যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠককে ‘অসাধারণ’ বলে মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বৈঠককে ১০-এর মধ্যে ‘১২’ নম্বরও দিয়েছেন। তবে বিশ্লেষকেদের চোখে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যে দুই নেতার এই সমঝোতা বা চুক্তি আসলে একধরনের নাজুক ‘যুদ্ধবিরতি’, যার মূল সমস্যাগুলো এখনো অমীমাংসিত।

গতকাল বৃহস্পতিবার যে কাঠামোতে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন চীন কেনা আবার শুরু করবে, বিরল খনিজ রপ্তানিতে এক বছরের জন্য নিয়ন্ত্রণ স্থগিত রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর আরোপিত শুল্ক ১০ শতাংশ কমাবে—তা কার্যত দুই দেশের সম্পর্ককে ট্রাম্পের ‘লিবারেশন ডে’ অভিযান-পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২ এপ্রিল ট্রাম্প লিবারেশন ডে ঘোষণা করে চীনের ওপর বাণিজ্যিক শুল্ক আরোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচনা দাবি করেন।

বুসানের বৈঠকের পর ওয়াশিংটন যা চায় এবং বেইজিং যা দিতে প্রস্তুত, তার মৌলিক অমিল পাওয়া যাচ্ছে। আলোচনায় ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের মূল কারণগুলো যেমন চীনের শিল্পনীতি, অতিরিক্ত উৎপাদন এবং রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি মডেল—এসব বিষয় অনুপস্থিত ছিল।

নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি সেন্টারের পরিচালক এমিলি কিলক্রিজ বলেন, ‘আসলে আমরা কী নিয়ে কথা বলছি? আমরা বলছি, দুই পক্ষের নেওয়া পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ কমানোর ব্যাপারে।’ বৈঠকের ফলাফলে দেখা যায়, সি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মোকাবিলায় নতুন এক বাস্তববাদী পদ্ধতি নিয়েছেন। যেখানে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানতে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের মতো নানা হাতিয়ার প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এক কর্মকর্তা বলেন, চীনা প্রতিনিধিদলের প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত ছিল। তারা জানত এই বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তন আসবে না। তবে ট্রাম্পের ইতিবাচক মনোভাব ও বৈঠকটিকে ‘জি-টু’ বা দুই পরাশক্তির বৈঠক হিসেবে উপস্থাপন করা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট ছিল।

কর্মকর্তা আরও বলেন, বেইজিং এই বৈঠককে বৃহত্তর এক আলোচনার সোপান হিসেবে দেখছে, যার মাধ্যমে দুই দেশ সম্পর্ক স্থিতিশীল করার সুযোগ পাবে।

বিশ্বমানের নেতা

দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনের পর দুই নেতার উষ্ণ বৈঠক এবং আগামী বছর ট্রাম্পের বেইজিং সফরের প্রতিশ্রুতি ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে বাণিজ্যযুদ্ধের মাঝে থাকা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত।

এপেক সম্মেলনের আগে বৈঠক শুরুর সময় সি বলেন, চীনের উন্নয়ন ও পুনরুত্থান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমেরিকাকে আবার মহান করার লক্ষ্যবিরোধী নয়।

সি আরও বলেন, ‘আমি ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করতে চাই, যাতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের জন্য দৃঢ় ভিত্তি তৈরি হয় এবং দুই দেশের উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়।’

বৈঠক শেষে ট্রাম্প উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তিনি সিকে এক মহান দেশের মহান নেতা বলে প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘দুই বিশ্বশক্তির এমনভাবেই পরস্পরের সঙ্গে আচরণ করা উচিত।’

সাংহাইভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্লেনামের অংশীদার বো ঝেংইয়ান বলেন, ‘সীমিত সময়ের মধ্যে এই চুক্তি ও এর কাঠামো দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের একটি উপায় হিসেবে কাজ করছে। এতে তারা ধীরে ধীরে পারস্পরিক স্বার্থ সামঞ্জস্য করতে পারে এবং আলোচনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সুযোগ পাবে।’

কঠিন পরিস্থিতি

এই চুক্তি উভয় পক্ষকেই কিছুটা সময় দিচ্ছে। এপ্রিলের বেইজিং সফরের আগে ট্রাম্প যেমন কূটনৈতিক সাফল্য পেলেন, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক চাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলেন। তবে এই কৌশলগত যুদ্ধবিরতি সম্পূর্ণ নয়। চীনের সাম্প্রতিক বিরল খনিজ রপ্তানির লাইসেন্স নিয়ন্ত্রণ কেবল বিলম্বিত হয়েছে, বাতিল নয়। আগের নিষেধাজ্ঞাগুলো বহাল থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলো এখনো কাঁচামাল সরবরাহের অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

ট্রিভিয়াম চায়নার ভূরাজনীতি বিশ্লেষক জো মাজুর বলেন, ‘এই বছর আমরা দেখেছি চীনের “আগে আঘাত নয়, পরে প্রত্যাঘাত” কৌশল পুরোপুরি সফল হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন পরিষ্কার, বিরল খনিজই চীনের মূল প্রভাবের অস্ত্র, যার জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলনীয় কোনো শক্তি বা বিকল্প নেই।’

চিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও কৌশল কেন্দ্রের পরিচালক দা ওয়েই সতর্ক করে বলেন, ‘যদি এমন উত্তেজনা বারবার বাড়তে থাকে, তবে দুই নেতার ব্যক্তিগত ধৈর্য ও আস্থাও ফুরিয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে আমরা এক অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হব।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র আরও বল ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

