দেয়াল আলমারিতে রাখা আখরঙা ফাইলে বাড়ির দলিল, চেকবই, জীবনবিমা, কাবিন, জন্মসনদ, পাসপোর্ট—আপাত দরকারি কাগজপত্রের ওপর আলগোছে ঝিমোয় আমার পাঁচ মাস বয়সী মেয়ের ডিএনএ কার্ড। কার্ডে হিমের তাবৎ বর্ণনা আছে—জন্মদাগ, ছবি, দশ আঙুলের ছাপ, ওর মুখের লালা...যতবার ফাইলটা খুলি, কার্ডটা ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়। নিজেকে যেন নব্বই সেকেন্ডের জন্য তৈরি করছি। সেই কবে একদিন পত্রিকার তৃতীয় পাতায় দেখেছিলাম নিখোঁজ শিশুর পরিসংখ্যান নামের এক জীবন্ত ভিসুভিয়াস। ভারতে প্রতি আট মিনিটে, ইউরোপে দুই মিনিটে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি নব্বই সেকেন্ডে মায়ের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সন্তান। মাসখানেক হলো এই শহরে এসেছি আমরা বরের গবেষণাকাজের সুবাদে। শহরের উত্তরে তেরো মাইল দীর্ঘ উপসাগর আর কুড়ি মিনিট গাড়ি চালালে নোনতা সমুদ্র। হাঁপ ধরে যাওয়া জীবনে আমার জন্য বুঝি সামুদ্রিক হাওয়া আর নির্জনতারই দরকার ছিল।
তবে মধ্যসকালে মহুয়াকে ঠিক মনে পড়ে। হিমকে নিয়ে আনকোরা শহরে হাঁটতে বেরোই, মহুয়া ফুল খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পাই বিদেশিনী ফুল: প্যাশনফ্লাওয়ার, ক্যামেলিয়া, বাটারফ্লাই নিডলস, পার্পল হার্ট, মর্নিং গ্লোরি, নক আউট রোজ, স্কাই ফ্লাওয়ার, ম্যাগনোলিয়া.
হিমের বাবার ধারণা, আমার এসব সতর্কতা বা ভয় প্রসব–পরবর্তী বিষণ্নতার ফসল। ইনস্যুরেন্স সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে সপ্তাহখানেকের মধ্যে একজন কাউন্সেলর ঠিক করল। দেখতে আমারই সমবয়সী, ময়ূররঙা স্কার্ট পরা কাউন্সেলর লিলিয়ানকে প্রথম প্রশ্নটাই করেছিলাম, ‘তোমার ছেলেমেয়ে আছে?’ লিলিয়ান উত্তরে বলেছিল, ‘আমি কোনো দিন মা হতে পারব না।’ এই উত্তরের জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। হুট করে মনে এল, পৃথিবীর সব থেকে ছোট গল্পটা—‘বিক্রির জন্য: বাচ্চার জুতা, কখনো পরেনি।’ লোকে বলে হতে পারে অনাগত শিশুর জন্য জুতা কেনা হয়েছিল। সেই শিশুটি হয়তো জন্মায়নি কিংবা হয়তো জন্মের পরপরই মারা গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, লেখক তখনো পিতা হয়ে ওঠেননি, মগজে খটকার মতন ঠকঠক করেছিল ‘বিক্রির জন্য...বিক্রির জন্য’ সত্যি কি বিক্রি করা যায়! এই টাকার ভার সন্তানহারা কোনো মা কি সহ্য করতে পারে? আমাদের বন্ধু পঙ্কজ খটকা শুনে গল্পটার একতোড়া অন্য মানে বের করেছিল আমার জন্য। হয়তো প্রবাসী বাবা ছেলের জন্য জুতা কিনেছিল, দেশে ফিরতে ফিরতে ছেলে বড় হয়ে গেছে। হয়তো অনেক উপহারের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল এক জোড়া জুতা। হয়তো এক হোমলেস মদের জন্য চুরি করেছিল দুটি জুতা। হয়তো শিশুটির পা ছিল না। হয়তো মেয়ের জন্য জুতা কেনা হয়েছিল, পরে ছেলে হয়েছে…
