়, মসৃণ এবং যান্ত্রিক ধরনের নড়াচড়া করে। কোমুরার অদ্ভুত মনে হয় যেন সে অতীতের কোনো দৃশ্যই দেখছে। যা হঠাৎ করে বর্তমানের সাথে মিশে গেছে।

‘তুমি কি আগে কখনো হোক্কাইডো গিয়েছ?’ শিমাও জিজ্ঞেস করে।

কোমুরা মাথা নাড়ে।

‘হ্যাঁ, অনেক দূরের পথ তাই নাহ?’

কোমুরা আবার মাথা নাড়ে, তারপর তার চারপাশ দেখে।

‘মজার ব্যাপার,’ সে বলে, ‘এভাবে এখানে বসে থাকলে মনে হয় না আমি এত দূরে এসেছি।’

‘কারণ, তুমি উড়ে এসেছ। ওই প্লেনগুলো অতটা দ্রুত যে তোমার মন তোমার দেহের সাথে তাল মেলাতে পারে না।’

‘তুমি ঠিকই বলছ।’

‘তুমি কি এত দীর্ঘ ভ্রমণ করতে চেয়েছিলে?’

‘হয়তোবা চেয়েছিলাম’ কোমুরা বলে।

‘কারণ, তোমার বউ চলে গেছে?’

কোমুরা মাথা নাড়ে।

‘তবে তুমি যতই দূরে যাও না কেন, নিজের থেকে কখনো তুমি পালাতে পারো না,’ শিমাও বলে।

শিমাওয়ের এ কথা বলার আগে কোমুরা টেবিলে রাখা চিনির বাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু শিমাওয়ের কথা শুনে তার পানে চোখ তুলে কোমুরা তাকায়।

‘হ্যাঁ তা সত্য,’ সে বলে। ‘তুমি যতই দূরে যাও, তুমি নিজের থেকে কখনো পালাতে পারো না। তা তোমার ছায়ার মতো। সর্বদা তোমার সাথে রয়ে যায়।’

শিমাও এবার কোমুরার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আমি বাজি ধরে বলছি, তুমি তাকে ভালোবাসতে, তাই না?’

কোমুরা প্রশ্নটি এড়াতেই যেন অন্য প্রসঙ্গ তোলে—‘তুমি কেইকো সাসাকির বন্ধু?’

‘হ্যাঁ। আমরা একসঙ্গে কিছু কাজ করি।’

‘কী কাজ?’

উত্তর না দিয়ে শিমাও জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার ক্ষুধা লেগেছে?’

‘জানি না,’ কোমুরা বলে। ‘কিছুটা ক্ষুধা লাগছে, কিছুটা না।’

‘চলো, আমরা তিনজন গরম কিছু খাই। তা তোমাকে শান্ত করে তুলবে।’

সবাই মিলে তখন একটা চার চাকার ছোট সুবারু গাড়িতে গিয়ে ওঠে। শিমাও গাড়িটা চালায়। সেটা কতটা পুরোনো, তা বোঝা যাচ্ছিল তার ঘন ঘন ঝাঁকি খাওয়ায়। পেছনের বাম্পারে বড় একটি ঢেউ পড়ে গেছে। কেইকো সাসাকি বসেছে শিমাওর পাশের সিটে আর কোমুরা পেছনের চিপাচাপা সিটটায় একাই। শিমাও ভালোই চালায়, কিন্তু পেছনে শব্দ ভীষণ ওঠে। সাসপেনশন প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। অটোমেটিক ট্রান্সমিশন যখন নিচে নামায় তখন জোরে জোরে গিয়ারে ঢুকে যায়, এবং হিটার কখনো গরম, কখনো ঠান্ডা বাতাস বের করে দেয়। তাই কোমুরার মনে হয় সে যেন কোনো ধোঁয়ার মেশিনে বন্দী হয়ে আছে। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

