অতি দীর্ঘ, পরিশ্রমসাধ্য একটি জার্নির পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তার কাজ শেষ করল। কমিশনকে অভিনন্দন। কিন্তু সর্বশেষ কমিশন যেভাবে তাদের সুপারিশ দিয়েছে, তা একদিকে যেমন কমিশনের এত দিনের কাজকে অর্থহীন বলে প্রমাণ করার ঝুঁকি তৈরি করেছে, অপর দিকে দেশকে ঠেলে দিতে পারে রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল প্রাথমিকভাবে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করা এবং সেটার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করা। সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, সেটা তাদের কর্মপরিধির মধ্যে ছিল না। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ জুলাইয়ের পর ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলো ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক–অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে। দীর্ঘ আলোচনার পরও এ ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে পদ্ধতির কথা বলছে, তাতে দেখা যায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’-এর মাধ্যমে কিছু প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এবং বাকিগুলোর যেগুলোতে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, সেগুলোকে গণভোটে দিয়ে জনগণের মতামত নিতে হবে। এরপর সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে এবং ওই সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করতে হবে।

নির্বাচনের পরে ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। গণভোটের ম্যান্ডেটের পরও সেই সংসদ যদি এই সংশোধনীগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ৯ মাসের মাথায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সবকিছু করিয়ে ফেলা যায় না, এই বাস্তবতা মাথায় নিয়ে আমাদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করা উচিত। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী এই সংকট নিয়ে আলোচনা চলছে; শিগগিরই লিখতে চাই এই ইস্যুতেও।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সময় বাকি আছে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন মাস। সরকার এমনিতেই নানা সংকটে জেরবার। দেশের অর্থনীতি ভালো চলছে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট নাজুক। এর মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে পদ্ধতি প্রস্তাবিত হয়েছে, সেটা গ্রহণ করা কোনোক্রমে উচিত হবে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। কারণ, এভাবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে গেলে উদ্ভূত পরিস্থিতি জাতীয় নির্বাচনকেই অনিশ্চিত করে তুলবে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতিতে এর চেয়েও বড় সংকট আছে। ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংবিধানের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে গণভোটে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমতের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে না। ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার ওপরই গণভোট হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে।

কমিশনের এই সিদ্ধান্ত দেখে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে সনদ স্বাক্ষরের দিন স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকা এনসিপির স্বাক্ষর শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত করতে তাদের দেওয়া শর্ত মেনেই এমন প্রস্তাব করেছেন তাঁরা। রাজনৈতিক দর-কষাকষির জন্য এমন শর্ত দেওয়াটা চলতে পারে, কিন্তু সেটাকে সনদ স্বাক্ষরের অলঙ্ঘনীয় শর্ত বানিয়ে ফেলাটাকে রাজনৈতিক অপরিপক্বতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। আর সেটা গ্রহণ করে ঐকমত্য কমিশন তার বিবেচনাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এটা মানতে দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) অনেক ক্ষেত্রেই অনেকের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে কোনো দল যদি ভিন্নমত প্রকাশ করে, তবে তাকে সম্মান জানানো উচিত। এখন যেভাবে গণভোটের প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন মাসের পর মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অতি দীর্ঘ আলোচনা করা হলো?

আরও পড়ুনজুলাই সনদ বাস্তবায়ন আর গণভোটের রাজনীতি১৬ অক্টোবর ২০২৫

প্রাথমিক ছয় কমিশন তো রাজনৈতিক দলগুলোসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই তাদের সুপারিশ প্রদান করেছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে আমি জানি সেই সুপারিশ তৈরির জন্য কত রকম অংশীজনের কাছ থেকে মতামত নেওয়া এবং সেটা বিবেচনা করা হয়েছে। এসব কমিশনের সুপারিশ থেকে বিবেচনা করে একটি চূড়ান্ত সুপারিশ করার মতো যথেষ্ট বিজ্ঞ সদস্যরা আছেন ঐকমত্য কমিশনে। এরপর সেটা এখন যেভাবে গণভোটে দেওয়ার কথা হচ্ছে, সেভাবে গণভোটে দিয়ে দেওয়া যেত।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজেদের পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে অনেক ক্ষেত্রেই সরে এসে অনেক সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছে। এই একমত হওয়ার সুবিধা যেমন আমাদের নেওয়া উচিত, তেমনি তাদের ভিন্নমতকেও মর্যাদা দেওয়া উচিত। ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাবিত গণভোট একটি মারাত্মক সংকট তৈরি করতে পারে। ভিন্নমত যুক্ত করা ছাড়া প্রস্তাবগুলো সব যদি প্যাকেজ আকারে গণভোটে যায়, তাহলে দেশে কার্যকর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটি (বিএনপি) সেই গণভোটে কী অবস্থান নেবে?