লিলিয়ান কখনো মা হতে পারবে না শুনে শুরুতে মনে হয়েছিল সেও বুঝি-বা হবে পিতা না হয়ে ওঠা লেখকের মতন, যিনি অগুনতি পাঠকের কাছে বিক্রির জন্য রেখে গেছেন প্রশ্নবিদ্ধ এক জোড়া বাচ্চার জুতা। পরে ভেবেছি, মা না হতে পারা এই মেয়েটার মতন করে কেউ আমাকে বুঝবে না! মেয়েটাকে সত্যিকার অর্থে দরজা খুলে দিলাম; সেই দরজায় ঝলমলে স্কার্ট পরা লিলিয়ান আসত প্রতি বৃহস্পতিবারের সকালে। সেসব সকালে আমি লিলিয়ান আর হিমকে নিয়ে বাতাসের বেলুনে করে ভেসে বেড়াতাম তিন হাজার ফিট উঁচুতে। বাতাসে তখন কী তীব্র মহুয়ার ঘ্রাণ! ওপর থেকে পৃথিবীটাকে মনে হতো থকথকে কালো-লাল পিঁপড়ার উপনিবেশ। লিলিয়ানের থেকে জেনেছি মানুষের ভাবনায় ঘুরে বেড়ানো লাল পিঁপড়াদের কথা; মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাবিদ্যায় যাকে বলে ‘এএনটি: অটোমেটিক নেগেটিভ থটস’। মগজের দাবাঘরে প্রতি সেকেন্ডে ষোলো লাল পিঁপড়ার সাথে যুদ্ধ চলে আমার। ভাস্কর্যে বসানো আমার মনে কালো-লাল পিঁপড়াভর্তি একটা ভাবনার বয়াম আছে। আমার অস্তিত্বকে সেই বয়ামে পুরে নির্নিমেষ ঝাঁকিয়ে নিজের বিধ্বস্ততা দেখি আমি।
আমার ছোটবেলার বান্ধবী সাদিয়ার প্রিয় খেলনা ছিল পিঁপড়া। ঘাসে সে হাত ছড়িয়ে রাখত; হাত বেয়ে উঠে আসা কুঁড়ি পিঁপড়াদের তালুতে নিয়ে খেলতে খেলতে এক বিকেলে সে বলেছিল ‘পিঁপড়েফুল’। আমার ভাবনাজুড়ে বসে থাকা একটা লাল পিঁপড়েফুলের নাম বুলু মামা। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর হাঁপ ছাড়ানো অবসরে বন্ধুদের নিয়ে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করছিল। নানাভাই প্রেরণার ঘুড়ি ওড়াতে টাকাও দিয়েছিলেন, অথচ বাদ সাধলেন বড় মামা, ‘বাচ্চা পোলাপান, ওরা ব্যবসার বোঝেটা কী? বুলুর ওসবে দরকার নেই, টাকা ফেরত আনুক!’ টাকা ফেরত আনতে গিয়ে আর ফেরেনি বুলু মামা। নানু যত দিন বেঁচেছিলেন, বিশ্বাস করতেন—তাঁর বুলু ফিরবে এক বৃহস্পতিবারে, বৃষ্টির রাতে ঠিক যেমন করে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। নানু আরও বলতেন, বুলু মামার বিড়ালগুলোও ফিরে আসবে বৃহস্পতিবার। সেই একই বৃহস্পতিবার বাড়ি থেকে নাই হয়ে গেল নয়টা বিড়াল। ফিরেছে তো বুলু মামা আর তার বিড়ালেরা পিঁপড়েফুলের ডাকটিকিট হয়ে। স্মৃতি বরাবরই ডাকটিকিটের মতন।