কুশিরোতে রাস্তায় কোথাও বরফ জমা নেই ঠিকই তবে রাস্তার দুধারে এলোমেলোভাবে নোঙরা, বরফে জমাট ছোট ছোট ঢিবি পড়ে আছে। আকাশে ঘন মেঘ নিচু হয়ে ঝুলে থাকায়, এখনো সূর্যাস্ত না হলেও চারপাশ যেন অন্ধকার আর নির্জন। তার মাঝে বাতাস শহরজুড়ে তীক্ষ্ণ শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে ছুটে বেড়ায়। রাস্তায় কোনো পথচারী দেখা যায় না। এমনকি নিস্তব্ধ জিনিসের মতো ট্রাফিক সিগন্যালগুলোও যেন জমে গেছে।

‘হোক্কাইডোর এই অংশে তেমন তুষার পড়ে না,’ কোইকো সাসাকি জোরে বলে। তারপর কোমুরার দিকে একবার ফিরে তাকায়। ‘আমরা এখন উপকূলীয় এলাকায় তাই বাতাসে এত জোর। বরফ যতটুকু জমে তার সবটুকুই উড়ে যায়। তবে শীত কিন্তু ভয়ানক—হাড়কাঁপানো শীত। কখনো কখনো মনে হয় যেন কানটাই ছিঁড়ে যাচ্ছে।’

‘মাতাল লোকজন রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়ে জমে মরে যাওয়ার কথাও মাঝে মাঝে শোনা যায়,’ শিমাও বলে।

‘এখানে কি ভালুক-টালুক দেখা যায়?’ কোমুরা জিজ্ঞেস করে।

কেইকো খিলখিল করে হেসে ঘাড় ঘুরায়ে শিমাওয়ের দিকে তাকায়, ‘শোনো, ভালুকের কথা জিজ্ঞেস করছে।’

শিমাও-ও একইভাবে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

‘হোক্কাইডো সম্পর্কে আমার খুব বেশি জানা নেই,’ কোমুরা ব্যাখ্যা করে বলে।

‘আমার কিন্তু ভালুক নিয়ে দারুণ একটা গল্প জানা আছে,’ কেইকো বলে। ‘ঠিক তো, শিমাও?’

‘চমৎকার গল্প!’ শিমাও সায় দেয়।

কিন্তু ঠিক তখনই তাদের কথাবার্তা থেমে যায়, আর তাদের কেউই আর সেই ভালুকের গল্পটা বলে না। কোমুরাও শুনতে চায় না। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা গন্তব্যে পৌঁছে যায়। সেটা হাইওয়ের ধারে বড় একটা নুডলসের দোকান। গাড়িটা পার্কিং লটে রেখে তারা ভেতরে ঢোকে।

কোমুরা এক বোতল বিয়ার আর ধোঁয়া ওঠা গরম রামেন খায়। দোকানটা নোংরা আর ফাঁকা, চেয়ার-টেবিলও নড়বড়ে, কিন্তু রামেনটা কোমুরার মুখে অসাধারণ সুস্বাদু লাগে। আর খাওয়া শেষে সে নিজেই বুঝতে পারে যে তার আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তি ফিরে এসেছে।

‘ভালোই লাগবে তোমার। জায়গাটা খুব সুন্দর। কোনো ভালুক-টালুকও নেই।’ দুই নারী একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে ওঠে। ‘তোমার বউ সম্পর্কে একটু জানতে চাইলে তুমি কি কিছু মনে করবে?’ কেইকো জিজ্ঞেস করে।

‘বলুন তো, মিস্টার কোমুরা,’ কেইকো সাসাকি বলে, ‘হোক্কাইডোতে এমন কোনো জায়গা কি আছে, যেখানে তুমি যেতে চাও? আমার ভাই বলেছে, তুমি নাকি এখানে পুরো এক সপ্তাহ থাকবে।’