সংবিধান সংস্কারের অনেকগুলো ইস্যুতে বিএনপি দ্বিমত প্রকাশ করেছে, বিতর্ক করেছে এবং রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকার পরও সেগুলোতে স্থির থেকেছে; ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। দলটি এখন এই গণভোটের জন্য সব সংস্কার প্রস্তাব মেনে নেবে? ওদিকে ভিন্নমতের বিষয়গুলোর প্রতি যেহেতু দলটির খুব কঠোর বিরোধিতা আছে, তাহলে কি তারা ‘না’ ভোটের পক্ষে যাবে?

বিএনপি যদি এই গণভোট হওয়াকে গ্রহণ করে এবং ‘না’ ভোটের পক্ষে যায়, তার সঙ্গে যদি পতিত স্বৈরাচার এবং তার দোসরদের ‘না’ ভোট যুক্ত হয়ে যদি ‘না’ বিজয়ী হয়, তাহলে তো এই পুরো সংস্কারপ্রক্রিয়া ভেস্তে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, এভাবে গণভোট হওয়াটা যদি বিএনপি গ্রহণ না করে এবং এর বিরুদ্ধে মাঠে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কী হবে?

অথচ ভিন্নমতসহ এই সনদের প্রস্তাব গণভোটে যেতে পারত। নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজিত হলে (সেটা হওয়াই ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে সঠিক হয়) এবং তাতে যদি ‘হ্যাঁ’ জয়লাভ করে, তাহলে ক্ষমতায় যে দল যাবে, সেই দলের একমত হওয়া সংস্কার প্যাকেজ কার্যকর হবে।

জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলে আরেকটা সুবিধা পাওয়া যাবে—দলগুলো তাদের অনুমোদিত সংস্কারকে নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করতে পারবে। এতে এটাও বোঝা যাবে, জনগণ কতটুকু সংস্কার গ্রহণ করতে এই মুহূর্তে প্রস্তুত। প্রতিটি দল যেহেতু মনে করে জনগণ সংস্কার চায় এবং তারা যেভাবে সংস্কার চায় জনগণও সেভাবেই চায়, তাহলে গণভোট সেটারও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। জনগণ চায় বলে রাজনৈতিক দলগুলো কথা বলবে, কিন্তু জনগণের সত্যিকার ম্যান্ডেট নিয়ে সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করার আত্মবিশ্বাস রাখবে না, এটা তো হওয়া উচিত না।

আরও পড়ুনগণভোট অপ্রয়োজনীয়, তবে এরপরও যদি হয়.

..০৮ অক্টোবর ২০২৫

ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমতো সরকার গণভোটের আয়োজন করতে গেলে অনিবার্যভাবেই দেশে রাজনৈতিক অনৈক্য, এমনকি সংঘাত তৈরির পরিস্থিতি তৈরি হবে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমনিতেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়ছে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই পরিস্থিতিকে আরও সংঘাতময় করে তুলবে।

গণভোট প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তৈরি হয়েছিল সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মোটা দাগে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজটি তারা দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করেছে। কিন্তু গণভোট প্রশ্নে অবস্থান শেষ মুহূর্তে এসে কমিশনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সময় বাকি আছে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন মাস। সরকার এমনিতেই নানা সংকটে জেরবার। দেশের অর্থনীতি ভালো চলছে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট নাজুক। এর মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে পদ্ধতি প্রস্তাবিত হয়েছে, সেটা গ্রহণ করা কোনোক্রমে উচিত হবে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। কারণ, এভাবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে গেলে উদ্ভূত পরিস্থিতি জাতীয় নির্বাচনকেই অনিশ্চিত করে তুলবে।

জাহেদ উর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক র প রস ত ব প রস ত ব ত গ রহণ কর পর স থ ত ই গণভ ট গণভ ট হ ভ ন নমত গণভ ট র ন করত ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত, আজ জমা দেওয়া হতে পারে

জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে প্রথমে একটি বিশেষ আদেশ জারি, এরপর গণভোট এবং আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) পালনের ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আজ সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই সুপারিশ জমা দেওয়া হতে পারে।

ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সূত্র জানায়, সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে গণভোটে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমতের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে না। ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার ওপরই গণভোট হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে। গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে আইনসভার উচ্চকক্ষ গঠন করার সুপারিশ করা হতে পারে।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৭টি প্রস্তাব সংবিধান-সম্পর্কিত। মূলত এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে। এ প্রস্তাবগুলোর বেশির ভাগের ক্ষেত্রে কোনো না কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এর মধ্যে ৭টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে বিএনপির।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল রোববার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশের খসড়া তৈরির কাজ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে আগামী সংসদ সংস্কার বাস্তবায়ন না করলে কী হবে, তা নিয়ে একটি উপায় এবং আগামী সংসদে কীভাবে উচ্চকক্ষ গঠন করা যায়—এ দুটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত আজ সকালে চূড়ান্ত করা হবে। আজ সকালে কমিশন আবার বৈঠক করে সুপারিশ চূড়ান্ত করে দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশন সুপারিশের রূপরেখা অনুযায়ী, প্রথমে একটি আদেশ জারি করা হবে। এই আদেশের ভিত্তি হবে গণ-অভ্যুত্থান। আদেশটির নাম হবে ‘জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’। সেটার অধীনে গণভোট নিয়ে একটি অধ্যাদেশ করা হবে। এর ভিত্তিতে হবে গণভোট।