নয়টি বিড়ালের ভিড়ে এক পিঁপড়েফুলের পাপড়ি বেয়ে গড়ায় এক ফোঁটা লাল মিষ্টির রস। পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর আমরা যখন লাল-সাদা মিষ্টি মুখে তুলছি, বান্ধবী সাদিয়া তখন ঘর থেকে বেরিয়ে হয়ে গেল এক নিখোঁজ জলপাই রোদ। আমাদের সফলতার আনন্দের থেকেও উজ্জ্বল হয়ে থাকল তার ব্যর্থতা। আজও রেললাইন দেখলে মাথার ভেতর একটা দৃশ্য তৈরি হয়—এক কিশোরী রেললাইন ধরে হেঁটে চলেছে, ওর পেছনে পিঁপড়ার সারি, আস্তে আস্তে ওরা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে, সুবর্ণরেখা নদীটির ধারের নীল পাহাড়ে। কখনো একটা লাল পিঁপড়া আমার বুকের ওপর তুলে দেয় সমুদ্ররঙা কায়াক। সমুদ্রের ৩ হাজার ৯১৮ বর্গমাইল খুঁজেও পাওয়া গেল না পৃথিবীর সবচেয়ে উজ্জ্বল হাসি ধরে রাখা ছেলেটার মুখ। ওর বাবা বাড়ির উঠানজুড়ে লাগিয়ে রেখেছে মৃত্যুর ফুল চন্দ্রমল্লিকা আর সাতটা জ্যৈষ্ঠ ধরে ওর মা অপেক্ষায়—এক দুপুরে কলবেল বেজে উঠবে, বিশাল এক মাছ হাতে দরজায় দাঁড়ানো ছেলে বলবে, ‘মাছটা ধরতেই এতটা দেরি হলো আম্মু।’ হিমের বাবা কি জানে আন্তর্জাতিক নিখোঁজ শিশু দিবস কবে? ২৫ মে—আরও একটা জ্যৈষ্ঠের তারিখ, নজরুলের জন্মজয়ন্তী, সেদিন নিখোঁজ হয়েছিল ছ বছরের ইথান...৪৬ বছর ২ মাস ১০ দিন...ওহ, প্রতি নব্বই সেকেন্ডে জলদস্যুর জাহাজ থেকে আমার ভাবনায় নেমে পড়ে লাল রঙের শিশু পিঁপড়া।
নানাভাই প্রেরণার ঘুড়ি ওড়াতে টাকাও দিয়েছিলেন, অথচ বাদ সাধলেন বড় মামা, ‘বাচ্চা পোলাপান, ওরা ব্যবসার বোঝেটা কী? বুলুর ওসবে দরকার নেই, টাকা ফেরত আনুক!’ টাকা ফেরত আনতে গিয়ে আর ফেরেনি বুলু মামা। নানু যত দিন বেঁচেছিলেন, বিশ্বাস করতেন—তাঁর বুলু ফিরবে এক বৃহস্পতিবারে।মহুয়া হাওয়ার বেলুনে ভাসতে ভাসতে হিম ঘুমিয়ে পড়ে আর স্কার্টের ঝিলমিলে সূর্যমুখীর বাগানে হাত রেখে লিলিয়ান আলগোছে প্রসঙ্গ বদলায়, ‘এমন কিছুর নাম বলো, সেটা হতে পারে সামান্য এক কাপ কফি, যার জন্য তুমি আজকে কৃতজ্ঞ।’ মনে ভাসে বাগানের তিনটা ছোট শসা। শাশুড়ি দেশ থেকে বীজ পাঠিয়েছিলেন, গাছভর্তি হলুদ ফুলের ঝিকিমিকি, অথচ ফলের দেখা নেই। এত দিন ধারণা করেছিলাম, পুরুষ ফুল সব। লিলিয়ান হাসি টেনে বলে, ‘জানো বিড়ালেরা শসা ভয় পায়। রান্নাঘরে হঠাৎ সাপ দেখলে তোমার যেমন লাগবে, সেই একই অনুভূতি বিড়ালের হয়। আমাদের কাছেও নিছক শসাকে কখনো মনে হয় দুর্বার সাপ, তাই না?’ যাওয়ার আগে লিলিয়ান তিনটি কালো পিঁপড়া ফেলে যায়: ষাটজন নিখোঁজ শিশু উদ্ধারের সুখবর, একটা গ্র্যাটিচুড জার্নাল যেন প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে দিনের অন্তত পাঁচটা জিনিস মনে করে কৃতজ্ঞ হই আর আটটা শব্দ ‘ভাবনাকে আলোর দিকে রেখে লিখতে শুরু করো আবার!’ আমি খামে ডাকটিকিট লাগিয়ে লাল পিঁপড়েফুলের কথা লিখে পাঠাই রোদে, ঘাসে, মহুয়া ফুলে, পায়ের ছাপে।