কোমুরা কিছুক্ষণ ভেবে দেখে, কিন্তু বিশেষ কিছুই তার মনে পড়ে না।

‘হট স্প্রিং কেমন হবে? গরম পানির টবে আরামে ডুব দিয়ে থাকবে? এখান থেকে বেশি দূরে নয়, একটা গ্রামের মতো জায়গায় ভালো ব্যবস্থা আছে।’

‘মন্দ না,’ কোমুরা বলে।

‘ভালোই লাগবে তোমার। জায়গাটা খুব সুন্দর। কোনো ভালুক-টালুকও নেই।’

দুই নারী একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে ওঠে।

‘তোমার বউ সম্পর্কে একটু জানতে চাইলে তুমি কি কিছু মনে করবে?’ কেইকো জিজ্ঞেস করে।

‘না, কিছু মনে করব না,’ কোমুরা জবাব দেয়।

‘সে কবে চলে গেছে?’

‘হুম… ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পর। মানে এখন থেকে দুই সপ্তাহের একটু আগে।’

‘ভূমিকম্পের সাথে তার চলে যাওয়ার কি কোনো সম্পর্ক ছিল?’

কোমুরা মাথা নেড়ে বলে, ‘সম্ভবত না। আমার তো তা মনে হয় না।’

‘তারপরও—এসব বিষয় হয়তো কোনোভাবে পরস্পরের সাথে জড়িয়ে থাকে,’ মাথা কাত করে বলে শিমাও।

‘হ্যাঁ,’ কোইকো বলে। ‘শুধু ব্যাপারটা ধরা যায় না।’

‘ঠিক তাই,’ শিমাও যোগ করে। ‘এমন ঘটনা সব সময়ই ঘটে।’

‘কী ধরনের ঘটনা?’ কোমুরা জিজ্ঞেস করে।

‘মানে, ধরো—যে লোকটাকে আমি চিনি তার সাথে যা ঘটেছে,’ কোইকো বলে।

‘তুমি কি সায়েকি সানের কথা বলছ?’ শিমাও জিজ্ঞেস করে।

‘ঠিক তাই,’ কেইকো বলে। ‘সায়েকি নামের এক লোক আছে। সে কুশিরোতে থাকে। তার বয়স প্রায় চল্লিশ। সে একজন হেয়ারস্টাইলিস্ট। তার বউ গত বছর, শরতে, একটি ইউএফও বা অচেনা উড়ন্ত জাহাজ দেখে। সে রাতে একা শহরের পাড়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় একটা বিশাল অচেনা উড়ন্ত জাহাজকে একটা মাঠে অবতরণ করতে দেখতে পায়। ঠিক ‘ক্লোজ এনকাউন্টারস’ সিনেমার মতো। এটা দেখার এক সপ্তাহের মধ্যে বউ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তাদের কোনো পারিবারিক সমস্যা ছিল না বা কোনো ঝগড়াঝাঁটিও হয়নি। সে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। আর কখনো ফিরে আসেনি।’

‘পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়?’ শিমাও বললে।

‘তা কি ইউএফওর কারণে হয়?’ কোমুরা জিজ্ঞেস করে।

‘আমি জানি না কেন,’ কোইকো বলে। ‘সে হঠাৎ চলে যায়। কোনো চিঠি বা কিছুই দেয় না। তার প্রাইমারি স্কুলে পড়ুয়া দুটো বাচ্চাও আছে। সে যাওয়ার আগের পুরো সপ্তাহটা, সে শুধু মানুষকে অচেনা উড়ন্ত জাহাজের কথা বলেছে। তাকে থামানো যায়নি। সে বারবার বলেছে যে সেটা অনেক বড় ও সুন্দর।’

গল্পটা যাতে সবাই বুঝতে পারে সে জন্য কেইকো একটু থামে।

‘আমার বউ একটা চিঠি রেখে গেছে,’ কোমুরা বলে। ‘আর আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই।’

‘তাহলে তোমার অবস্থা সায়েকির চেয়ে একটু ভালো,’ কেইকো বলে।

‘হ্যাঁ। ছেলেমেয়েদের কারণে পরিস্থিতি অনেক সময় অন্য রকম হয়।’ মাথা নেড়ে শিমাও বলে।