তিন জরিপে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে মামদানি

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী ও শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী জোহরান মামদানি সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর চেয়ে এগিয়ে আছেন। তিনটি পৃথক জরিপে মামদানিকে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবধানে এগিয়ে থাকতে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কুইনিপিয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ের বুধবার প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, দুজনের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। মামদানি কুমোর চেয়ে মাত্র ১০ শতাংশ এগিয়ে। মামদানির সমর্থন ৪৩ শতাংশ আর কুমোর ৩৩ শতাংশ। রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়ার সমর্থন ১৪ শতাংশ।

কয়েক সপ্তাহ আগের জরিপে মামদানির সমর্থন ছিল ৪৬ শতাংশ, কুমোর ৩৩ শতাংশ। তবে মেয়র এরিক অ্যাডামস নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর কুমোর অবস্থান কিছুটা শক্ত হয়েছে।

কুইনিপিয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক মেরি স্নো বলেন, ‘জোহরান মামদানি বর্তমানে অ্যান্ড্রু কুমোর চেয়ে ১০ শতাংশ এগিয়ে আছেন, কার্টিস স্লিওয়ার অনেক পিছিয়ে। তবে এখনো একটি অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সম্ভাব্য ভোটারদের মধ্যে যাঁরা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি, তাঁদের হার কুমোর ক্ষেত্রে কিছুটা বেড়েছে, যা শেষ মুহূর্তে ফল পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি করছে।’

তবে এমারসন কলেজ, পিক্স ১১ ও দ্য হিলের যৌথ জরিপে দেখা গেছে, মামদানি স্বতন্ত্র প্রার্থী কুমোর চেয়ে অনেক বেশি ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যকার ব্যবধান ২৫ শতাংশ। এই জরিপে মামদানি পেয়েছেন ৫০ শতাংশ সমর্থন, কুমো ২৫ শতাংশ।

ওই জরিপ অনুযায়ী, রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া ২১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পেয়েছেন, যা মামদানিবিরোধী ভোটকে কুমো ও স্লিওয়ার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে। স্লিওয়ার সমর্থন অন্য জরিপগুলোর তুলনায় বেশি।

গত মাসে এমারসন কলেজের আগের জরিপের তুলনায় মামদানির সমর্থন ৭ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে মামদানির সমর্থন ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে কুমোর সমর্থন ৩ শতাংশ কমে ২৫ শতাংশে নেমেছে। স্লিওয়ার সমর্থন দ্বিগুণ বেড়ে ১০ থেকে ২১ শতাংশ হয়েছে।

ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে কুমোকে পরাজিত করার পর কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে জোহরান মামদানির সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তাঁর সমর্থন ৫০ শতাংশ থেকে লাফিয়ে ৭১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটারগোষ্ঠীর দৃঢ় সমর্থন প্রতিফলিত করে। এদিকে মারিস্ট ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক ওপিনিয়নের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, মামদানি কুমোর চেয়ে ১৬ শতাংশ এগিয়ে আছেন তাঁদের সমর্থন যথাক্রমে ৪৮ শতাংশ ও ৩২ শতাংশ। রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া পেয়েছেন ১৬ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।

তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় মামদানি

মারিস্ট জরিপে দেখা গেছে, ৪৫ বছরের নিচের তরুণ ভোটারদের মধ্যে জোহরান মামদানির বিপুল জনপ্রিয়তা। এই গোষ্ঠীতে তাঁর সমর্থন ৬৪ শতাংশ, যেখানে কুমোর পক্ষে মাত্র ২১ শতাংশ। তবে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্ব ভোটারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হাড্ডাহাড্ডি। কুমোর সমর্থন ৩৯ শতাংশ এবং মামদানি ৩৮ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন। উদারপন্থী ভোটারদের মধ্যে মামদানি বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও মধ্যপন্থী ভোটারদের মধ্যে কুমো সামান্য এগিয়ে। অন্যদিকে রক্ষণশীল ভোটারদের ৪৫ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া—যা মামদানি ও কুমোর চেয়েও বেশি।

ইহুদি ভোটারদের সমর্থন ধরে রেখেছেন মামদানি

আগামী ৪ নভেম্বর নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগেই জোহরান এমন এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের পথে হাঁটছেন, যেখানে একদিকে রয়েছে তাঁর দীর্ঘদিনের ইসরায়েলবিরোধী ও ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান, অন্যদিকে তিনি বিশাল ইহুদি জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায়েও কাজ করে যাচ্ছেন। জোহরানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে একাধিক প্রগতিশীল ইহুদি সংগঠন। যেমন বেন্ড দ্য আর্ক, জিউইশ ভয়েস ফর পিস (জেভিপি) অ্যাকশন এবং জিউস ফর রেসিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক জাস্টিস (জেএফআরইজে)। এসব সংগঠন প্রকাশ্যে গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমিকার সমালোচনা করেছে এবং জোহরানের প্রচারে মাঠে নেমেছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, নিউইয়র্কে বসবাসরত ইহুদি ভোটারদের মধ্যে জোহরান মামদানিই সবচেয়ে এগিয়ে আছেন। গত জুলাইয়ে জেনিথ রিসার্চ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, জোহরান ইহুদি ভোটারদের মধ্যে ১৭ শতাংশ এগিয়ে আছেন। বর্তমানে এখনো তাঁর সমর্থন ১০ শতাংশ বেশি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