একদিন বয়ামে আবিষ্কার করি একটা জলপাইগাছ, ডালভর্তি তার ফুটফুটে লাল পিঁপড়া। দেশে, আমাদের জলপাইয়ের বাগানে একবার খুব বিছা পোকা হয়েছিল; টুপ টুপ করে বৃষ্টির মতন পোকা ঝরত। আম্মা খুব ভয় পেয়ে ঘোষণা ছড়াল—একটা বিছা মারার জন্য দুই টাকা দেওয়া হবে। পরের দিন লুঙ্গি কাছা দিয়ে বয়াম হাতে জলপাইগাছে উঠে গেল ছ্যাংগা ধরতে একটা ছেলে। মাঝেমধ্যে ভান করত আমার ওপর বিছা ছেড়ে দেবে। আমি আতঙ্ক আর বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখতাম। বিছা ধরতে ধরতে ছেলেটার শরীর লাল হয়ে যেত। ওর মা এসে কান ধরে বাড়ি না নেওয়া পর্যন্ত দমত না। এই জলপাই ভ্রমণে ভাব হয়ে গেল আমাদের। আমাকে কাঁদতে দেখে এক দুপুরে সে আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল শাপলার বিলে। একসাথে এত শাপলা দেখে মাথা ঝিমঝিম করছিল, মনে হয়েছিল আমি বুঝি দাঁড়িয়ে আছি বেহেশতের বাগানে। মন খারাপের দিনে আজও আমার এক বিল শাপলা ফুলের জন্য হাহাকার হয়।
ছেলেটার স্কুলে যেতে দেরি হতো প্রায় প্রতিদিন। হেডস্যার ‘কোথায় ছিলি’ জিজ্ঞেস করলে সে বলত, চা জলপাইগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রোদ দেখছিল। ‘রোদ দেখার জন্য কেউ স্কুলে আসতে দেরি করে! বানোয়াট সব, বদমাশ ছেলে!’ রেগে গিয়ে কোনো দিন স্যার বেত চালাতেন, কোনো দিন স্কুলের মাঠে ইট হাতে দাঁড় করিয়ে রাখতেন—‘খা, রোদ খা মন ভরে।’ ক্লাস ফোরের রেদোয়ান বলেছিল, চা জলপাইগাছের নিচে ওকে নিশ্চিত জিনে ধরে, তাই ও নড়তে পারে না। অবশ্য বাসে করে ভার্সিটি যাওয়ার কালে একদিন আমিও মুগ্ধতা দেখেছি রোদে, লিখেছি,‘দশ থেকে এগারোর রোদে এত মায়া হয় কেন? তাকিয়ে থাকি আশ্চর্য ঘন রোদে। শুধু রোদ দেখি। বাড়ি ফিরি। চোখেমুখে লেগে থাকে রোদের ডাকটিকিট…’ রোদ দেখে থমকে যাওয়া ছেলেটার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। সে হারিয়ে যেতে থাকে আমাদের দিনকাল থেকে। অবশ্য তাকে নিয়ে শোরগোল উঠেছিল দুই দুপুরে। আধা উলঙ্গ হয়ে চা জলপাইগাছের সাথে গোপন মৈথুন করার সময় ছেলেটা ধরা পড়েছিল। লিলিয়ান শুনলে বলত ডেনড্রোফিলিয়া, গাছের প্রতি যৌন আকর্ষণ। তখন তো অতশত জানতাম না। চা জলপাইগাছটাকে দেখলেই খুব রাগ হতো, হয়তো ঈর্ষাই হতো। গাছের বদ জিনকে পাথর ছুড়ে মারতাম। একবার দাদুর বাঁশ কাটার দা দিয়ে কুপিয়েও ছিলাম ঘিনঘিনে গাছটার শরীর।
আশ্চর্য এই—অনেক বছর পর এই শহরের বাতাসে হঠাৎ এক ফুলের গন্ধ পেয়ে বাসে উঠতে গিয়েও নেমে পড়ি। ফুলের ঘ্রাণ জাদুর মতন আমাকে টেনে নিল মেমোরিয়াল পার্কে। দুপুরের বাউকুড়ানি হাওয়ায় তখন শত শত দুধসাদা পাপড়ি। লেকের জলে এক পরিবার রাজহাঁস আর লেকটাকে ঘিরে আছে সারে সারে ওসমান্থাস, চা জলপাইয়ের গাছ! মহুয়া ফুল না পাওয়ার তীব্র কষ্টে কিংবা চা জলপাই খুঁজে পাওয়ার আনন্দেই ভীষণ কেঁদেছিলাম সেদিন। কাছেই বেঞ্চে তাবৎ রোদের গন্ধ নিয়ে বসে থাকা এক আধপাগল বৃদ্ধ আপনমনে বলেছিল, ‘পৃথিবীতে আকুল করা ঘ্রাণ সব নিখোঁজ মানুষের জন্য, যাতে ওরা গন্ধ শুঁকে পথ চিনে ঠিক ফিরে আসতে পারে।’ সে সময় জেনেছি, লোকটা প্রতিদিন পার্কে বসে থাকে কারও আসার অপেক্ষায়। ‘ও আসবে’ বলতে বলতে কোনো দিন চা জলপাইয়ের গল্প ছড়ায়। আকাশে তখন সূর্যের সংখ্যা ছিল দশ। মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে; এই দুর্দশা থেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন মহান বীর হোওই। তাঁর অব্যর্থ তিরে চূর্ণ হলো নয়টি সূর্য; পৃথিবীর জন্য থেকে গেল একটি সূর্য। দেবতারা খুশি হয়ে হোওইকে বর দিলেন এক শিশি অমৃত। অমৃত পান করলে মহানায়ক পাবে অমরত্ব, দেবালয়ে দেবতার আসন। অথচ প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কাছে এই অমরত্বকে তাঁর তুচ্ছ মনে হয়। সংসারের কোথাও অবহেলায় পড়ে থাকে সেই শিশি। একদিন স্ত্রী চন্দ্রাবতী ভীষণ কৌতূহলে মুখে দেয় সেই অমৃত। নিমেষেই পালকের ভার আর অমরত্ব নিয়ে পৃথিবী থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় চন্দ্রাবতী। তবে মধ্যশরতের পূর্ণিমায় চাঁদের গায়ে চন্দ্রাবতীর ছায়া পড়ে। চাঁদে, চন্দ্রাবতীর বাড়ির উঠানে আছে এক চিরঞ্জীব চা জলপাইয়ের গাছ। চন্দ্রাবতী ভালোবাসার মানুষদের উদ্দেশে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয় চা জলপাই ফুল, ফুলের সুরভী। সেই চা জলপাই ফুলের পাপড়ি থেকে জন্ম নিয়েছিল পৃথিবীর প্রথম রাজহাঁস।
আধা উলঙ্গ হয়ে চা জলপাইগাছের সাথে গোপন মৈথুন করার সময় ছেলেটা ধরা পড়েছিল। লিলিয়ান শুনলে বলত ডেনড্রোফিলিয়া, গাছের প্রতি যৌন আকর্ষণ। তখন তো অতশত জানতাম না। চা জলপাইগাছটাকে দেখলেই খুব রাগ হতো, হয়তো ঈর্ষাই হতো। একবার দাদুর বাঁশ কাটার দা দিয়ে কুপিয়েও ছিলাম ঘিনঘিনে গাছটার শরীর।পার্কের চা জলপাইগাছে একদিন উইন্ড চাইম বেঁধে যায় এক মা মিঠে টুংটাং নিখোঁজ মানুষের জন্য হুহু তুলে। একদিন গাছের গায়ে আমিও লিখি, ‘মোহন।’ মোহনকে আমি শেষ দেখেছিলাম মুণ্ডমালা গলায়। লোকে বলত, কোনো এক কাপালিকের শিষ্য হয়ে সে শশ্মানচারী হয়েছে। সেবারই আমাদের মহল্লায় ধরা পড়েছিল একটা কিশোর বাঘ। খেলার মাঠে রাখা হলো বাঘের খাঁচা। বন কর্মকর্তা ছুটিতে; অন্য হর্তাকর্তারা বৈঠক করছে—কী করণীয়। ততক্ষণে সব স্কুলে ছুটি দেওয়া হয়েছে, চানাচুরওয়ালা বসে গেছে মাঠের এক পাশে, আলেয়া এনেছে আম্মার বানানো জলপাইয়ের আচার। দলে দলে লোক আসছে আহত বাঘ দেখতে। সেই ভিড়ে মোহনকে আমি শেষ দেখেছিলাম। একটা জ্যান্ত খরগোশ হাতে সে এগিয়ে যাচ্ছে বাঘের দিকে। পরদিন সকালে খবর ছড়াল—বাঘ নিয়ে মোহন হারিয়ে গেছে। মায়ের কাছে বাঘ ফিরিয়ে দেওয়ার পণ করা ছেলেটা আর ঘরে ফেরেনি।