‘শিমাওর বাবা তখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় যখন শিমাও সাত বছর বয়সী ছিল,’ কেইকো কণ্ঠে বেদনা নিয়ে বলে। ‘নিজের বউয়ের ছোট বোনের সাথে পালিয়ে যায়।’

‘একদিন একেবারে হঠাৎ করে সে চলে যায়,’ শিমাও হাসি দিয়ে বলে।

এবার তাদের মাঝে একটা নীরবতা নেমে আসে।

‘সায়েকির বউ হয়তো পালিয়ে যায়নি, বরং অচেনা উড়ন্ত জাহাজ-এর এলিয়েনরা হাতে ধরে নিয়ে গেছে,’ বিষয়টাকে হালকা করার জন্য কোমুরা বলে।

‘হতে পারে,’ শিমাও গম্ভীর মুখে বলে। ‘এ রকম গল্প তো সব সময়ই শোনা যায়।’

‘মানে সেই—তুমি রাস্তায় হাঁটছ আর হঠাৎ একটা ভালুক এসে তোমাকে খেয়ে ফেলল—এই ধরনের গল্প?’ কেইকো জিজ্ঞেস করে। দুই মহিলা আবার হেসে ওঠে।

সে হঠাৎ চলে যায়। কোনো চিঠি বা কিছুই দেয় না। তার প্রাইমারি স্কুলে পড়ুয়া দুটো বাচ্চাও আছে। সে যাওয়ার আগের পুরো সপ্তাহটা, সে শুধু মানুষকে অচেনা উড়ন্ত জাহাজের কথা বলেছে। সে বারবার বলেছে যে সেটা অনেক বড় ও সুন্দর।

তিনজনই নুডলসের দোকান থেকে বের হয়ে কাছের একটা ‘লাভ হোটেলে’ (কয়েক ঘণ্টা বা রাতের জন্য ভাড়া দেয় এমন হোটেল) যায়। শহরের সীমানায়, এমন এক রাস্তায় হোটেলটা যেখানে আরও অনেকগুলো লাভ হোটেল সার দিয়ে আর সমাধিফলক বিক্রির দোকান পালা করে দাঁড়ানো। তাদের ভেতর থেকে শিমাও যে হোটেলটা পছন্দ করে সেটা বেশ অদ্ভুত—একেবারে ইউরোপীয় কেল্লার মতো বানানো। তার সবচেয়ে উঁচু টাওয়ারে লাল রঙের ত্রিভুজাকৃতি একটি পতাকা ওড়ানো।

হোটেলের ফ্রন্টডেস্ক থেকে কেইকো চাবি নেয়। তারপর আর তিনজন মিলে লিফটে চড়ে রুমে যায়। তার বিশাল বড় বেডের তুলনায় জানালাগুলো অবিশ্বাস্য রকম ছোট। কোমুরা তার নরম পালক ভরাজ্যাকেটটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে।

সে বাথরুমে যে কয়েক মিনিট থাকে তার ভেতরে দুই মেয়ে মিলেমিশে গোসলের পানি ছেড়ে দেয়, আলো কমিয়ে ফেলে, হিটার ঠিক আছে কি না তা দেখে নেয়, টেলিভিশন চালু করে, স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলোর ডেলিভারি মেনু উল্টেপাল্টে দেখে, বিছানার মাথার দিকের লাইট সুইচগুলো পরীক্ষা করে, আর মিনিবারে কী আছে তা–ও দেখে নেয়।

‘আমার বন্ধুরা এ হোটেলের মালিক,’ কেইকো বলে। ‘আমি তাদের বলেছি, তাদের সবচেয়ে বড় রুমটা দিতে। এটা একটি লাভ হোটেল বটে তবে সেটা কোনো ব্যাপার না। তোমার তো কোনো সমস্যা নাই, তাই না?’

