ফার্নেস তেলের বাড়তি দামের চাপে পিডিবি
Published: 30th, October 2025 GMT
প্রতি লিটার ফার্নেস তেলে ৭০ টাকা খরচ পড়ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে। একই তেল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সরবরাহ করছে ৮৬ টাকা দরে। অর্থাৎ প্রতি লিটারে ১৬ টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)।
প্রতি মাসে গড়ে ৬০ হাজার টন ফার্নেস তেল নিচ্ছে পিডিবি। এতে পিডিবির বাড়তি খরচ হচ্ছে ৯৬ কোটি টাকা। অঙ্কটি বছরে হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
সর্বশেষ গত বছরের ২ আগস্ট ফার্নেস তেলের দাম নির্ধারণ করে বিপিসি। এরপর গত এক বছরে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও দেশে তা সমন্বয় করা হয়নি। বিপিসি সূত্র বলছে, গত জানুয়ারিতে প্রতি টন ফার্নেস তেলের দাম ছিল ৪৮৬ ডলার। এখন তা কমে হয়েছে ৩৭৩ ডলার। এর মানে গত ১০ মাসেই বিশ্ববাজারে দাম কমেছে ২৩ শতাংশ, অথচ দেশে কমানো হয়নি।
জ্বালানি খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত বছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি গেছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। এ বছরও বিদ্যুৎ খরচ কমাতে হিমশিম খাচ্ছে পিডিবি। একদিকে পিডিবির কাছে তেল বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা করছে সরকারি সংস্থা বিপিসি; অন্যদিকে সরকারি আরেক সংস্থা পিডিবিকে নিয়মিত ভর্তুকি দিতে পারছে না সরকার। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি।
বিপিসি সূত্র বলছে, গত জানুয়ারিতে প্রতি টন ফার্নেস তেলের দাম ছিল ৪৮৬ ডলার। এখন তা কমে হয়েছে ৩৭৩ ডলার। এর মানে গত ১০ মাসেই বিশ্ববাজারে দাম কমেছে ২৩ শতাংশ, অথচ দেশে কমানো হয়নি।‘এটা তো অপরাধ’
চুক্তি অনুসারে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে জ্বালানি তেল সরবরাহের ব্যবস্থা করে দেয় পিডিবি। আর বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেরা আমদানি করলে ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ তাদের তেলের দাম পিডিবি পরিশোধ করে দেয়।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সংগঠন (বিআইপিপিএ) সূত্র জানিয়েছে, প্রতি লিটার ফার্নেস তেলে গত জানুয়ারিতে তারা নিয়েছিল ৮৫ থেকে ৮৭ টাকা। তারা এখন পিডিবির কাছ থেকে গড়ে নিচ্ছে ৭০ টাকা। পিডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও দামের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
একটি সরকারি সংস্থা লিটারে ১৬ টাকা বেশি নেয় কেমন করে? এটা তো অপরাধ। এ লুণ্ঠনের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিতএম শামসুল আলম, জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাবপিডিবি ও বিপিসি সূত্র বলছে, গত বছর বিপিসির কাছ থেকে ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫১২ টন ফার্নেস তেল নিয়েছিল পিডিবি। এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে ৫ লাখ ৭২ হাজার ৫৫৮ টন। এর মানে বছরের ৯ মাসে পিডিবি মোট ফার্নেস তেল নিয়েছে ৫৭ কোটি ২৫ লাখ ৫৮ হাজার লিটার। পুরোটা সময়ই বাড়তি দাম শোধ করে আসছে পিডিবি। বাকি ৩ মাসে আরও ১৩ কোটি লিটার ফার্নেস তেল সরবরাহের কথা রয়েছে। দাম না কমালে পিডিবিকে ৩ মাসেই বাড়তি দিতে হবে ২০৮ কোটি টাকা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, একটি সরকারি সংস্থা লিটারে ১৬ টাকা বেশি নেয় কেমন করে? এটা তো অপরাধ। এ লুণ্ঠনের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। জ্বালানি বিভাগও এর দায় এড়াতে পারে না।
বিইআরসি নীরব
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে ২০০৩ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গণশুনানি করে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করার কথা এ কমিশনের। তবে প্রবিধানমালা চূড়ান্ত না করায় জ্বালানি তেলের (অকটেন, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন) দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি বিভাগ। আর ফার্নেস তেলের দাম নির্ধারণ করে বিপিসি। যদিও সরকার পরিবর্তনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফার্নেস তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে দেওয়া হয়।
বিইআরসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিইআরসির লাইসেন্স নেই বিপিসির। তাই তাদের প্রস্তাব ধরে গণশুনানি আয়োজনের আইনগত সুযোগ নেই।
বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ফার্নেস তেলের দাম নির্ধারণের পরের মাসেই দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে দেয় সরকার। তাই বিপিসির দাম সমন্বয়ের আর সুযোগ নেই। দাম নির্ধারণে বিইআরসির কাছে প্রস্তাব করা হলেও শুনানি হয়নি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: টন ফ র ন স ত ল ব ইআরস র গত বছর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
এক মাস বন্ধ থাকার পর তেল সরবরাহ আজ শুরু
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপলাইন প্রকল্প উদ্বোধনের এক মাসের মধ্যেই ধরা পড়েছে তেলের হিসাবে গরমিল, মজুতের জালিয়াতি ও প্রযুক্তিগত ত্রুটি। এ কারণে এক মাসের বেশি সময় ধরে তেল সরবরাহ বন্ধ ছিল। অবশেষে আজ বুধবার ৫০ লাখ লিটার তেল সরবরাহের কথা রয়েছে।
বিপিসির একাধিক সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পাইপলাইনে তেল পাঠানো বন্ধ। সর্বশেষ ১৯ সেপ্টেম্বর পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড পাঠায় ৩৯ লাখ ৯০ হাজার ৯০৭ লিটার তেল। এর আগে ৪ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর মেঘনা পেট্রোলিয়াম পাঠায় ৭০ লাখ লিটার এবং ১২ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর আরও ৭৫ লাখ লিটার। যমুনা অয়েল কোম্পানি ১৫ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঠায় ১ কোটি ৮ লাখ লিটার ডিজেল।
এক মাসের বেশি সময় তেল সরবরাহ বন্ধের পেছনে মূল কারণ হিসাবে তেল ঘাটতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও ফতুল্লা ডিপোয় পৌঁছানোর পর পদ্মা ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের অন্তত ৫০ হাজার লিটার তেল কম পাওয়া গেছে। তবে সবচেয়ে বড় ঘাটতি ধরা পড়ে যমুনা অয়েল কোম্পানির ক্ষেত্রে। ফতুল্লা ডিপোয় দুই দফায় মোট ৩ লাখ ৭৫ হাজার লিটার ডিজেল কম পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার পর পাইপলাইনে সরবরাহ বন্ধ করা হয়।
কিছু ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। তেলের হিসাবে গরমিলও পাওয়া গেছে। কয়েকটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ত্রুটি ঠিক হলে পুরোদমে সরবরাহ শুরু হবে।এ কে এম আজাদুর রহমান, পরিচালক (অপারেশনস), বিপিসিজানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক (অপারেশনস) এ কে এম আজাদুর রহমান বলেন, কিছু ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। তেলের হিসাবে গরমিলও পাওয়া গেছে। কয়েকটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ত্রুটি ঠিক হলে পুরোদমে সরবরাহ শুরু হবে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তেলের হিসাবে গরমিল, ট্যাংক মজুতের সক্ষমতা জালিয়াতি ও পরিমাপে ত্রুটি ধরা পড়েছে। এসব কারণে সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছিল। সরবরাহ বন্ধ থাকায় তেল পুরোনো পদ্ধতিতেই—নদী, রেল ও সড়কপথে ঢাকায় আনা হচ্ছে। এতে খরচ বাড়ছে, অপচয় ও চুরির ঝুঁকি ফিরেছে পুরোনো অবস্থায়।
২০১৬ সালে নেওয়া এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। ২২ জুন পরীক্ষামূলকভাবে সরবরাহ শুরু হয়। এরপর ১৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সেনাবাহিনী, কিন্তু এখনো বিপিসি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প বুঝে নেয়নি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ হস্তান্তরের আগেই বিপুল ব্যয়ে নির্মিত পাইপলাইন চালু করা হয়। ফলে সরবরাহ শুরু হলে ধরা পড়ে গলদ।
দেশে বছরে গড়ে ৬৫ লাখ টন তেলের চাহিদা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরবরাহ ছিল ৬৮ লাখ টন, যার ৬৩ শতাংশ ডিজেল। পাইপলাইন চালু থাকলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বছরে ২৭ লাখ টন বা ৩১৭ কোটি লিটার ডিজেল সরবরাহ করা যাবে।
দেশে বছরে গড়ে ৬৫ লাখ টন তেলের চাহিদা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরবরাহ ছিল ৬৮ লাখ টন, যার ৬৩ শতাংশ ডিজেল। পাইপলাইন চালু থাকলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বছরে ২৭ লাখ টন বা ৩১৭ কোটি লিটার ডিজেল সরবরাহ করা যাবে।বিপিসি সূত্র জানায়, ঢাকা বিভাগেই ব্যবহৃত হয় দেশের ৪০ শতাংশ তেল। এখন পতেঙ্গা থেকে নদীপথে নারায়ণগঞ্জের ডিপো, সেখান থেকে সড়কপথে ঢাকায় পৌঁছায়। মাসে প্রায় ১৫০টি ছোট-বড় জাহাজ লাগে। বছরে পরিবহন বাবদ খরচ হয় ২০০ কোটি টাকার মতো। এই ব্যয় কমাতে, চুরি ও অপচয় ঠেকাতে, এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সরবরাহ গড়তে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।