আদেশের পরিশিষ্টে সংস্কার প্রস্তাবগুলোর উল্লেখ থাকবে। গণভোটে প্রশ্ন হবে এমন—জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ অনুমোদন করেন কি না এবং সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না। গণভোটে পাস হওয়া সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। এ সময় সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। বাস্তবায়নের পুরো প্রক্রিয়া জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে উল্লেখ থাকবে।

ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, আদেশ জারির পর এর কিছু অংশ তাৎক্ষণিক এবং কিছু কিছু বিষয় পরবর্তী সময়ে কার্যকর হবে। আদেশের কোন ধারা কবে কার্যকর হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকছে। জুলাই সনদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো আদেশের পরিশিষ্টে উল্লেখ থাকবে। তবে সেখানে কোনো দলের ভিন্নমতের বিষয় উল্লেখ থাকবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বাস্তবায়নের আরেকটি বিকল্প পদ্ধতিও সুপারিশ করবে। তবে সেটাও প্রায় একই। সেখানে শুধু গণভোটের বিষয়টি আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হতে পারে। সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে একটি বিল আকারে উপস্থাপন করে তার ভিত্তিতে গণভোট করার বিকল্প সুপারিশ করা হতে পারে।

দুই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে সরকার

গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলেও গণভোট কবে হবে, এর ভিত্তি কী হবে, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে—এসব ক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে মতবিরোধ আছে। ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, গণভোট কি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে হবে, নাকি আগে হবে—এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ কি রাষ্ট্রপতি জারি করবেন, নাকি প্রধান উপদেষ্টা জারি করবেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারও সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে।

আগামী সংসদেই হতে পারে উচ্চকক্ষ

গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন করা হতে পারে। এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সূত্র জানায়, কমিশন চায় এটি আগামী সংসদেই বাস্তবায়ন হোক। কিন্তু সংবিধান সংস্কার হওয়ার আগে সেটা কীভাবে হবে, সে প্রশ্নের পুরোপুরি সুরাহা হয়নি। কারণ, প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনের আগে উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে হবে। অন্যদিকে উচ্চকক্ষ গঠন করতে হবে সংস্কার প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদে গৃহীত হওয়ার পর।

কমিশন–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ বিষয়ে গতকাল বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, এটি আগামী সংসদেই করা যাবে। সংসদে ২৭০ দিনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের প্রস্তাবগুলো গৃহীত হওয়ার পর উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। সংসদে এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে দলগুলো উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে।

সূত্র জানায়, যেহেতু গণভোটে ভিন্নমতের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে না, সেহেতু গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব পাস হলে পিআর পদ্ধতিতেই উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। অর্থাৎ একটি দল জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে।

বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা

সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ মূলত আটকে ছিল বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা প্রশ্নে। ২৭০ দিনের মধ্যে আগামী সংসদ সনদ বাস্তবায়ন না করলে কী হবে, এ নিয়ে কমিশন নানা বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, গণভোটে সংস্কার প্রস্তাবগুলো পাস হলে আগামী সংসদে সেগুলোর বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক হবে। তা ছাড়া সনদে ইতিমধ্যে দলগুলো সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। কমিশন এটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। এর বাইরে কোনো নিশ্চয়তা বিধান করা যায় কি না, সেটা এখনো কমিশনের বিবেচনায় আছে।

কমিশনের একটি সূত্র জানায়, ২৭০ দিনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন করা না হলে সংসদ বিলুপ্ত করা বা এ ধরনের কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হবে না। তবে ইতিবাচক একটি বিকল্প নিয়ে তাঁরা ভাবছেন। সেটা আজ সকালে চূড়ান্ত করা হতে পারে।

ঐকমত্য কমিশনের গতকালের বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেন। তাঁরা হলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন।

কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। জাতীয় ঐকমত্য গঠনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সভায় উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত করেছি। কমিশন আশা করছে, আজকের মধ্যে সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া সম্ভব হবে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে সরকার এগোলে স্বাক্ষরেও অগ্রগতি হবে: এনসিপি
  • ইতিবাচকভাবে দেখছে জামায়াতে ইসলামী
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে সালাহউদ্দিনের প্রতিক্রিয়া
  • সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট করার সুযোগ নেই: বিএনপি
  • প্রধান উপদেষ্টার হাতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ
  • ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ পেশ দুপুরে 
  • আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার করবে ৯ মাসে
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের শেষ বৈঠক হয়ে গেল, সুপারিশ দেবে আগামীকাল
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত, আজ জমা দেওয়া হতে পারে