‘একদম না,’ কোমুরা বলে।

‘আমার মনে হয় স্টেশনের কাছে কোনো সস্তা বিজনেস হোটেলের ছোট, চিপাচাপা রুমের বদলে এটা অনেক বেশি ভালো হবে।’

‘ঠিক বলছ,’ কোমুরা বলে।

‘স্নান করবে না? টবে পানি ভরে দিয়েছি।’

যেমনি বলা অমনি কোমুরা বাথরুমে ঢুকে যায়। তার টবটা খুব বড়। একা সেখানে ভিজতে ভিজতে সে অস্বস্তি বোধ করে। কারণ, এই হোটেলে যারা আসে, তারা সাধারণত দুজন একসাথে গোসল করে।

কিন্তু বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর কোমুরা অবাক হয়ে দেখে কেইকো সাসাকি নাই। চলে গেছে। তবে শিমাও এখনো আছে। বিয়ার খেতে খেতে সে টিভি দেখছে।

‘কেইকো বাসায় চলে গেছে,’ শিমাও বলে। ‘এ জন্য ক্ষমা চেয়েছে। আর তোমাকে বলতে বলে গেছে যে সে কাল সকালে ফিরে আসবে। আমি কি একটু সময় এখানে বসে বিয়ার খেলে কি তোমার কোনো সমস্যা হবে?’

‘না, ঠিক আছে,’ কোমুরা বলে।

‘তুমি শিওর, এতে কোনো সমস্যা নেই? মানে, তুমি একা থাকতে চাও, নাকি অন্য কেউ থাকলে স্বস্তি পাবে না তেমন কিছু না তো।’

কোমুরা জোর দিয়ে বলে যে তার কোনো সমস্যা নেই। সে একটা বিয়ার খেতে খেতে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে শিমাওর সাথে টিভি দেখতে বসে যায়। টিভিতে কোবে ভূমিকম্পের ওপর একটা বিশেষ অনুষ্ঠান চলে। সাধারণ চিত্রগুলো বারবার দেখায়—ভেঙে পড়া ভবন, ভাঁজ হওয়া রাস্তা, কাঁদতে থাকা বৃদ্ধাদের চেহারা, হতভম্ব এবং উদ্দেশ্যহীন তাদের ক্রোধ। যখন বিজ্ঞাপন শুরু হয়, শিমাও রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে দেয়।

‘চলো, গল্প করি,’ সে বলে, ‘যতক্ষণ আমরা এখানে আছি।’

‘ঠিক আছে,’ কোমুরা বলে।

‘হুম, আমরা কী নিয়ে গল্প করব?’

‘গাড়িতে, তুমি আর কেইকো কিছু বলেছিলে ভালুক নিয়ে, মনে আছে? তুমি বলেছিলে এটা একটা দারুণ গল্প।’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে,’ সে মাথা নেড়ে বলে। ‘ভালুকের গল্প।’

‘সেটা বলো?’

‘অবশ্যই, কেন না?’

শিমাও মিনিবার থেকে নতুন একটা বিয়ার নিয়ে দুজনেরই গ্লাস ভর্তি করে দেয়।

‘এটা একটু অশ্লীল,’ সে বলে। ‘তোমার কোনো অসুবিধা হবে না তো?’

কোমুরা মাথা নাড়ে।

‘কিছু মানুষ মেয়েদের কাছ থেকে যে ধরনের গল্প পছন্দ করে না সে রকম।’

‘আমি তেমন নই।’

‘গল্পটা এমন কিছু যা আসলে আমার সাথে ঘটেছিল, তাই এটা একটু লজ্জাজনক।’

‘যদি তোমার কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আমি শুনতে চাই।’

‘যদি তোমার কোনো সমস্যা না হয় তাহলে আমিও ঠিক আছি।’