সেদিন এক প্রতিবেদনে পাখিদের অদ্ভুত স্বভাব ‘অ্যান্টিং’ নিয়ে পড়ছিলাম। পৃথিবীতে দুই শ প্রজাতির পাখি আছে, যারা ইচ্ছা করে শরীরে নেয় পিঁপড়ার বিষকামড়। আমিও মহুয়া হাওয়ায়, বেলুনে ভাসতে ভাসতে পিঁপড়াদের সাথে মানিয়ে নিতে শিখি যেমন বিষময় রডোডেনড্রন গাছেও মানিয়ে নেয় পিঁপড়া। তাবৎ লাল পিঁপড়া শরীরে নিয়ে অতিক্রম করি এই শহরের একটি ব্রিজ। ব্রোঞ্জের তৈরি সুখী পরিবারের পাশে বসে, বীর হোওইয়ের রেখে যাওয়া সূর্যে লাল পিঁপড়া মিশিয়ে আঁকি সূর্যাস্ত। পার্কের বৃদ্ধ লোকটা বলে পশ্চিমের মেঘে ভালো করে খুঁজলে সোনার সিংহ দেখা যায়। শেষ রোদ আর পিঁপড়ার স্রোতে পা ডুবিয়ে পশ্চিমের মেঘে আমার ভালো লাগে দেখতে ডাকটিকিট—সোনালি বাঘের পিঠে আমার বন্ধু মোহন, ওর মাথায় চা জলপাই ফুলের মুকুট। দেখি, চন্দ্রাবতীর উঠানের চা জলপাইয়ের ফুলের পাপড়ি থেকে জন্ম নেওয়া হাজার রাজহাঁসের ডাকটিকিট আকাশে ছড়ানো, সেখানে শিশুরা ভেসে যাচ্ছে মায়ের ওমে। মা হাওয়ায় দুই হাত তুলে আমিও কোলে নিই মহুয়ার গন্ধভরা একটি নিখোঁজ শিশুর নরম ডাকটিকিট।
আকাশের ডাকঘরে ভেসে থাকা অজস্র ডাকটিকিটের ভিড়ে পাঠকেরা দেখে এক জোড়া ছোট্ট জুতা হেঁটে চলেছে। জুতার পেছনে জমতে থাকে আগ্রহী পাঠকের সারি যেন পিঁপড়া। হঠাৎ জুতা দুটি থমকে গেলে পিঁপড়েফুলেরা মিশে যায় একটি কবর অথবা ডাকটিকিটে—
হিমাদ্রি মহুয়া
২৪ মে ২০২৫—২৫ মে ২০২৫
এক রাতের মহুয়া দিয়েছিল জীবনভর ঘ্রাণ।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ক র র জন য ট র মতন আম দ র কর ছ ল বল ছ ল এক জ ড একদ ন জলপ ই দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন–কার্যক্রম চালুর জন্য গেজেটসহ যাবতীয় কাজ শেষ করার আহ্বান
জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপন, সচিবালয়ের কার্যক্রম চালুর জন্য গেজেট প্রজ্ঞাপনসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
আজ সোমবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে খসড়া অনুমোদনের পর গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেন রাষ্ট্রপতি। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে অধস্তন আদালত ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সব প্রশাসনিক ও সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবে এই সচিবালয়।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতিতে বলেছে, জারি করা অধ্যাদেশের ধারা ১ (২)–এ উল্লেখ রয়েছে, ‘(২) সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন সম্পন্ন ও ইহার কার্যক্রম পূর্ণরূপে চালু হওয়া সাপেক্ষে সরকার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে, ধারা ৭–এর বিধানাবলি সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা কার্যকর করিবে।’ অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার আইন হলেও তা বাস্তবায়ন হওয়ার আগপর্যন্ত বিচারকদের বদলি, পদায়ন, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান–সংক্রান্ত বিষয় সরকারের অধীনই রয়ে গেছে। তাই অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে তার মেয়াদের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে পৃথক সচিবালয় স্থাপন ও এর কার্যক্রম চালুর জন্য গেজেট প্রজ্ঞাপনসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দেশের জনগণের বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেছে। এই অধ্যাদেশ জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অন্যতম বন্দোবস্ত এবং ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ঐতিহাসিকভাবে আলোচিত হলেও তা বিভিন্ন কারণে এ দেশে বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৯৯ সালে বিখ্যাত মাসদার হোসেন মামলার রায়ে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হলেও কার্যত তা নির্বাহী বিভাগের অধীন থেকে যায়। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আপামর জনগণ স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আশাবাদী হয়। অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো তরুণ বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইয়ং জাজেস ফর জুডিশিয়াল রিফর্ম’ তাদের ১২ দফা দাবি ঘোষণা করে। এর ১ নম্বর দফা ছিল সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দেশের প্রধান বিচারপতি সারা দেশের বিচারকদের সম্মুখে অভিভাষণের সময় স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, যা বিচারকদের মনে অকৃত্রিম আশার সঞ্চার করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাসোসিয়েশন ২০২৪ সালের ২০ নভেম্বর অফিশিয়াল বিবৃতির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানায়। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গত ১ বছরে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সব বিচারক এবং বিচার বিভাগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে মতবিনিময় সভা ও সেমিনারের আয়োজন করে।
‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হয়ে থাকবে’
বিবৃতিতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ৩০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেছে, যা এ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হয়ে থাকবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য অ্যাসোসিয়েশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সর্বোপরি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।