‘আমার কোনো সমস্যা নাই,’ কোমুরা বলে।

‘বছর তিনেক আগে—যখন আমি জুনিয়র কলেজে ভর্তি হই—তখন এক ছেলের সাথে ডেট করি। সে আমার চেয়ে এক বছর বড়, কলেজের ছাত্র। আমার প্রথম সঙ্গী। একদিন আমরা দুজন পাহাড়ে চড়তে উত্তরের দিকে অনেক দূরে যাই।’

সে বিয়ারে একটা চুমুক দেয়।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উড়ন ত জ হ জ ভ ম কম প র জ জ ঞ স কর শ ম ও বল ত ম র বউ পর ক ম র ত রপরও স ন দর র গল প র আগ র অন ক ব ত র বউ র র পর র জন য আম র ভ এ জন য আম র ব আম র ক র বন ধ মন ক ছ র ভ তর এক ব র দ ন পর কর র প ধরন র ত রপর এমন ক র ওপর র বয়স র একট র কখন র সময় তখন ত অবস থ সবচ য় একস থ সমস য বউয় র র খবর

এছাড়াও পড়ুন:

আট দশক পর দেশের মাটিতে ফিরে যাওয়া

জাপানের টোকিওর নগরকেন্দ্রের ব্যস্ত এক জায়গাজুড়ে আছে বিতর্কিত একটি শিন্তো মন্দির। জাপানে যেটা ইয়াসুকুনি মন্দির নামে পরিচিত। ১৮৬৯ সালে যাত্রা শুরু করা শিন্তো ধর্মের এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল মূলত এক বছর আগে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক জাপানের ভিত্তি তৈরি করে নেওয়া মেইজি পুনরুত্থানের সময় গৃহযুদ্ধে নিহত বিজয়ী পক্ষের সৈন্যদের ‘দেবতুল্য’ ভাবমূর্তি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে। ফলে বিজয়ী পক্ষের নিহত সব সৈনিকের নাম সেখানে দেবতার সারিতে সন্নিবেশিত আছে, পরাজিতদের নয়।

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়ার বিনিময়ে পাওয়া এ রকম প্রতিদানের মধ্যে বিতর্কের কিছু থাকার কথা নয়। দীর্ঘকাল ধরে এটা নিয়ে কোনো রকম বিতর্কও ছিল না। তবে সেই হিসাব পাল্টে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সর্বোচ্চ সাজা পাওয়া জাপানের সেই সময়ের কয়েকজন নেতাকে ১৯৭০–এর দশকের শেষ দিকে ইয়াসুকুনির দেবতার তালিকায় যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানোর মধ্য দিয়ে।

ফলে যুদ্ধের পুরো সময় ধরে জাপানের যে কয়েক লাখ তরুণ দেশপ্রেমে নিবেদিত থেকে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, ইয়াসুকুনির সেই ঘটনার আলোকে তাঁদেরও এখন ধরে নেওয়া হচ্ছে ‘বিতর্কিত’ হিসেবে। জাপানের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের বাইরে অন্য একটি মর্মান্তিক দিক হচ্ছে এটা।

যেকোনো যুদ্ধের বলি সর্বাগ্রে হতে হয় যুদ্ধে জড়িত কোনো একটি দেশের তরুণদের। নিজেরা না চাইলেও দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে যাঁদের সাধারণত বাধ্য করা হয়। এর পরোক্ষ ফলশ্রুতিতে নেতৃত্বের স্খলনের জন্য নেতারাই কেবল নয়, সেসব তরুণকেও চিহ্নিত করা হয় ‘খলনায়ক’ হিসেবে।

এমনটাই সম্ভবত ঘটেছে আট দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত জাপানের কয়েকজন তরুণ সৈনিকের জীবনে। তাঁদের অনেকেরই সম্ভবত জানা ছিল না কেন তাঁরা যুদ্ধে জড়িত। আর যাঁরা তাঁদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা সেই তরুণদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে, তা নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করার দরকার সম্ভবত নেই।

সমাধিতে চিরনিদ্রায় শায়িত জাপানিদের নামফলক

সম্পর্কিত নিবন্ধ